ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,২৫,২৬

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,২৫,২৬
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২৫)

“” এখন কোথায় যাবি?””

রুবিনার এই একটা প্রশ্নই যথেষ্ঠ ছিলো রিপ্তির চোখে পানি আনার। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। যার চাল নেই,কুল নেই,ঘর নেই,আপন বলতেও কি কেউ নেই? রিপ্তির চোখের পানি গাল বেয়ে পড়তেই পাশ দিয়ে একটি বাচ্চা মেয়ে হেটে গেলো। খালি গায়ে ময়লা প্যান্ট পড়ে আছে। চোখে,মুখে ময়লা আবছা রঙ,চুলে দীর্ঘদিন পানি না পড়ায় অনেকটা দলা পাকিয়ে আছে। পেট তার পিঠের সাথে মিশে। হাতে ভারী বস্তা। রাস্তার মধ্যে পড়ে থাকা হাজারও ময়লার মধ্য থেকে কি এমন গুপ্তধন টুকাচ্ছে সে! রিপ্তির এক পলকের জন্য মনে পড়লো সেও তো এতিম! মা নেই,বাবা নেই,ভালোবাসার মানুষও নেই। যারা ছিলো তাদেরকেও ছাড়তে হয়েছে,নিজেরই দোষের কারণে। একটা সন্ধ্যে তার জীবনের সকল সুখকে ডুবিয়ে দিলো!

রুবিনা থম মেরেই দাড়িয়ে ছিলো। রিপ্তিকে কিছুক্ষণ কাঁদার সময় দিচ্ছিলো। সময়শেষে বললো,,

“” চল।””
“” কোথায়?””
“”আমার বাড়ী!””
“” তোর বাড়ী?””

রুবিনা আর কোনো উত্তর দিলোনা। হাতের ইশারায় রিকশা ডাকলো। রিপ্তিকে টেনে বসিয়ে বললো,,

“” ভরসা রাখতে পারিস!””

রিপ্তির স্থিরদৃষ্টি রুবিনার উপর। যাদের সে সহ্য করতে পারেনা তারাই কেন তার কাছের কেউ হয়ে যায়?এমন কেউ যে ছাড়া দুনিয়া অচল লাগে! পরিস্থিতির স্বীকার হোক অথবা ভাগ্যের লিখন,অপছন্দের মানুষটির হাত ধরেই কেন তার বাকি জীবন চলতে হয়? কিন্তু বাকি জীবন কি চলতে পারে? পারে না,বাকি জীবনের মাঝপথেই হাতটা ছেড়ে দেয়। বুঝিয়ে দেয়,নিজেরটা এবার নিজে গড়তে শিখো! অন্যজনের পাখায় ভর করে আর কত? বারবার কেন একি ঘটনা পুনরাবৃত্তি হয় তার সাথে? তাতে কি আদৌ সে কিছু শিখতে পারে? না গড়তে পারে? না চলতে পারে? নিজের ইচ্ছেতে কিছু করতে গেলেই ভুল কিছু করে ফেলে,তারপর দিশাহারা! আর এই দিশাহারা থেকে বাঁচতে হলে আবারও কারো আনুকূল্যে চলে যায়। এভাবেই কি তার শেষ জীবনটা কাটাবে? নিজে কিছু করতে পারবেনা? পারবে কি করে? সে বল কি আদৌ আছে তার? রিপ্তি ভাবনায় ডুবে থেকেই আনমনে বললো,,

“” থ্যাংক ইউ!””

~~~

তিনজন সদস্য নিয়ে ছোট ফ্যামিলি রুবিনার। ভাড়া থাকেন। দুরুমের ফ্ল্যাট। একটাতে তার বাবা-মা ও অন্যটাতে রুবিনা থাকে। এখন রিপ্তি অর্ধেক দখল করেছে। প্রথমদিকে রুবিনার বাবা-মা একটু অসন্তোষ্টি আচরন করলেও এখন সবকিছু স্বাভাবিক। রুবিনার বাবা আলিফ আহম্মেদ গল্পপ্রেমি। রিপ্তিকে পেলেই গল্পের আসর পেতে বসেন। রিপ্তির বেশ ভালো লাগে,মাঝে মাঝে খারাপও লাগে। নিজের বাবার কথা মনে পড়ে যায় যে! সে রাতে তার আর ঘুম আসেনা। সারারাত ছটফট করে আর বালিশ ভেজায়! অনুশোচনায় ভোগে,অপরাধি সাজে,অভিমান করে মাঝে মাঝে নিজেকে কষ্ট দেয়।

খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস না থাকলে রিপ্তি ক্যাম্পাসে যায়না। আবার আগের মতো অনিয়মিত ছাত্রীর খাতায় নাম লিখিয়েছে তবে বাসায় পড়াশুনা করছে পুরোদমে। এর মধ্যে দুটো টিউশনিও জোগার করে দিলেন আলিফ আহম্মেদ। রিপ্তি ঠিক করেছে এখান থেকে যা টাকা পাবে তা থেকে নিজের জন্য কিছু খরচপাতি রেখে বাকি সব টাকা রুবিনার হাতে তুলে দিবে। আর কত অন্যের দয়ায় চলবে?

কাল থেকে পরীক্ষা। সারারাত জেগে পড়েছে রিপ্তি। স্বপ্ন পূরণ করবে সে নিজের নয়,বাবার! ভালো রেজাল্ট তো করতেই হবে সাথে ভালো ভবিষ্যৎ। কিন্ত….

রিপ্তি আর কিছু ভাবতে পারেনা মনের অজান্তেই ডান হাতটা পেটে চলে যায়!

~~~

“” তুমি রিপ্তির বান্ধুবী না?””

পরীক্ষা শেষে রিপ্তির অপেক্ষায় ছিলো রুবিনা। হাতে ঝালমুড়ি। একা একা দাড়িয়ে থাকার চেয়ে ঝালমুড়ি খাওয়াটাও ভালো। তারমধ্যে ক্ষিধেটাও খুব বেশি ছিলো। রিপ্তি যে তার মতো অর্ধেক খাতা খালি রেখে বের হবেনা এটা তার জানা। যারমানে অপেক্ষার সময় কম করে হলেও এক ঘন্টা। সে ধৈর্য্য ধরে রাখতেই গুনে গুনে ঝালমুড়ি মুখে পুরছিলো। তারমধ্যেই ভারীপুরুষকন্ঠ। মুখের ঝালমুড়িটা না চিবিয়েই গিলছে সে। তারপর বললো,,,

“” না। রিপ্তি আমার বান্ধুবী!””

অনুভব এমনভাবে নিশ্বাস ছাড়লো যেন দীর্ঘ বছর ধরে কেউ তার শ্বাসটা গলায় আটকে রেখেছিলো। অনুভব উৎসুক হয়ে বললো,,

“” ও এখন কোথায়?””

রুবিনা আরেকবার ঝালমুড়ি মুখে পুড়লো। তবে ভাবনাময় চিবুনি রেখে বললো,,

“” আপনি কে বলুন তো!””

রুবিনার প্রশ্ন এড়িয়ে গেলো অনুভব। ব্যাকুলকন্ঠে বললো,,

“” বলুন না রিপ্তি কোথায়?””
“” ও তো এখনো প….””
“” ও তো এখনো কি?””

রুবিনা আর কিছু বলছেনা। চোখের সামনে অনুভবের একটু পেছনেই রিপ্তি দাড়িয়ে আছে। চোখের ইশারায় কিছু বলতে নিষেধ করছে। রুবিনা সন্দেহদৃষ্টি দুজনের মাঝেই রাখলো। রিপ্তি আর সে একসাথে থাকছে প্রায় দেড়মাস। কিন্তু আজ অবধি এটাই জানতে পারলো না রিপ্তি কেন বাড়ী ছেড়েছে। জিজ্ঞেস করেনি তা নয়, ধরতে গেলে প্রতিরাতেই ঘুমানোর আগে এই প্রশ্নটা তুলে ধরে রুবিনা। কিন্তু প্রতিত্তোরে রিপ্তি বলে,গুড নাইট!

“” কি হলো বলুন না!””

অনুভবের আকুলবাণীতে রুবিনার ঘোর কেটেছে। ছোট্ট করে বললো,,

“” জানিনা।””
“” মিথ্যে বলছেন।””

রুবিনা ধারালো কন্ঠে বললো,,

“” মিথ্যে বলছি মানে! আমাকে দেখে আপনার মিথ্যেবাী মনে হয়? যদি মনে হয় তাহলে তাই। এখন কি করবেন? বলুন কি করবেন?””

রুবিনার উচ্ছৃঙ্খল আচরনে অনুভব নিরব। কিছু একটা ভাবছে। ভাবুক কন্ঠেই বললো,,

“” অপেক্ষা করবো।””
“” কিসের?””
“” আপনার সত্য বলার।””

অনুভব সত্যি সত্যি রুবিনার পাশে দাড়িয়ে রইলো। রুবিনার ন্যায় সে ঝালমুড়ি কিনলো। এমন একটা ভাব যেন,দুজন খুব পরিচিত। দুজনেই কোনো একজনের অপেক্ষায় আছে।

এদিকে দুর থেকে রিপ্তিও অপেক্ষা করছে। মাঝে মাঝেই আড়চোখে অনুভবকে দেখছে। মানুষটার হাবভাব ঠিক বুঝতে পারছেনা। রুবিনার চোখে চোখ পড়তেই হাতের ইশারা করলো। যার মানে হলো-আমি যাচ্ছি,আপদ বিদেয় হলে তুইও চলে আসিস!

~~~

রিপ্তি বিছানায় শরির এলিয়ে দিতেই রুবিনা প্রশ্ন করে বসলো,,

“” ছেলেটা কে?””

রিপ্তির পাল্টা প্রশ্ন,,

“” বিদেয় করলি কিভাবে?””

রুবিনা ফোন টিপা বন্ধ করলো। রিপ্তির পাশে শুয়ে বললো,,

“”আমার করতে হয়নি। লিনা নামের একটি মেয়ের কল এসেছিলো তারপর চলে গেলো।””
“” ওহ!””
“”বললি নাতো ছেলেটা কে?””
“” আমার জীবনের অভিশাপ!””

~~~

মাঝরাতেই ঘুম ভেঙে গেলো রিপ্তির। পানি পিপাসা পেয়েছে। হাতের কাছে থাকা গ্লাসটা ফাঁকা। এখন পানি খেতে হলে রান্নাঘরে যেতে হবে। যাবে কি যাবে না ভাবছে রিপ্তি। দোটানা নিয়েই পানির উদ্দেশ্যে বেরোলো। নিজেদের রুম ছেড়ে ডানে পা ফেলতেই আলিফ আহম্মেদের গলা পেলো,,

“” কি ভুলভাল বলছো,জমিলা? ঐটুকুন মেয়ের আবার বাচ্চা কোথা থেকে আসবে? ওর তো এখনো বিয়েই হয়নি।””
“” আজকালকার মেয়ের বিয়ে হওয়া লাগে নাকি? আর কি এইটুকুন বলছো? তোমার মেয়ের থেকে কি ছোট? রুবিনার বিয়ে হলে তো এতোদিনে দুই বাচ্চার মা হয়ে যেতো।””
“” মাঝরাতে কি শুরু করলে বলো তো? ঘুমাতে দাও।””

আলিফ সাহেবের বিরক্তমাখা কথাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেন জমিলা বেগম। সন্দেহিকন্ঠে বললেন,,

“” মেয়েটার চালচলন সন্দেহজনক। খাওয়ার মধ্যে এতো অনিহা তাহলে পেট এতো বড় হচ্ছে কেন? আজ তো খেতে বসে বমিই করে দিলো। আমার কিন্তু কিছু ঠিক লাগছেনা রুবিনার বাবা। না জানি কোন ছেলের সাথে রাত কাটিয়ে পেট বানিয়েছে। তুমি কি বুঝতে পারছো আমার সন্দেহ সত্যি হলে কি হবে? ঐ মেয়েটার সাথে সাথে আমাদেরও নাক কাটবে। আর তোমার মেয়ে? বদনাম তো তার উপরেও পড়বে। আমি কালই রুবিনার সাথে কথা বলবো। যত দ্রুত সম্ভব এই মেয়েকে এখান থেকে বিদেয় করতে হবে।””

রিপ্তি আর এগুতে পারলোনা। অজানা ভয় তার শিরদাড়া বেয়ে উপরে নিচে নামছে। হঠাৎ করেই তার সবকিছু শূন্য মনে হলো। দৌড়ে রুমে চলে গেলো। লাইট অন করে আয়নার সামনে দাড়িয়েছে। পেটের কাছ থেকে জামাটা সরাতেই তার বুক কেঁপে উঠলো। সুক্ষ আর্তনাদ বেরিয়ে আসলো নিশ্বাসের সাথে। সত্যিই তো তার পেট আগের তুলনায় অনেকটায় ভাসমান। চোখে পড়ার মতো। পড়াশোনা নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো যে এই ব্যাপারটা তার মাথায় আসেনি। প্রেগন্যান্সির বয়স যত বাড়বে পেটটাও যে তত বড় রুপ নেবে!

রিপ্তি সেভাবেই মেঝেতে বসে পড়লো। বারবার রুবিনার মায়ের কথাগুলো কানে বাজছে। উনি তো কিছু ভুল বলেননি। সত্যিইতো সে রাত কাটিয়েছে!

ফযরের আযান আসতেই রুবিনার ঘুম হালকা হয়ে এসেছে। এপাশ থেকে ওপাশ হলো। সূর্যের আলো চোখে পড়তেই কপাল কুঁচকিয়ে গেলো। পিটপিট করে চোখ মেলতেই রিপ্তির জায়গাটা শূন্য। কয়টা বাজে দেখার জন্য মোবাইল খুজতে গিয়ে কাগজ এসে পড়লো হাতে।

**তোকে অনেককিছু বলার ছিলো,কিন্তু কিছুই বলা হয়নি। এতো অল্প সময়ে অল্প পরিচয়ে তুই আমাকে অনেক কাছে টেনে নিয়েছিস। আমিও চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। আসলে আমি পারার সাহসই পায়নি। ছোটবেলা থেকেই আমি যাদের কাছে টেনে নিয়েছি তারাই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমি চাইনি তুই ও আমাকে ছেড়ে চলে যাস। তাই দুরত্ব আরো বাড়িয়ে নিলাম।

আমি জানি আমাকে নিয়ে তোর মনে অনেক প্রশ্ন আছে। উত্তর পাসনি একটারও। যদি কখনো সুস্থজীবনে ফেরত আসতে পারি তাহলে তোর সাথে আমার আবার দেখা হবে কোনো এক বিকেলে অথবা সকালে। সেদিন আমি গল্প করবো আর তুই শুনবি। কথার ঝুড়ি আমার পেটেও আছে,বুঝলি?!

ভালো থাকিস।

রহস্যময়ী রিপ্তি

~~~

“”আমার সামনে তো শুধু বুকের আঁচল সরিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলে তুমি বড় হয়ে গিয়েছো। তার সামনে বুঝি সবটায় খুলতে হয়েছিলো?””

ভরাটগলার তিক্ত কথাতে মাথা নিচু হয়ে গেলো রিপ্তির। সাথে সাথেই সামনের মানুষটা পুনরায় কন্ঠ বাজলো,,

“”সঙ্গে করে তো সার্টিফিকেট নিয়েও ঘুরছো। তা সার্টিফিকেটের বয়স কত?””

রিপ্তি আড়ষ্টগলায় বললো,,

“” মনে নেই।””

মহসীন কালো বোরকায় আবৃতে ঢেকে থাকা পেটটায় সুক্ষ নজর ঠেকিয়ে বললো,,

“” পাঁচমাস তো হবেই। কালোকে ঢাকতে কালো রঙ পড়ে ঘুরছো নাকি সত্যিই পর্দা শুরু করেছো?””
“” আমার পা ব্যথা করছে,মহসীন!””

রিপ্তির হাত থেকে ব্যাগটা নিজের হাতে নিলো মহসীন। মৃদুকন্ঠে বললো,,

“” ঠিকানা দিলাম হোস্টেলের হাজির হলে বাড়ীতে। প্রেগন্যান্সির বয়স মনে নেই আমার বাড়ীর ঠিকানাটা এখনো মনে আছে?””

মহসীনের পেছন পেছন রিপ্তি ভেতরে ঢুকলো। এ বাড়ীটা তার চেনা। চেনা বাড়ীর ঠিকানা কি মনে রাখতে হয়? বসার রুমে ঢুকে রিপ্তিকে ইশারায় বসতে বললো মহসীন। রিপ্তি অসম্মতি জানিয়ে বললো,,

“” আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমার রুমটা দেখিয়ে দাও,প্লিজ!””

বসার রুমের পাশেই ছোট্ট একটি রুম দেখিয়ে দিলো মহসীন। রিপ্তি সেদিকেই পা বাড়িয়েছে। দরজার ভেতর পা রাখতেই রজনীগন্ধার তীব্র গন্ধ নাকে বারি খেলো। রিপ্তি চোখটা বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস টেনে বললো,,

“” ফুলগুলো বাসি হয়ে গিয়েছে!””

সাথে সাথে প্রতিত্তোর,,

“” তুমিও তো বাসি হয়ে গিয়েছো,রজনীগন্ধা!””

রিপ্তি আর কিছু বলতে পারলোনা। পুরোনো আর নতুন ঘা মিলেমিলে এক ব্যথাদায়ক যন্ত্রণা হচ্ছে তার। পুরো শরীরজুড়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো পুরোনো প্রেমকথার….

~~~

মহসীন স্যারের কথামতো রিপ্তি নানিকে জানিয়ে দিয়েছিলো,সন্ধ্যাবেলা পড়াতে আসবেন। রিপ্তি সকাল থেকেই পুরোবাড়ী গুছিয়ে রাখলো। নিজের পড়ার টেবিলটার কভার পাল্টালো। বই-খাতাগুলো সুন্দর করে সুবিন্যাস করলো। যদি কারেন্ট চলে যায়,সে ভয়ে মোম আর ম্যাচ টেবিলের উপরেই গুছিয়ে রেখেছে। নিজের সবচেয়ে সুন্দর সবুজ রঙের ফ্রকটা পড়ে চুলে দুই বেনি করলো। সবশেষে সন্ধ্যার আযান পড়তেই রিপ্তির মনে প্রশ্ন উদয় হলো,আমি এতো সাজুগুজু কেন করলাম? রিপ্তির প্রশ্নের আর উত্তর পাওয়া হলোনা। মহসীন স্যার চলে এসেছেন। সাথে যেন দুনিয়ার অভ্যন্তরে থাকা সকল ভয়গুলোও নিয়ে এসেছেন যা রিপ্তির উপর ঢেলে দিলেন। দুজনে মুখোমুখি বসে আছে। রিপ্তি ভয়ে সামনের মানুষটির দিকে তাকাতে পারছেনা। কিন্তু সামনের মানুষটি পূর্ণদৃষ্টিতে রিপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। পুরো একঘন্টা এভাবেই কাটলো। ইংলিশ বইটা খোলা হলোনা। নতুন খাতা মেলা হলোনা। নতুন কলমের কালি শেষ করা হলোনা। রিপ্তির হাতের সুন্দর লেখাও দেখানো হলোনা। একঘন্টার নিরবতা শেষে মহসীন স্যার নড়েচড়ে বসলেন। রিপ্তির ডানহাতের কনিষ্ঠ আঙুলটা নিজের দিকে টেনে নিলেন। বুক পকেটে থাকা কলমটা খুলে লিখলেন,,

“” তুমি এতো ছোট হলে কেন?””

লেখা শেষ করে গটগট করে বেড়িয়ে গেলেন। রিপ্তি মাথা তুলে তাকালো কিন্তু কিছু বলতে পারলোনা। সারাটা রাত কাটলো তার নির্ঘুমে। সাথে নানিরও। রিপ্তি নিজের আঙুলে তাকায় আর নানিকে জিজ্ঞেস করে,,

“” নানি আমি এতো ছোট কেন?””

তারপরের সন্ধ্যা মহসীন স্যার পুরো একঘন্টায় রিপ্তিকে পড়ালেন। একটা মিনিটও অন্যকিছুতে ব্যয় করেননি এমনকি রিপ্তির দিকে ঠিক করে তাকায়ও নি। লিখতে লিখতে রিপ্তির নতুন খাতা শেষ। নতুন কলম শেষ। বইয়ের পৃষ্ঠা ছিড়ে গেলো। তবুও মহসীন স্যারের বুঝানো শেষ হয়না,পড়ানো শেষ হয়না,লেখানো শেষ হয়না। এমন করেই কেটে গেলো একটি মাস। এর মধ্যে রিপ্তির ভেতরে থাকা ভয় চলে গিয়েছে। হঠাৎ একদিনের জেগে উঠা নতুন অনুভূতির কুড়ি প্রায় শুকিয়েই গিয়েছিলো। মন তখন পুরো বই আর খাতায়। এটা যেন সহ্য হলোনা মহসীন স্যারের। হঠাৎ আরেক সন্ধ্যায় মহসীন স্যার চুপ। রিপ্তি বই খুলে বসে আছে। খাতা খুলে কলম ধরে আছে। কিন্তু কি লিখবে সেটা আর জানা হলোনা। সামনের মানুষটির এমন অদ্ভুত আচরণে রিপ্তির শুকিয়ে যাওয়া কুড়িটা আবার মাথা তুলতে শুরু করলো। পানি ঢালতেই বুঝি মহসীন স্যার রিপ্তির অনামিকা আঙুলটা নিজের দিকে টেনে নিলেন। বুক পকেটে থাকা কলমটা খুলে লিখলেন,,

“” তুমি কবে বড় হবে?””

আরো একটি নির্ঘুম রাত কাটলো রিপ্তির। সাথে নানিরও। একটু পর পর আঙুলে তাকায় আর নানিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করে,,

“” নানি,আমি কবে বড় হবো?””

নানি বিরক্ত হয়ে বললেন,,

“” যেদিন তোর বিয়া অইবো,জামাই আদর করবো!””

রিপ্তি কি কিছু বুঝলো? লজ্জায় মুখ ঢেকে নিলো।

~~~

রিপ্তির দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে। মহসীন স্যার আবার ঘন্টায় ঘন্টায় নতুন নতুন খাতা লেখা দিয়ে ভরিয়ে তুললেন। এখন ইংলিশের সাথে গণিত,বাংলা,সাধারণ বিজ্ঞানও পড়ানো শুরু করেছেন। এক ঘন্টার জায়গায় দুইঘন্টা পড়াচ্ছেন। এতো পড়ার চাপে রিপ্তির বড় হওয়ার উত্তরটায় জানানো হলোনা!

পরীক্ষা হলো,রেজাল্ট এলো। রিপ্তি দ্বিতীয় হয়েছে। সে তো মহাখুশি। আগেরবার ফেল আর এবার ত্রিশ থেকে একদম দুই’য়ে চলে এসেছে। আনন্দের ছ’টা নিয়েই পরেরদিন মহসীন স্যারের অপেক্ষা করছে রিপ্তি। রিপ্তির মন ভেঙে দিয়ে সেদিন মহসীন স্যার এলেননা। তারপরের দিনও এলেননা। তারপরের দিনও না। পুরো গুনে গুনে নয়দিন পরে এলেন। দুজনে মুখোমুখি বসে নিরবতা পালন করছিলো। নিরবতা ভেঙে রিপ্তিই বললো,,

“” এতোদিন আসেননি কেন?””
“” তুমি অপেক্ষা করেছিলে?””
“” হুম। কেন আসেন নি?””

মহসীন স্যারের পাল্টা প্রশ্ন,,

“” কেন অপেক্ষা করেছিলে?””

রিপ্তি চুপ। কিছুসময় পর বললো,,

“” আপনাকে রেজাল্ট কার্ড দেখাতে চেয়েছিলাম।””
“” আর?””
“” আর কি?””
“” আর কিছু না?””
“” হুম।””
“” কি?””
“” আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো।””

মহসীন স্যার আগ্রহ নিয়ে বললেন,,

“” কেন?””
“” জানিনা!””

রিপ্তি মাথা নিচু করে ফেললো। মহসীন স্যার কিছুক্ষণ গভীরদৃষ্টি রাখলেন রিপ্তির মুখে। তারপর ওর মধ্যমা আঙুলটা টেনে নিলেন নিজের দিকে। বুক পকেটে থাকা কলম দিয়ে লিখলেন,,

“”কাল থেকে রোজ শাড়ী পড়বে!””

চলবে

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২৬)

রিপ্তি মাথা নিচু করে ফেললো। মহসীন স্যার কিছুক্ষণ গভীরদৃষ্টি রাখলেন রিপ্তির মুখে। তারপর ওর মধ্যমা আঙুলটা টেনে নিলেন নিজের দিকে। বুক পকেটে থাকা কলম দিয়ে লিখলেন,,

“”কাল থেকে রোজ শাড়ী পড়বে!””

মহসীন স্যার আর একদন্ডও বসলেন না। দ্রুত পায়ে রিপ্তিদের বাসা ত্যাগ করলেন। রিপ্তি তখনো থম মেরে চেয়ারটায় বসে আছে। একবার হাতের আঙুলে লেখা গুটিগুটি অক্ষরের ছোট লাইনটায় চোখ রাখছে তো আরেকবার মহসীন স্যারের ফেলে যাওয়া পথপানে। এই মানুষটা হঠাৎ হঠাৎ কিসের আভাস দেয়? কোন পরশ পাথরের অদৃশ্য ওজন ঢেলে দিয়ে যায় তার অন্তরে? যার ভার বয়তে গিয়ে রিপ্তির ছোট মনে চলে হাজারও প্রশ্নের আকিবুকি আর না জানা,না বুঝা অনুভূতির তুমুল ঝড়। সাথে ঘুমটাও তো উধাও। চোখে তখন চলে রঙিন স্বপ্ন,রঙিন কিছু ঝাপসা আলো! আর থমকা থমকা লাজুক হাঁসি।

রিপ্তি চেয়ার ছেড়েই সোজা চলে গেলো কাঠের আলমারীর কাছে। শুরু হলো নতন উদ্যম। নানির হাতের গুছিয়ে রাখা সকল জিনিস ঘাটাঘাটি করে শাড়ীকাপড় বের করছে। একটার পর আরেকটা তারপর আরেকটা। কিন্তু কোনোটায় সে পড়তে পারছেনা। তবে কি সে শাড়ীর তুলনায় ছোট হয়ে গেলো? শাড়ীর নিচটাতো মাটিতে পড়ে আছে অর্ধেক। উফ! সে কেন আরেকটু লম্বা হলোনা? এতো এতো প্যাচ দিয়েও শাড়ীর আঁচল গুটাতে না পেরে ভাবছে,উফ! কেন আরেকটু মোটা হলাম না? কবে বড় হবো আমি? কবে পাগুলো লম্বা হবে? আর কবে মোটা হবো? একরাতের মধ্যে কি বড় হওয়া সম্ভব?

রিপ্তি একটু ভাবে তো আরেকটু শাড়ী পড়ে। একটা শাড়ীর সাথে আরেকটা শাড়ীর মাপ নেয়। লম্বায় যেটা একটু ছোট হয় সেটা নিয়েই চলে আবার প্যাচানো! সারা রাত তার কাটলো শাড়ী গবেষণায়। ঘুম তার শাড়ীতেই আটকালো। নানি বুঝি বাদ যাবে? উহু! নানির ঘুমটাও তো নাতনির উপরেই আটকালো।

পরেরদিন সন্ধ্যায় মহসীন স্যার উপস্থিত হলেন দশ মিনিট লেটে। অন্যদিনের মতো আজ দরজায় উকি দিচ্ছেনা রিপ্তি। তবে কি সে আজ বাসায় নেই? মহসীন চলে যাবে ভাবতে গিয়েও থমকে গেলো। ভেতরে আলো জ্বলছে। নিশ্চুপতা খুব বেশিই নয় কি? সামান্য সংকোচ নিয়েই মহসীন ভেতরে পা রাখে। ভেতরে পা ফেলতেই কপাল তার কুঁচকিয়ে গেলো। ভ্রুজোড়া একে অপরের সাথে মিলে গিয়েছে। চোখে সরু দৃষ্টি। চেয়ার টেনে বসতেই মহসীন শব্দ করে হেঁসে উঠলো। শরীর দুলিয়ে চেয়ারের সাথে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। কিছুতেই হাঁসি থামছেনা। বহুকষ্টে হাঁসিটাকে নিয়ন্ত্রণে এনে বললো,,

“” তুমি তো ছুরি থেকে বুড়ি হয়ে গিয়েছো,রিপ্তি!””

রিপ্তি এবার লজ্জার শেষ সীমানায়। সীমানা অতিক্রম হলেই বুঝি আত্মদান করবে। যাকে বলে লজ্জামৃত্যু! নিজেকে আড়াল করার উপায় খুজছে। সে কি উঠে যাবে? লুকিয়ে পড়বে আলমারির পেছনে নাহয় দরজার আড়ালে নাকি বাড়ি ছেড়ে কোনো নির্জন জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে থাকবে?

রিপ্তির উপায় খোজার মধ্যেই মহসীন হাঁসি থামালো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,,

“”পড়া শুরু করি?””

রিপ্তি চটপট বই খুলে ফেললো। খাতা খুলে কলমটাও আকড়ে ধরলো। আজ সে সব লজ্জা কলমের কালি দিয়েই শেষ করবে।

পড়ানোর মাঝেই রিপ্তির অকস্মাৎ চিৎকার,,

“” বৃষ্টি নেমে গেলো তো! আমি তো কাপড় তুলিনি। নানি বকবে!””

মহসীন জানালা দিয়ে এক ঝলক বাইরে তাকালো। এখনো বৃষ্টি নামেনি। তবে আকাশের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এই নামলো বলে। মহসীনের থেকে কোনো পারমিশন না নিয়েই রিপ্তি দৌড় দিয়েছে। তাড়াহুড়োই পায়ে শাড়ী পেচিয়ে গেলো। পড়তে গিয়ে পড়েনি তবে কুঁচি খুলে মাটিতে! সেদিকে কোনো ধ্যান নেই তার। সে তো এখন দুশ্চিন্তার মহারানি। বাইরে পা ফেলতেই ঝপঝপ করে বৃষ্টি! বৃষ্টিতে ভিজছে আর কাপড় কুড়াচ্ছে। দৌড়ে রুমে ঢুকলো কাকভেজা হয়ে। শুকনো কাপড় আবার ভিজে গিয়েছে। এখানে এটা নাড়ে ওখানে ওটা নাড়ে। যাহ! জানালগুলোও তো খোলা,বিছানা ভিজে যাবে তো। রিপ্তি আবার দৌড় লাগায় জানালা লাগাতে। একটা লাগিয়ে আরেকটার দিকে দৌড়াচ্ছে। ইশ! আজ নানির হাতে বকুনি খেতে খেতে রাত পার করতে হবে। কতবার করে বলে গিয়েছিলো,আযান পড়ার আগেই যেন কাপড় তুলে রাখে,জানালা লাগিয়ে রাখে,উঠোনটা ঝাড় দিয়ে রাখে। পাশের রুমের লাইটটাও তো দেওয়া হয়নি। উফ! সব এখনি মনে পড়ছে,আগে কেন পড়লোনা?

মহসীন চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়েছে অনেক্ষণ। হেলান দিয়ে বসেছে। গভীর মনোযোগী রিপ্তির উপর। ছুটন্ত রিপ্তির দিক থেকে একবারের জন্যও চোখ সরাচ্ছেনা। পলকটাও ফেলছেনা। যেন পলক ফেললেই হঠাৎ পাওয়া সুন্দর মুহুর্ত হারিয়ে ফেলবে। ছুটন্ত আর দুশ্চিন্তার মহারানিকে দেখতে দেখতে একটু বাকা হলো মহসীন। বা’হাতে কনুইটা টেবিলে ঠেকালো। আঙুলগুলো আধোভাজ করে কপাল ছুয়েছে। আজ সে মনভরে এই মেয়েটিকে দেখবে। ছোট্ট মেয়েটি। আসলেই কি ছোট্ট? কই এখন তো ছোট লাগছেনা। কিশোরী মেয়েটা কি হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেলো? মনে হচ্ছে যৌবনার প্রথম সিড়িতে দাড়িয়ে আছে। একটু ছুয়ে দিলে সিড়ির আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে! এটা কিশোরী মেয়ে হতেই পারেনা। মনে হচ্ছে নতুন বউ সবেই বিয়ে হয়েছে। নতুন সংসারের নতুন কাজগুলো তার অজানা। হঠাৎ করেই সংসারবাধনে বাধুনীতে পড়ে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। কোনটা রেখে কোনটা করবে বুঝতে পারছেনা। তবে হাল ছাড়ছেনা। চেষ্টা করে যাচ্ছে।

রিপ্তি সবকাজ শেষে নিজের ভেজা চুলের পানি ঝড়াচ্ছে। মাথাটা ডানদিকে একটু ঝুকতেই ব্লাউজের কাধের অংশটা টুপ করে পড়ে গেলো। মহসীন হালকা হেঁসে উঠলো। ঘোরলাগা কন্ঠেই বিড়বিড় করলো,কল্পনায় বড় বানাতে চাইলাম তাও বাধা দিলে? নানির ব্লাউজ যে তোমার হবেনা এইটুকু বুঝও কি তোমার হয়নি?

দৌড়াদৌড়িতে শাড়ীর সিংহভাগ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে রিপ্তির। যৎসামান্য বুকের দিকটায় পড়ে আছে। তাও কুচঁকিয়ে দলা পেকে। সেটাও সম্ভব হয়েছে বৃষ্টির পানির জন্য। কিন্তু এতে যেন প্রসন্ন হতে পারছেনা সাদা রঙের শাড়ীটি। সে যেন আজ পণ করেছে রিপ্তির শরীরে থাকবেইনা। রিপ্তি ভেজা চুলে দু’হাতে ঘন বারি দিতেই শাড়ীর পণ সম্পূর্ণ হলো। সাথে সাথে মহসীন দাড়িয়ে গেলো। দরজার দিকে পা ফেলতে ফেলতে বললো,,

“” কাল থেকে নানিকে সাথে নিয়ে পড়তে বসবে!””

রিপ্তি পড়ে যাওয়া শাড়ী তুলছিলো। দ্রুত কয়েক প্যাচ দিয়ে বললো,,

“” কোথায় যাচ্ছেন?””

মহসীনের চলতি পথের উত্তর,,

“” বাসায়।””

রিপ্তি দৌড়ে মহসীনের পেছনে এসে দাড়ালো। আড়ষ্ট কন্ঠে বললো,,

“” আমার একা একা ভয় লাগবে।””

মহসীন দাড়ালো। রিপ্তির দিকে চোখ রাখতেই সামান্য হাসলো। বিড়বিড় করে বললো,যতটা ছোট ভেবেছিলাম ততটা না। একটু বেখেয়ালি তবে অতটাও না। নিজের জিনিস আড়াল করতে শিখেছে।

“”আরেকটু থাকুন না। আমার পড়া তো শেষ হয়নি। পড়তে পড়তে নানি চলে আসবে।””

মহসীন থাকবে কি থাকবে না ভাবছে। এমনি রাত হয়ে গিয়েছে। বাসায় তারা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই তারমধ্যে সর্বনাশী আবহাওয়া। আর সামনেরজনতো..

মহসীনের ভাবনার মাঝেই কারেন্ট চলে গেলো। সাথে সাথে উষ্ণ গরম স্পর্শ। মহসীন হতভম্ব,বিস্ময়ের শেষ কোঠরে দাড়িয়ে আছে স্থিরমূর্তি হয়ে। রিপ্তি মহসীনের বুকে মুখ লুকিয়ে বললো,,

“” ওমা কি অন্ধকার! মোমবাতিটা জ্বালান।””

মহসীনের মনে হলো সে নিজেই মোমবাতি আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে তার শরীরেই দাউদাউ করে অগ্নিশিখা জ্বলবে। আচ্ছা এই মোমবাতির নামটা কি দেওয়া উচিত?

রিপ্তি ধীরে ধীরে মহসীনের মধ্যে মিশে যাচ্ছে। কন্ঠে এখন আর জোর নেই। মৃদু স্বরে বললো,,

“” মোম আর ম্যাচ একসাথেই টেবিলে…””

হঠাৎ করেই রিপ্তি চুপ। কিছু শুনতে পারছে। ডিপডিপ শব্দ! কিন্তু কোথায়? কিসের শব্দ এটা? শব্দের উৎস খুজতে লেগে পড়েছে রিপ্তি। গালটা আরেকটু মিশিয়ে নিলো মহসীনের বুকের সাথে। হালকা সরে এলো বা’পাশটাতে। মনোযোগি শ্রোতা হয়ে শুনছে সে হৃদস্পন্দন। এতো ভালো,এতো মধুর,এতো শীতল,হীমপড়া শব্দতো এর আগে শুনেনি সে। কেমন মাতোয়ারা অনুভূতি। রিপ্তির হাতদুটো মহসীনের শার্ট খামচে ধরে থাকলেও এখন আর নেই। হাতদুটো হঠাৎই চঞ্চলতার রূপ নিয়েছে। বুক ছেড়ে পিঠে আচড় পড়তেই মহসীন নরমগলায় বললো,,

“” রিপ্তি,কারেন্ট চলে এসেছে।””

রিপ্তির দিক থেকে কোনো সাড়া নেই। নতুন কিছুর সাথে পরিচয় হওয়ার জন্য প্রায় মরিয়া অবস্থা তার। মহসীন রিপ্তিকে নিজের কাছ থেকে সারালো। রিপ্তির চোখ তখনো বন্ধ।

“” তোমার নানি কোথায় গেছে, তুমি জানো?””

রিপ্তি চুপ। মহসীন বুক পকেট থেকে কলমটা নিলো। রিপ্তির মুঠো হয়ে থাকা হাতটা খুলে অনামিকা আঙুলে লিখলো,,

“”অসময়ে নয়,সুসময়ে, নবরূপে,পবিত্র বন্ধনে,দেখবো তোমায়! আখি ভরে,সময় পুড়িয়ে!!

আঙুলে কলমের খোঁচায় রিপ্তির মোহচ্ছেদ ঘটলো। লেখা এতো ছোট যে খালি চোখে পড়া বেশ কষ্টকর! রিপ্তি আঙুলটা চোখের নিকটে নিতেই মহসীন আবারও নিরব হাসলো। হাসির রেশ ধরেই বললো,,

“” নানি কোথায় গিয়েছে?””

রিপ্তি আঙুলে চোখ রেখেই বললো,,

“” খোঁচানানির বাসায়।””
“” খোঁচা নানি?””

রিপ্তি আমতা আমতা করে বললো,,

“”ঐতো,পাঁকারাস্তার ওপারে।””
“” চলো তোমাকে দিয়ে আসি।””
“” কেন?””
“” আমি বাসায় যাবো। জরুরী কাজ আছে। তুমি যদি একা থাকতে চাও তাহলে থাকো। আমি যাই।””

রিপ্তি দ্রুততাসহিত বললো,,

“” আমিও যাবো।””
“” কোথায়?””
“” নানির কাছে। চলুন!””

মহসীন হাঁটা ধরতে গিয়েও পিছু ঘুরলো। রিপ্তির আপাদমস্তকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে বললো,,

“”নানির শাড়ীর বারোটা বাজিয়ে ফেলেছো সাথে অন্যকারোও। যাও চেন্জ করে আসো। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।””

~~~
উঠোনে পা রেখেই রিপ্তির শাসনীকন্ঠ,,

“” আমার কাছে ছাতা থাকতেও আপনি ভিজছেন কেন? ছাতার নিচে আসুন।””
“” সমস্যা নেই।””
“” দাড়ান আসছি।””

মহসীন কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রিপ্তি দৌড়ে বাড়ির পেছন দিকে গেলো। কিছু সময় পর এক বিশাল সাইজের কচুপাতা নিয়ে হাজির। মহসীনের মাথায় দিয়ে বললো,,

“”ভালো করে ধরুন। মাথায় পানি পড়লে জ্বর আসবে তো। আমি আপনার ছাত্রী দেখে এক ছাতায় আসা নিষেধ তাইনা? আমি বুঝতে পেরেছি।””

মহসীন পাতাটা মাথায় ধরে বললো,

“” আমার জ্বর আসলে কি হবে?””
“” আপনার কষ্ট হবে।””
“” আমার কষ্ট হলে কি হবে?”‘
“” আমারও কষ্ট হবে।””

মহসীন যেন এমনি এক উত্তরের অপেক্ষায় ছিলো। উৎসাহ নিয়ে বললো,,

“” তোমার কষ্ট হবে কেন?””

রিপ্তি হাঁটা থামিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ ভেবে বললো,,

“” জানিনাতো!””

মহসীনের উৎসাহ মিইয়ে গেলো। নিরব পায়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। তন্মধ্যেই মহসীন পুনরায় কথা তুললো,,

“” তোমার আমার ব্যাপারে কিছু জানতে ইচ্ছে করেনা?””
“” কেমন ব্যাপার?””
“”নানা ব্যাপার।””
“” কেমন নানা?””
“” আচ্ছা ছাড়ো। অন্যকিছু বলি।””
“” আচ্ছা।””

মহসীন আর কি বলবে খুজে পাচ্ছেনা। কিন্তু তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটার মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু ঠিকঠাকভাবে পরিবর্তনগুলো প্রকাশ পাচ্ছেনা। প্রকাশ যে পেতে হবে। নাহলে নিজের অনুভূতির রূপ কি করে দিবে সে? রিপ্তি হঠাৎ থমকে দাড়ালো। মহসীনের উদ্দেশ্যে বললো,,

“” জানতে ইচ্ছে করে তো।””

এমন আগাগোড়া ছাড়া মাঝপথের বাক্যে কিছুটা চমকালো মহসীন। কথাটার মানে বুঝতে বেশ সময় লাগলো। সময় শেষে বললো,,

“” অল্প নাকি বেশি?””
“” অনেক। জিজ্ঞেস করবো?””
“” না।””
“” কেন?””
“”কারণ আমরা চলে এসেছি।””
“” কোথায়?””
“” তোমার নানির কাছে। ঐ যে দোকানের ছাউনিতে দাড়িয়ে আছেন। হয় তো অনেক আগেই আসতে চেয়েছিলেন। বৃষ্টির জন্য আটকা পড়েছেন। আমি আর এগুবো না। তুমি যাও আমি আসছি।””

রিপ্তি মন খারাপ করে সামনে এক পা ফেলে সতর্কীকন্ঠে বললো,,

“” সাবধানে যাবেন!””

মহসীন থেমে গেলো। দ্রুতকদমে রিপ্তির দিকে এগিয়ে এলো। রিপ্তির বা’হাতটা টেনে নিয়ে বৃদ্ধাঙুলে লিখলো,,

“” আপনি নয় তুমি করে বলবে!””

ফিরতে পথে পা বাড়িয়ে বললো,,

“” তোমার যা জানার আছে সবগুলো ক্রমিক নং য়ে খাতায় সাজিয়ো। কাল আমি এসে দেখবো। সবসময় তুমি উত্তর লিখ কাল নাহয় আমি লেখবো!””

~~~

পরেরদিন সন্ধ্যাবেলা,

নানিকে সাথে নিয়েই পড়তে বসেছে রিপ্তি। তবে তিনি ঝিমুচ্ছেন। তসবিহ পাঠ করছেন একমনে। সেদিকে মহসীনের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। তার চমকানো দৃষ্টি দুইপৃষ্ঠার কাগজে। তার ধারণা ছিলো পেজভর্তি প্রশ্নেভরা থাকবে। যার উত্তর লিখতে লিখতে তার কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে শুধু একটা লাইন লিখেছে রিপ্তি। প্রথম পৃষ্ঠা ফাঁকা। তারপরেরও ফাঁকা তারপরেও ফাঁকা রেখে একদম নিচে অনেকটা পড়ে যাওয়ার মতো করে লিখেছে,

*আপনি এমন কেন?!!!

চলবে

[ এই গল্পটা রিপ্তিকে নিয়ে। আর তাকে ঘিরে যে চরিত্রগুলো আছে তাদেরকে আনতে হচ্ছে। কখনো অনুভব কখনো মহসীন আসবে। কার সাথে মিল হবে আদৌ মিল হবে নাকি সেটা জানার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা জিনিসটা খুবই পীড়াদায়ক তবুও বলবো সময় নিয়ে সব রহস্য খোলা হবে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here