ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,২৩,২৪

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,২৩,২৪
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২৩)

আতরের গন্ধের টানে পুরো গ্রামের মানুষ হাজির হয়েছে রিপ্তিদের বাড়ী। উঠোন জুরে চেনা অচেনা মানুষদের ভীড়। সকলেই এক নজর দেখতে চায় সাদা কাফনে ঢাকা মৃত মানুষটির মুখ। বাচ্চা-কাচ্চা থেকে শুরু করে সত্তরে পা দেওয়া বুড়ো মতিলব সাহেবও হাজির হয়েছেন। এক সময় এই গ্রামের বেশ ক্ষমতাবান ছিলেন। এখন কবরে যায় যায় অবস্থা। শুকনো কাঠের লাঠিতে ভর করে উঁকি দিলেন চৌকিতে শুয়িয়ে রাখা নিথর দেহটির উপর। একজন মুখ থেকে কাপড়টা সরাতেই দুর্বল কন্ঠে বললেন,,

“” বড়ো ভালা মানুষ আছিল কবির। আল্লাহ বেহেস্ত দান করুক!””

সাথে সাথে চারপাশের মানুষের মধ্য থেকে ভেসে আসলো মৃদু কান্নাসুর। বাড়ির মূল দরজার সামনে বিন্যাসিত সিড়ির এক কোনে বসে ছিলো রিপ্তি। হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে উঠলো,,

“” উফ! এতো শব্দ কিসের? দেখছো না আমি মানুষ গুনছি? সবাই চুপ করো তো।””

রিপ্তির কথায় কেউ কান দিলোনা। রিপ্তিও সেদিক থেকে নজর সরিয়ে গেটের দিকে মনোনিবেশ করলো। উৎসুক নয়নে চেয়ে আছে। আরেকজন ছেলেমানুষ আসলেই পাঁচশত পূর্ণ হবে!

বাড়ীর ভেতরে জায়গা না পেয়ে অনেকে রাস্তা থেকেই ভেতরে উঁকি মারছে। অনেক্ষণ কেটে যেতেও যখন আরেকটি পুরুষ মানুষের আগমন ঘটলো না রিপ্তির মন খারাপ হলো। সিড়ি ছেড়ে উঠোনে পা রাখতেই দুজন লোক ভেতরে প্রবেশ করে। খুশিতে রিপ্তির চোখ চকচক। দৌড়ে বাসার ভেতর ঢুকে গেলো। সোজা রান্না ঘরে ঢুকেছে। বিশাল এক হাড়ি চুলায় বসিয়ে দিলো। ম্যাচে শলা ঘষতেই মিন্মি দৌড়ে এসেছে। চোখ,মুখ ফোলা। চোখের কোলে অশ্রু নিয়ে বললো,,

“” কি করছিস,রিপ্তি?”‘

রিপ্তি চুলায় আগুন ধরালো। বড় মগ দিয়ে গুনে গুনে পানি ঢালছে পাতিলে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,,

“”চা বানাচ্ছি,ভাবী। বাড়ীতে এতো মেহমান এসেছে খাতিরযত্ন করতে হবেনা?””

মিন্মির গাল ভিজে গেলো। রিপ্তিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,,

“” তোর কি হয়েছে রিপ্তি? এসব পাগলামি কেন করছিস?””
“” কিসের পাগলামী? পাগলিরা কি চা বানায়? তুমি বরং ভাইয়াকে বলো,দোকান থেকে কয়েক প্যাকেট বিস্কুট এনে দিতে। বাসায় যেগুলো আছে,সবার হবেনা। পরে তো সবাই বলবে,কবির সাহেব কৃপণ হয়েছে গিয়েছে। আমার বাবা মোটেও কৃপণ নয়। আমি থাকতে বাবার অপমান হবে? কিছুতেই না।””

মিন্মি রিপ্তিকে জড়িয়ে ধরে বললো,,

“”আমাদের বাবা আর নেই রিপ্তি। এটা তুই কেন বুঝতে চাচ্ছিস না?””

রিপ্তি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। চা-পাতির কৌটো’টা খুলতে খুলতে বললো,,

“” আমি কি পিচ্ছি মেয়ে যে,এই ছোট জিনিসটা বুঝবোনা? ঐতো উঠোনে বাবার মৃতলাশটা পরে আছে। একটু পরে জানাজা হবে। তারপর চাইলেও বাবাকে দেখতে পারবোনা। ছুতে পারবোনা। কথা বলতে পারবোনা। কখনোইনা। আমি সব বুঝি ভাবী!””

রিপ্তির ডান হাতটা চেপে ধরে মিন্মি। হাতে কৌটো’টা মাটিতে পড়ে গেলো। রান্নাঘরে চা-পাতির ছড়াছড়ি!

“” দিলে তো সব ফেলে? এখন চা করবো কি দিয়ে?””

রিপ্তির কথা অগ্রাহ্য করে সামনে হাঁটা ধরেছে মিন্মি। বাবা যে আর নেই এ খবরটা রিপ্তিই এসে জানিয়েছিলো। ভোর বেলা। এমনভাবে বলেছিলো যেন এমন ঘটনা দৈনিক আট-দশবার করে ঘটে। তারপর থেকে সকলে কান্নারকোলে ঢলে পড়লেও রিপ্তি পড়েনি। এতোটা স্বাভাবিক কি করে থাকছে মেয়েটা? অতিরিক্ত শোকে অনুভূতিনামক জিনিসটা কি হারিয়ে ফেলেছে? কিন্তু অনুভূতি ছাড়া কি মানুষ হয়? হয়না। তারা প্রাণীর কাতারেই পড়েনা। তাহলে কি রিপ্তিও জড়বস্তুর মহলে নিজের নাম লিখিয়েছে? নাহ! এ হতে পারেনা। মিন্মি থাকতে তো কখনোইনা। ওকে কাঁদতে হবে। একবার চোখের পানি পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সব!

রিপ্তি শক্ত হয়ে দাড়িয়ে পড়ায় হাঁটায় বাধা পেয়েছে মিন্মি। প্রচন্ড পরিমানের বিরক্ত নিয়ে বললো রিপ্তি,,

“” কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? চুলোয় আগুন ধরিয়ে এসেছি তো।””

মিন্মি রিপ্তির গালে হাত রাখলো। শান্ত গলায় বললো,,

“” বাবাকে দেখতে। শেষবারের মতো বাবাকে দেখবিনা?””
“”বাবা কি আমাকে দেখবে?””

মিন্মি চমকে উঠে। রিপ্তি আরো কয়েকগাছা প্রশ্ন রাখে,,

“” বাবা কি আমার সাথে কথা বলবে? বাবা কি আমার চোখের পানি মুছে দিবে? বাবা কি আমার মাথায় হাত বুলাবে? বাবা কি আমার সাহস জোগাবে? করবে নাতো? তাহলে আমি কেন দেখতে যাবো?””
“” এমন অবুঝের মতো করছিস কেন রিপি?””

রিপ্তি রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,,

“” আমি অবুঝ নই,ভাবী। তোমরা অবুঝ। তাইতো মিছে কান্না করছো! কান্না করলে কি মৃতরা ফিরে আসে?””

মিন্মি ওখানেই থমকে আছে। না রিপ্তির কাছে যাচ্ছে না অন্য কোথাও। তখনি রান্নাঘর থেকে জোরালো কন্ঠ এলো,,,

“” এ বাড়ীতে আমি যতদিন আছি ততদিন যেন বাবার কোনো ছাত্র ঢুকতে না পারে। এমনকি বাবার মৃত্যুসংবাদটাও না পায়।””

~~~
কবির সাহেব চলে গিয়েছেন আজ চারদিন। বাসার সবাই গভীর শোকাহত। এখনো যেন ধাক্কাটা সামলিয়ে উঠতে পারছেনা। মৃত্যু সবসময় আকস্মিকই হয়। কিন্তু কবির সাহেবের জন্য যেন খুব বেশিই আকস্মিক। মেনে নেওয়ার মতো কোনো মনোবলই পাচ্ছেনা কেউ। একমাত্র রিপ্তি বাদে। তার মধ্যে কোনো শোক শোক ভাব নেই। যখন তখন কান্না তো দুর,এক পলকের জন্যও এক ফোঁটা পানি ঝরেনি তার চোখ থেকে। তার চোখ শুকনো। অনেকটা মরুভমির বিশাল বিস্তৃতের ন্যায়। তবে সে খুব ব্যস্ত। সকাল,দুপুর,রাত তিনবেলায়ই রান্নার চুলো জ্বালাচ্ছে আর নিভাচ্ছে। কোমড়ে ওড়না বেধে ঘর মুচছে,কাপড় কাচছে,উঠোন,ঝাড়ু দিচ্ছে। পাক্কা গিন্নি! আচ্ছা বিয়ে না হয়েও বুঝি গিন্নি হওয়া যায় না? কেন যায় না? বিয়ের আগে গর্ভবতী হতে পারলে গিন্নিও হতে পারে।

রাতের খাবার সাজাচ্ছে রিপ্তি। আজ সে অনেক কিছু রান্না করেছে,মুরগির মাংসের ঝোল,ডিম বোনা,পাতলা ডাল,দুরকম ভাজি সাথে আলুভর্তা। একে একে সব সাজাচ্ছে আর সকলকে ঠিক সময়ে টেবিলে আসার তাগিদ দিচ্ছে। মিন্মি লুকিয়ে লুকিয়ে রিপ্তিকে দেখছে আর শাড়ীর আঁচলে চোখ মুচ্ছে! আর সহ্য করতে না পেরে স্বামীর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। করুণ কন্ঠে বলে,,

“” আমার মেয়েটাকে ঠিক করে দাও!””

~~~

যাত্রী ছাউনিতে বসে আছে রিপ্তি। ঢাকার বাস ধরবে। এতো তাড়াহুড়ো করে বেরোলো তবুও ট্রেণটা মিস করেছে। তাই বলে তো বাসায় ফেরত যেতে পারেনা। এক গুরুত্বপূর্ণ কাজের উদ্দেশ্যে এগারদিন বাদে বাইরে পা ফেলেছে সে। হসপিটাল যেতে হবে। ভালো হসপিটাল লাগবে সাথে ভালো ডাক্তার। অবশ্যই মহিলা ডাক্তার হতে হবে। যাতে সে লজ্জা না পায়। নিজের কুকর্মের জন্য! বাবা নেই তো কি হয়েছে? বাবার রেখে যাওয়া সম্মানটা সে কিছুতেই নষ্ট হতে দিবেনা। তারজন্যই তো ঢাকা যাওয়া। আজ যে সে আরেকটা পাপ করতে যাচ্ছে। একটা নিষ্পাপ,ফেরেশতাসমতুল্য প্রাণকে খুন করতে যাচ্ছে। এতো বড় বড় দুটো পাপের জন্য তার কি শাস্তি হবে? যা খুশি হোক। তবুও সে বাবার সম্মানহানি হতে দিবেনা!

বাস চলে এসেছে। রিপ্তি সবার আগে উঠলো। পুরো বাস ফাঁকা। তেমন কোনো যাত্রী নেই। নরসিংদী থেকে ছাড়া এটাই প্রথম বাস। কিছুক্ষণ পরেই ভরাট হয়ে যাবে। রিপ্তি একদম পেছনের সিটে গিয়ে বসলো। কন্টাক্টর চেচিয়ে উঠলেন,,

“” আপা,এতো পেছনে বইছেন ক্যান? সামনে আহেন।””

লোকটির কথা কর্ণপাত করলো না রিপ্তি। জানালার কাঁচ খুলে দিচ্ছে। সকালের মিষ্টি রোদ এখন কড়া হয়ে উঠেছে। সূর্যের সবটা তেজই গিয়ে পড়লো রিপ্তির মুখে। সেদিকেও ভ্রাক্ষেপ করেনি রিপ্তি। রোদকে সঙ্গি করেই সিটে হেলান দিলো। চোখদুটো বুঝতেই পাশে কেউ এসে বসেছে। সাথে বাচ্চাও আছে। ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। এতো অল্প সময়েই সব সিট দখল হয়ে গেলো? পেছনে বসেও শান্তি নেই! বাচ্চাটি অনরবত কেঁদে চলেছে। বাচ্চার মা বিরক্ত হচ্ছেন। প্রথমে বাবা,সোনা,কলিজা,লক্ষি,পেঁচা ডাকাডাকি করেও থামাতে না পেরে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছেন। চড়ের শব্দটা রিপ্তির কানে পৌছিয়েছে। সাথে সাথে সব নিরব। রিপ্তিও খুশি। কঁপালে জমে থাকা বিরক্তের ভাজটা মিলিয়ে যেতেই মৃদু সুর ভেসে এলো। গান বাজছে কোথাও। রিপ্তি ঠিক অনুৃমান করতে পারছেনা কোথায় বাজছে। তার পাশেই কি? নাকি অন্যকোথাও? আজকাল তো বাসের মধ্যেও গান হয়। সেখানেও হতে পারে। কোথায় বাজছে কেন বাজছে তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই রিপ্তির। তবে মনের কোনো এক কোণ সেই গানেই আটকা পড়েছে। কানের ভেতর দিয়ে গভীরে চলে যাচ্ছে সেই গানের কথাগুলো,,

না জানি কোন অপরাধে
দিলা এমন জীবন!
আমারে পোড়াইতে তোমার
এতো আয়োজন!!
আমারে ডুবাইতে
তোমার এতো আয়োজন!!(গান)

গানের কথাগুলো রিপ্তির অন্তরে বাজছে। হারিয়ে যাচ্ছে এক অজানায়। রিপ্তির মনে হলো এই গানটা তাকে নিয়েই গাওয়া হয়েছে। হ্যা তাকেই। রিপ্তি পুরোদমে গানে ডুবে গেলো। তলিয়ে যাচ্ছে ঘুমের তলদেশে। গাঁথছে সাদাকালো স্বপ্ন। নানা আবিজাবি স্বপ্নের মাঝেই সে তার বাবাকে খুজে পেলো। সাদা চমকানো সাদা পান্জাবী পড়ে আছেন তিনি। পান্জাবীতে পা ঢেকে আছে। মাথায় পাগড়ী,মুখে সাদা দীর্ঘদাড়ি। এমন চমকানো সাদা রঙ আগে কখনো দেখেনি রিপ্তি। সে বিস্ময় নিয়ে বাবাকে দেখছে। বাবার মুখটাও কেমন দুধসাদা। কিন্তু বাবা তো এতো ফর্সা রঙের ছিলোনা। তাহলে এই লোকটি কে? বাবার মতো অন্য কেউ?? রিপ্তির ভাবনার মধ্যেই সাদারঙের লোকটির এক চোখ দিয়ে রুপোলি পানির টুকরো গড়িয়ে পড়েছে। রিপ্তি শঙ্কিতকন্ঠে বললো,,

“” বাবা! তুমি কাঁদছো কেন?””

এবার দুচোখ থেকে রুপোলি পানির টুকরো ঝরছে। রিপ্তি আতঙ্কে পড়ে যায়। মহাব্যস্ত হয়ে পড়ে বাবার চোখের পানি মুছে দিতে। কিন্তু তার ছটফট করা শরীরটা নড়তে পারেনা। এক জায়গায় গেথে আছে। মনে হচ্ছে কোনো শক্ত বরফজমা দিয়ে সে তৈরী। রিপ্তি অসহায়ভাবে বাবার দিকে তাকাতেই বাবা নরমসুরে বললেন,,

“” কোনো প্রাণের বিনিময়ে সম্মান চাইনা,মা। আবার সম্মানের বিনিময়েও প্রাণ চাইনা।””

বাবার গুরুগম্ভীর কথার মানে বুঝতে পারছেনা রিপ্তি। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বুঝার আগেই বাবা মিলিয়ে গেলেন। রিপ্তি চিৎকার করে বাবা,বাবা বলে ডাকছে।

“” আপা! আপা!!””

হঠাৎ ভরাট গলার পুরুষকন্ঠে রিপ্তির ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নের সাথে বাস্তবটা এখনো ঘোলাটে হয়ে আছে। রিপ্তি আবার চোখ বন্ধ করে নিতেই বাস কন্টাক্টর বিরক্ত নিয়ে বললেন,,

“” বাস আর যাইবোনা। আপনি কি নামবেন?””

রিপ্তি লাফ দিয়ে উঠে। পুরো বাস ফাঁকা। সে আর এই মাঝ বয়সী কঠোর লোকটা ছাড়া কেউ নেই। কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সামলে নেয়। কন্টাক্টরকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত নেমে আসে। এখান থেকে রিকসা উঠলে দশ মিনিটের রাস্তা আমেনা হসপিটালের। স্থিরমূর্তি হয়ে দাড়িয়ে আছে রিপ্তি। তার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে খালি রিকসা। রিপ্তির চোখ সেদিকে নেই রোডের উল্টো পাশে। চোখ বন্ধ করে দম আটকে দাড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ শব্দ করে নিশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করলো,বাবা,সম্মান আর প্রাণ দুটোই বাঁচবে!

~~~

বাড়ি ফিরেই এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিপ্তি। ঘর ছাড়বে সে,শুধু ঘর নয় গ্রামও ছাড়বে। সাথে পুরো নরসিংদী। কিন্তু কিভাবে? লুকিয়ে? না বলেই রাতের আধারে হারিয়ে যাবে নাকি ভাইয়া-ভাবীকে জানিয়ে যাবে? কিন্তু উনারা কি রাজি হবে? নানা চিন্তাভাবনার মাঝেই রাতের খাবার সাজাচ্ছিলো রিপ্তি। মিন্মিও হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে। আড়চোখে রিপ্তিকে পরখও করছে। তার এই জীবনের দেখা সবচেয়ে আশ্চর্যজনক চরিত্র হলো রিপ্তি। কিছুদিন আগেও ভেবেছিলো রিপ্তির মন পড়ার অদৃশ্যশক্তি আয়ত্ব করে ফেলেছে সে। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর তার চিন্তাভাবনাকে ভুল প্রমান করে দিলো রিপ্তি। যতদিন যাচ্ছে মেয়েটা তত জটিলরুপ ধারণ করছে। না কিছু বলছে না কিছু বুঝতে দিচ্ছে। তবে আজ অন্যরকম লাগছে। কিছু একটা নিয়ে মগ্ন। কিন্তু সেটা কি?

ভাইয়ের পাতে ভাত বেড়ে দিচ্ছে রিপ্তি। নিজের ভয়টা কাটিয়ে সাহস করে বলেই দিলো,,

“” ভাইয়া, আমি হলে থেকে পড়তে চাই।””

রাসেল গরম ভাত নাড়ছিলো। ভাত নাড়া বন্ধ করে বললো,,

“” যখন বাবা বলেছিলো তখন যাসনি। এখন মত পাল্টালো কেন? আর তুই তো সবে ফার্স্ট ইয়ারে পড়িস। হলে সিট পাওয়া কি এতো সহজ?
“”তাহলে অন্য কোথাও থাকবো।””
“” কোথায়?””
“” কোথাও একটা!””

রাসেল আর শান্ত থাকতে পারলোনা। কঠিনসুরে বললো,,

“” কোথাও যাবিনা। এখানে থেকেই পড়বি। তোর যাতায়াতে সমস্যা হলে মিন্মি তোর সাথে যাবে।””

রিপ্তিও কঠিন করে বললো,,

“” আমি যাবো যাবো যাবো! আমার যেখানে থেকে ইচ্ছে হয় সেখান থেকেই পড়বো। আমার তোমাকে জানানোর ছিলো জানিয়ে দিয়েছি।””

রাসেল চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে গেলো। চোখ পাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনি মিন্মি সামনে এসে দাড়ালো। দুজনের মাঝে দেয়াল হয়ে মিন্মিকে বললো,,

“” আগে খাওয়াটা শেষ কর। পরে ভাবিস কোথায় থেকে পড়বি।””

হাতে থাকা ভাতের বোলটা শব্দ করে রাখলো রিপ্তি। চুপচাপ নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। পেছনে ভাবী,নানির ডাককে পরোয়া করলোনা।

~~~

নিয়মিত ক্লাস করার সুবাদে অনেকের সাথেই পরিচয় হয়েছে রিপ্তির। তবে কারো সাথেই তেমন একটা সখ্যতা গড়ে উঠেনি একমাত্র রুবিনা বাদে। ওর সাথে মিশতে খুব একটা ভালো লাগেনা রিপ্তির। প্রচুর কথা বলে! সবকিছুতেই আগ বাড়িয়ে ঢুকে পড়ে। সাথে রিপ্তিকেও জড়িয়ে ফেলে। মাঝে মাঝে এতো রাগ হয় যে ইচ্ছে করে গালে দু/চারটা থাপ্পড় মেরে বসে। আজও ক্লাস শেষে বের হতেই রুবিনা সামনে এসে দাড়ালো।

“” কোথায় যাচ্ছিস?””

রিপ্তির দায়সারা উত্তর,,

“” বাড়ীতে।””
“” এতো জলদি?””

রিপ্তি ভ্রূ কুঁচকে ফেললো। বিরক্ত নিয়ে বললো,,

“” প্রতিদিন তো এই সময়েই যায়। আমার ট্রেণ ধরতে হয়।””

রুবিনা হাত ঘড়িটার দিকে চোখ বুলিয়ে বললো,,

“” এখনো অনেক সময়। চল আমার ভাগ্নিকে দেখে আসি।””
“” ভাগ্নি?””
“” হুম। চলনা। আমি আপুকে বলেছি তোকে নিয়ে যাবো।””
“” আমি বলেছি যাবো?””
“” আমি তো বলেছি! তোর ট্রেণ মিস না হলেই তো হলো।””

রিপ্তিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওকে টানতে টানতে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে রুবিনা।

হসপিটালে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করে রিপ্তি,,

“” এটা তোর আপুর বাসা?””

রুবিনা একগাল হেঁসে বললো,,

“” হুম। কাল রাতেই ভাড়া নিয়েছে। আরো দুদিন থাকতে হবে,বুঝলি?””
“” মশকরা বন্ধ করবি? আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে।””
“” তোর রাগ হয়না কখন? সারাক্ষণই তো চোখে কড়া দৃষ্টি! আচ্ছা রাগটা কি শুধু আমাকে দেখলেই আসে নাকি সবাইকে দেখলেই?””

রিপ্তি কড়া কথা বলতে যাবে তখনি শুনতে পেলো,,

“” আমার স্ত্রী!””

রিপ্তি হাওয়াবেগে ডানপাশে ঘুরলো। পলকহীনভাবে চেয়ে আছে সামনে থাকা মানুষটির দিকে। কতযুগ পরে দেখা পেলো এই মানুষটাকে?? শতাব্দিও কি পেরিয়ে গিয়েছিলে? রিপ্তি অদ্ভুত উত্তেজনায় সামনে পা ফেলছে। এইতো আর কয়েককদম ফেললেই অনুভবের মুখোমুখি হবে। চোখে চোখ রেখে বলবে,কোথায় ছিলেন লাল ব্যাঙ?

অনুভবের সামনে থাকা নার্সটি ভরাট গলায় বললো,,

“” আপনার মেয়ে হয়েছে।””

চলবে

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২৪)

“” আমার স্ত্রী!””

রিপ্তি হাওয়াবেগে ডানপাশে ঘুরলো। পলকহীনভাবে চেয়ে আছে সামনে থাকা মানুষটির দিকে। কতযুগ পরে দেখা পেলো এই মানুষটাকে?? শতাব্দিও কি পেরিয়ে গিয়েছিলে? রিপ্তি অদ্ভুত উত্তেজনায় সামনে পা ফেলছে। এইতো আর কয়েককদম ফেললেই অনুভবের মুখোমুখি হবে। চোখে চোখ রেখে বলবে,কোথায় ছিলেন লাল ব্যাঙ?

অনুভবের সামনে থাকা নার্সটি ভরাট গলায় বললো,,

“” আপনার মেয়ে হয়েছে।””

বাচ্চাটিকে অনুভবের দিকে ধরে আছে। মায়া দৃষ্টি নিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকা শিশুটির দিকে তাকিয়ে আছে অনুভব। হাতদুটো উচু করতে চেয়েও পারছেনা। এক অজানা ভয়ে শরীরজুরে শিরশির অনুভব হচ্ছে। কিন্তু কেন? এমন তো নয়,এই প্রথম কোনো বাচ্চাকে কোলে নিচ্ছে। তাহলে? নার্সটি নরমসুরে বললো,,

“” এটা বুঝি আপনাদের প্রথম সন্তান?””

অনুভব এক পলক তাকালো সাদা শাড়ী পরিহিতা মাঝ বয়সী মহিলাটির দিকে। আনমনে মাথা নিচু করে বললো,,

“” হুম।””
“” এই জন্যই কোলে নিতে ভয় পাচ্ছেন। এতো ভয়ের কিছু নেই। নিন,ধরুন!””

কাঁপা কাঁপা হাতদুটো দিয়ে বাচ্চাটিকে আকড়ে ধরে অনুভব। বুকের সাথে এমনভাবে মিশিয়ে নিচ্ছে যে মনে হচ্ছে,বুক থেকে একটু আলাদা হলেই বাচ্চাটি টুপ করে পড়ে যাবে। বাচ্চাটির দিকে স্নেহদৃষ্টি রেখে বললো,,

“” লিনা কেমন আছে?””

সাথে সাথে পাশ থেকে আরেকটা মৃদু সুর ভেসে এলো,,

“” লিনা!””

অনুভব মাথা ঘুরে তাকিয়েই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো। অকল্পনীয় কিছু ঘটে গিয়েছে এমনভাবে চেয়ে আছে। অবাকরাঙা চোখদুটির স্থির দৃষ্টি। বিস্ময় নিয়ে বললো,,

“” রিপ্তি!””

রিপ্তির ক্লান্ত চাহনি অনুভবের বুকের সাথে ল্যাপ্টে থাকা শিশুটির উপর। পা দুটো মেঝের সাথে আটকে আছে।হাঁটতে পারছেনা সে। অথচ আর দুকদম এগুলোই অনুভবকে ছুতে পারবে। হাত বাড়িয়ে! চোখ সরিয়ে অনুভবের দিকেও রাখতে পারছেনা। তার বুঝি এই দুনিয়ার সকল শক্তি হারিয়ে গিয়েছে। নিস্ব সে। এই দুনিয়াবি শক্তিছাড়া সে বেঁচে আছে কেন? আসলেই কি বেঁচে আছে? রিপ্তি কথা বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছেনা। কন্ঠনালীটা বিমুখ করে আছে। তবুও সে বহু কসরৎ চালাচ্ছে কিছু বলার জন্য। গলা ছিড়ে যাওয়া উপক্রম হলেও কিছু বলতে পারলোনা। চলছে অন্তর্মনের কথা,, তারমানে সেই ভুলটা অনিচ্ছাতে নয়,ইচ্ছে করেই করেছিলেন? যা ইচ্ছে করে করা হয় তাকে তো ভুল বলে সম্বোধন করা যায় না। তাকে বলতে হয় অন্যায়। আমার বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যেটাকে আপনি একটি অন্যায়ঘেরা সন্ধ্যা বানিয়ে দিলেন,লাল ব্যাঙ?

রিপ্তির মাথা ঘুরাচ্ছে,পেটের ভেতরের সকল যান্ত্রিকগুলো যেন একে অপরের সাথে যুদ্ধে লড়ছে। অশ্রুভেজা চোখদুটো হঠাৎ করেই পলক ফেললো। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে নিচে পড়ে যেতে নিবে,তখনি রুবিনা দৌড়ে এলো। শঙ্কিত কন্ঠে বললো,,

“” রিপ্তি! ঠিক আছিস তো?””
“” আমি বাসায় যাবো!””
“” কিন্তু..””
“” প্লিজ!””

খানিকটা অনাগ্রহ নিয়েই রিপ্তিকে নিয়ে হাঁটা ধরেছে রুবিনা। রিপ্তিও ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। দুজনের পায়ের দ্রুত চাপ পড়ছে সাদা মসৃণ টাইলসের উপর। অনুভব তখনো ধাক্কা আর অবাকটাকে সামলিয়ে উঠতে পারেনি। রিপ্তির চলে যাওয়ার পানেই গভীরদৃষ্টি। যা রিপ্তিকে ফেলে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে। তখনি নার্সের গলা,,

“” আপনার ওয়াইফ আপনাকে ডাকছেন।””

অনুভবের হুশ এলো। সাথে সাথেই ব্যাকুল হয়ে পিছু ডাকছে,,

“” রিপ্তি,দাড়াও। রিপ্তি!””

অনুভব দৌড়োবে নাকি দাড়িয়েই থাকবে বুঝে উঠতে পারছেনা। এতোগুলো মাস পর এক পলকের দেখাতে তার সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। খরস্রোত বয়ছে আপাদমস্তকে। কি করা উচিত,কোনো কুল কিনারায় পাচ্ছে না। নির্বোধের মতো দাড়িয়ে চিৎকার করে শুধু ডেকেই চলেছে। অবশেষে যখন বোধশক্তি ফিরে এলো বাচ্চাসহই দ্রুত হেঁটে চলেছে। সিড়ি পার হয়ে নিচে এসে শূন্যহারা হয়ে গেলো। কোথাও রিপ্তির চিহ্ন নেই। তবে কি সে ভুল দেখলো? কিন্তু এতোটা ভুল কি করে হতে পারে? সে স্পষ্ট রিপ্তির ক্লান্তমাখা চোখদুটো দেখেছে। কন্ঠধ্বনি পেয়েছে। খুব কাছ থেকে। অনুভব অতিশয় উৎকন্ঠা হয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলো। চোখের দৃষ্টি চারপাশে ঠেকছে। অস্থির নয়নদুটি শুধু রিপ্তিকেই খুজছে। কিন্তু কোথায় সে? কোথায় হারিয়ে গেলো??

~~~

দীর্ঘদিন ধরেই সকালের চুলোটা রিপ্তি ধরাচ্ছিলো। আজ হঠাৎ চুলোয় আগুন না দেখে চিন্তায় পড়ে যায় মিন্মি। চিন্তা ঝেড়ে ফেলে নিজেই চুলোয় আগুন ধরিয়েছে। হাড়িতে তিন কাপ পানি ঢেলে দিয়ে সাথে লবণ মিশিয়ে দিলো। পানি সিদ্ধ হতে হতে আটার কৌটোটা নিচে নামিয়ে রাখে,রুটি বানানোর পিড়ি বেলুনগুলো ভালো করে ধুতে থাকে। সবশেষে সিদ্ধপানিতে আটা ঢেলে নাড়তে লাগলো।

ঘন্টাখানিকের মধ্যে সকালের নাস্তা গুছিয়ে ফেলে মিন্মি। সময় এখন আট’টা। রাসেল একটু পরই বের হবে। কোচিং খুলেছে সে। এক মাস পার হতে চললো। কোচিংয়ের মাঝেই মাস্টার্স শেষ করে একটা ভালো চাকরির খোঁজ লাগাবে। সংসারের কর্তা তো এখন সে’ই!রিপ্তিরও এতক্ষণে বের হয়ে যাওয়ার কথা। রোজ তো আট’টা নাগাদই বের হয়। এখনো ঘুমুচ্ছে নাকি? ভাস্যমান প্রশ্নটির সাথেই মনের ভেতর থেকে অজান্তেই আরেকটা প্রশ্ন চলে আসে,রিপ্তির শরীরটা ভালো তো?

মিন্মি আর সময় নষ্ট করেনি সোজা রিপ্তির রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে। কাল বাসায় আসার পর থেকে মেয়েটা রুম থেকে তেমন বের হয়নি। রাতে জোর করে দু’দলা ভাত খায়িয়ে দিয়েছিলো মিন্মি। এ কয়দিন তো বেশ ছিলো,হঠাৎ কি হলো? না চাইতেও মিন্মির মনের ভেতর কুচিন্তারা উকি দিচ্ছে। জড়ো হচ্ছে নানা অজানা আসঙ্কিত দুশ্চিন্তা। একেই হয়তো বলে মায়ের মন!

দরজায় ছোট্ট বারি মারতেই পাল্লা খোলে গেলো। ভেতরে কেউ নেই। পুরো রুমটা গুছানো। খুব যত্নসহিত গুছিয়ে রাখা হয়েছে সবকিছু। রিপ্তি সবসময় আশেপাশের জিনিসকে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করে কিন্তু আজকেরটা খুব বেশিই যত্ন করা। যেমনটা কেউ দীর্ঘদিনের জন্য কোথাও বেড়াতে গেলে গুছিয়ে রেখে যায়। মিন্মির মনের কুচিন্তারা এবার জোরালোভাবে বয়ছে। দ্রুতকদমে ভেতরে ঢুকে আশেপাশে খোঁজ করছে রিপ্তির। কয়েকবার ডেকেও যখন সাড়া পেলোনা তখন বাইরে ছুটলো। দরজা ছেড়ে বাইরে পা ফেলবে তখনি নজর আটকালো বিছানার উপর। একদম মাঝ বরাবর একটি বালিশ রাখা। যার নিচ দিয়ে এক টুকরো কাগজ বেরিয়ে আছে। মিন্মি ব্যগ্রভঙ্গিমায় কাগজটি তুলে নিলো।

**প্রিয়
মিন্মি মা

খুব অবাক হয়েছো তাইনা ভাবী? হবেই তো। অবাক হওয়ার কান্ড ঘটালে অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। তুমি কি খেয়াল করেছো তোমাকে আমি মা বলে সম্বোধন করেছি? যদি না করে থাকো তাহলে এবার করো,এই আমি আবার ডাকলাম,মিন্মি মা!

আমি মা হারা সন্তান ছিলাম। কিন্তু এখন নেই। ‘মা’ নামক এই ছোট্ট শব্দটাতে যে কত অজস্র অনুভূতি লুকিয়ে থাকে তা শুধু সেই জানে যার মা নেই। আমিও জানি। বাবা নিশ্চয় তোমাকে বলেছে,আমি ছোটবেলা আম্মু এনে দেওয়ার বায়না ধরতাম? তখন তো বুঝিনি আমার এই আবদার বাবাকে কত কষ্ট দিতো। যখন বুঝতে পারলাম তখন তুমি চলে এলে। আমার বাবা তোমায় এনেছে। ভাইয়ার বউ হয়ে আসলেও আমি জানি,বাবা তোমাকে আমার জন্য এনেছিলো। আমার মা রূপে! বাবার সব সিদ্ধান্ত সবসময় সঠিক হয়। কোনো সমস্যা সমাধান বাচ-বিচার না করে চট জলদি সিদ্ধান্তে চলে যায়না। উনার এক কথা,সব থেকে ভালো সমাধান পেতে হলে খুটিয়ে,সময় নিয়ে,বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে হয়। তাহলে এবার কেন তা করেনি? আমাকে এতো বড় সমস্যার মধ্যে রেখেই কেন চলে গেলেন? এতো অল্প সময়ে কি করে সমাধান খুজে নিলেন? যে সমাধানের মানে আমি বুঝতেই পারছিনা! আমার কি বাবাকে স্বার্থপর বলা উচিত?

বাবা সবসময় বলতেন,আমি খুব বুদ্ধীমতী মেয়ে কিন্তু বুদ্ধীর ব্যবহার করিনা বলে মস্তিষ্কে মরিচা পড়ে গিয়েছে তাই বোকা বোকা কাজ করি। এবারও কি বোকা কাজটাই করেছি? নাকি বুদ্ধীর ব্যবহার করেছি? যেটাই হোক না কেন,সমস্যার সমাধান তো আমি বের করবোই। তারজন্যই আমায় বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। মিন্মি মা! আমাকে তুমি সাহায্য করবেনা? আমার পাশে থাকবেনা? তোমার কাছে আমার তেমন কোনো চাওয়া নেই,শুধু এইটুকুই আবদার ভাইয়াকে সামলে নিও। আমি যা করছি আমার বাবার সম্মান বাঁচাতে। তারজন্য তো ভাইয়ারও আমার পাশে থাকা উচিত তাইনা বলো? নিশ্চয় থাকবে। আমি জানি আমার ভাইয়া আমাকে খুব ভালোবাসে,বাবার মতো!

পাপ করেছি,অনেক বড় পাপ। পাপ মোচন করে আমি আবার আমার মিন্মি মা,বাবার সমতুল্য ভাইয়ের কাছে ফিরে আসবো। দু’হাত ভরে তোমাদের স্নেহ,মমতা,ভাললবাসা কুড়িয়ে নিবো। ততদিন তোমরা আমার অপেক্ষায় থেকো। কথা দিচ্ছি,আমি ভালো থাকবো,সুস্থ থাকবো। যদি মনে হয়,ভালো থাকতে পারছিনা তখন তোমাদের ডেকে নিবো!

ভালো থেকো

তোমার হঠাৎ পাওয়া রিপ্তি মেয়ে

পুনশ্চঃ

১.মায়ের বোরকা আর তোমার কাছে থাকা আমার মোবাইলটা নিয়ে যাচ্ছি।
২.না বলে চলে আসার জন্য ক্ষমাপার্থী!
৩.আমার এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণপ্রার্থীর থেকে আমাকে আড়াল করার অনুরোধ। তার মুখদর্শনে হয়তো আমি দ্বিতীয় পাপটিও করে ফেলতে পারি। তুমি মা হয়ে নিশ্চয় চাইবেনা তোমার মেয়ে আরো একটি পাপ করুক?
৪.তোমার সাথে আবার যেদিন দেখা হবে,শুধু মা বলে ডাকবো। হয়তো লুকিয়ে রাখা দুটি গোপন কথাও জানাবো! যার একটি বাবা জেনেছেন,এতক্ষণে তুমিও আন্দাজ করতে পেরেছো। অপরটি শুধু তুমি জানবে,বাবা জানতে পারেননি!

~~~

“” বাব্বাহ! রিপ্তি,তুই বোরকাও পড়িস? তোকে তো চেনায় যাচ্ছেনা। পুরো আন্টি লাগছে।””

রুবিনার কথায় সামান্য হাঁসলো রিপ্তি। তবে মুখে কিছু বললোনা। ক্লাস চলছে। ক্লাস চলাকালিন কথা বলাকে সে বেয়াদবী মনে করে। রিপ্তি হাতমোজাটা খুলে লিখা শুরু করেছে। রুবিনা তখনো রিপ্তির দিকেই তাকিয়ে। তার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে চমকানোর পর্বটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রথম ঘন্টা পড়তেই রিপ্তি রুবিনার দিকে ঘুরলো। অসহায় গলায় বললো,,

“” আমার হলের একটি সিট লাগবে। সেটা আজই!””

রুবিনা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,,

“” হলের সিট কি মুড়ির মোয়া যে তুই চাইলি আর পেয়ে যাবি? আজকাল তো মোয়াও পাওয়া যায়না রে। ইশ! অনেকদিন হলো মোয়া খাইনা।””

রিপ্তি বিরক্ত হয়ে বললো,,

“” আমি সিরিয়াস। বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।””

রুবিনা সন্দেহচোখে তাকাচ্ছে। মনে মনে হিসেব-নিকেশ করে বললো,,

“” পালিয়ে এসেছিস? তোর আশিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবিনা?””

রিপ্তি চোখরাঙিয়ে বললো,,

“”কোনো আশিক নেই।””
“” আশিক ছাড়াই পালিয়েছিস? এটা কেমন পালানো হলো?””
“” হলের সিট কি করে পাবো জানা থাকলে বল নাহলে আমার পাশ থেকে সরে যা!””

এবার রুবিনাও গম্ভীর হয়ে বললো,,

“” এভাবে বললেই কি পাওয়া যায় নাকি? আমি কত চেষ্টা করলাম। লাভের লাভ কিছুই হয়নি উল্টো কতগুলো টাকা জলে গিয়েছে। তবে..””
“” তবে কি?””
“” ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করে দেখতে পারিস। যদি ভাগ্যে লেগে যায় পেয়েও যেতে পারিস।””
“” তোর ভাগ্যে লাগেনি আমার ভাগ্যে লাগবে কিভাবে?””
“” যেভাবে তুই আমাদের ডিপার্টমেন্টে এসে লেগেছিস!””

রুবিনা শব্দ করে হেঁসে দিলো। যেন সে চুড়ান্ত পর্যায়ের হাঁসির জোকস বলেছে।

~~~

“” তুই যেভাবে সিড়ি পার হচ্ছিস অফিসরুমে যেতে যেতে একমাস লাগবে,রিপ্তি। তোর জন্য আমি একমাস এই সিড়িতে কাটাতে পারবোনা।””

সাথে সাথেই উল্টোদিকে পা বাড়ালো রিপ্তি। চলতি পথে বললো,,

“” তাহলে চল ফেরত যাই।””

রুবিনা দৌড়ে এসে পথ আটকালো রিপ্তির।

“” আরে মজা করছিলাম এতো রাগ করছিস কেন? তোর জন্য একমাস কেন একহাজার বছরও আমি সিড়িতে কাটিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু আমাদের ডিপার্টমেন্টের হ্যাড,মহসিন স্যার তো কাটাবেন না। উনি এখন আছেন নাকি চলে গিয়েছেন কে জানে! চলে গেলে আবেদনটা কার কাছে দিবি?””

রিপ্তির মনটা কুঁকড়িয়ে গেলো। সে জানে মানুষটা এখনো আছে। বাতাসে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে যে তার উপস্থিতির সুবাস। রজনীগন্ধার সুবাস! আর উনি আছেন বলেই রিপ্তি যাবেনা। এই লোকটার কাছে কোনো আবেদন করবে না সে। কখনো না! দরকার হলে রেললাইনে থাকবে,গাছতলায় থাকবে,ফুটপাতে থাকবে তবুও এই লোকটার সামনে আর কখনো মাথা নিচু করবেনা।

হাতের মাঝে থাকা কাগজটা টুকরো টুকরো করে ফেললো রিপ্তি। যেন কত বছরের প্রতিহিংসা ছিড়ে ফেলছে সে। রুবিনা অসহায়ভঙ্গিতে বললো,,

“” অ্যাপ্লিকেশনটা লিখতে কত্ত খাটনি করতে হয়েছিলো রিপ্তি,তুই এভাবে ছিড়ে ফেললি? আমারতো মনে হলো তুই আমাকে ছিড়ে ফেলেছিস। তোর একটুও মায়া লাগলো না?””

রিপ্তি বিনাবাক্যে হাঁটা শুরু করেছে। মাথার ভেতরটা ঝিন ধরে আছে তার। এভাবে চলে আসাটা ঠিক হয়নি। এখন কোথায় যাবে? রিপ্তি মনে মনে বিড়বিড় করলো,বাবা! আমি আবারও বোকার মতো কাজ করেছি!

“” আপনাদের মধ্যে রিপ্তি কে?””

রিপ্তি চট করে চোখ খুললো। চল্লিশ/পঁয়তাল্লিশ বছরের একটি লোক দাড়িয়ে আছে। লোকটাকে চেনাচেনা লাগছে কিন্তু কোথায় দেখেছে তা মনে করতে পারছেনা সে। রিপ্তির মনের সন্দেহ দুর করতেই হয়তো রুবিনা কথা বললো,,

“” জমিল মামা যে? কি খবর? কেমন আছো?””

লোকটি জবাব দেওয়ার আগেই রিপ্তি ফিসফিসিয়ে বললো,,

“” উনি তোর মামা লাগেন?””

রুবিনা মুখভর্তি হাঁসি নিয়ে বললো,,

“” আরে উনি হলেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের দপ্তরিমামা। আমি জমিলমামা বলে ডাকি।””
“” ওহ!””

রুবিনা রিপ্তির দিকে ইশারা করে বললো,,

“” ওর নাম মিন্মি। কি হয়েছে মামা?””

লোকটি কোনো কথায় জড়ালোনা। সরাসরি এক টুকরো কাগজ এগিয়ে ধরেছে রিপ্তির দিকে। বেশ সংশয় নিয়েই কাগজটা নিলো রিপ্তি। চোখ বুলাতেই দেখতে পেলো কাগজটিতে,ক্রমানুসারে হলের নাম,রুম নং,সিটনংসহ আরো বিভিন্ন ধরনের তথ্য দেওয়া। এতোকিছু পড়ার প্রয়োজন মনে করলোনা রিপ্তি। কাগজে চোখ রেখেই রুবিনার উদ্দেশ্যে বললো,,

“” কলমটা দে তো।””

রুবিনাও বাধ্য মেয়ের মতো ব্যাগ থেকে কলম বের করলো। রিপ্তি কাগজটা উল্টিয়ে খচখচ করে লিখছে,,

Ans: I love you
=আমি তোমাকে ভালোবাসি।

লেখা শেষ করেই কাগজটা দপ্তরির হাতে ধরিয়ে বললো,,

“”এইটা আপনার স্যারকে দিবেন।””

লোকটির বোধহয় ভিষণ তাড়া ছিলো। কাগজ নিয়েই ফিরতিপথে হাঁটা ধরেছে। এতোক্ষণ মুখ বন্ধ করে চুপচাপ সবকিছুই দেখছিলো রুবিনা। এবার মুখ খুললো,,

“” এটা কি হলো? আমি তো আগাগোড়া কিছুই বুঝলাম না।””

রিপ্তি সামান্য হাঁসলো। মুখের নেকাপটা বেধে নিয়ে বললো,,

“” বলার ইচ্ছে নেই তবুও বলছি। শোন!””

রুবিনা বেশ আগ্রহ নিয়ে রিপ্তির পাশে হাঁটছে। রিপ্তি চোখটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ স্মৃতিচারণ করে বললো,,

“” আমি যখন জেএসসি দিলাম তখন আমাদের স্কুলে একজন স্যার নিয়োগ দেওয়া হয়। উনি আমাদের ইংলিশ পড়াতেন। খুব ভালো পড়াতেন। রসিকতাও করতেন। সকলে তার রসিকতার ফাঁদে পড়ে উনার কাছে প্রাইভেট পড়তে শুরু করলো। একমাত্র আমি বাদে। একমাস পরেই আমাদের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা হলো। সকলে পাস আর আমি ফেল! তাই আমিও বই-খাতা নিয়ে ছুটে গেলাম প্রাইভেট পড়তে। প্রথমদিনই উনি আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি ভয়ে ভয়ে উনার সামনে যেতেই বললেন,ট্রান্সলেট করো!

আমি বললামঃকি?
উনি বললেনঃআমি মনে মনে যে সেন্টেন্সটা বললাম ঐটার বাংলা ট্রান্সলেট করো নাহলে তোমাকে আমি পড়াবোনা।

কারো মনে মনে বলা বাক্য কি আমি শুনতে পারবো? শুনতে পারলে তো চেষ্টা করে দেখতে পারতাম পারি কিনা। আমি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম,পারিনা। উনি হাঁসলেন সাথে প্রাইভেটে উপস্থিত থাকা সকলেই হেঁসে দিলো। লজ্জায় আমার চোখ থেকে পানি ঝরলো!””

রিপ্তি থেমে গিয়েছে আর কিছু বলছেনা দেখে রুবিনা বললো,,

“” তারপর?””
“” তারপর উনার টেবিলে থাকা ফুলদানি থেকে রজনীগন্ধা ফুলটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন,তোমার স্পেশাল ট্রেইনিং হবে। যাতে করে মনের কথা বুঝতে পারো। নানি কে বলে দিও,কাল থেকে আমি রোজ সন্ধ্যায় তোমাকে পড়াতে আসবো!””
“” তারপর?””

রিপ্তি আবার নিরব। ধীরপায়ে হাঁটছে। রুবিনা বুঝে গেলো গল্পটা আর গড়াবেনা। তাই শুরু থেকে শেষটা নিয়ে ভাবনায় ডুব দিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর বললো,,

“” তারমানে তোর প্রাইভেট টিউটরের মনের বাক্যটার ট্রান্সলেশন করলি? আই মিন উনি তোকে মনে মনে পছন্দ করতো?””

রিপ্তি কোনো উত্তর দিলোনা। রুবিনা পুনরায় বললো,,

“” কিন্তু তুই কি করে বুঝলি এই কাগজটা তোর প্রাইভেট টিউটর দিয়েছিলো?””
“” হাতের লেখা দেখে।””
“” কিন্তু কে সে?””

রিপ্তি ফিসফিস করে বললো,,

“”মহসীন স্যার!””

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here