#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,২১,২২
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২১)
রিপ্তি পেছন না ঘুরেই দাড়িয়ে আছে। বা হাতে পিঠ ছুতেই বুকটা ধক করে উঠলো। অজানা ভয়, আসঙ্কা আর লজ্জার স্রোত বয়ছে শিরা উপশিরায়। কারো নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছে সে,তাহলে কি অনুভব তার দিকে এগিয়ে আসছে? রিপ্তির হাত-পায়ে কাপুনি উঠে গেলো। দৌড়ে পালাবে,তখনি দুটো হাত কোমড় জড়িয়ে ধরলো।
মুগ্ধ চোখ,ভেজা ঠোঁট
অনুভূতির ক্রন্দে
ভাসুক আবেগ,ডুবুক বিবেক
ভালোবাসায় ভেজা সন্ধ্যে!(রোকসানা)
~~~
“” এই আধরাততিরে জামাকাপুড় খুইললা শুইয়া আছস ক্যান? ভূতে ধরছেনি?””
নানির কর্কশ কন্ঠে লাফিয়ে উঠলো রিপ্তি। নিজের দিকে চাইতে লজ্জায় চাদরটা খামচে ধরলো। নানির সামনে সে এভাবে পড়ে ছিলো? মরার ঘুমে? ঘুম আসলোই কিভাবে? সে তো এমন অসময়ে ঘুমায়না। রিপ্তি আপ্রাণচেষ্টায় আছে চাদরটাকে নিজের শরীরের বস্ত হিসেবে ধরে রাখতে। নানি তিক্তকন্ঠে বললেন,
“” আর কি দেখমু আল্লাহই জানে। বিয়ার বয়স পার অইয়া যাইতাছে তাও বিয়ার কোনো খবর নাই। এমন বিয়াত্তা মাইয়ারে ঘরে একলা ফালাইয়া রাখলে এগুলাই তো দেখতে হইবো। শরীর তো জ্বলবোই,হেইডা পুরুষ মাইনসের ছুইলেও না ছুইলেও।””
পরিবানু গটগট করে ওয়াশরুমে গেলেন। ওযু করছেন হয়তো। এশার আযান শোনা যাচ্ছে। রিপ্তি বিছানা ছাড়লো। চটজলদি জামা পড়ে নিচ্ছে। নানি এখনি বের হবে। আর কোনো লজ্জা পেতে চায়না সে। তাড়াহুড়োয় রিপ্তি উল্টো জামা পড়েছে। সেলাই উপরে। পায়জামার বাধুনিটা সামনে থেকে পেছনে চলে গেলো। হাতের থরথর কাঁপনে ফিতেতে শক্ত গিট্টু লেগে গেলো। সুতি ওড়নাটা বুকে জড়িয়ে রুম ছাড়ছে। মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে তার। শরীরের বিশেষ জায়গাতেও শীর্ণব্যথার উপস্থিতি টের পাচ্ছে। ঠিকমতো হাঁটতে পারছেনা। মন চাইলেও শরীর তার সাথে সায় দিচ্ছেনা। ধীরগতিতে বসার রুমের দিকে এগুচ্ছে। কি হয়েছে তার সাথে ঠিক মনে করে উঠতে পারছেনা। তবে ঝাপসা একটা মুখ চোখের সামনে বারবার এদিকওদিক ছুটছে। যা ভাবছে তা যদি সত্যি হয়??? রিপ্তি আর কিছু ভাবতে পারলোনা। যন্ত্রণা তীব্র হতে তীব্রে রুপান্তর হচ্ছে। বসার রুমের পরিষ্কার আলো চোখে আবছা হয়ে ঠেকছে।
বাবা বসার রুমে বেতের চেয়ারে বসে আছেন। ভাইয়াও আছে। কিন্তু ভাবী নেই। ভাবী কি এখনো আসেনি? আসবেনা কেন? ভাইয়া নিশ্চয় এতোরাতে ভাবীকে একা রেখে আসবেনা। হয়তো অন্য কোথাও আছে। অন্যকাজে। রিপ্তি পেছন ঘুরতেই ভাবীর সাথে ধাক্কা খেলো। গরম চা এসে পড়লো রিপ্তির ওড়নায়। রিপ্তি অপ্রস্তুতে দ্রুততারসহিত বললো,,
“” সরি! সরি ভাবী। আমি দেখিনি!””
চায়ের কাপটা নিচে পড়ে সামান্য শব্দও হলো। ভেঙে গিয়েছে। মিন্মি সেদিকে নজর দিলোনা। রিপ্তির ওড়না ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,,
“” গরম চা ছিলো রিপি,ওড়নাটা খোল,শরীর পুড়ে যাবে!””
মিন্মি নিজেই ওড়না টেনে খুলে নিলো। রিপ্তির জামায়ও চা পড়েছে। মিন্মি জামায় হাত দিতে গিয়ে গলায় হাত দিলো।
“” তোর গলায় দাগ কিসের রিপ্তি? দেখি আলোর দিকে ঘুরতো!””
ভাবীর কথায় রিপ্তি আৎকে উঠলো। চট করে ভাবীর হাত থেকে ওড়নাটা ছিনিয়ে নিলো। গলা ঢাকতে ঢাকতে বললো,,
“” কই দাগ? চা পড়েছে তাই হতো। একটু পরই ঠিক হয়ে যাবে।””
মিন্মি রিপ্তির ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে। সন্দেহকন্ঠে বললো,,
“” তোর ঠোঁট…””
রিপ্তি অন্যদিকে ঘুরে গেলো। ভয়ে শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে তার। ভাবী এসব কি বলছে? তাহলে কি সত্যি সত্যি আমার সাথে কিছু হয়েছে?? রিপ্তির অন্তরআত্মা কুকিয়ে উঠলো। হঠাৎ করেই যেন পুরো শরীরে ব্যথার যন্ত্রণার ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেছে। ক্ষিপ্রতা বহুগুন! রিপ্তি আর স্থিরভাবে দাড়িয়ে থাকতে পারছেনা। অস্থিরতায় তার সব লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার উপক্রম। রিপ্তি ভারীগলায় বললো,,
“” আমার মাথাটা খুব ব্যথা করছে,ভাবী। আমি
একটু ঘুমোবো। কেউ ডাকতে এসোনা। পরে উঠে খেয়ে নিবো।””
“” একটু রঙ চা করে দিবো? তোর ভাইয়া কে বলি মাথাব্যথার ট্যাবলেট এনে দিতে?””
রিপ্তি ব্যস্তগলায় বললো,,
“” না লাগবেনা। ঘুমোলেই সেরে যাবে।””
রিপ্তি আর একদন্ডও ভাবীর সামনে দাড়ালোনা। সাহসই নেই। কেমনজানি ধরা পড়ার ভয়। ব্যস্তপায়ে নিজের রুমে ছুটছে। কিছু একটা ভেবে ভাবীর দিকে ঘুরলো।
“” ভাবী,তোমরা যখন এলে তখন আমি ছাড়া আর কেউ ছিলো বাসায়?””
“” আর কেউ বলতে?””
“” অ…””
রিপ্তি নামটা উচ্চারণ করতে গিয়েও থেমে গেলো। ভাবী এখনো সন্দেহদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিপ্তি জোরপূর্বক হাসি নিয়ে বললো,,
“” অন্যকেউ!””
“” না তো। বাসায় অন্যকেউ কোথা থেকে আসবে? তুমি তো একাই ছিলে।””
রিপ্তির মন নানারকম ভাবনায় জর্জরিত। রুমের দিকে ছুটছে। দরজায় খিল দিয়ে ওড়না খুলে ফেললো,ভীতপায়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে। অবাকদৃষ্টিতে চেয়ে আছে নিজের দিকে। এগুলো কিসের চিহ্ন? খুব কড়া কোনো আঘাত নয়,তবুও কেন যন্ত্রণাদায়ক লাগছে? রিপ্তির ইচ্ছে হলো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে। এ সে কি ভুল করে ফেললো?? কেন করলো? এমন কিছু হওয়ার তো কথা ছিলোনা। রিপ্তি নিজের চুলের গোড়ায় খামচে ধরলো। নিজের সাথেই নিজে বিড়বিড় করছে,,এটা আমি কিভাবে করলাম? আমি তো উনার উপর রেগে ছিলাম। রাগ থেকে এমন মারাত্মক ভুল কি করে করলাম? কিভাবে সম্ভব হলো? কি ছিলো উনার ছোয়ায় যে আমাকে এমন ভুল করতে বাধ্য করলো! ভালোবাসা? কিন্তু উনি তো কখনো বলেননি উনি আমায় ভালোবাসেন! ভালোবাসা থাকলেই কি এমন মারাত্মক ভুল করতে হবে? কেন আটকালাম না আমি? কেন? কেন? কেন?
~~~
আজ তিনদিনবাদে রিপ্তি নিজের ক্যাম্পাসের জন্য রেডি হচ্ছে। আয়না দেখতে ইচ্ছে করেনা তার। নিজেকে নিজে দেখলেই লজ্জা পায়। তাহলে ঐ মানুষটার সামনাসামনি কি করে হবে? উনার চোখের দিকে তাকাতে পারবে তো? ভাবনা রেখেই ব্যাগটা কাধে নেয় রিপ্তি। বাবার কাছে বিদায় নিয়ে বের হবে,তখনি মিন্মি এলো,,
“” অনুভবের সাথে তোর কথা হয়?””
“” কেন?””
“” উনার সাথে দরকারী কথা আছে। আমার কথা বলিস তো।””
রিপ্তি আর বাইরে যেতে পারলোনা। সোজা ভেতরে ঢুকে গেলো। একদম নিজের রুমে। ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলো। মিন্মি অবাক। দরজায় কড়া নাড়লেন,,
“” কিরে,কি হলো? ক্লাসে যাবিনা?””
“” ভালো লাগছেনা ভাবী!””
“” মাত্রই তো বের হলি,এরমধ্যে আবার কি হলো?””
রিপ্তি বিছানায় বসে পড়লো। হুট করেই হাসি পেলো। নিঃশব্দের হাসি নিয়ে বললো,,
“” জানিনা,ভাবী!””
রিপ্তি এখনো হেসেই যাচ্ছে। লাজুক হাসি। যে মানুষটাকে সে দেখতেই পারতোনা সেই মানুষটা তার সব দেখে নিলো? ছি! আমি উনার সামনে যেতে পারবোনা। কিছুতেই না। লজ্জায় মরেই যাবো! রিপ্তি পুরো তিনদিন বাদে আয়নার সামনে দাড়ালো। ওড়না সরিয়ে গলায় হাত বুলাচ্ছে। দাগ নেই। মিলে গিয়েছে। কিন্তু এখনো তার ছোয়া অনুভব করতে পারছে। রিপ্তি আরেকদফা গাঢ় লজ্জা নিয়ে আয়না থেকে নিজেকে লুকালো।
~~~
বারোটা দিন পেরিয়ে গেলো রিপ্তি ক্যাম্পাসে যাচ্ছেনা। লজ্জা অনেকটা কেটে গিয়েছে। কিন্তু এবার তার মনে ভয়েরা জায়গা করে নিয়েছে। এতোগুলো দিন চলে গেলো অনুভব তো একবারও তার খোঁজ করেনি। তার তো খোঁজ নেওয়ার জন্য এখানে আসার প্রয়োজন নেই। তবুও কেন নেয়নি? লুকিয়ে নিচ্ছে কি? নাকি নিচ্ছেইনা। হয়তো নেওয়ার প্রয়োজন নেই! ‘প্রয়োজন নেই’ কথাটা যেন রিপ্তির ভেতরে ঘা তুলে দিলো। বিষাক্ত ঘা! এমনটাও কি হতে পারে? রিপ্তি মন আর ভাবনার সাথে যুদ্ধ চালাচ্ছে। মন বলছে উনি এতো বাজে নয়,কিন্তু ভাবনারা সারাক্ষণ খারাপটাই সামনে আনছে। কি করবে? নিজে থেকেই অনুভবের সামনে দাড়াবে? গিয়ে কি বলবে,,আমিও কি আপনার বাবুওয়ালা মেয়েবন্ধু?
রিপ্তি ধৈর্যহারা হয়ে তেরোতম দিনে ক্যাম্পাসে হাজির। মূল ফটকে ঢোকার পর থেকে সচেতনদৃষ্টি ফেলছে চারপাশে। চোখের তারারা চাতকপাখির ন্যায় চিৎকার করছে অনুভবকে দেখার জন্য। উনার কথা শোনার জন্য,গান শোনার জন্য কানদুটো ছটফট করছে। কোথায় আছে সে? কোন গ্রহে হারিয়েছে? কেউ যে এদিকে উতলা,ব্যাকুল,হন্ন হয়ে খুজছে সে কি জানেনা? কোথায় পাবো আপনাকে? কোথায় আপনি লাল ব্যাঙ?
রিপ্তি চোখ মুছে মাইলের পর মাইল হাঁটছে। পুরো ক্যাম্পাস চষে বেড়াচ্ছে। তবুও অনুভবের দেখা মেলেনি। তবে কি উনি আমায় ধোকা দিলেন? ‘ধোকা’ শব্দটা রিপ্তির ভেতরের সব অনুভূতিকে পুড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। সন্ধ্যা নামার আগ মুহুর্তে রিপ্তি রেল স্টেশনে পৌছুলো। নিজের মনকে নিজেই শান্তনা দিচ্ছে,হয়তো আজ উনার ক্লাস নেই!
দ্বিতীয়,তৃতীয়,চতুর্থ দিনেও যখন অনুভবের দেখা পেলোনা রিপ্তি বেশ ঘাবড়ে গেলো। অনুভবের ডিপার্টমেন্টেও চলে গিয়েছিলো। সেখান থেকেও কোনো কোনোরকম খোঁজ পায়নি সে।
~~~
“” রিপ্তিমা!””
মাথায় বাবার আদরের স্পর্শে রিপ্তি চোখ মেললো। কিন্তু বাবার মুখটা দেখতে পাচ্ছেনা। কবির সাহেব মোলায়েম কন্ঠে বললেন,,
“” রুম অন্ধকার করে রেখেছো কেন? শরীর খারাপ?””
রিপ্তি ক্লান্তকন্ঠে বললো,,
“” না,বাবা। আলো ভালো লাগছিলোনা।””
“” তোমার ক্লাস কেমন চলছে?””
“” ভালো।””
“” বড্ড অনিয়ম করছো। এটা কি ঠিক?””
“” আমার ভালো লাগেনা,বাবা।””
“” তোমার কি আমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে?””
“” না।””
কবির ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়লেন। মেয়ের মনের ভেতরের কথাগুলো তিনি কখনোই সামনে আনতে পারেননা। কিন্তু কেন? বাবা হিসেবে কি আমার ভালোবাসাটা এতোটাই দুর্বল? দশ,পনেরোদিন ধরে তিনি মেয়েকে লক্ষ করছেন। চালচলনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কেমনজানি সবকিছুতে অনিহা,অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। ইদানিং রুমের লাইট অফ করে সন্ধ্যাবেলা শুয়ে থাকছে। কি হয়েছে ওর? এদিকে অনুভবের নাম্বারটাও বন্ধ পাচ্ছে। এই মাসেই তো মা-বাবাকে নিয়ে আসার কথা ছিলো। বিয়ের কথা পাড়তে! কবির সাহেবের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। অজানা আসঙ্কায় ভুগছেন তিনি! মেয়ের পাশেই কিছুক্ষণ বসে রইলেন। সময় নিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে পড়লেন নিজ রুমের উদ্দেশ্যে।
~~~
“” চেহারার একি হাল হয়েছে রিপি!””
তৃণার কন্ঠে ক্লান্ত হাসলো রিপ্তি। দুর্বল চোখেই মেয়েটার দিকে চেয়ে আছে। বিয়ের দু-মাসেই পাক্কা গিন্নি হয়ে গেছে। কি সুন্দর শাড়ী পড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে,গুছিয়ে কথা বলছে,মুরুব্বীদের মতো উপদেশ দিচ্ছে,মাঝেমাঝে শাসনিবাক্যও তুলছে।
“” চুপ করে আছিস কেন? চুলে কি শ্যাম্পু লাগাসনা? অমন কালো ঝলমলে চুলগুলো এতো রুক্ষ কি করে হলো? চিকনও হয়ে গিয়েছিস। খাওয়া দাওয়া করছিসনা নাকি?””
রিপ্তি ছোট্ট করে বললো,,
“” তোকে খুব সুন্দর লাগছে!””
তৃণা লাজুক হাসলো। ফিসফিসিয়ে বললো,,
“” হবোনা? মেয়েদের আসল সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয় স্বামীর ছোয়ায়,বুঝলি?””
‘ছোয়া’ কথাটা যেম ধারালো ছুরি হয়ে বিধলো রিপ্তির বুকে। হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে গেলো। বসা থেকে উঠে পড়লো। তৃণার ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে ঘাটছে!
তৃণা ক্ষীণ আর্তনাদ নিয়ে বললো,,
“” কি খুজছিস? পাগলের মতো আচরণ করছিস কেন?””
“” তোর ফোন কোথায়?””
“” নেই।””
“” নেই মানে?””
মুহুর্তেই তৃণার সৌন্দর্যের সোনালী আভাটা মিলে গেলো। মুখে ভর করেছে কালো আধার। দুখীমুখ বানিয়ে বললো,,
“” তোর দুলাভাই আমাকে মোবাইল ব্যবহার করতে দেয়না।””
রিপ্তি চটে গেলো। ইচ্ছে হচ্ছে টাকলুর টাকবেলটা এখনি ফাটিয়ে দিতে। কি দিয়ে ফাটাবে? ইট,পাথর নাকি হাতুরী? রিপ্তি অনেকটা ক্ষেপে গিয়ে বললো,,
“” টাকলুটা কই? চল আজ উনার মাথা ফাটাবো!””
“” এসব কি বলছিস রিপ্তি? ও তোর দুলাভাই হয় আর উনিতো আমাকে রেখে চলে গিয়েছেন। এক সপ্তাহ পর এসে নিয়ে যাবেন।””
অনুভবের সাথে কথা বলার ক্ষীণ আলোটাও নিভে গেলো। রিপ্তি ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। মাথায় হাত পড়াটা বাকি!
~~~
দু’মাসের বেশি হতে চললো অনুভবের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেননা কবির সাহেব। এভাবে হুট করে হারিয়ে যাওয়া ছেলে তো নয় অনুভব। তাহলে? কোনো বড় দুর্ঘটনার শিকার হয়নি তো অনুভব? এক প্রকার ধৈর্য্যচ্যুত হয়ে পড়লেন কবির সাহেব। বড্ডবেশি ব্যাকুলতায় ভুগছিলেন। তাই আর সময় নষ্ট না করে ভোরের ট্রেণে ঢাকা পাড়ি দিলেন উনি।
কালো রঙের বিশাল গেইটের সামনে দাড়িয়ে আছেন কবির সাহেব। হ্যা এটাই অনুভবদের বাড়ী৷ অনুভবের পরিবারের সাথে পরিচয় আছে তার। তবে সেটা গ্রামে। এই শহরের বাড়ীতে কখনো যাতায়াত হয়নি। খুব নার্ভাস ফিল করছেন তিনি। এভাবে না জানিয়ে হুট করে চলে আসায় কে কি ভাববে কে জানে! কিন্তু প্রয়োজনটা যে খুব বেশি! খুব বেশি দরকারী। গেটটা ভেতর থেকে আটকানো। কবির সাহেব হালকা বাড়ি দিতেই গেট খুলে গেলো। মধ্যবয়সী সুস্বাস্থ অধিকারী এক লোক মাথা বের করে বললেন,,
“” কি চাই?””
“” অনুভব। অনুভব কি বাসায় আছে?””
“” স্যার তো বাড়িতে নেই।””
“” ওহ! জামাল সাহেব?””
“” উনি আছেন।””
“” আমি উনার সাথে কথা বলতে চাই। জরুরী।””
দারোয়ান সরুচোখে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলেন কবির সাহেবকে। কপাল কুঁচকে গেট থেকে সরে দাড়ালো।
কবির সাহেব ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,,
“” অনুভব কোথায় গিয়েছে বলতে পারবে?””
“” বিদেশ গেছেন।””
কবির সাহেব মাঝপথেই আটকে গেলেন। চোখে,মুখে অবিশ্বাস্যের ছাপ স্পষ্ট! কবির সাহেব কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন,,
“” বিদেশ? কেন?””
“” কেন আবার, ছোট মেডামরে নিয়া হানিমুনে গেছেন!””
কবির সাহেব নিজের শরীরের ভারসাম্য হারালেন। পড়ে যেতে নিলে,দাড়োয়ান ধরে ফেললো। দুর্বলকন্ঠে বললেন,,
“” পানি খাবো!””
চলবে
#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২২)
আকাশ কাঁদিয়ে তুমুল বেগে বৃষ্টি হচ্ছে। মায়া কান্নার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ ভুবন কাঁপিয়ে চিৎকার তুলছে কালচে রঙের গগন। সাথে সাথে বিজলির তীব্র রশ্মি জ্বলছে-নিভছে! মিন্মি চুলায় খিচুড়ি বসিয়েছে। বোনা খিচুড়ি। তার কাছে বৃষ্টি মানেই খিচুড়ি। সাথে কয়েক পদ ভর্তা হলে তো জিহ্বে জল আসার উপক্রম! সে খিচুড়িতে পানি দিয়ে পেঁয়াজ ছিলছে। ভর্তার প্রধান উপকরণ হলো পেঁয়াজ। যেকোনো জিনিসের সাথে পেঁয়াজ আর মরিচ মেশালেই তো ভর্তা হয়ে যায়। এটা অবশ্য তার কথা নয়,রিপ্তির কথা! কথায় যুক্তিও আছে। তাই মিন্মি রিপ্তির সাথে একমত পোষণ করে পরশুদিনই মাংসের ভর্তা বানিয়েছিলো। যদিও তেমন একটা স্বাদ পায়নি তবে খারাপও লাগেনি। মিন্মি পেঁয়াজ রেখে রসুনে হাত দিলো। শুটকি ভর্তা বানাতে গিয়ে দেখে শুটকি নেই। এই বৃষ্টির মধ্যে বাইরে যাওয়ার জোঁ নেই,শুটকি আনবে কি করে? রসুনের কয়েক কোয়া পানিতে ভেজাতে ভেজাতে বাইরে তাকালো মিন্মি। বাইরে কালো অন্ধকারের মাঝে ঘন বৃষ্টির ফোঁটায় সবকিছুই ঝাপসা দেখাচ্ছে,অন্ধকারটাও ঝাপসা! মিন্মি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা যে এখন সন্ধ্যা নাকি রাত। বসার রুমেই দেয়ালঘড়িটা। রান্নাঘর থেকে হালকা উঁকি দিলো সে। সাতটা বেজে পনেরো। মুহুর্তেই মিন্মি চিন্তায় পড়ে গেলো। মনেমনে বিড়বিড় করলো,বাবা তো এখনো এলেননা। সাথে ছাতাটাও তো নেননি!
রিপ্তির রুমে দুটো জানালা। একটা উত্তরে আরেকটা দক্ষিণে। জানালা দুটো এখন প্রায়ই বন্ধ থাকে। মাঝে মাঝে ঘরের ভাপসা গন্ধ দুর করতে খোলে দেয় রিপ্তি। তবে কয়েক মিনিটের জন্য। আজও সেই উপলক্ষেই জানালা খুলেছিলো সে। কিছু সময়বাদেই বৃষ্টির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোটা অদৃশ্যভাবে জানালার ধারগুলো ভেজাতে থাকে। জালানার কাছ ঘেষেই আনমনে দাড়িয়েছিলো রিপ্তি। দিনের আলোটা তার ভালো লাগেনা। আজ ভালো লাগেনা জিনিসটাকেই দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। প্রবল ইচ্ছে! কিন্তু এইভাবে কালবৈশাখীর ন্যায় ঝড় তুলবে তা কি সে জানতো? বৃষ্টির ফোঁটা গালে পড়তেই রিপ্তি শিউরে উঠে। প্রচন্ডবেগে রক্ত চলাচল শুরু হয় শিরাউপশিরায়। বুকের বা পাশের হৃদস্পন্দনটাও হুট করেই বেড়ে গেলো। ঢিপঢিপ শব্দটা যেন বুকে নয়,রিপ্তির কানে বাজছে। সাথে সাথেই শরীরের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কোষগুলো কেঁপে উঠে মিথ্যে যন্ত্রণায়। রিপ্তি কাঁপছে,কাঁপছে তার অনুভূতিগুলো। রিপ্তি চট করে জানালা থেকে সরে গেলো। দু’হাতে কান চেপে ধরে আপনমনে বিড়বিড় করছে,আমি শুনতে চাইনা তোমার শব্দ! বৃষ্টি তুই চলে যা। তারমাঝেই বর্জ্যপাত। রিপ্তি ছিটকে উঠে। দৌড়ে পালিয়ে যায় নিজের রুম ছেড়ে। ছুটছে সে,কিন্তু কোথায়? কোন গন্তব্যে? ভাবীর রুম,বাবার রুমে গিয়েও সে শান্তি পেলোনা। সব জায়গায় কেন বৃষ্টি হতে হয়? কেন এমন শব্দ তুলে বৃষ্টি হতে হয়?? তারা কি জানেনা তাদের শব্দে কারো নিশ্বাসের উপস্থিতি টের পায় সে। কারো নরম ছোঁয়া অনুভব করতে পারে,কারো আদুরী গোঙানির শব্দ শুনতে পারে!
রিপ্তি বাবার রুম ছেড়ে রান্নাঘরে ছুটলো। মিন্মি পা’টায় শুকনো মরিচ বাটছিলো তারমধ্যেই রিপ্তি চিৎকার করে বললো,,
“” জানালা বন্ধ করো,ভাবী! বৃষ্টির ঝুপঝাপ শব্দ অসহ্য লাগছে। বন্ধ করো এখনি!””
মিন্মি চমকে উঠলো। হাতের পাশে থাকা পানির বাটিরা উল্টে গেলো। ভাসিয়ে দিলো বাদাম ভর্তা! হায় হায় ভঙ্গি করতেই রিপ্তি ছুটে এসে জানালা বন্ধ করে দিলো। সাথে রান্নাঘরের দরজাটাও আটকে দিলো বাইরে থেকে। মিন্মি ভেতরেই আটকা পড়েছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,,
“” রিপি,কি হয়েছে? আমায় বন্দী করলি কেন? খোল!””
ধীরে ধীরে কান থেকে হাত সরালো রিপ্তি। নাহ! এখন আর শব্দ পাচ্ছেনা। ঠোঁটে বিজয়ী হাঁসি নিয়ে বললো,,
“” এখন কোনো শব্দ নেই ভাবী। তোমার ভর্তা বানানো হলে খুলে দিবো। এখন আমি টিভি দেখবো।””
“” এটা কেমন পাগলামি রিপি?””
“” বাবা কখন আসবে?””
“” আমাকে বলে যায়নি।””
রিপ্তি আর কথা বাড়ালো না। টিভিটা চালু করে ভলিউম একশতে দিলো।
~~~
কবির সাহেব বাসায় ফিরলেন রাত আটটায়। কাকভেজা হয়ে। মিন্মি তখনো রান্নাঘরে বন্দী। রিপ্তিই দৌড়ে বাবার শরীর মুছে দিলো। বাবার হাতে-পায়ের তালুতে সরিষা তেল ঘষতে ঘষতে বললো,,
“” কোথায় গিয়েছিলে,বাবা? এতো দেরি করে এলে কেন? তুমি বাসায় না থাকলে নিজেকে এতিম এতিম লাগে। কান্না পায়!””
কবির সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। কিছু বললেননা। কিই বা বলবেন? বলার মতো কিছু নেই। আজ তার কথার ঝুড়ি খালি সাথে উপদেশের বানীগুলোও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। রিপ্তি বাবার পাশ ঘেষে বসতে বসতে বললো,,
“” চুল বানিয়ে দিবো? ছোটবেলা রিপ্তির চুল বানানো তোমার খুব পছন্দ ছিলো।””
কবির সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। রিপ্তিও পুরোদমে বাবাকে খুশি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কবির সাহেবের চোখটা লেগে আসছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীরটা অনেক দুর্বল সাথে হার্টটাও। প্রায় ঘুমিয়েই ঘুমিয়েই নানা চিন্তা করছিলেন। তারমধ্যেই গম্ভীরগলায় বললে,,
“” রিপ্তি,মা! তোমার এখন মায়ের কথা মনে পড়েনা? আগে তো খুব কাঁদতে বারবার জেদ ধরতে মা এনে দিতে!””
রিপ্তি হাতের কাজ বন্ধ করলো। বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো,,
“” মা তো পেয়ে গিয়েছি তাহলে আবার মনে পড়ার কি আছে? মনে তো তাকেই পড়ে যে চোখের আড়ালে চলে যায়। আমার মা তো চোখের সামনেই আছে।””
“” তাই নাকি? কে সে?””
রিপ্তি ভণিতা ছাড়াই বললো,,
“” মিন্মি মা!””
কবির সাহেবের প্রাণটা জুরিয়ে গেলেন। মনে মনে কিছুটা সস্থির নিশ্বাস টানলেন। পরক্ষণেই আবার জিজ্ঞেস করলেন,,
“”বাবা যদি চোখের আড়াল হয়? তখন কি করবে?””
রিপ্তি সাথে সাথে বাবার গলার জড়িয়ে ধরে বললো,,
“” কখনোই না। আমার বাবা সবসময় আমার চোখের সামনে থাকবে। চোখের মনি হয়ে!””
~~~
আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে রিপ্তির। তবে বিছানা ছাড়লো আটটায়। শরীরটা এখনো আলসেমীতে মত্ত। কিছুতেই মেঝেতে পা ফেলতে চায়ছেনা। কিন্তু শরীরের সাথে তাল মেলালে তো চলবেনা। রিপ্তি ঠিক করেছে আজ থেকে ইউভার্সিটিতে যাবে। রোজ যাবে। মন দিয়ে ক্লাস করবে। কিন্তু মনটা তাই চায়তো? নাকি অন্যকিছু চায়? আচ্ছা মনটা কি আদৌ নিজের কাছে আছে? রিপ্তি হঠাৎই অনুভব করলো,তার বুকটা ফাঁকা,শূন্যতায় ডুবে আছে বিরহ অন্ধকারে!
“” এখনো বিছানা ছাড়িসনি?””
ভাবীর কন্ঠে রিপ্তির ভ্রম কাটলো। পা’দুটো মাটি ছুই ছুই। কোলে কাথা নিয়ে বিছানার ধারে বসে আছে রিপ্তি। কাঁথাটা পাশে রেখে চট করে নেমে দাড়ালো। কাঁথা ভাজ করতে করতে বললো,,
“” এইতো ছাড়লাম। আমাকে ডাকতে এসেছো নাকি অন্যকিছু?””
মিন্মি রিপ্তির কাছ ঘেষে দাড়ালো। জড়োতা নিয়ে বললো,,
“” তোর কাছে প্যাড আছে? আমারটা কবে যে ফুরোলো একদমই খেয়াল নেই। তোর ভাইও বাসায় নেই! থাকলেতো…””
রিপ্তি বাধা দিয়ে বললো,,
“” আছে। এতো মশলা মাখছো কেন ভাবী? তোমার দরকারে আমি,আমার দরকারে তুমি। আমার রুমের কোনো জিনিস ধরতে হলেও তোমার জিজ্ঞেস করতে হবেনা। যখন যা ইচ্ছে নিয়ে যেও।””
মিন্মি সামান্য হাঁসলো। আড়ষ্টভাবটা কেটে গিয়েছে। রিপ্তি কাঁথা ছেড়ে রুমের এককোনায় চলে গেলো। টেবিলের ড্রয়ার খুলে প্যাড বের করেছে। কিন্তু ভাবীর দিকে না বাড়িয়ে সেটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হঠাৎ করেই মনে পড়লো,দীর্ঘদিন ধরে সে প্যাড ব্যবহার করছেনা। করার প্রয়োজন পড়েনি। তার তো পিরিয়ডই হয়নি। গতমাসেও হয়নি আর এই মাস? রিপ্তি উদগ্রীব কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,,
“” আজ কয় তারিখ ভাবী?””
“” ২৭। কেন?””
রিপ্তির হাত থেকে প্যাডটা পড়ে গেলো। শরীরের বল হারিয়ে টেবিলের সাথে পিঠ ঠেকেছে। মিন্মি দৌড়ে এলো। রিপ্তিকে শক্ত করে ধরেছে। উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,,
“” কি হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? রিপ্তি? চোখ মেল!””
রিপ্তির মাথাটা ভাবীর কাঁধে পড়ে আছে। অস্পষ্ট গলায় বিড়বিড় করছে,দশদিন আগেই ডেট চলে গিয়েছে!
রিপ্তিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়েছে মিন্মি। রিপ্তির গালে ছোট আঘাত করতে করতে বললো,,
“” কিসের ডেট রিপ্তি? কি আবিজাবি বলছিস? বোন আমার তাকা আমার দিকে! কি হয়েছে বল আমায়। রিপ্তিমা!””
রিপ্তি পিটপিট চোখে ভাবীর দিকে তাকালো। অস্ফুটে বললো,,
“” পানি খাবো!””
মিন্মি হন্ন হয়ে পানি আনতে চলে গেলো। পদে পদে চিন্তারা মাথায় ঘুরছে তার। হঠাৎ করে কি হলো? বাসায় তো কোনো ছেলে মানুষও নেই। কাকে ডাকবে? রাসেলকে একটা কল দিবে? উফ! আজই ওকে বাজারে পাঠাতে গেলাম? বাবার স্কুল তো কাছেই। বাবাকে কল দিবো? নাকি আমিই ডাক্তার আনতে চলে যাবো? কিন্তু রিপ্তিকে একা রেখে কিভাবে যাবো?
মিন্মির সকল চিন্তা দুর করে রিপ্তি সুস্থ হয়ে গেলো। মিন্মির আনা পানিটুকুও খেলোনা। ওড়না আর পার্সটা নিয়ে অতিব্যস্ততায় বাইরে বেড়িয়ে এলো।
~~~
রাতের টুকিটাকি কাজ শেষে রুমে ঢুকলো মিন্মি। ভেতরে বাবাকে দেখে খানিকটা অবাক হয়েছে। বাবার সাথে তার প্রায়শই কথা হয়,বেশিরভাগ সময় খাবার টেবিলে অথবা উনার রুমে। আজ হঠাৎ নিজের রুমে দেখে সামান্য অসস্থি বোধ হচ্ছে। তার মধ্যে সে রুমে ঢুকতেই বাবা এমনভাবে তাকালেন যেন তার অপেক্ষায় ছিলেন। কবির সাহেব ছেলের মুখোমুখি হয়ে বিছানায় বসেছিলেন। বউমাকে দেখে পকেটে হাত দিলেন। চাবির গোছা বের করে মিন্মির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মিন্মি কয়েক কদম এগিয়ে আড়ষ্টভঙ্গিতে চাবি নিলো। বাবার দিকে জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকাতে,কবির সাহেব তরল গলায় বললেন,,
“” এটা আমার রুমের আলমারীর চাবি। তোমার শ্বাশুড়ির হাতে রাখা অনেককিছুই পড়ে আছে ওখানে। নিজের কাছে এনে রেখো।””
মিন্মি কিছু বলতে চাইলে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন কবির সাহেব। ছেলের দিকে মুখ করে বললেন,,
“”মেয়েরা স্বামীর মধ্যে বাবার ছায়া খোঁজে। বাবা আর স্বামীর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। দুজনের ভালোবাসা দুরকম। একজনের সাথে আরেকজনের কখনোই মিল হয়না। তবে সুক্ষ মিলটা মেয়েরা চায়। কোনোরকম ভয়,আক্ষেক,সংসয়,দ্বিধা ছাড়াই বাবাকে যেমন ভরসার সর্বোচ্চটা অনুভব করতে পারে? ঠিক তেমনটাই স্বামীর কাছ থেকেও পেতে চায়। অনুভবের মাঝে আমি তেমন কিছু দেখতে পেয়েছিলাম। আমার রিপ্তির জন্য ওর মতো কাউকেই প্রয়োজন ছিলো। তাই তোমাদেরকে না জানিয়ে আমি অনেককিছু এগিয়েও রেখেছিলাম। কিন্তু..””
রাসেল এতক্ষণ মনোযোগীতে বাবার কথা শুনছিলো। এবার উৎসাহ নিয়ে বললো,,
“” কিন্তু কি বাবা? অনুভবকে আমারও খুব পছন্দ। আমরা একসাথে পড়েছি। বন্ধুত্বও বেশ ভালো। আমাদের রিপ্তির জন্য ওর মতো অন্য কাউকে পাবো না।””
কবির সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,,
“” এখন আর সেটা সম্ভব না।””
“” কেন?””
“” ও বিয়ে করে ফেলেছে। মেয়েটির নাম সম্ভবত লিনা।””
এমন একটা কথার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা রাসেল,মিন্মিও। রাসেল এতোটাই অবাক হলো যে বসা থেকে দাড়িয়ে গেলো। মিন্মি অবিশ্বাস্যভঙ্গিতে বললো,,
“” এটা কি করে সম্ভব? আমিতো ভেবেছিলাম অনুভব ভাই রিপ্তিকে পছন্দ করেন। উনার চালচলনে স্পষ্ট ধরা পড়তো।””
কবির সাহেবও বসা থেকে দাড়ালেন। তরল গলায় বললেন,,,
“” যা হয়ে গিয়েছে তা ভেবে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। আমার রিপ্তিমায়ের কপালে কে আছে তা আমার জানা নেই। তবে আমি চাই খুব শিঘ্রই রিপ্তির বিয়ে দিতে। তার পুরো দায়িত্বটা তোমাদের উপর ছেড়ে দিলাম।””
কবির সাহেব কথা শেষ করে চলে যাচ্ছেন। দরজার কাছে গিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,,
“” বাবার ছায়া কিন্তু বড় ভাইদের মধ্যেও দেখা যায়!””
~~~
গভীর রাত। ঘুমের তলদেশে অবস্থান করছিলেন কবির সাহেব। হঠাৎ পায়ে নরম পানির স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায়। মৃদুসুরে বললেন,,
“” কে?””
বাবার কন্ঠ পেয়েই রিপ্তি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বাবার দুটি পা জড়িয়ে ধরে বলছে,,
“” আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি,বাবা। তোমার মেয়ে হয়ে আমি এতো বড় ভুল কি করে করলাম? বাবা,আমাকে শাস্তি দাও,কঠিন শাস্তি। কিন্তু তোমার থেকে দুরে ঠেলে দিওনা।””
মেয়ের ক্রন্দনে কবির সাহেবের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। কি এমন ভুল করেছে সে যে এভাবে ভেঙে পড়েছে? রিপ্তি পা ছেড়ে বাবার নিকটে আসলো,,,
“” আমার অনুভবকে চাই,বাবা। তোমার প্রিয়ছাত্রকে চাই। তুমি বললে উনি ঠিক শুনবেন। আমাকে বিয়ে করবেন। কল দাওনা। তোমার মোবাইল কোথায়? দাড়াও আমি খুজে দিচ্ছি!””
রিপ্তি পাগলের মতো এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে। অন্ধকারে পড়ে যেতে নিলে কবির সাহেব ধরে ফেললেন। কঠিনসুরে বললেন,,
“” কি ভুল করেছিস?””
রিপ্তি শান্ত হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে আছে। কবির সাহেব অস্থির হয়ে পড়লেন।
“” কি হলো বল!””
রিপ্তি অস্পষ্টসুরে বললো,,
“” আমি প্রেগন্যান্ট!””
~~~
নিজের প্রিয়ছাত্র শুধু ভরসায়ই নয় বিশ্বাসটাও ভেঙে দিয়েছে। এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো কবির সাহেবের। এতোদিনে একটু একটু করে গড়ে তোলা অর্জিত সম্মানটাও যে যেতে বসেছে সেটাও বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু এর জন্য কি রিপ্তি দায়ী? নাকি অনুভব? নাকি সে নিজেই? এমন চোখ বন্ধ করা বিশ্বাসের জন্যই আজ তার মেয়ের জীবনটা অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছেনা? আরেকটু সচেতন হলে হয়তো অন্যকিছু হতে পারতো। হতাশা,আক্ষেপ আর এক প্রকার অপরাধবোধ নিয়ে এতোটাই ভেঙে পড়েন যে সেইরাতে ঘুমেরঘোরে মৃত্যুবরণ করেন কবির সাহেব!
চলবে