ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,১৫,১৬

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,১৫,১৬
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৫)

রিপ্তি বাবাকে পিছু হটাতে পারবেনা দেখে বললো,,

“” সেটা কি করে? আমি হোস্টেলে থাকতে পারবোনা।””
“” সমস্যা নেই। মোহাম্মদপুরে আমার ছোটবেলা বন্ধু আছেন। ওখানে থাকবে,ওর একটা তোমার বয়েসী মেয়েও আছে। তারসাথে থাকবে।””

রিপ্তি বাবার হাত সরিয়ে ফেললো। কঠিন গলায় বললো,,

“” আমি এখান থেকে গিয়ে পড়বো। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিনা। যদি এতে তোমার সম্মতি থাকে তবেই আমি ভর্তি হবো। নাহলে না।””
“” এটা কেমন কথা রিপ্তি? নরসিংদী থেকে ঢাকা যাতায়াত অনেক বেশিই সময়ব্যয় হবে।””

রিপ্তির একরোখা জবাব,,

“” হলে হবে,আমি এখান থেকে পড়বো মানে এখান থেকেই। তুমি আমাকে একদম জোর করবেনা,বাবা!””

কবির সাহেব কোমলকন্ঠে বললেন,,

“” বোঝার চেষ্টা কর মা,এখান থেকে ঢাকা ট্রেণপথে দুঘন্টার রাস্তা। বাসে গেলে আরো বেশি। তারমধ্যে তোর ক্লাসটাইম,টুকিটাকি আরো অনেক কিছু মিলিয়ে সারাটাদিন রাস্তায় কেটে যাবে। এতো জার্নি পেরে উঠবিনা।””
“” সে পরে দেখা যাবে।””
“” পরেরটা পরে নয়,আগে ভাবতে হয়,মা। তারমধ্যে টাইমটেবিলের একটু ভুল-ভ্রান্তি হলে তোর বাসায় ফিরতে মাঝরাতও হতে পারে।””

বাবা যে দুশ্চিন্তাগ্রস্তে ভুগছেন তা তার কন্ঠেই টের পাচ্ছে রিপ্তি। তবুও নিজের জেদে অটল থেকে বললো,,

“” আমি কিছু জানিনা। তুমি যদি চাও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তাহলে এখান থেকেই পড়বো। না চাইলে ভালো,আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো। বেশি সমস্যা হলে পড়বোইনা!””

রিপ্তি নিজের মতামত জানিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো। মেয়ের জেদের উপর রাগ হলেও তার মন খুশিতে ভরে উঠছে। তার মুড়িয়ে পড়া মেয়েটা আবার সেই জেদকে কুড়িয়ে নিচ্ছে। শুকনো ফুল তবে কি সতেজতার পূর্ণ রুপটা ধারণ করেই ফেললো??

কবির সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন,,

“” অমন একটা নতুন শহরে তুই একা একা যাতায়াত করতে পারবি?””

রিপ্তি দাড়িয়ে পড়লো,বাবার দিকে ঘুরে চুপ করে রইলো। লম্বা নিশ্বাস টেনে মৃদুসুরে বললো,,

“” শহরটা আমার জন্য নয় বাবা,আমিই শহরটার জন্য নতুন!””

রিপ্তি চলে গেলো। বাবার জন্য নতুন ভাবনা রেখে!

~~~

ভাদ্র মাসের দুপুর বেলা! তীর্ষকরশ্মি মাখা সূর্যের তাজ আকাশে। ঝকঝকে রোদ্দুরে পিঠ পেতে বসে আছে রিপ্তি। খোলা ছাদের গরম অনুভূতিতেও রিপ্তির কাছে সব পানসে। তার মনে হচ্ছে আজ পানসে দুপুর। যে দুপুরে নেই সূর্যের তাপ,কাঠফাটা গরম,গাছের পাতার ঝনঝন শব্দ! নেই কিছু নেই,বিরক্ত নেই,ভালো লাগা নেই,কিছু নেই। শুধু আছে পানসে পাতার পানসে দুপুর!

গরমে রিপ্তির ভেজা চুল শুকিয়ে আবার ভিজে উঠছে,নাকপাশাটায় বিন্দু বিন্দু ঘামে ডুবে আছে। তবুও সে ছাদ থেকে নামছেনা। নেমে কি হবে?? কি করবে? তার তো কিছু করতে মন চাচ্ছেনা। তাহলে কেন করবে?? রিপ্তির হাজারও অহেতুক,কাল্পনিক ভাবনার মাঝে ভাবী এসে ডেকে গেলেন। রিপ্তি একরকম অনিহা নিয়ে খাবার রুমে পৌছুলো। চেয়ার টেনে বসলো না। টেবিলে রাখা ডালের দিকে তাকিয়ে বললো,,

“” ডালে মুরগি দাওনি?””

তরকারীর বাটিটা টেবিলে রেখে মিন্মি বললো,,

“” মসুরডালে মুরগির মাংস?””
“” হুম!””

মিন্মি কিছুটা চমকালো। ভ্রূদুটো কুঁচকে বললো,,

“” মসুরডালে মুরগির মাংস? আমি তো বাপের জন্মেও শুনিনি!””

রিপ্তি উৎসাহ নিয়ে বললো,,

“” তুমি তো এখন বাপের জন্মে নেই ভাবী। তোমার জন্মে আছো। আর এই জন্মে শুধু মসুর ডালে কেন,সবকিছুতেই মুরগির মাংস দেওয়া যায়। তুমি চাইলে আমি তোমাকে মুরগির মাংসের ভর্তা বানিয়ে খাওয়াতে পারি।””

মিন্মি চোখদুটো বড়বড় করে বিস্ময় নিয়ে বললো,,

“” মুরগির মাংসের ভর্তা?””

রিপ্তি মহাজ্ঞানী ভাব নিয়ে বললো,,

“” হুম,তুমি খাওনি?””
“” আমি তো নামই শুনিনি,খাবো কখন?””
“” এটা তো একদম সহজ রেসিপি ভাবী। আমি তোমাকে শিখিয়ে দিবো।””

কবির সাহেব এতক্ষণ চুপ করে মেয়ে আর ছেলে বউয়ের কথোপকথন শুনছিলেন। এবার মুখ খুললেন,,

“” রিপ্তি মা,তোর কথা শুনে তো মনে হচ্ছে তুই পাকা রাধুনী৷ রান্নার উপর ডিগ্রী অর্জন করেছিস। কোথায় শিখলি রান্না? নানি শিখিয়েছে?””

রিপ্তি ঠোঁট কামড়ালো। লজ্জায় চোখ বুঝলো। কপালে ভাজ তুলে লাজুক ভঙ্গিতে বললো,,

“” আমি রান্না করতে পারিনা,বাবা। কিন্তু রান্নার নিয়ম বলতে পারি!””

কবির সাহেব মাথাটা হালকা ঝাকালেন,গভীরসুরে বললেন,,

“” তা কি কি রান্না বলতে পারো শুনি!””

রিপ্তি জ্ঞানীভাব নিয়ে বললো,,

“” এখন বলতে ইচ্ছে করছেনা,বাবা। আরেকদিন শুনাবো।””

রিপ্তি কথা শেষ করে উল্টো পথে হাঁটা ধরতেই কবির সাহেব আদেশিসুর তুললেন,,

“” রান্না পরে শুনাবে ভালো কথা,কিন্তু খাবারটা যে এখনি খেতে হবে!””

রিপ্তি মন খারাপ নিয়ে বসে আছে। সামনে একথালা ভাত। ভাতে আঙুল নাড়তে নাড়তে বাবার দিকে তাকালো,সে কি করে বুঝাবে,পানসে দুপুরে খেতে নেই। খেলে যে গলায় আটকে থাকে,বুকে ভার নামে! তার যে এখন পানসে দুপুরের ঢেউ নেমেছে। কিছু ভালো লাগেনা। কিছুনা! শুধু থেকে থেকে কান্না পায়,কেন পায় জানে না। তবে সে কান্নার অশ্রু ঝরেনা। ব্যথারা ঝরে!

~~~

“” তোর মাথার নাকি একটা তার ছিড়ে গিয়েছে?””

আকস্মিক কারো কন্ঠ পেয়ে রিপ্তি জানালার শিকের সাথে বারি খেলো। ছোট্ট আহত শিষ ছেড়ে পেছনে তাকালো। তৃণা এসেছে। এক হাতে পেয়ারা আরেকহাতে লবণমরিচের গুড়ো। তৃণা রিপ্তির পাশে হাত-পা মেলে মেঝেতে বসে পড়লো। রিপ্তির মুখের দিকে সরুচোখে তাকিয়ে বললো,,

“” এই সন্ধ্যাবেলা ঘুমাচ্ছিলি? তাও বসে বসে,জানালায় হেলান দিয়ে? ব্যাপার কি বান্ধুবী? রাতে ঘুম হয়না নাকি?””

রিপ্তি চোখ মুছলো। গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললো,,

“” কে বললো ঘুম হয়না? অবশ্যই হয়!””

তৃণা পেয়ারায় লবণ মরিচের গুড়ো মেখে রিপ্তির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,,

“” তুই মিথ্যে বলছিস,তোর চোখের নিচের কালি বলছে তুই শুধু কাল নয়,তার আগের কালগুলোও নির্ঘুৃমে কাটিয়েছিস!””

রিপ্তি ভড়কে গিয়েছে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। লুকিয়ে চোখের নিচটা পরিষ্কার করে বললো,,

“” তুই জ্যোতিষী নাকি? চোখ দেখে বুঝে নিচ্ছিস আমার ঘুমের কাহিনি!””

তৃণা মিটিমিটি হেঁসে বললো,,

“” বান্ধুবী সত্যি কইরা কও কার প্রেমে পড়ছো? তোমার মতিগতি সুবিধার লাগছেনা। আর সেটা শুধু আমার না তোমার ভাবীর চোখেও কিন্তু পড়েছে। হাটে কাঁঠাল ভাঙার আগে আমাকে বল,আমি সামলে নিবো। তোকে সাহায্য করবো!””
“” তুই আমার রুম থেকে বেরিয়ে যাবি। এখনি!””

তৃণা রিপ্তির দিকে ঝুকে এসে বললো,,

“” তোর এই কড়া চাহনি বলছে তুই প্রেমরোগে ব্যাধী। ভাইরাসটা কে? অনুভব ভাইয়া?””

অনুভব নামটা কানে বাজতেই রিপ্তির কড়া চোখ সহজ হয়ে এসেছে। বুকের ভেতর শীতল স্রোত বয়ছে। মুখের আবরণে ফুটছে স্নিগ্ধ,কোমলতা! তার মনে হলো সারাদিনের ভালো লাগেনা একঘেয়েমিটা এক নিমিষেই শেষ। তার এখন সব ভালো লাগছে সব। রিপ্তি আচমকা তৃণার হাত থেকে পেয়ারা কেড়ে নিলো। একগাদা লবণমরিচের গুড়ো মেখে দাঁতের শক্ত কামড় বসালো।

“” তারমানে আমার ধারণা ঠিক?””

রিপ্তি পেয়ারা খাওয়া বন্ধ করে বললো,,

“” না। অনুভব লাল ব্যাঙ হতে পারে কিন্তু প্রেমের ভাইরাস নয়!””
“” ওকে তাহলে এখনি প্রমাণ হবে!””
“” কি?””
“” তোর ভাইরাসকারীর নাম!””
“” কিভাবে?””
“” চোখ বন্ধ কর!””
“” কেন?””
“” আগে তো কর!””

রিপ্তি চোখ বন্ধ করলো। মানুষ সাধারণত চোখ বন্ধ করলে কালো আর হলুদ রঙ মিশ্রিত এক অদ্ভুত ধোয়া দেখতে পায়। কিন্তু রিপ্তি শুধু লাল ধোয়া দেখতে পাচ্ছে। চারধারে লালকালো অন্ধকারে সে ডুবে যাচ্ছে। তৃণা বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো,,

“” কি দেখতে পাচ্ছিস?””
“” লাল..””
“” লাল ব্যাঙ?””

রিপ্তি চট করে চোখ মেলে বললো,,,

“” তুই জোর করে আমার মধ্যে লাল ব্যাঙকে ঢুকাতে চাচ্ছিস। এই খেলা বাদ।””

তৃণা দ্রুততার সাথে বললো,,

“” আরে না না। ওকে আমি কিছু বলবোনা। তুই বলবি আমি শুনবো!””
“” সিউর?””
“” হুম!””

রিপ্তি আবার চোখ বুঝলো। আগেরবারের থেকে এবার লাল অন্ধকারটা আরো বেশি গাঢ়। রিপ্তির বন্ধ চোখের ভেতরে মনিগুলো নড়ছে। চারপাশ ঘুরছে। ঘোর লাগা কন্ঠে বললো,,,

“” লাল অন্ধকারে গাঢ় লালের তিল দেখতে পাচ্ছি! তিলটা হাঁসছে,কিন্তু দাঁত দেখা যাচ্ছেনা। চোখও দেখা যাচ্ছেনা। কারণ ও চোখ বন্ধ করে হাঁসছে।””

তৃণা বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো,,

“” আর কি দেখতে পাচ্ছিস?””

রিপ্তি কাঁপছে। ওর ঠোঁট কাঁপছে। আচমকা তৃণার একহাত চেপে ধরলো। চোখ বন্ধ করেই বললো,,

“” তিলটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে আমাকে খেয়ে ফেলবে। তৃণা ওকে থামা! আমাকে সত্যি সত্যি খেয়ে ফেলবে।””

রিপ্তির কথায় তৃণা ভয় পেয়ে গেলো। সে তো শুধু মজা করতে চেয়েছিলো। কিন্তু রিপ্তি এগুলো কি ভুলভাল বলছে? তিল কি কখনো হাঁসে? মানুষকে খেতে পারে??? তৃণা ভাবনার মাঝখানেই রিপ্তি অস্পষ্টসুরে বললো,,

“” প্রিয়াঙ্গিনী! রাগিনী! মায়াকন্যা! জোসনাকন্যা! মায়াক্ষী!!!….””

রিপ্তি একের পর এক অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করে যাচ্ছে। তৃণা ভয়ভয় নিয়ে মৃদুস্বরে রিপ্তিকে ডাকলো। রিপ্তি চোখ মেলছেনা। সে তারমতো শব্দ উচ্চারণে ব্যস্ত। তৃণা হাতের লবণমরিচের গুড়ো ঝেড়ে ফেললো। দুহাতে রিপ্তির কাধ চেপে ধরলো। জোরে ঝাকি দিয়ে চিৎকার করে ডাকলো,,

“” রিপি!””

রিপ্তির চোখ খুলে গিয়েছে। নির্লিপ্তে চেয়ে আছে তৃণার দিকে। মুখে কোনো শব্দ নেই। হাবভাবে মনে হচ্ছে ওর এখানে থাকার কথা না ভুল করে চলে এসেছে!

“” কিরে! এভাবে কি দেখছিস? স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গিয়েছে?””

তৃণার কথায় রিপ্তি হালকা শিউরে উঠলো। চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। কিছু একটা খুজছে। কিন্তু কি?

তৃণা ঠোঁট টিপে হেঁসে ফিসফিসিয়ে বললো,,,

“” অনুভব ভাইয়া তাহলে সত্যি তোর হৃদয়হরণ করেছে?””

তৃণা এবার শব্দ করে হেঁসে উঠলো। রিপ্তির ভ্রম কেটে গিয়েছে। তবে এখনো কোনো শব্দ আউড়ায়নি। আগের মতোই নিরব আছে। তৃণা মহা উৎসাহ নিয়ে কোমড় থেকে ফোন বের করলো। ফোনের লক খুলতে খুলতে বললো,

“” অনুভব ভাইয়াকে খবরটা জানাতে হবে। এখনি। উফ! আমার তো তর সইছেনা।””

রিপ্তি ছো মেরে ফোনটা ছিনিয়ে নিলো। কঠিনসুরে বললো,,

“” তুই আমাকে বাবুওয়ালা মেয়েবন্ধু বানানোর জন্য,এভাবে উঠেপরে লেগেছিস কেন? উনার গার্লফ্রেন্ড হওয়া মানেই প্রেগন্যান্ট। নষ্ট শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ছি! উনি এসে আমার হাতে-পায়ে ধরলেও আমি উনার গার্লফ্রেন্ড হবোনা।””
“” ভেবে বলছিস তো?””
“” তুই আমার রুম থেকে যাবি নাকি ধোলাই খাবি?””
“” হাজার প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনের মাঝে বন্ধু-বান্ধুবীরাই ধোলাই খায়। আমিও নাহয় একটু খেলাম!””

রিপ্তি দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ বুঝাচ্ছে। এতে তৃণা খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠলো। রিপ্তি আর সহ্য করতে না পেরে ওকে রুম থেকে বের করে দিলো। দরজা আটকাতে নিলে তৃণা বাধা দিচ্ছে। একজন লাগানোর চেষ্টায় আছে আরেকজন খোলার। এই লড়াইয়ের মাঝেই তৃণা বললো,,

“” আমার ব্ল্যাকমেইলিং গিফটটা তাড়াতাড়ি পাঠাস নাহলে তোর হৃদয়হরণকারীর বিয়ে হবেনা!””

~~~

কোনোপ্রকার সাজসজ্জা ছাড়াই রিপ্তি নবীনবরণে উপস্থিত। সাথে বাবাও এসেছেন। তবে বাবা এই মুহুর্তে তার সাথে নেই। কোনো জরুরী কাজে অন্যত্র গিয়েছেন। নবীনবরণ উপলক্ষে বেশ ভালো সাজানো হয়েছে। গাছের ফুল,কাগজের ফুল,রঙিন কাগজ,বেলুন,কেক কিছুই বাদ পড়েনি। সবকিছুর মাঝে এক তীব্র সুবাস রিপ্তির মাথা ধরে গিয়েছে। তার সামনেই বিশেষ বিশেষ ভাষণ চলছে। সে মাঝামাঝিতে আছে। মাথা নিচু করা। সামনে কি চলছে তা দেখবেনা। কোনো প্রকারেইনা। দেখলেই তার শেষ,সব শেষ!

রিপ্তি অসস্থি আর অস্থিরতায় কুকড়ে যাচ্ছে। যতটা পারছে নিজেকে আড়াল করায় ব্যস্ত। নিশ্বাস আটকে নিচ্ছে। রজনীগন্ধার তীব্র গন্ধ কপালের দুপাশে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করছে। রিপ্তির অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির মাঝেই এক মেয়ে বলে উঠলো,,,

“”নীলশার্ট পড়া যে স্যার,উনি আমাদের ডিপার্টমেন্ট হ্যাড না? ইশ! কন্ঠ শুনেছিস? আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো। আমি তো শুনেছি উনি এখনো অবিবাহিত!””

পাশ থেকে আরেকজন বললো,,

“” হুম,আমিও তাই শুনেছি। উনি আমাদের ক্লাস নিবে তো?””
“” কেন? ক্লাস নিলে কি হবে?””

মেয়েটির কন্ঠ পরিবর্তন হয়ে গেলো। লাজুকভঙ্গিতে বললো,,,

“” তাহলে রোজ রোজ দেখতে পারতাম!””

দুজনের আহ্লাদী কথাবার্তার মাঝেই রিপ্তি গর্জে উঠলো। বসা থেকে উঠে দাড়িয়েছে। চিৎকার করে বললো,,,

“”” গলায় ঝুলে পড়লেই তো হয়,রোজ রোজ কেন? সেকেন্ডে সেকেন্ডে দেখতে পারবে। আমার কাছে এসো,আমি তোমাকে টাই বানিয়ে দিবো। তারপর উনার গলায় বেধে বসে থেকো। উনার কন্ঠে আগুন ঝরবে আর তুমি বসে বসে পুড়বে। যত্তসব! এসব ঢং করতে এখানে ভর্তি হয়েছো? এখনো ক্লাস শুরু হয়নি,এর মাঝেই কে বিবাহিত,কে অবিবাহিত তাই নিয়ে গড়াগড়ি! আশ্চর্যের বাটখারা সব। সর সামনে থেকে আমি বেরোবো!””

মেয়ে দুজন ভয়ে ভয়ে সরে গেলো। পুরো ক্লাসজুড়ে উপস্থিত সকলের চোখগুলো রিপ্তিনামক ঘুর্ণিঝড়ের দিকে তাকিয়ে রইলো!

রিপ্তি শব্দসহিত জোরে জোরে পা ফেলছে। খোলা আকাশ প্রয়োজন,মুক্ত বাতাস প্রয়োজন। চোখে কি সে কম দেখছে?? সবকিছু এমন ঘোলাটে লাগছে কেন? মাথার যন্ত্রণাটা বেড়েই চলেছে। এই যন্ত্রণা কমাতে হলে তার মাটির ধুলো প্রয়োজন। রিপ্তি প্রাণপণে ছুটছে। যত দুরে যাবে তত রজনীগন্ধার গন্ধটা তাকে ছেড়ে যাবে।

রিপ্তি নাক টেনে গন্ধ শুকলো। না আর গন্ধ লাগছেনা। মাথা ব্যথাটা কমছে। কিন্তু চোখের ঝাপসা ভাবটা এখনো কাটেনি। বাবা কোথায়? এখনো এলোনা যে? বলেছিলো এখানেই থাকবে। রিপ্তির মনে হলো সে হারিয়ে গিয়েছে। যাকে বলে মেলায় হারিয়ে যাওয়া! বাবাকে আর কখনো ফিরে পাবেনা। রিপ্তির গলা ধরে আসছে,চোখগুলোও ভিজলো বুঝি! সে কি চিৎকার করবে?? বাবার কানে ডাক পৌছাবে তো??? রিপ্তির এই দোটানা ভাবনার মাঝে অপরিচিত কন্ঠ,,,

“” এক্সকিউজ মি!””

রিপ্তি পেছন ঘুরলো। ছাই রঙের টি-শার্ট সাথে হলদেটে ভাবের প্যান্ট পড়া। মাথায় চুলের পরিমান অল্প,মুখ গোলাকার,দুগালে হালকা দাড়ির উপস্থিত। রিপ্তি সুক্ষনয়নে ছেলেটিকে পর্যক্ষণ করে বুঝতে পারলো,এই ছেলেকে সে চেনানা। অবশ্য এখানের কাউকেই তার চেনার কথা না!

“” আপনি কি বিবাহিত?””

রিপ্তি অন্যমনস্কতাসহিত মাথা নাড়িয়ে না বুঝাতেই ছেলেটির মুখে হাসি ফুটলো। পাশ থেকে আরো একগাদা ছেলে এসে হাজির। দুটো মেয়েও আছে। চোখের সামনে এমন পালবাহিনি তৈরী হতে রিপ্তি বেশ বিচলিত। মনের অজান্তেই ছোট্ট শব্দ বেরিয়ে এলো,র্যাগিং!

রিপ্তি চুপচাপ ঘুরে দাড়াতে মেয়েটি সামনে এসে দাড়ালো। স্বাভাবিকভাবেই বললো,,

“” তোমার নাম্বারটা দাও তো!””

রিপ্তি কি বলবে বুঝতে পারছেনা। মনে মনে বাবাকে খুজছে। এই মুহুর্তে তার নিজেকে পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চা মনে হচ্ছে। যে বাবাকে ছাড়া চলতে পারেনা। খেলতে গিয়ে মার খেয়ে এসে বাবার কাছে অবাধ্যে কান্না করে আর নালিশ করে।

“” তুমি ফেসবুক চালাওতো?””
“” না!””
“” হোয়াটস অ্যাপ!””
“” না!””
“” তাহলে নাম্বার দাও!””
“” আমার ফোন নেই।””

সকলে একে অপরের দিকে তাকালো। তার কথা যে বিশ্বাসযোগ্য নয়,তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। এবার ছেলেটি বললো,,

“” তাহলে ঠিকানা দাও!””

রিপ্তি হা করে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলো
তারমাঝেই পেছন থেকে গানের কন্ঠ ভেসে এলো,,,

মার ঝাড়ু মার
ঝাড়ু মেরে ঝেটিয়ে
বিদেয় কর!
যত আছে নোংরা সবি
ঠেঙিয়ে দুর কর!!!

রিপ্তি হাওয়া বেগে পেছন ঘুরলো,অত্যাশ্চর্যিত নিয়ে বললো,,

“” লাল ব্যাঙ! আপনি এখানে??””

চলবে

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৬)

মার ঝাড়ু মার
ঝাড়ু মেরে ঝেটিয়ে
বিদেয় কর!
যত আছে নোংরা সবি
ঠেঙিয়ে দুর কর!!!

রিপ্তি হাওয়া বেগে পেছন ঘুরলো,অত্যাশ্চর্যিত নিয়ে বললো,,

“” লাল ব্যাঙ! আপনি এখানে??””

রিপ্তি দৌড়ে অনুভবের সামনে গিয়ে দাড়ালো। ধূসর রঙের শার্টের সাথে কালো রঙের ব্যাগ ঝুলছে কাধে। চুলগুলো একপাশে ঢেউ খেলে পেছনে চলে গিয়েছে। গায়ের রঙটা আগের থেকে উজ্জ্বল। মুখটা কেমন থমথমে ভাব!

রিপ্তি বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো,,

“” আপনি এখানে কি করছেন?””

অনুভব চুপ। মুখের ভাবটা গম্ভীর হতে গম্ভীর। চোখের পলক ফিরিয়ে পাশে চাইলো। অনুভবকে দেখে রিপ্তি মহাখুশি। কিন্তু তা সে প্রকাশ করবেনা। কিছুতেই না। তাই কিছুটা রূঢ়কন্ঠে বললো,,

“” আবার আমার পিছু নিয়েছেন? জ্বালাতে এসেছেন? আপনার কি মনে হয়,আপনি জ্বালালেই আমি জ্বলবো?””

রিপ্তির প্রশ্নে অনুভব পকেটে হাত ঢুকালো। বেশ কসরৎ শেষে হাত বের করে আনলো। হাতে দিয়াশলাই!

রিপ্তি মনে মনে বিড়বিড় করলো,আমাকে সত্যি সত্যি জ্বালিয়ে দিবে নাকি?

অনুভব ওর দিকে দিয়াশলাই এগিয়ে দিলো। রিপ্তি স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে,দিয়াশলাইয়ের দিকে। অনুভব হাত নাড়িয়ে বলছে ওটা ধরতে। রিপ্তি ধরবে কি ধরবেনা বুঝতে পারছেনা। মনটা হঠাৎ করেই ভীত হয়ে উঠলো। রিপ্তিকে এমন চুপ মেরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অনুভব আগ বাড়িয়ে ওর হাতে দিয়াশলাইটা ধরিয়ে দিলো। রিপ্তি ভ্রূজোড়া সংকুচিত করে বললো,,

“” এটা দিয়ে আমি কি করবো?””

অনুভব রিপ্তির কথা কানে নিলোনা। কাধ থেকে ব্যাগটা নামালো। চেইন খুলে ভেতরটা হাতড়াচ্ছে। হঠাৎ তার ঠোঁটজোড়া প্রসারিত হলো। ছোট্ট হাসি নিয়ে ব্যাগ থেকে আইডি কার্ডটা বের করলো। রিপ্তির সামনে ধরে আছে। রিপ্তি সরু দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে সান্দেহিক প্রশ্ন,,,

“” আপনি এখানকার স্টুডেন্ট?””

অনুভবের দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে রিপ্তির মেজাজ নড়ে যাচ্ছে। আবার সেই ঢং,সেই নিরবতা! উফ!

রিপ্তি রাগ রাগ মুখ বানিয়ে পাশ ঘুরতেই ব্যস্ত পায়ের শব্দ। চোখ তুলে সামনে তাকালো। একটু আগের পাকবাহিনি সব গায়েব। রিপ্তি অবাক! অবাক নিয়ে আবার অনুভবের দিকে ঘুরলো। আইডিকার্ড গলায় ঝুলছে। লাল ফিতেতে চোখ পড়তেই রিপ্তির চোখ আনন্দ খুজে পেলো। তারমানে এতোক্ষণ তার চোখজোড়া লালরঙ খুজছিলো। আজ অনুভবের পরিধানে কোনো লালরঙের ছোয়া ছিলোনা। যা রিপ্তি মানতে পারছিলোনা। চাইছিলো কোথাও একটু লালরঙের ছিটফোটা দেখতে! অবশেষে পেলো।

অনুভব আগের ন্যায় ব্যাগটা কাধে ঝুলালো। রিপ্তির হাত থেকে দিয়াশলাইটা নিয়ে পকেটে পুরে সোজা হাঁটা ধরেছে। রিপ্তিও পিছু নিলো। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তগলায় বললো,,

“” ওরা আপনার পরিচিত?””
“”…..””
“” আপনি তাকালেন আর ওরা চলে গেলো কেন?””
“”…..””
“” আপনাকে এখানকার সবাই ভয় পায়?””
“”…..””
“” আপনি কি গুন্ডাবাহিনীর বিগব্রাদার নাকি গডফাদার?””

অনুভব হঠাৎ করে দাড়িয়ে পড়লো। রিপ্তি অনুভবের সাথে হেঁটে পেরে উঠছিলোনা বলে,কিছুটা দৌড়ভঙ্গিমায় হাঁটছিলো। অনুভব যে এমনভাবে দাড়িয়ে পড়বে রিপ্তি ভাবতে পারেনি। সামলাতে না পেরে অনুভবের পিঠের সাথে ধাক্কা খেলো। অনুভব ঘুরে সহজ গলায় বললো,,

“” ওরা আমার জুনিয়র,সিনিয়রকে সম্মান দেখিয়ে চলে গিয়েছে। সব মাথা নিচু করার কারণ ভয় নয়,সম্মান-শ্রদ্ধাও হতে পারে!””

রিপ্তি মাথা নিচু করে বললো,,

“” তাহলে কি আমাকেও আপনার সামনে মাথা নিচু করে থাকতে হবে?””

অনুভব হাসলো। রিপ্তিকে পিছনে ফেলে দুকদম এগিয়ে গেলো। বিনয়ীর সাথে বললো,,

“” আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন?””
“” ওয়ালাইকুমুস সালাম,ভালো। তুমি কেমন আছো?””
“” জ্বী ভালো!””

রিপ্তি মাথা তুলে ছোট্ট করে বললো,বাবা!

অনুভব আর কবির সাহেব কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন। রিপ্তি পাশে দাড়িয়ে শুনছে। আর নিজেকে বকে যাচ্ছে। ছি! প্রথমদিন এসেই হারিয়ে গিয়েছিলাম? বাবা কোথায় দাড়াতে বলেছিলো,আর আমি কোথায় গিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম?? বলদ একটা! কিছু পারিনা! ভাগ্যিস লাল ব্যাঙ আমায় নিয়ে এসেছে। আসলেই কি নিয়ে এসেছে? নাকি ভুল করে উনার পিছু নিতে নিতে বাবার সামনে চলে এসেছি?? তাই হবে! উনি নিয়ে আসতে যাবেন কেন? উনি হয় তো জানতেনই না আমি হারিয়ে গিয়েছি! সে রকম হলে উনার প্রথমবাক্য হতো,বলদরানী,আপনি ভুলকরে আলুখেতে না দাড়িয়ে,বেগুন খেতে দাড়িয়ে আছেন। চলুন আপনাকে আলু খেতে দিয়ে আসি!

রিপ্তি মনে মনে হাসলো। বিড়বিড় করে বললো,,,

“”বলদরাজ,আপনার উপস্থিতি এতো মিঠা কেন? আপনি জানেন মিষ্টি আমার কত প্রিয়? যদি ভুল করে খেয়ে ফেলি? কেমন হবে??””
“” খাচ্ছিস না কেন?””

বাবার কন্ঠে রিপ্তির ঘোর কাটলো। অনুভবের দিক থেকে চোখ সরালো। বাবার হাতে ঠান্ডা পানি! কে এনে দিলো? লাল ব্যাঙ? বাহ! এতো যত্ন??

রিপ্তি পানি মুখে ধরে আছে,কিন্তু খাচ্ছেনা। তার হঠাৎ করেই মনে হলো,এই পানির মধ্যে অনুভব ডুবে আছে। পানি পান করার সাথে সাথে অনুভব তার পেটে,ছি! শেষে কিনা অনুভবকে পেটে নিয়ে ঘুরতে হবে??? রিপ্তি চট করে পানিটা সরিয়ে নিলো। বাবার দিকে এগিয়ে ধরলো। উনি কথা বলছিলেন,মুখে এখনো চিন্তার ভাজ। কথা চালাতে চালাতে বোতল নিলেন। দুজন অনেক্ষণযাবত কথাবার্তায় মশগুল। রিপ্তি অন্যঘোরে থাকায় তেমন কিছু শুনতে পায়নি। এবার পাচ্ছে। কবির সাহেব উদ্বিগ্নভর্তি কন্ঠে বললেন,,

“” সুপারিশকারীর কোনো খোঁজ পেলাম না। ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। তেমন কাউকে পায়নি। পিয়নের সাথে কথা হয়েছে। উনি তেমন কিছু বলতে পারলেন না। শুধু বললো,,বিভাগীয় প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলতে। তাহলে হয়তো জানতে পারবো। কিন্তু দুঃখের বিষয় উনি নাকি আধঘন্টা আগে বেরিয়ে গিয়েছেন। আজ আর দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।””

অনুভব আশ্বাসের সুর তুলে বলছে,,

“” আপনি চিন্তা করবেননা। দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা। যে সুপারিশ করেছে সে নিজেই যদি নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চায়,তাহলে বের করা অনেক টাফ হবে। তবুও আমি খোঁজ লাগিয়ে দেখি। কিছু জানতে পারলে আপনাকে…..””

অনুভব মাঝপথেই থমকে গেলো। হাতে টান খাচ্ছে। রিপ্তি ওর শার্টের হাতা খামচে ধরে আছে। হাত কাঁপছে। অনুভব রিপ্তির মুখের দিকে তাকালো। চোখ বন্ধ,ঠোঁট কাঁপছে। প্রচন্ড ব্যথার ঝড় সামলাচ্ছে এমন ভঙ্গি। অনুভব কিছু বুঝার আগেই রিপ্তি আধোবুলিতে বললো,,

“” উনি যাননি,বাবা। এখানেই আছে। আশেপাশে।””

কবির সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন।

“” রিপ্তি,মা! তোর কি খারাপ লাগছে??””

রজনীগন্ধার তীব্র গন্ধটা রিপ্তির নাকে বারি লাগছে। রিপ্তি দম আটকে বললো,,

“” আমার খুব মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে,বাবা। বাড়ি চলো!””

কবির সাহেব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মেয়ের বাহুতে হাত রাখতে অনুভব বললেন,,,

“” আমি রিকসা ঢেকে দিচ্ছি। এমনিতেও এখন আপনাদের বেরোনো উচিত। ট্রেণ আসার সময় হয়ে গিয়েছে। এই ট্রেণটা মিস করলে সন্ধ্যের ট্রেণে যেতে হবে।””
“” হুম চলো।””

অনুভব রিকসা ঢাকতে সামনে পা চালালে আবারও হাতে টান খেলো। রিপ্তি এখনো তার শার্টের কিছু অংশ খামচে ধরে আছে। হাত দিয়ে ছাড়াতে গিয়েও ছাড়ালোনা। স্যারের অগোচরে রিপ্তির দিকে ঝুকে এলো। নিভুস্বরে বললো,,

“” শক্ত কাপড়ে খামচে ধরে নখ ভোতা বানালে চলবে? এখনো যে অনেক জায়গায় আচড় কাটা বাকি!””

রিপ্তি তাৎক্ষনিক হাত সরিয়ে নিলো। চোখদুটো বড়বড় করে চেয়ে আছে,মুচকি হাসি মানুষটার দিকে।

~~~

কমলাপুর স্টেশনে দাড়িয়ে আছে রিপ্তিরা। অনুভব টিকেট কাটতে গিয়েছে। ট্রেণ এখনো আসেনি,তবে আসবে। এনাউন্সমেন্ট চলছে। তাদের চারপাশে ঘিরে আছে নানা অজানা মানুষজন। কেউ হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে,কেউ নষ্ট ফ্যানের দিকে তাকিয়ে সরকারকে বকে যাচ্ছে। কেউ বসার জায়গা না পেয়ে মাটিতেই পুটলাপুটলির উপর বসে আছে। অনেকেই স্মার্ট সেজে রেললাইনের উপর বসে হ্যাডফোন কাজে গুজে আছে। সকলেরই তাড়া,আর অপেক্ষা। এদের মধ্য থেকে সিংসভাগ লোকগুলো হয়তো আসছে ট্রেণে উঠে পড়বে,বাকিরা অন্য ট্রেণের অপেক্ষায় থাকবে। অপেক্ষা! শব্দটা বড্ড বেশি বিরক্তের,তবুও আমাদের জীবন চলে এই অপেক্ষানামক গাড়িতে!

রিপ্তির সামনে দিয়ে চানাচুরওয়ালা ঘুরঘুর করছে। নানা মশলায় মেশানো চানাচুর মাখার গন্ধে রিপ্তির ক্ষুধা লেগে গেলো। বাবার দিকে তাকাতে, বাবা বুঝে গেলেন।

অনুভব টিকেট নিয়ে এসেছে। ট্রেণও চলে এসেছে। বাবা ভাংতি টাকা নেওয়ার অপেক্ষায় থেকে রিপ্তিকে ট্রেণে চড়তে বললো।

রিপ্তি টিকেটের সাথে সিটের নাম্বার মিলিয়ে বসে পড়লো। জানালা দিয়ে বাবাকে খুজছে। শুধু কি বাবাকে? চোখজোড়া যে আরেকজনকেও খুজছে!

“” রিপ্তি!””

রিপ্তি খানিকটা চমকালো। অনুভব তার পাশেই বসে আছে। অনুভবের চোখে চোখ রাখতে পারছেনা। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে অনুভবের কাছ থেকে একটু সরে যেতেই অনুভব গম্ভীর গলায় বললো,,

“”যে ঝড়ের সৃষ্টি তুমি করেছো তা তোমাকেই সামলাতে হবে রিপ্তি! একটা কথা মনে রেখো,যে গড়তে পারে,সে ভাঙতে পারে। তুমিও পারবে। আমার তো মনে হয় তুমি পেরেছোও। কিন্তু তুমি যে সফল হয়েছো তা বুঝতে পারছোনা। নিজেকে প্রকাশ করো! তোমার ভেতরটাকে পরিষ্কার করো। একা না পারলে সঙ্গী বানাও। একটু ভালো করে চোখ মেললেই দেখবে,তোমাকে সাহায্য করার জন্য তোমার আপন মানুষরা অপেক্ষায় আছে। রিপ্তি, ঝড় উঠলে একটু ক্ষয়ক্ষতি হবে,এটা স্বাভাবিক। এখন যদি তুমি সেই সূত্রধরে নিজেই নিজের সৃষ্টিতে হারিয়ে যাও তাহলে কি চলবে?? গোপনীয়তা ভালো,তবে অতিরিক্ত নয়। অতিরিক্ত জিনিসটা সবসময় খারাপমুখী হয়।””

রিপ্তি ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে আছে অনুভবের দিকে। কি বলছে,কেন বলছে?? রিপ্তির মাথায় কিছু ঢুকছেনা। তবে তার ভেতরে কিছু একটা চলাচল করছে,উদ্দমতা জাগছে। কিছু বলে ফেলার ইচ্ছে,যা সে লুকিয়ে রেখেছিলো। আড়াল করেছিলো সবার থেকে,এমনকি সবচেয়ে প্রিয় মানুষ বাবার থেকেও।

“” রিপ্তি!””

রিপ্তি আবার চমকালো। এই মানুষটা তো তাকে সবসময় উল্টাপাল্টা নামে ডাকে। তাহলে আজ,হঠাৎ এই নাম ধরে ডাকছে কেন?

“”তুমি কি আমার কথা কিছুই বুঝতে পারছোনা? আচ্ছা বুঝতে হবেনা। শুধু একটু ভেবো। তাহলেই চলবে।””

রিপ্তি মাথা নেড়ে হ্যা সম্মতি দিতেই অনুভব হাসলো। নিঃশব্দের হাঁসি।

“” আমি জানি তুৃমি পারবে।””

রিপ্তি আবার চমকালো। অনুভবের মাঝে সে কার ছায়া দেখতে পারছে? বাবার??

অনুভব উঠে দাড়ালো। দাড়িয়েই বললো,,

“” আমি প্রকাশিতব্য রিপ্তির অপেক্ষায় রইলাম। নতুন করে নতুন ঝড়ের তান্ডবের অপেক্ষায় রইলাম। কিছু ক্ষয়ক্ষতির অপেক্ষা। তবে এই ঝড়, তোমাকে সামলাতে হবেনা। কারণ,কেউ একজন সেই ঝড়কে আকড়ে ধরে নতুন স্বপ্ন বুনার অপেক্ষায় আছে। শুরুটা তোমার,শেষটা তার!””

অনুভব মিষ্টি হেঁসে কামড়া ছাড়লো। রিপ্তি তখনো মায়ালাগা দৃষ্টিতে অনুভবের দাড়িয়ে থাকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে আছে।

~~~
রিপ্তি বাড়ি পৌছে সোজা তৃণার বাসার দিকে দৌড় লাগালো। পেছনে বাবার সতর্কবাণী শোনার সময় নেই তার।

তৃণা শুকনো কাপড় তুলছিলো। একটুপর সন্ধ্যা নামবে। শেষ কাপড়টা তুলতে হাত বাড়ালো। তারমাঝেই রিপ্তি ওকে ঝাপটে ধরেছে। তৃণা ভয়ে চিৎকার লাগাবে তখনি রিপ্তি আধোবুলিতে বললো,,

“” লাল ব্যাঙ!””

রিপ্তির কন্ঠ পেয়ে তৃণার যায় যায় প্রাণটা ফিরে এসেছে। ভয়টা তাড়াতে তাড়াতে রিপ্তির বুলিটা মগজে নাড়া দিলো। সে পাল্টা জবাব দিলো,,

“” অনুভব ভাই?””
“” হুম!””
“” অনুভব ভাই কি?””
“” আমার ভার্সিটিতে!””
“” মানে?””
“”জানিনা!””

তৃণা নিজেই সবটা বুঝার চেষ্টা করলো। ব্রেইনে ভালো চাপ পড়তে সব বুঝে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি রিপ্তিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে তাচ্ছিল্যের সুর টানলো,,

“” তোর এতো খুশি লাগছে কেন?””

তৃণার প্রশ্নের ধরনে রিপ্তিও ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলো। ইতস্ততভাবে বললো,,

“” ঐ তো,এমনি…””
“” এখন কথা লুকাচ্ছিস কেন? প্রেমে পড়েছিস স্বীকার কর!””

রিপ্তি ভাব নিয়ে বললো,,

“” আবার প্রেম? ছি! উনার সাথে কে প্রেম করবে?””
“” তাহলে?””

রিপ্তি তৃণাকে এড়িয়ে যেতে চাইলো। তৃণাও বেকে বসলো। সে উত্তর নিয়েই ছাড়বে এমন ভাবে রিপ্তির পথ আগলালো,,,

“” তাহলে কি বল!””
“” আমার…””
“” আমার কি?””
“” আমার উনার ভাঙা গলা শুনতে ভালো লাগে!””

একদমে জবাব দিয়ে রিপ্তি তৃণাকে পাশ কাটিয়ে দৌড় লাগালো।

~~~

ঘড়ির কাটা এগারোটাতে পৌছুতে রিপ্তি নিজের ক্যাম্পাসে হাজির। ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে দাড়িয়ে। স্থিরচিত্তে সামনে তাকিয়ে আছে। কোথায় যাবে সে? তার ডিপার্টমেন্ট কোনদিকে? বাবা কোথায় দাড়িয়ে ছিলো? লাল ব্যাঙের সাথেই বা কোথায় দেখা হয়েছিলো?? রিপ্তির কিছু মনে পরছেনা। তার সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। পা দুটো যেন মাটির সাথে এটে আছে। নড়তে চাইছেনা। মনে হচ্ছে পা বাড়ালেই হারিয়ে যাবে। কি দরকার ছিলো আসার? রুটিন অনুযায়ী আজ তো তার ক্লাস নেই। তবুও কেন এলো? এমন তো নয় সে জানতো না। জেনেই এসেছে। এসেছে ভালো কথা। একা কেন আসতে গেলো? বাবাকে নিয়ে আসলেই হতো,ভাবীও তো আসতে চাইলো। কেন মুখ খুলে বড়বড় কথা বলতে হয়েছে? আমি পারবো!

রিপ্তির আফসোসের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কি প্রয়োজন ছিলো এই মস্ত বড় ঐতিহাসিক স্থাপনে পড়াশোনার কার্য চালানোর?? ছোট্ট হলে কি হতো??? রিপ্তি রাস্তার পানে ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে,যার জন্য এসেছি সেই যদি না আসে? উনি কি জানেন আমি উনার জন্য এসেছি? জানলেই কি আমার জন্য আসতেন?? হতেই পারে উনারও আজ কোনো ক্লাস নেই,প্রয়োজন ছাড়া আসবে কেন? সবাই কি আমার মতো বোকা???

“” বলদরানী!””

নিজের রাখা নাম অন্যের মুখে শুনে রিপ্তি ছিটকে উঠলো। সামনে থেকেই এসেছে কন্ঠটা। রিপ্তি চোখ তুলে তাকালো। চিকন,ছিপছিপে গড়নের একটি ছেলে দাড়িয়ে আছে। হাসি হাসি মুখ। বয়সটা ঠিক বুঝা যাচ্ছেনা। এই ছেলেটা তার কোনো কালেই পরিচিত হতে পারেনা। আমার মনে রাখা নাম উনি কি করে পড়লো?

ছেলেটি রিপ্তির কাছে এসে একটা কাগজ এগিয়ে দিলো। রিপ্তি কাগজটার দিকে একপলক চেয়ে পেছন সরে গেলো। অন্যদিকে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়ালে,ছেলেটি বললো,,

“” এইটা লাভ লেটার নয়,আপু!””

সুন্দর কন্ঠ। আবেদনময়ী ডাক। রিপ্তি হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিলো। খুলে পড়তে শুরু করলো,,,

***চোখ বন্ধ করে ১০০ কদম সামনে হাঁটো!***

রিপ্তি সামনে তাকালো। ছেলেটি নেই। কোথায় চলে গেলো?

রিপ্তি কাগজের নির্দেশ পালন করবে নাকি ভাবছে। আবার কোনো র্যাগিং নাতো??? আশেপাশে বার কয়েক চোখ বুলাচ্ছে। সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ছেনা। রিপ্তি চোখ বন্ধ করে বিসমিল্লাহ পাঠ করলো। তারপর গুনতে শুরু করলো,,

“” এক,দুই,তিন,চার……একশ।””

পুরো নির্দেশ পালন করে চোখ মেলতেই একটা মোটা করে মেয়ে দেখতে পেলো। তার ঠিক সামনেই দাড়িয়ে। রিপ্তি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালে,সেও একটি কাগজ ধরিয়ে দিলো। রিপ্তি এবার বেশ আগ্রহ নিয়ে কাগজটা খুললো,,,

*** ১৩ আর ১৭ ঘরের নামতা পড়তে পড়তে ডানদিকে হাঁটা শুরু করো। চোখ অবশ্যই বন্ধ থাকবে।

বিঃদ্রঃ নামতা ভুল হলে বিপদ সংকেত বাজতে পারে। এর জন্য আমি দায়ী নই!***

কাগজটা হাত থেকে পড়ে গেলো। মনে মনে দ্রুত নামতা পড়তে শুরু করলো,,

১৩*১=১৩
১৩*২=২৬
১৩*৩=৩৯
১৩*৪=??

রিপ্তি শুরুতেই আটকে আছে। কিছুতেই মনে করতে পারছেনা। এখন কি হবে?? রিপ্তি মেয়েটার কাছে সাহায্য চাইবে,সেও নেই! রিপ্তির মুখ কাঁদো কাঁদো। এখন কি করবে??? রিপ্তি চটপট আঙুলের কড়ি গুনে গুনে নামতা মুখস্ত শুরু করলো। আগে মুখস্ত করবে তারপর ডানদিকে ঘুরবে। সে কোনো বিপদ সংকেতে পড়তে চায়না,না না না!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here