#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,পর্ব (৯)
#রোকসানা_রাহমান
রিপ্তি আরেকবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে চট করে লাল টাওয়ালটা তুলে নিলো। বেরিয়ে যেতে যেতে গান ধরলো,,,
আমি চলি আগে আগে
সবাই আমার পিছে রে
আমি চলি উড়ে উড়ে
আকাশ আমার নিচে রে
আমি যে নাম্বার ওয়ান
ও লাল ব্যাঙ
আমি যে নাম্বার ওয়ান
রিপ্তি মহানন্দে রাতের খাবার খাচ্ছে। মুরগির হাড্ডিটা কড়মড় করে চিবুচ্ছে,মনে হচ্ছে মুরগি নয় অনুভবের সব অহংকার সে দাতের মাড়ায় ধূলিসাৎ করছে। রিপ্তি পুরো প্লেটের ভাত শেষ করে আরেক প্লেট ভাত নিলো। সামনের মুরগি মাংসের পেয়ালার সবটা তরকারী পাতে ঢেলে নিয়ে বললো,,,
“” ভাবী,আরেক টুকরো মাংস হবে?? বুকের খাচার টুকরো এনো!””
মিন্মি অনেক্ষণযাবত রিপ্তিকে পর্যবেক্ষণ করছিলো। সে রিপ্তির মাঝে অভিনিবেশ সহকারে দর্শনে এতোটাই বিভোর ছিলো যে নিজের প্লেটের ভাত এখনো দুই তৃতীয়াংশ অভুক্ত রয়েছে। অনুভবকে ডাকতে গিয়ে মেয়েটার কি হলো?? কোনো রাক্ষসের নজর পড়েনি তো?? যদিও এ এলাকাটা অন্যান্য গ্রামের তুলনায় জঞ্জালহীন। ভূত প্রেতের তেমন একটা দেখা মেলেনা। তবুও আগে মেলেনি বলে যে এখন মিলবেনা তা তো নয়,মানুষ মাত্রই যদি পরিবর্তনশীল হয়,তাহলে ভূতেরও তো পরিবর্তন আসতেই পারে। আমরা যদি ডিজিটাল হয়ে হাতের মুঠোয় পৃথিবী নিয়ে বসে থাকতে পারি ওরা কেন পারবেনা?? এমন ও তো হতে পারে,আজকাল ভূতেরাও ডিজিটাল হয়ে গিয়েছে। তারা এখন আর গাবগাছ,তেতুল তলায় না ঝুলে বাসাবাড়িতে ঢুকে বসে আছে! শক্ত কাঠের বিছানা আকড়ে ধরে ঝিমুচ্ছে!!
ভূতের কথা ভাবতেই মিন্মির শরীর অদৃশ্য শিউরে কেঁপে উঠলো,সকালে রাসেলকে খুজতে যাওয়ার সময় মাঝবয়সী দুজন লোকের কানাকানি শুনেছিলো। পাশের গায়ের মারিয়াকে নাকি সারারাত খুজে পাওয়া যাচ্ছিলোনা। সকলেই কান্নাকাটি করে যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিলো তখনি ভোরের কুয়াশার মাঝ থেকে চিৎকার করে উঠে মারিয়া। তারপর অচেতন!
“” ভাবী এখনো বসে রইলে যে? আচ্ছা আমি গিয়ে নিয়ে আসছি!””
রিপ্তি হাতে লেগে থাকা ভাত চেটে পরিষ্কার করে নিলো। চেয়ার ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে। ঠিক তখনি অনুভব সামনে। রিপ্তি সিউরিটির ধারণার উপর চেপে বসেই তো হাড্ডি গুড়া করছিলো। তারমতে,অনুভবের রুম ছেড়ে বের হওয়া অসম্ভব। সভ্য সমাজের মানুষ যত অসভ্যতায় মাতিয়ে উঠুকনা কেন,বস্ত্রহীন কারো সামনে আসার সাহস জুগাতে পারবেনা। সেই জায়গায় অনুভব তার কাছে অসভ্য হলেও অন্যদের কাছে অতুলনীয়! তাহলে কোন সাহসে বাইরে বেরিয়ে এসেছে?? তাহলে কি পেটের দায় খুববেশিই পীড়াদায়ক??
“” এতো রাতে কোথায় যাচ্ছেন,অনুভব ভাই?'”
ভাবীর কন্ঠে রিপ্তির ঘোর কেটেছে। সে নিছকই কাকতালীয়ভাবনায় ডুবে ছিলো। অনুভব আদিমযুগের আদিম পুরুষদের মতো খোলা শরীরে নয়,বড্ডবেশি ঢেকে রেখেছে। কালো সু,কালো প্যান্ট,কালো স্যুটের সাথে লাল টাই ঝুলছে!
অনুভব হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে জবাব দিলো,,
“” একটা জরুরী কাজ আছে,ভাবী।””
“” হঠাৎ?””
অনুভব রিপ্তির দিকে চেয়ে উত্তর দিলো,,
“” হঠাৎ নয়,ভাবী।””
“” তাহলে?””
“” কিছুনা।””
মিন্মি চটপট সময়টা দেখে বললো,,
“” এটা কিন্তু আপনার শহর নয়। অলরেডি দশটা বেজে গিয়েছে৷ রাস্তাঘাট কালো অন্ধকারে ডুবে আছে। খুব জরুরী কিছু কি?? সকালে গেলে হয় না?””
মিন্মির কথায় অনুভব ম্লান হাসলো। তরল কন্ঠে বললো,,
“” আমার জন্ম কিন্তু গ্রামেই হয়েছিলো,উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে শুষে নেওয়ার জন্যই শহরে পড়ে আছি।””
মিন্মিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অনুভব ব্যস্ত পা ফেলে বাইরে।
রিপ্তি এতক্ষণ হা’হয়ে ছিলো। একে তো তার সিউরিটির ভাবনার খাদে পড়ে গিয়েছিলো সে। তার উপর অনুভবের সাজসজ্জাটা ঠিক হজম করতে পারছেনা। একটু আগে গপগপ করে সাবার করা দু প্লেটের ভাত হঠাৎ করেই সারা শরীরে ভার এনে দিলো। লাল ব্যাঙ এমন সাহেব সাহেব সেজে কোথায় যাচ্ছে? তাও এতো রাতে?? আর এমন সাহেবী পোষাক কোথায় পেলো? আমি তো উনার সব জামাকাপড় পুকুরে ফেলে দিয়েছিলাম৷ ম্যাজিক জানে নাকি?? জানতেও পারে কন্ঠের গুরুগম্ভীরতায় তা স্পষ্ট!
অনুভবকে নাজেহাল করতে পেরেছে এমন মহানন্দে যে রাজভোগ সেরেছিলো তা এখন পচন ধরেছে। পেটের ভেতর থেকে বিশ্রী ঢেকুর আসছে। নিজের ঢেকুরে নিজেরই বমি পাচ্ছে। তাও যদি বমিনামক মহাকাজটা সে সারতে পারতো! কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। উল্টো পেট ফুলে বিরাট আকার। সাতমাসের বাচ্চা পেটে থাকলেও এমন ফুলে উঠেনা। কি এক অসস্থি চেপে আছে পেটে। রিপ্তি এদিক ঘুরে শোয়,ওদিক ঘুরে শোয়,বালিশ ছাড়া শোয়,বালিশ পেটের নিচে দিয়ে শোয়,তাও ঘুম আসেনা। পেটের বেদনা টের পাচ্ছে।
ঘুমের সাথে যুদ্ধ করতে সে হয়রান হয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো,সবে ১১টা বাজে! রিপ্তি ঘড়ির দিকে তাকিয়েই রইলো,সময় যাচ্ছে,যাচ্ছে তো যাচ্ছে,সেদিকে রিপ্তির কোনো হুশ নেই। হঠাৎই রিপ্তির নিচের ঠোঁট উল্টে গেলো,চোখের জলেরা উকি দিলো,বড় নিশ্বাস ছেড়ে রিপ্তি চিৎকার করে উঠলো,,,
“” বাবা,আমি বাবার কাছে যাবো!””
~~~
সকালের ছোট্ট রাগের সূত্রধরে মিন্মি তার স্বামীকে খেতে ডাকেনি। রাসেলও বাধ্য স্বামীর মতো একবারও খাবার ঘরে উকি দেয়নি। ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক ঠেকলো মিন্মির কাছে। তারমধ্যে কেমন এক অপরাধবোধ। বিয়ের বয়স মাত্র তো দুদিনে পড়েছে। শ্বশুড়বাড়ীতে এসে জামাই অভুক্ত থাকবে? তাও বউয়ের কথা রাখতে? বড্ডবেশি পাষাণী মনে হলো মিন্মির কাছে। তাই আর তোরজোড় করে রাসেলকে খাবারঘরে ডেকে পাঠালো না। নিজেই খাবার নিয়ে হাজির।
রাসেল দরজার দিকে পিঠ রেখে শুয়ে আছে। মিন্মি চুপচুপ করে প্লেটটা পাশে রাখলো। রাসেলের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,,
“” স্বামী কি ঘুমিয়েছে?””
মিন্মির ডাকে রাসেল চোখ মেললো। ওর দিকে হালকাভাবে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে নিলো।
“” আবার শুলে যে? উঠো খেয়ে নিবে।””
রাসেল উঠে বসলো। মিন্মির দিকে আহতদৃষ্টি ছুড়ে আদ্রকন্ঠে বললো,,
“” তোমার আমাকে পছন্দ নয়,আগে বলতে পারতে,মিন্মি!””
রাসেলের কথাতে মিন্মি স্তম্ভিত। এমন একটা কথা শোনার সামান্যতম প্রস্তুতিও তার ছিলোনা।
“” তুমি হয়তো ভাবছো এ কথা কখন বললে। এতো ভাবার কিছু নেই। তুমি সরাসরি না বললেও ইঙ্গিতে বলেছো। সেটা রাগ থেকেই হোক,আর মজা থেকে। কিন্তু বলেছো। এতে তোমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার। আমি কখনোই কোনোকাজে খুব পারদর্শী ছিলাম না। লেখাপড়াতেও না। কিন্তু বাবার খুশির জন্য আমি আমার চেষ্টার শেষটুকুও ঢেলে দিয়েছি। কারো জীবন কারো জন্য সারাজীবন চলতে পারেনা। আমার বাবার জন্য যতটুকু দেওয়ার, দিয়েছি। কিন্তু শেষ জীবনটা আমি আমার মতো করে চেয়েছি। কলেজজীবনে আমার প্রথম ভালো লাগা তুমি ছিলে। কিন্তু সেই অনুভূতির কথা আমি তোমাকে জানাতে চাইনি। ভয়ে নয়,সাহস নেই, তার জন্যও নয়। বাবার জন্য। তুমি জানো আমার বাবা কেমন প্রকৃতির মানুষ। সম্মাননামক বস্তুটাকে খুব গভীরভাবে দেখেন। আমি চাইনি আমার কোনো ভুল পদক্ষেপে বাবার সম্মানে আঘাত আনুক। অল্পবয়সের প্রেম মারাত্মক হতে পারে। যত ভুল সিদ্ধান্ত,ভুল আকর্ষণ সব এই বয়সেই মারাত্মকভাবে চেপে ধরে। আর সব থেকে বড় কথা,আমাদের গ্রামাঞ্চলের মানুষদের জন্য তখন ছেলে-মেয়ে একসাথে হাটাহাটি করলেও গায়ের মানুষরা নাক সিটকাতো। আমি এতোকিছু বুঝে কি করে তোমার দিকে এগুতাম? তাই সবসময় দুরেই ছিলাম।
একটা নতুন সংসার সাজানোর মতো আয়রোজগার আমার এখনো হয়ে উঠেনি। তারমধ্যেও বাবা চেয়েছেন সংসারে একজন সুশীল নারীর আগমন ঘটুক। তাই আমার বিয়ের আয়োজন। দেখ মিন্মি,আমি ছোটবেলা থেকে বাবার ইচ্ছেতে ছুটেছি। কখনো অমত করিনি। কিন্তু সেই আমিই বউ হিসেবে তোমাকে চেয়ে বসলাম। কারণ,আমার মনে হয়েছিলো বিয়েটা কোনো সংক্ষিপ্ত ইচ্ছে,লক্ষ বা উদ্দেশ্য নয়। বাবা-ছেলের সম্পর্কটা হয়তো হঠাৎ করে নিবে যাবে তারপর? তখন তো আমার বাকি জীবনটা বিয়েনামক বন্ধন থেকে পাওয়া বউটাকে নিয়েই বাঁচতে হবে। সুখে-দুখে ছায়া নয় সশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে। তাহলে সেই দীর্ঘজীবনের মানুষটা নিজের পছন্দসই হওয়া উচিত। কারণ,আমরা পছন্দসই জিনিসটাকে আগলে রাখতে ভালোবাসি। তাই আমি তোমাকে আমার সাথে জড়িয়েছি। কিন্তু সেই তুমি এতোবড় ভুলটা কি করে করতে পারলে মিন্মি? তুমি তো পরীক্ষা হলে ১ নাম্বারের উত্তরটা নিজে জানা থাকা সত্ত্বেও আশেপাশে কয়েকজনের কাছে পুনরায় জিজ্ঞেস করে তারপর লিখতে। তাহলে মনুষ্যজীবনের সবচেয়ে কঠিন সম্পর্কটায় আমার বাবার ইচ্ছেতে কেন জড়ালে?””
রাসেলের দীর্ঘ বয়ানের শেষবাক্যে মিন্মি বুকে আটকে থাকা নিশ্বাসটা ছাড়লো। এতক্ষণে রাসেলের বলতে চাওয়া কথাটা বোধগম্যে এসেছে। তারমানে সকালে কথার খেলায় যে বলেছিলো,তোমার বাবার জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি,এইটা স্বামীসাহেবের মানে লেগেছে!
মিন্মি রাসেলের মুখের দিকে তাকালো। সে এখনো তার উত্তরের অপেক্ষাতে আছে। মিন্মি মুচকি হেঁসে মুহুর্তেই নাকি স্বরে কান্নাজুড়ে দিলো,,,
“” আমার একটা কথার জন্য তুমি আমাকে এতোগুলো কথা শুনাতে পারলে,রাসেল?””
রাসেল ভেবেছিলো,মিন্মিকে কিছু কড়া কথা শুনাবে। কিন্তু কথার সুতো যে একেবেকে অন্যপথে চলে গিয়েছে তা সে খেয়ালই করেনি। এদিকে মিন্মির এমন কাঁদোভঙ্গিতে বোকা বনে গিয়েছে। অজান্তেই মাথার চুলে হাত ঢুকিয়ে চুলকাচ্ছে। তার এখন কি করা উচিত??
“” কে বলেছে আমি শুধু তোমার বাবার কথাতে বিয়ে করেছি। আমি তো তোমাকে…””
রাসেল উৎসাহী কন্ঠে বললো,,
“” আমাকে কি?””
মিন্মির আর রাসেলের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলোনা। মিন্মি সন্দেহকন্ঠে বললো,,
“” এতোরাতে কে কাঁদছে? ওটা রিপ্তির কন্ঠ না?””
~~~
মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে কাদছে রিপ্তি। হাউমাউ করে কাঁদছে। কেঁপে কেঁপে কাঁদছে। চোখে পানির বর্ষণ ঝড়ছে। রিপ্তিকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে মিন্মির আত্মা কেঁপে উঠলো। ভয়ে রাসেলের এক হাত খামচে ধরেছে।
রিপ্তি অশ্রুনয়নে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,,
“” ভাইয়া, ভাইয়া রে। আমাকে বাবার কাছে নিয়ে চল। বাবাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।””
রাসেল মিন্মির হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে বোনের কাছে এলো। বোনের মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে বললো,,
“” লক্ষীবোন আমার। আমরা সকালেই বাবার কাছে যাবো।””
রিপ্তি ভাইয়ার বুক ছেড়ে গলা ফাটিয়ে বললো,,
“” আমি এখনি যাবো। আমার বাবা কই?””
রিপ্তি ভাইয়ের বাধন ছেড়ে আবার হাত-পা ছুড়ে কাঁদছে। রাসেলের চোখেও পানির বন্যা। ভাইবোনের কান্ডে মিন্মি নির্বোধ। রাসেল কড়া গলায় বললো,,,
“” মিন্মি,কাপড় গোছাও। আমরা এখনি বেরোবো!””
“” এখন বেরোবে? কোথায়?””
“” বাবার কাছে!””
“” কিন্তু আমরা তো দুই…””
মিন্মি নিজের বাক্যের মাঝে নিজেই থমকে গেলো। মনে পড়ে গেলো সে রাতের শ্বশুড়ের প্রশ্নটা! “” রিপ্তিকে সাথে নিয়ে যাচ্ছো যাও। কিন্তু সামলাতে পারবে তো বৌমা?””
উনি সেদিন কোন সামলানোর কথা বলেছিলেন? তাহলে কি রিপ্তির মাথায় কোনো..ছি! ছি!!ছি!!! আমি এসব কি ভাবছি??
মিন্মি আর দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকতে পারলোনা। ছুটলো রিপ্তির কাছে।
~~~
“” রিপ্তি মা!””
কান্নার জলসাগরে রিপ্তি ডুবতে চাইলেও মিন্মির জন্য পারেনি। বোনের পাগলামীকে প্রশ্রয় দিয়ে রাসেল যখন ফিরে যাওয়ার তড়িঘড়ি পাকাচ্ছিলো তখন রিপ্তি ওকে আটকে দেয়। প্রখর দৃষ্টি ছুড়ে বলেছিলো,বাবা আমায় ভাবী নয়,মা রুপে চেয়েছিলেন। মা হওয়ার সুযোগটা তো দাও!
মিন্মির শীতলকন্ঠকে পাড়ি দিতে পারলোনা রাসেল। চুপচাপ দুজনের পাশে বসে ছিলো। কি হবে,বা হতে দিচ্ছে কেন সে জানেনা। তবে তার ভালো লাগছে। মনের ভেতর সুপ্ত গর্ব অনুভব করছে,তৃপ্তিবোধ করছে তার পছন্দের মানুষটির জন্য!
মিন্মির প্রবল ইচ্ছে,ভালোবাসার বাধে আটকে পড়ে রিপ্তি। মিন্মির উষ্ণ বুকে মাথা ঠেকিয়ে কান্নার জোয়ারে ভাসলেও এক সময় তা ক্ষীণ হয়ে আসে। পরম মমতাময় আদরে বন্ধ হয়ে আসে রিপ্তির চোখ। মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কি স্বয়ং মাকেই প্রয়োজন?? নাকি মায়ের ভালোবাসা জাগরণের জন্য সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রয়োজন?? মা! সম্বোধনটির জন্য হয়তো জন্ম শব্দটাও চলে আসে। কিন্তু মায়ের ভালোবাসার জন্য জন্ম শব্দটির প্রয়োজন নেই। যেকোনো বয়সে,যে কোনো সম্পর্কে,যে কোনো পরিস্থিতিতে নারীজাতি মায়ের রূপধারণ করতে পারে। ঢেলে দিতে পারে অজস্র ভালোবাসার জোয়ার! তারজন্য শুধু নারীটির মনের ইচ্ছের প্রয়োজন,নিবিড় সাড়া প্রয়োজন!
বাবার মধুরডাকে রিপ্তি চোখ মেললো। ভালোবাসার দীপ্তছায়ার মুখটি দেখেই বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়েছে।
“” তুমি কোথায় ছিলে বাবা? আমার খুব মনে পড়ছিলো। কষ্ট হচ্ছিলো তো!””
“” জানিতো,এজন্যই চলে এলাম।””
রিপ্তি বাবাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে। আহ্লাদে ভুলেই গিয়েছে সে এখন আর ছোটটি নেই। পাশ থেকে রাসেল ঈর্ষা নিয়ে বললো,,,
“”বাবার আদরের উপোস তো আমিও করেছি রিপ্তি,তুই একা কেন ভাঙছিস? আমাকেও ভাঙতে দে!””
“” বাবা,তোমার এই ছেলেটাকে এখান থেকে যেতে বলো তো। সবসময় আমার সাথে হিংসে করে!””
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন কবির হক। মিন্মিও হাসছে।
“” এই বুঝি আপনার জরুরী কাজ,অনুভব ভাই?
“” হয় তো!””
অনুভবের কন্ঠ পেয়ে রিপ্তি দুয়ারের দিকে চায়লো। তার মুখটাও হাস্যোজ্বল। উনি তো চলে গিয়েছিলেন আবার ফিরে এলো কেন? রিপ্তির মনের প্রশ্নের উত্তরটা কি মিন্মি পড়তে পারলো??
“” আপনি কি করে জানলেন,এখন বাবার এখানে প্রয়োজন?””
অনুভব রিপ্তির দিকে তাকালো। রিপ্তির চোখেও প্রশ্নের বাসা। তবে অন্য রকম প্রশ্ন!
“”জানাটা কি খুব জরুরী?””
অনুভব মিন্মির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে চলে এলো। রিপ্তি তখনো অনুভবের দাড়িয়ে থাকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে আছে। তাহলে কি লাল ব্যাঙ বাবাকে আনতে গিয়েছিলো???
~~~
“”আমার পরীক্ষাতে তো তুই পাস,অনুভব। এবার আমি নিশ্চিন্তে চোখের পাতা এক করতে পারবো।””
অনুভব বিনয় নিয়ে ভদ্রতার সাথে বললো
“” এভাবে বলছেন কেন,স্যার? আপনার ছায়া ওদের সবসময় চায়। বিশেষ করে রিপ্তির!””
“” চাইলেই কি সব সম্ভব? তবে কথাটার গভীরত্ব অনুভব কর। তোর নামের মতো। আমি এর মানে চলে যাওয়া নয়,সাথে এটাও বুঝিয়েছি বিশ্বাস আর ভরসার সবটা জায়গা জুরে তুই আছিস!””
“” আপনার শিষ্য আমি। এতো জলদি আপনার গুরুগম্ভীর কথার মানে পড়ে ফেললে যে আপনার সম্মানে লাগবে!””
অনুভবের কথায় বুক ফুলে উঠছেন কবির হকের। ভাগ্যগুনে কয়জন পাই এমন ছাত্রের সন্ধান?? কিছুক্ষণ তৃপ্তভরে অনুভবকে পরোখ করে বললেন,,,
“” এবার কি তাহলে….””
“” না। আমি জানি আমার হাতে সময় কম। তবুও তাড়াহুড়ো করে কোনো ঝামেলা সৃষ্টি করতে চায়না। এতদিন আপনার শুকিয়ে যাওয়া গাছে কুড়ি ফুটানোর চেষ্টায় ছিলাম। এবার যে সেই গাছে ভালোবাসার ফুল ফুটাতে হবে। ততদিন পর্যন্ত আমি অপেক্ষায় থাকবো।””
~~~
ভোরের আযানের সুর রিপ্তির কানে বাজছে। বাবা গভীর ঘুমে। চারপাশটা এখনি ফর্সা আলোয় ছড়িয়ে পড়বে। মিলে যাবে রাতের অন্ধকার কুয়াশা৷ রিপ্তি বাবাকে ছেড়ে উঠে বসলো। লাল ব্যাঙ তারজন্য বাবাকে আনতে গিয়েছিলো এটা এখনো তার কাছে অবিশ্বাস্য! এর মাথায় কি চলছে কে জানে?? নতুন করে আমাকে পরাস্ত করার বুদ্ধী আটেনি তো?? রিপ্তি বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে এগুচ্ছে। যেমনই হোক,যেই কারণেই হোক,উপকার তো তার হয়েছে। আর করেছে তো লাল ব্যাঙই। ছোটখাটো একটা ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। কিন্তু ধন্যবাদ দিলে যদি আমাকে ছোট চোখে দেখে তখন? সইতে পারবো তো? মুখে যদি রাক্ষসী হাসি এনে আমাকে উপহাস করে? ভাবনার মাঝেই রিপ্তি অনুভবের রুমের সামনে চলে এসেছে। এই লোকটার রুম সবসময় খোলা থাকে কেন? রিপ্তি ভেতরে ছোট্ট উকি দিতেই অনুভবকে দেখতে পেলো। জানালায় দাড়িয়ে,শক্ত হাত জানালার শিকে,কানে ফোন,অস্থির আর উদ্বিগ্ন কন্ঠ,,,
“” এ্যাবোরশন? তোমার ভাবনা এতোদুর কি করে গেলো,লিনা? আবার কান্না করছো কেন? লিনা প্লিজ কেঁদোনা,আমি বাবা-মায়ের সাথে কথা বলবো। আমি তো আছি। আমার উপর একটু ভরসা রাখো। আমি বেঁচে থাকতে আমার বংশের প্রথম আলো আমি কিছুতেই নিভতে দিবোনা। তুমি একটু ধৈর্য্য ধরো,আমি কিছুদিনের মধ্যে….””
“” আউচ!””
চলবে