#ভালোবাসায়_ভেজায়_সন্ধ্যে,পর্ব (১৪)
#রোকসানা_রাহমান
“” তুই বলতে চাচ্ছিস লাল ব্যাঙ আমাকে ভালোবাসে? আর সেই ভালোবাসার কথা জানাতে একটা সারপ্রাইজ সাজাতে তোকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো?””
“” হুম। কিন্তু উনি তো কাল আসেনি। আমি এতোবার করে কল দিলাম,ধরলোইনা!””
“” তোকে কে বললো উনি আমায় ভালবাসে?””
“” উনি নিজে বলেছেন।””
“” মিথ্যা বলেছেন।””
“” মিথ্যে বলতে যাবে কেন?””
“” কারণ উনার তুই বাদেও আরো একটি প্রেগন্যান্ট গার্লফ্রেন্ড ও একটি বউ আছে! হতে পারে অধিক প্রেগন্যান্ট গার্লফ্রেন্ড আর অধিক বউ আছে। আমি তো শুধু একটির খোঁজ পেয়েছি!!
তৃণা প্রথম দফায় অবাক হলেও পরক্ষণেই সন্দেহ নিয়ে বললো,,
“” অনুভব ভাইয়া বিবাহিত?””
“” তা নয় তো কি? আমার জানামতে যাদের বউ থাকে তারা বিবাহিতই হয়!””
“” অসম্ভব! উনাকে দেখে তো বিবাহিত মনে হয় না।””
রিপ্তি তৃণার হাত থেকে নিজের ব্রাশটা ছিনিয়ে নিলো। মুখে পুরে অস্পষ্ট কন্ঠে বললো,,
“” তোর জন্য কি উনি বিবাহের চিহ্ন হিসেবে হাতে চুড়ি,নাকে নাকফুল পড়ে বসে থাকবে?? আজকাল মেয়েদের দেখেও তো বুঝা যায়না কে বিবাহিত কে অবিবাহিত।””
তৃণা ছোট্ট চিন্তারঘোরে ঢুকে বললো,,
“” তা ঠিক।””
তৃণা যে এখনো রিপ্তির কথা বিশ্বাস করছেনা তা ওর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। রিপ্তির ইচ্ছে হলো কালকের সব ঘটনা ওকে খুলে বলতে কিন্তু কেমনজানি আলসেমি পাচ্ছে। তাই তৃণাকে চিন্তায় ফেলে রেখেই রিপ্তি মুখ ধুতে পানির খোজে নামলো।
পানি গলায় নিয়ে গরগরানি শুরু করতেই তৃণার জিজ্ঞাসা,,
“” অনুভব ভাইয়া যে বিবাহিত,তুই এতো জোর দিয়ে কিভাবে বলছিস? তুই কি উনার বউকে দেখেছিস?””
রিপ্তি তৃণার কথার কোনো জবাব দিলোনা। মুখ ধোয়া সম্পন্ন করে ওয়াশরুম ছেড়েছে। তৃণা তখনো নিজের প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায়। রিপ্তির অনিচ্ছাসত্ত্বেও বললো,,
“” কাল উনার মোবাইলে বউ নামের এক মহিলা কল করেছিলেন।””
এইবার তৃণার মুখের পরিবর্তনতা বাড়ছে। কিছুক্ষণ থম মেরে থাকলেও হুট করেই বলা শুরু করলো,,
“”তাহলে কি অনুভব ভাইয়া বউয়ের কাছে চলে গেলো? আমাকে এভাবে ছ্যাকা দিতে পারলো?””
রিপ্তির ভ্রূ কুঁচকে গেলো,,
“” তোকে ছ্যাকা দিয়েছে?””
“” তা নয় তো কি?? আমি কতদিন ধরে আশায় আশায় রয়েছি,তোরা প্রেম করবি আর আমি পাহারা দিবো। বিনে পয়সায় পাহারা নয়,এদিক থেকে আর ওদিক থেকে,দুদিক থেকেই গিফটের পাহাড় বানাবো।””
“” ব্ল্যাকমেইল?””
তৃণা রিপ্তির ধারে এসে নরমসুরে বললো,,
“” হ!””
রিপ্তি তৃণাকে দুরে ঠেলে বললো,,
“” ছি! বান্ধুবী হয়ে বান্ধুবীকে ব্ল্যাকমেইল করতি? বেশ হয়েছে আমার প্রেম হয়নি। আমার অনেকগুলো টাকা বেঁচে গেলো।””
তৃণা মুখ বাকিয়ে ভেংচি কাটলো। চলে যাবে নাকি ভাবছে তারমাঝেই গলারসুর উচু করে বললো,,
“” চল প্রতিশোধ নেই!””
“” কিসের?””
“” এই যে অনুভব ভাইয়া আমাকে এতোবড় ছ্যাকা দিলো তার!””
রিপ্তি বিছানার চাদর টেনে ঠিকঠাক করে তৃণার দিকে ঘুরলো,,
“” তুই ছ্যাকা খেয়েছিস তুই প্রতিশোধ নে। আমাকে টানছিস কেন??””
তৃণা আহ্লাদীসুরে বললো,,
“” বান্ধুবী,বান্ধবীকে টানবে না তো কে টানবে? তাছাড়া প্রতিশোধের অস্ত্র তো তোর কাছে!””
“” অস্ত্র? কিসের অস্ত্র?””
“” উনার বউয়ের নাম্বার!””
“” বউয়ের নাম্বার?””
“” হুম। তোর কাছে আছে। ওটা লাগবে।””
রিপ্তি বিরক্ত নিয়ে বললো,,
“” আমি তোকে কখন বললাম উনার বউয়ের নাম্বার আমার কাছে আছে?””
তৃণা উৎসাহ নিয়ে রিপ্তিকে নিয়ে বিছানায় বসলো। দরাজ গলায় বললো,,
“” তুই তো বলেছিলি কাল উনার বউয়ের কল দেখেছিস। তারমানে নাম্বারও দেখেছিস।””
“” দেখেছি,মুখস্ত করিনি।””
রিপ্তি পরিষ্কার জবাব দিয়ে উঠে পড়তে নিলে তৃণা ওকে আবার বসিয়ে দিলো। নিজের ফোনটা ওর সামনে ধরে বললো,,
“” স্মৃতিশক্তিকে কাজে লাগা। চোখ বন্ধ করে মনে করবি আর মোবাইলে তুলবি। একদম সিম্পল!””
“” একবার দেখে এতোবড় নাম্বার মুখস্ত হয়ে যাবে? আমাকে কি তোর রোবট মনে হয়??””
“” তার থেকেও বেশি কিছু। একটু ট্রাই করে তো দেখ!””
রিপ্তি বিরক্তের চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছে। কালরাতে অনুভবের ফোনে ওর নাম্বারটা দেখাতেই মাথার ভেতর রাগ জমে আছে। ইচ্ছে তো করছিলো তখনি রাস্তা পেরিয়ে ওর দুগালে কষে কয়েকটা চড় মেরে আসে। কিন্তু চড়টা গিয়ে পড়লো অনুভবের গালে। গালটা কেমন লাল হয়ে গিয়েছিলো। রিপ্তির হাতে যে এতো শক্তি উনাকে চড় না মারলে জানতোইনা। এই মুহুর্তে সেই রাগটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। চড়টা কি মেরেই ফেলবে?? তৃণার গালের দিকে স্থিরভাবে চেয়ে আছে রিপ্তি। অমন শক্ত একটা মানুষের গাল লাল করতে পারলে ওর পারবে না?? রিপ্তি নিজের হাতের তালুর দিকে তাকাতেই তৃণার আবেদনীসুর,,,
“” কিরে মনে পড়লো?””
রিপ্তি ভাবনাজগৎ থেকে বেরিয়ে এলো। তৃণার বাড়িয়ে দেওয়া ফোনটার দিকে চেয়ে আছে। তৃণার কান্ডকারখানায় সে বিরক্ত হলেও মনের কোনো এক কোন চাইছে সেই বউ নামের মেয়েটার কন্ঠস্বর শুনতে! কিন্তু একবার দেখাতে কি নাম্বার মনে রাখা সম্ভব? তাও সময়ের তফাৎটাও অনেক। রিপ্তি ফোনটা হাতে নিলো। চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করছে। প্রথম কয়েকটা নাম্বার মনে পড়ছে। বাকিগুলো কেমন ঝাপসা।
রিপ্তি ব্যর্থমনে, মনে থাকা নাম্বারগুলো তুললো। তৃণাকে হতাশ করতে তার ভালো লাগছেনা। এমন আশা নিয়ে অপেক্ষায় আছে! চারপাশটা নাম্বার তুলতেই রিপ্তির মনে হলো এই নাম্বারটা সে একবার নয়,কয়েকবার দেখেছে। নাম্বারটা সে চিনে,শুধু চেনেইনা পুরো নাম্বারটা তার মাথায় সংরক্ষিত। রিপ্তি ঝটপট নাম্বার তুলে ফোন লাগালো। ঐপাশে একবার রিং বাজতেই ভাবীর কন্ঠ ভেসে এলো,,
“” এই রিপ্তি,দেখ তো আমাকে আবার কে কল করলো? আমার হাতে আটা,চুলায় রুটি। পুরে যাবে!””
ভাবীর কন্ঠে রিপ্তির সাথে সাথে তৃণাও ছিটকে উঠেছে। দুজনের চোখেই চোখ পড়লো। মুখে কোনো শব্দ নেই। চোখে চোখে কথা বলে নিয়ে দৌড় লাগালো ভাবীর রুমে। রিপ্তি আগে,তৃণা তার পিছে। রিপ্তি ভাবীর রুমের দরজার সামনে আচমকা দাড়িয়ে পড়ায় তৃণা ওর উপরে এসে পড়লো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,,
“” দাড়িয়ে পড়লি যে?””
অদূর ভবিষ্যতের ভাবনা নিয়ে রিপ্তি ধীরগলায় বললো,,
“”আমরা যা ভাবছি, যদি তাই হয়?””
“” আগে তো দেখি। অন্যকারো কলও তো হতে পারে? একি সময় দুটো ফোন বাজতে পারেনা?””
বান্ধুবীর আসস্তবুলিতে রিপ্তি তেমন ভরসা পাচ্ছেনা। কিন্তু সন্দেহ দুর না করে ফিরেও যেতে ইচ্ছে করছেনা। রিপ্তি শুকনো গলা ভিজিয়ে ভাবীর রুমে পা রাখলো। ফোনটা তখনো বেজে যাচ্ছে। শব্দ অনুসরণ করে খোজছে। আশেপাশে কোথাও চোখে পড়ছেনা। শব্দ সামনের দিক থেকেই আসছে। বিছানাতেই হয় তো। কিন্তু দেখা যাচ্ছেনা কেন? তৃণা রিপ্তির পদক্ষেপ অনুসরণ করে ওর পিছুপিছু ঘুরছে। ও যেদিকে তাকাচ্ছে সেও সেদিকেই তাকাচ্ছে। এই মুহুর্তে এটাই তার মুখ্য কাজ। যাতে মন লাগিয়েছে পুরোদমে।
রিপ্তি বিছানার কাছে এসে ভাবীর বালিশের নিচে হাত দিলো। মনে মনে চলছে হাজারও দোয়া পাঠ। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করছে,যা ভাবছি তা যেন না হয়! আমি ভাবীকে পছন্দ করি,অনেক পছন্দ!
রিপ্তিকে অনুলিপি করতে করতে তৃণা হাঁপিয়ে উঠেছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। শুধু শুধু সময় নিয়ে দুজনেই আতঙ্কে ভুগছে। সে অনুলিপি করা থামিয়ে রিপ্তির দিকে তাকালো। রিপ্তিকে অভাবে থমকে থাকতে দেখে তার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেলো। নিজেই চট করে বালিশটা সরিয়ে দিলো। রিপ্তির হাত থেকে ছো মেরে ফোনটা নিবে,তখনি,,
“” এইটা তো আমার ফোনের মতো দেখতে!””
তৃণা ফোনটার দিকে ভালো করে তাকালো। ফোনটা হাতে নিতেই,ভাবীর আগমন,,
“” ওটা তোমার মোবাইলের মতো দেখতে নয়,বরং ওটা তোমারি ফোন!””
রিপ্তি আর তৃণা দুজনেই চমকে গেলো। যেন চোর চুরি করতে এসে ধরা খেয়েছে। মিন্মির হাতে এখনো আটা লেগে আছে। ব্যস্তগলায় বললো,,
“” কাল আসার পথে আমার ফোনটা আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। রাসেল কাল এনে দিবে। একদিন যদিও ফোন ছাড়া থাকতে তেমন অসুবিধা হওয়ার কথানা। তবুও বাবা এই ফোনটা আমাকে দিয়ে বললেন,যতদিননা আমার ফোনটা আসছে ততদিন এটা চালাতে। প্রয়োজনে কাজে লাগতে পারে! বাসায় তো পড়েই আছে!””
রিপ্তি আড়ষ্ট গলায় বললো,,
“” সিম?””
“” তোমারই!””
রিপ্তির ছোট্ট প্রশ্নের ছোট্ট উত্তর দিয়েই মিন্মি রান্নাঘরে ছুটলো। চুলায় রুটি রেখে এসেছে পুড়ে গেলো নাকি। সকালটাও ভালো করে ফুটে গিয়েছে। আজ নাস্তা সাজাতে অনেক দেরি হয়ে গেলো!
তৃণা অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে আছে রিপ্তির দিকে। রিপ্তি সবটা সামলে নিতে নিজেই সাফাই দেওয়া শুরু করলো,,
“” অমন করে তাকানোর কি আছে? আমার এইচ.এস.সির পরেই তো বাবা আমাকে ফোন কিনে দিয়েছিলো। তারপর ইউনিভার্সিটির এডমিশন টেস্টের জন্য কোচিংয়ে ভর্তি করালেন। আর পড়ার দোহাই দিয়ে ফোনটা নিয়ে গেলো। বলেছিলো ইউভার্সিটিতে যখন ভর্তি হবো তখন দিবে। আমি তো মাত্র এক সপ্তাহের মতো ফোনটা চালিয়েছিলাম। নাম্বারটা তোকে দেওয়ার জন্য মুখস্ত করে ছিলাম!””
“” তাই বলে নিজের নাম্বার নিজে চিনবি না?””
“” তখন এতো খেয়াল করিনি!””
তৃণা কয়েকটা ঝাড়ি শুনাতে চেয়েও শুনালোনা। সরাসরি অন্যকথাতে চলে গেলো,,
“” তারমানে অনুভব ভাইয়ার বউ তুই? ও মাইগড,তোরা বিয়ে করলি কবে?””
রিপ্তি ছোটখাটো ভিষম খেলো। জড়ানোকন্ঠে বললো,,
“” বিয়ে? বউ? ঐ লাল ব্যাঙের? ছি! উনার সাথে তো আমার ঠিকঠাক কথাই হয়নি!””
তৃণার সন্দেহকন্ঠ,,
“” তাহলে তোর নাম্বার উনি বউ লিখে সেভ করলো কেন?””
রিপ্তি তৃণার কাছ থেকে কিছুটা সরে এলো। অন্যদিকে ঘুরে বললো,,
“” আমি কি করে জানবো? আমি তো উনাকে নাম্বার দেইনি!””
তৃণা রিপ্তির সামনে এসে ওকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। কিছু সময় পর আমোদিত কন্ঠে বললো,,
“” সে যাই হোক। আমার অনুভব ভাইয়া যে বিশুদ্ধ অবিবাহিত তা তো প্রমাণ হলো? যদি কালি লেগে থাকে সেটা তুই লাগিয়েছিস। কারণ বউনামক মেয়েটি তুই!””
তৃণার যুক্তিতে রিপ্তি একমত না হতে পারলেও,মনের ভেতরটা এখন পরিষ্কার লাগছে। সারারাত সে ঘুমুতে পারেনি। চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছিলো ধারালো কাঁটা মনে আঘাত হানছে। এখন একটু সস্থি। ভালো লাগছে,খুশি লাগছে। কিন্তু এই খুশির কারণ কোনটা? অনুভব আনম্যারেড তাই? নাকি বউনামক মেয়েটি সে দেখে???
“” এবার তো মানছিস,অনুভব ভাইয়া তোকে ভালোবাসে?””
“” না।””
“” কেন?””
“” কারণ তার বউঘটিত সন্দেহটা দুর হলেও প্রেগন্যান্ট গার্লফ্রেন্ডের সন্দেহ তীর এখনো আছে। ওটা মিথ্যে হতে পারেনা। আমি নিজের কানে উনার সব কথা শুনেছি। আর হ্যা,ঐ মেয়েটা যে আমি নই সেটা নিশ্চয় তুই বুঝতে পারছিস?””
তৃণার আমোদি চেহারায় আবার ময়লা পানি পড়লো। মুখ কালো করে রিপ্তির দিকে চেয়ে আছে। রিপ্তি দরজার দিকে পা ফেলতে ফেলতে বললো,,
“” ক্ষুধা লেগেছে। আমি খেতে গেলাম। তুই কি খেয়ে এসেছিস?””
তৃণা কোনো উত্তর দিলোনা। নিঃশব্দে রিপ্তির পিছু পিছু খাবারঘরের দিকে যাচ্ছে। মাঝপথেই সে হঠাৎ চিৎকার করে বললো,,
“” হতে পারে অনুভব ভাইয়ার বড় ভাই আছে? লিনা হয়তো তার গার্লফ্রেন্ড। বাচ্চাটাও…””
তৃণার কথা শেষ হওয়ার আগে,মিন্মি গরম রুটি নিয়ে হাজির। তৃণাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো,,
“” অনুভব ভাইয়ার বড় ভাই নেই। উনিই বড়।””
তৃণার আশার আলো ধপ করে নিভে গেলো। অন্ধকারটা তৃণাকে কতটা ছুলো তা না জানলেও রিপ্তিকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলেছে। দুজনকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে মিন্মিই আবার বললো,,
“” লিনাকে?””
অনুভবকে নিয়ে আর কোনো ধরনের কথা শুনতে ইচ্ছে করছেনা রিপ্তির। কিছুক্ষণ আগেও সে অপরাধবোধে ভুগেছে। অনুভবকে থাপ্পড় মারার অপরাধে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে কোনো ভুল করেনি। বিয়ের আগে একটা মেয়েকে প্রেগন্যান্ট বানিয়ে দেওয়া অন্যায়,ঘোর অন্যায়। প্রেম হতে পারে,ভালোবাসা হতে,একটু ঘনিষ্ঠও হতে পারে,তাই বলে অতদুর? ছি! এমন নোংরা মানুষের সাথে কথা বলার জন্য আমি এতো ছটফট করেছিলাম? ভাবতেই গা গুলাচ্ছে। না জানি এমন কত বাবুওয়ালা মেয়েবন্ধু উনার! নষ্ট শরীরের লোক একটা! রিপ্তি গরম রুটি ছিড়ে টুকরো টুকরো করে বললো,,
“” কেউনা। বাবা কোথায়? ভাইয়া বাজার থেকে আসেনি?””
~~~
রিপ্তি বাবার রুমে দাড়িয়ে আছে অনেক্ষণ। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে বাবা তার রুমে যায়। তাকে গল্প শোনায়,মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়,কপালে চুমু খান। ফেরত আসার সময় বলেন,মা,তুমি এখন বড় হয়েছো তাই আমার সাথে ঘুৃমানো নিষেধ। মেয়েরা বড় হলে,বাবা,ভাই,মামা,চাচা সম্পর্কের আগে পুরুষ শব্দটা আগে আনতে হয় বুঝলে? তোমার যাতে ভয় না হয় তাই তোমার নানি তোমার সাথে ঘুৃমায়। তবুও যদি বেশি খারাপ লাগে,আমার সাথে ঘুমুতে ইচ্ছে হয়,তাহলে আমার রুমের দরজা খোলা আছে। তুমি চলে এসো। কেমন??
রোজ এক কথা শুনতে শুনতে রিপ্তির মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। তবে আজ ব্যতিক্রম। বাবা রুমে যায়নি। কাজের মেয়েটিকে দিয়ে ডাক পাঠিয়েছিলো। রিপ্তি তখন বাবার অপেক্ষায় আধঘুমেতে। এমন ভাঙা ঘুমে তার উঠতে ইচ্ছে করছিলোনা। কিন্তু বাবার ডাককি ফেরাতে পারে?? ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে বাবার রুমে হাজির হয়েছে। কিন্তু আসার পর থেকে সে বাবাকে রুমের মাঝখানে হাঁটতে দেখতে পাচ্ছে। এদিক থেকে ঐদিকে ব্যস্ত পায়ের পায়চারী চলছে,কপালে চিন্তার ভাজ! রিপ্তি আর অপেক্ষা করতে পারলোনা। ছোট্ট করে বললো,,
“” কিছু হয়েছে,বাবা? তোমাকে চিন্তিত লাগছে!””
কবির সাহেব ব্যস্ত পা স্থির করলেন। মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে পরক্ষণেই আবার হাঁটা শুরু করেছেন। তারমাঝেই বললেন,,
“” তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছো!””
রিপ্তির চোখ চকচক করছে। অনেকটা উৎফুল্ল নিয়ে বললো,,
“” সত্যি,বাবা?””
“” হুম!””
বাবার গম্ভীর উত্তরে রিপ্তির খুশিভাব মিলিয়ে গেলো। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার কোনো ইচ্ছে বা স্বপ্ন তার ছিলোনা। যা ছিলো তা বাবার। বাবার ইচ্ছেতেই সে কোচিং করেছে,রাত জেগে পড়েছে। কিন্তু সেই বাবার মুখে খুশির ছটা দেখতে পারছেনা কেন? তবে কি বাবা খুশি নন? রিপ্তির মনের প্রশ্ন মনেই চাপা পড়লো,কবির সাহেব আরেকচক্র শেষ করে বললেন,,
“” তোমাকে এখন আরো বেশি পড়তে হবে। কারণ তোমাকে ইংলিশ বিভাগে সিলেক্ট করেছে!””
বাবার কথায় রিপ্তির মাথায় বাজ পড়লো। অজান্তেই রিপ্তির ডান হাতটা মাথায় গিয়ে পড়েছে,যেন সে কোনো মহামসিবতে পড়েছে। বিভ্রান্তভরা কন্ঠে বললো,,
“” কিন্তু আমি তো ‘সি’ ইউনিটে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ইংলিশ কি করে এলো? এটা কি করে সম্ভব?””
কবির সাহেব হাঁটা বন্ধ করলেন। ক্লান্ত শরীরে বিছানায় বসলেন। হ্যা রিপ্তির এই প্রশ্নের উত্তরটা নিয়েই এতো উদ্বিগ্ন। ইংলিশ কি করে এলো? এমন অসম্ভব ঘটনা কি করে ঘটলো?? রিপ্তির পরীক্ষার রেজাল্ট কালকেই বেরিয়েছিলো। উনি নিজেই চেক করেছিলেন। রিপ্তি ওয়েটিং লিস্টে ছিলো,তাও অনেক দুরবর্তীতে। সে জায়গা থেকে সিট পাওয়াই অনেক কঠিন। কবির সাহেব আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। মেয়েকে পরে এক সময় বলবেন ভেবে রেখেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। সেখান থেকেই জানা রিপ্তির ইংলিশ বিষয়ের ব্যাপারটা। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। তাই নানা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঐপাশ থেকে স্বল্পবাক্যে এইটুকু বলেছেন,কারো গুপ্ত সুপারিশে এই অসম্ভব কার্য সম্ভব হয়েছে। তিনি ভেবেই পাচ্ছেননা এই গুপ্ত সুপারিশকারকটি কে? একবার অনুভবের কথা মাথায় আসলেও পরক্ষণেই তা বাদ করেছেন। কারণ, সেও একজন স্টুডেন্ট। তার সুপারিশ কর্নগোচর হওয়ার কথা ভাবাও বোকামী। তাহলে কে? কে করেছে এই অসম্ভবকে সম্ভব?
“” বাবা,আমার মনে হয় তুমি ভুল দেখেছো,নাহয় রোল নাম্বার গুলিয়ে ফেলেছো!””
“” কিছু ভুল হয়নি। তুমি পড়াশোনার তৈয়ারী শুরু করো।””
রিপ্তি দৌড়ে বাবার কাছে এলো,,
“” বাবা,আমি ইংলিশ নিয়ে পড়বোনা। তুমি তো জানো আমি ইংলিশে কত কাঁচা। আমি নির্ঘাত খেল করে বসে থাকবো!””
কবির সাহেব মেয়ের দিকে ঘুরলেন। মাথায় হাত রাখলেন,আদুরী গলায় বললেন,,
“” ক্লাস থ্রিতে তুমি ইংলিশে সর্বোচ্চ নাম্বার উঠিয়েছিলে। জে.এস.সিতে তোমার ‘এ+’ এসেছিলো।””
“” কিন্তু এস.এস.সি তে তো ‘সি’ আর এইচ.এস.সি তেও…””
“”আমি জানি তুমি পারবে। আর যদি ফেল করো আমার কোনো আপত্তি নেই। তোমার পড়াশুড়া করতে হবেনা। ক্লাস অ্যাটেন্ড করলেই হবে।””
রিপ্তি বাবাকে পিছু হটাতে পারবেনা দেখে বললো,,
“” সেটা কি করে? আমি হোস্টেলে থাকতে পারবোনা।””
“” সমস্যা নেই। মোহাম্মদপুরে আমার ছোটবেলা বন্ধু আছেন। ওখানে থাকবে,ওর একটা তোমার বয়েসী মেয়েও আছে। তারসাথে থাকবে।””
রিপ্তি বাবার হাত সরিয়ে ফেললো। কঠিন গলায় বললো,,
“” আমি এখান থেকে গিয়ে পড়বো। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিনা। যদি এতে তোমার সম্মতি থাকে তবেই আমি ভর্তি হবো। নাহলে না।””
চলবে