#বিবশ_রজনী
#পর্ব_দুই
…..
দুপুর বারোটা, নিজাম সাহেব ল্যাবে ঘুমিয়ে আছেন। ল্যাবঘরে সূর্যের আলো, বাইরের শব্দ প্রবেশ করতে পারে না এবং ঘরের এসির তাপমাত্রা সবসময় আঠারো ডিগ্রীতে দেওয়া থাকার কারণে রাত-দিনের পার্থক্য খুব একটা বোঝা যায় না। নিজাম সাহেব খুব যত্নের সাথে ল্যাব সাজিয়েছেন। তাঁর কাছে বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা নিয়ে মানুষ আসে। মনের সমস্যার কথা বলতে মানুষ সবচেয়ে বেশি সংকোচে ভোগে। মানসিক সমস্যার সাথে পরিবেশের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে, মানুষ সব কথা সব পরিবেশে বলতে পারে না, সেজন্যেই নিজাম সাহেব ল্যাবঘর এমনভাবে সাজিয়েছেন যেন মানুষ নিঃসংকোচে তাদের সমস্যার কথা বলতে পারে।
হামিদুল ল্যাবঘরে এসে নিজাম সাহেবকে ডেকে তুলে বলল, “বুয়া আসছে, কি রাঁধবে?”
নিজাম সাহেব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “বারোটা বেজে গেছে!”
–“আমি আরও একবার তোমাকে ডেকে গেছি।”
নিজাম সাহেব অবাক হয়ে বললেন,
“বলিস কী! আমি টের পাইনি?”
–“ঘুমের মধ্যে একবার বললে, আরেকটু ঘুমাবো।”
–“কী! সত্যি এমন কিছু বলেছি?”
–“বিশ্বাস না হলে সিসি ক্যামেরা তো আছে, দেখে নাও।”
–“ভাল কথা বলেছিস, চল দেখি দুপুরে কি খাওয়া যায়।”
নিজাম সাহেব হামিদুলকে নিয়ে ল্যাব থেকে বের হয়ে ঘরে গেলেন। বিউটি জিজ্ঞাসা করলো, “ভাইজান আজকে কি রাঁধবো?”
নিজাম সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “বেশকিছুদিন থেকে তো বাজার করি না। তরি-তরকারি আছে কিছু?”
–“ফ্রীজে সবজি আছে তবে বেশি একটা সুবিধার না। মাছ-মাংস কিছু খাবেন?”
–“তাহলে বাদ দাও, আজ আমি হামিদুলকে নিয়ে বাইরে কিছু খেয়ে নেবো। তোমার জামাইটার কি খবর?”
–“সে ইদানিং আবারও নেশা করতে শুরু করেছে, টাকার জন্যে যন্ত্রণা করে।”
–“রিকশা না কিনে দিলে, চালায় না?”
–“সে তো কবেই বেচে সাবাড় করেছে। তাহলে ভাইজান আজকে আমি চলে যাই।”
বিউটি চলে গেল, নিজাম সাহেব মুখ-হাত ধুয়ে হামিদুলকে বললেন,
“চল কিছু খেয়ে আসি।”
বাইরে খাবারের প্রস্তাব পেয়ে হামিদুল ঝটপট রেডি হয়ে বলল, “আমি রেডি।”
নিজাম সাহেব হামিদুলকে নিয়ে হোটেলে গিয়ে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবজি বাজারে ঢুকলেন। বাজার থেকে সবজি কিনে তিনি হামিদুলকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গোসল করে ল্যাবঘরে চলে গেলেন।
হামিদুলের কথা মতো নিজাম সাহেব সিসি ফুটেজ দেখতে শুরু করলেন। সিসি ফুটেজে তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন, হামিদুল তাকে ডাকছে, হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, “আরেকটু ঘুমাই।”
হামিদুলের সাথে কথা বলার সময় তাঁর চোখদুটো বন্ধ ছিল। নিজাম সাহেব ভাবলেন, “মানুষ ঘুমিয়ে গেলেও তাদের মস্তিষ্ক তো সচলই থাকে তাহলে হামিদুলের সাথে কথোপকথনের কথা তাঁর স্মৃতি থেকে মুছে গেল কি করে?”
বেশকিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে নিজাম সাহেব নিজেকে নিজেই বললেন, “কিছুদিন থেকে তাঁর ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না, সেজন্যেই হয়তো হামিদুলের সাথে কথোপকথনের বিষয়টি তাঁর মনে নেই।”
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। নিজাম সাহেব নাইট ভিশন ক্যামেরা, মাইক্রোফোন গুছিয়ে নিলেন। রাত বারোটার দিকে তিনি ঈশানদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন বলে মনস্থির করলেন। হামিদুলকে নিয়ে তিনি বেশ চিন্তার মধ্যে পড়েছেন, হামিদুলকে বাসায় একা রেখে যাওয়া কি ঠিক হবে? আবারও যদি ভয় পায়? রাতে জানালার কাঁচ ভাঙ্গার ঘটনায় সে বেশ ভয় পেয়েছে। হামিদুলকে নিয়ে যাওয়া যেত যদি সে সর্দি-কাশি বাঁধিয়ে বসে না থাকতো৷ রাতের বেলা তাপমাত্রা কম থাকে তাছাড়া হামিদুলের এখন রাতের বেলা ঘুমের প্রয়োজন। সর্দি-কাশি হঠাৎ যেমনি হয় তেমনি হঠাৎ ভালোও হয়ে যায়। নিজাম সাহেবের ধারণা অধিকাংশ সময় ঘুমের মধ্যেই সর্দিকাশির ব্যামো ভালো হয়ে যায়।
নিজাম সাহেব বাসা থেকে বের হয়ে রাতের খাবার কিনে এনে হামিদুলকে নিয়ে খেতে বসলেন। হামিদুল সর্বদাই বাইরের খাবার পছন্দ করে। বাইরের খাবার সে যেমন তৃপ্তি নিয়ে খায়, বাসায় বুয়ার রান্না ততটাই বিরক্ত হয়ে খায়, যদি ক্ষুধা না লাগতো তাহলে সম্ভবত সে খেতো না। সর্দি-কাশির জন্যে হামিদুলের খাবারের প্রতি খুব একটা রুচি নেই। দুপুরে হোটেলে বসেও সে অর্ধেকটা খাবার নষ্ট করেছে, এখনো তার হাব-ভাব দেখে নিজাম সাহেব বললেন, “কিরে খেতে ইচ্ছা করছে না? তোর পছন্দের বিরিয়ানি নিয়ে এলাম, তুই তো খাচ্ছিসই না, মনে হচ্ছে খেতে ইচ্ছা করছে না।”
হামিদুল বলল, “খেতে কেমন জানি লাগে।”
–“আচ্ছা, খেতে ইচ্ছা না করলে জোর করে খাবার প্রয়োজন নেই।”
হামিদুল এরপরও দুই লোকমা বিরিয়ানি মুখে দিয়ে প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নিজাম সাহেব হামিদুলকে বললেন, “আমাকে তো আজকেও বের হতে হবে, ফিরতে ফিরতে সকাল হয়ে যেতে পারে, ভয় পাবি?”
হামিদুল মৃদু গলায় বলল, “না।”
নিজাম সাহেবের মনে হলো, হামিদুল ভয় পেলেও কিছু বলবে না, তবে মাঝে মাঝে বাচ্চাদের ভয় পেতে হয়, নাহলে তারা সাহসী হবে কি করে?
হামিদুলকে বাসায় রেখে নিজাম সাহেব গাড়ি নিয়ে ঈশানদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
রাত দুইটা বাজার আগেই নিজাম সাহেব ঈশানদের বাড়ির ছাদে, সিঁড়িতে দ্রুত ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন সেট করে ফেললেন।
ঘড়ির কাটায় রাত ঠিক দুইটা বাজতেই ঈশান ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেল।
নিজাম সাহেব ঈশানের ঘরে গিয়ে ঈশানের বিছানায় বালিশের ঠিক পেছন দিকে বিছানার বক্সে ক্ষুদ্র মাপের একটা মাইক্রোফোন রাখলেন।
ঈশান রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। কিছু সময় পর পর তার ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছে। নিজাম সাহেব নিঃশব্দে রাত তিনটা পর্যন্ত ঈশানকে পর্যবেক্ষণ করলেন। রাত তিনটায় ঈশান রেলিং থেকে নেমে ঘরে চলে গেল।
নিজাম সাহেব দ্রুত ক্যামেরা, মাইক্রোফোন গুছিয়ে ব্যাগে ভরে নিচে নেমে আসলেন। ঈশানের বাবা আব্দুল মালেক সাহেব তাঁর জন্যে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। নিজাম সাহেবকে দেখতেই তিনি বললেন, “আসুন ভাই, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”
নিজাম সাহেব মালেক সাহেবের সাথে বসার ঘরের সোফায় গিয়ে বসলেন। মালেক সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “ঈশানকে কেমন দেখলেন? ওর সমস্যাটা ঠিক কী?”
নিজাম সাহেব বললেন, “সমস্যা ঠিক কি এখনই বলতে পারছি না, সময় দিতে হবে।”
–“সময় নিন, কিন্তু আমার ছেলেটাকে রক্ষা করুন। ছেলেকে নিয়ে প্রতিটা রাত আতংকে থাকি।”
নিজাম সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা আপনাদের বংশে এরকম সমস্যা আর কারও ছিল?”
–“নাহ।”
–“ঈশানের মায়ের বংশে?”
–“নাহ, এরকম কারও কথা ঈশানের মা কখনো বলেনি, আমি বরং এক কাজ করি ঈশানের মাকে নিয়ে আসি আপনি ওর সাথে কথা বলুন।”
মালেক সাহেব বসার ঘর থেকে উঠে ভেতরের ঘরে গিয়ে ঈশানের মা নাজিয়া আফরোজ সমেত পুনরায় বসার ঘরে এসে বসলেন।
নিজাম সাহেবের বুঝতে বাকি রইলো না, ঈশানের জন্যে রাত জেগে চিন্তা করতে করতে ভদ্রমহিলার চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। তিনি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাচ্ছিলেন না হঠাৎ মালেক সাহেব সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনারা কথা বলুন আমি আসছি।”
মিসেস নাজিয়া আফরোজ নিজাম সাহেবকে বললেন, “কিছু বলবেন?”
নিজাম সাহেব মৃদুগলায় বললেন, “আমি বুঝতে পারছি ঈশানের চিন্তায় আপনারা কেউই ভাল নেই। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো ঈশানকে এই সমস্যা থেকে মুক্ত করার। আচ্ছা আপনাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কারও কি ঈশানের মতো এমন সমস্যা ছিল?”
–“নাহ।”
–“ঈশান ছোট থাকতে বড় ধরনের কোনো ভয় পেয়েছিল কখনো? অথবা কোনো দূর্ঘটনায় শরীরে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে কখনো?”
–“নাহ এরকম কিছু হয়নি।”
–“ঈশানের এরকম সমস্যার পেছনে কি কি কারণ থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?”
–“আমি সঠিক জানি না। ছেলেটার হঠাৎ কি যেন হলো, মাসখানেক কারও সাথে তেমন কথা-বার্তা বলেনি, দরজা বন্ধ করে ঘরে পড়ে থেকেছে। দিনে একটা বেলাও ঠিকমতো খেতো না। আমি অসংখ্যবার জিজ্ঞাসা করেছি কি হয়েছে, ও আমাকে কিছু বলেনি।”
–“আচ্ছা, ঈশান কি কখনো নেশাগ্রস্থ ছিল?”
–“নাহ, ও আমার জানামতে কখনো সিগারেটও স্পর্শ করেনি।”
–“ঠিক আছে, আমি আজ উঠি।”
–“সে কি বসুন, আপনি গত রাতেও এলেন কিছু আপ্যায়ন করতে পারিনি, আজও খালিমুখে যাবেন তাই কি হয়?”
নিজাম সাহেব হেসে বললেন, “এত রাতে ঝামেলা করবার কোনো প্রয়োজন নেই।”
–“না না, আপনি বসুন, অন্তত এক কাপ চা খেয়ে তারপর যাবেন।”
–“আরেকদিন খাওয়া যাবে, আমাকে আরও অনেকবার আপনাদের বাসায় আসতে হতে পারে, আমি খুব চা খাই, তখন বার বার বিরক্ত করবো। আজ উঠছি।”
নিজাম সাহেব বসার ঘর থেকে ব্যাগ হাতে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়িতে উঠে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলেন। রাতের শহরের নিরব পরিবেশ তিনি ভীষণ পছন্দ করেন। দিনের আলোর সকল কোলাহল রাতের কাছে এসে থেমে যায়। তিনি দ্রুত গতিতে ওয়ারীর দিকে গাড়ি ছোটালেন।
নিজাম সাহেব বাসায় এসে গাড়ি পার্ক করে দোতলায় গিয়ে দেখলেন, হামিদুল অঘোরে ঘুমিয়ে আছে। হামিদুলকে ঘুমাতে দেখে তিনি স্বস্তির শ্বাস ফেললেন।
…..
#চলবে
লেখা-
নাহিদ হাসান নিবিড়