বসন্ত বিলাপ-৪

বসন্ত বিলাপ-৪
ইসরাত মোস্তফা

ঘড়ির কাটা অনুযায়ী রাত বারোটা বাজবে আর একটু পরেই। নতুন একটা দিনের শুরু হবে, হাসিব জানে না তার জন্য কোনো সুখবর বয়ে আনবে কিনা সে নতুন দিন। হাতে প্রিয় কফির মগটা নিয়ে তার কামরার সাথে লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সে। একটা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকে তারা। ফ্ল্যাটটা কিনেছে হাসিবের বাবা। বেশ বড় কম্পাউন্ডের উপর তৈরি এই এপার্টমেন্টে ছয়টা ইউনিট, পুরো বিল্ডিংটা একটা অর্ধবৃত্তাকারে কম্পাউন্ডটাকে ঘিরে আছে। ফলে এক ইউনিট থেকে আশেপাশের ফ্ল্যাটগুলোর বারান্দায় চোখ পড়ে যায়। কফি হাতে বারান্দায় বসে একাকী রাত্রি বিলাস হাসিবের রোজকার অভ্যাস। উল্টোদিকের ফ্ল্যাটটায় বহুদিন আলো জ্বলে না। সম্ভবত ভাড়াটিয়া চলে গেছে, তাই বিপরীত দিক থেকে কেউ এসে হাসিবের ধ্যানভঙ্গ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না এতদিন। তবে আজ আবছা আলো দেখা যাচ্ছে, স্লাইডিং দরজায় পর্দা ঝুলছে, অর্থাৎ নতুন বাসিন্দা এসেছে। আগে যারা ছিল, তারা বারান্দায় আসতো অনেক, স্বামী-স্ত্রী বারান্দায় বসে প্রেম করত আর তাদের খুনসুটি দেখে হাসিবের গাত্রদহন বেড়ে যেত। এরা এরকম না হলেই হয়। তবে আরেকটি সম্ভাবনার কথা মনে করে হাসিবের মন কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠল, ঠোঁটের কোণে একটা অস্পষ্ট হাসির রেখাও ফুটে উঠতে দেখা গেল।
সন্ধ্যায় পাত্রীর সাথে বিরক্তিকর ও ব্যর্থ সাক্ষাত শেষে বাড়িরে ফেরার পথে বন্ধু রুমি ফোন। “কী রে দোস্ত, আরিফের হলুদ ছিল আজকে, আসলি না যে?” বন্ধু-বান্ধবের বিয়েতে যেতে ইচ্ছা করে না হাসিবের। এই আরিফ কি তার চাইতে ভালো পাত্র? বেতন পায় তার অর্ধেক, ভাঙ্গাচুরা চেহারা, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার, বিয়ে করছে সেই এক ডাকসাইটে সুন্দরীকে। মেয়ে নাকি আবার বুয়েট পাশ। মনে মনে নিজের কপালে দুটো জুতার বাড়ি দেয় হাসিব। হাসিবের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে রুমি বলল, “এই কথা কস না ক্যান? তোমার খবর কবে দিবা মামা? এই শীতেও কি ডবল কম্বল দিয়া ঘুমাবি? আমাদের তো লেপ-কম্বল কিছুই লাগে না দোস্তরে…” ফোনটা দায়সারাভাবে কানে ঠেকিয়ে লিফটে ঢুকতেই হন্তদন্ত হয়ে এক তরুণীর প্রবেশ লিফটে। রুমির বাকি কথাগুলো হাসিবের কানে পৌঁছাল না। হাসিবের চারপাশে তখন ভায়োলিনের সুর বাজছে, লিফটের ভেতরে যেন সহস্র জোনাকি পোকা জ্বলে সমস্তটা একেবারে মায়াময় করে তুলেছে। হাসিবের দিকে একবার তাকিয়ে থ্যাঙ্কস বলল মেয়েটি, সাথে উপহার দিলো মিষ্টি হাসি। ইশ! মধু একেবারে গুলিয়ে দিয়েছে যেন সৃষ্টিকর্তা সে হাসিতে। মুখ চিরে “অপূর্ব” কথাটা বেরিয়েই যাচ্ছিল, বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করল হাসিব। মেয়েটা তার গন্তব্যে এসে লিফট থেকে নেমেও গেল, হাসিবের তখনও ঘোর কাটেনি, হঠাৎ খেয়াল করল টপ ফ্লোরে চলে এসেছে, তার যাওয়ার কথা চার তলায়।মেয়েটা কোন ফ্লোরে নামল সেটাও সে খেয়াল করেনি সে। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজের গালে আক্ষরিক অর্থেই নিজের বাম গালে আলতো করে একটা চড় দিলো সে। পরমুহূর্তে কী মনে করে ডান গালেও একটা চড় দইয়ে দিলো সে। এক গালে চড় খেলে নাকি বিয়ে হয় না, মুরুব্বি মহিলারা বলেন। হাসিব কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি না।
বাসায় ঢুকে আরেক দফা মায়ের প্রশ্নবাণের মুখোমুখি হতে হলো। ডেইজি আহমেদ হাসিবের দিকে যেভাবে রণাঙ্গিনীর রূপে এগিয়ে এলেন, তাতে হাসিবের প্যান্ট খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ক্লাস এইটে যখন অংকে দশ পেয়ে খাটের নিচে খাতা লুকিয়ে রেখেছিল, সেই খাতা মায়ের হাতে পড়ার পরও তিনি এত রাগেননি। কিংবা মাসুদ রানার বইয়ের এক রগরগে অংশ পড়ার সময় হাতেনাতে ধরা খেয়েও হাসিব এত ভয় পায়নি। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, “আ আ আম্মু, ক্কী হয়েছে?”
“তুই কি আর মানুষ হবি না?” বজ্র হুংকার ছাড়লেন ডেইজি।
“হ হয়েছি তো।”
“দুই ভাই বোনই কিছু হলেই তোতলাতে থাকো, ব্যাপারটা কী, হ্যাঁ? এমনিতেই তো বিয়ে হচ্ছে না তোমার, তার উপর এমন তোতলালে হবে? কী বলেছ তুমি মেরিনাকে?
রাগের কারণ যে এটাই, সেটা আগে আন্দাজ করলেও এবার নিশ্চিত হলো হাসিব। “আম্মু আমি তো জাস্ট একটা নরমাল…”
কথা শেষ করার সুযোগ পেল না হাসিব, তার আগেই ডেইজির মুখ চিরে “চো-ও-ও-প” হুংকার বের হয়ে এলো। আমার কলেজের এক্স ছাত্রীর কাজিন হয় ও, জানো তুমি? ছি ছি ছি, কোথাও আমার সম্মান রাখবে না তুমি? মেয়ে শাড়ি পরলে বলো, এত ফরমাল হয়ে এসেছেন কেন? মেকআপ করলে বলো, এতো সেজেছেন কেন? না সাজলে বলো বিয়েতে রাজি না। বেশি বয়স হলে বলে বুড়ি, ছুড়ি আনলে বলো বাচ্চা মেয়ে। হিজাব পরলে বলো খ্যাত, না পরলে বলো পর্দা করে না। কি সমস্যা কী তোমার?”
হাসিব মাথা নিচু করে রইল। তার মায়ের কথায় কিছুটা অত্যুক্তি থাকলে খুব একটা ভুলও বলেননি তিনি। একবার একটা মেয়ে এসেছিল হিজাব পরে, কিন্তু আথে উগ্র মেকআপ আর চুল স্টাইল করে বের করে রাখা। বলবে না বলবে না সত্ত্বেও হাসিব সেটা নিয়ে মন্তব্য করে ফেলেছিল। মেয়েটা ছিল হাসিবের বাবার কলিগের আপন ভাগ্নি। খুব ঝামেলা হয়েছিল সেবার। বাবা তো এক সপ্তাহ হাসিবের মুখ দেখেননি। হাসিব কী করবে, মেয়েটার পুরো আউটলুকটা বড় অদ্ভুত লাগছিল তার। এরপর আরেকটা মেয়ের প্রস্তাব এসেছিল, যে কিনা সবে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। বাপ-মা হজ্জে যাওয়ার আগে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যেতে চায়। বুঝাই যাচ্ছিল মেয়েকে জোর করে নিয়ে আসা হয়েছিল। এমন মেয়েকে কি বিয়ে করা যায়? এখনও মা সেই কথা তুলে খোটা দেন। সেই মেয়ে নাকি এখন দিব্যি চুটিয়ে সংসার করছে। অন্যমনস্ক হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হাসিব। ছেলের করুণ মুখ থেকে ডেইজিরও মনটা নরম হয়ে গেল। আসলে তার ছেলেটার মধ্যে প্যাঁচ কম, যা মনে আসে বলে ফেলে। এত বাছ-বিচার করে কি বিয়ে করা যাবে? আজকালকার মেয়েদের কি এত কথা বলা যায়? এখন কি আগের যুগ আছে?
হাসিবের ভাবনার গাড়িতে ব্রেক কষিয়ে একটু আগেই মনে জাগা আশাটাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বিপরীত দিকের বারান্দায় সেই রূপসীর আগমন। আবছা আলোর বারান্দাটা হঠাৎ এমন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে গেল কী করে? মেয়েটার হাতে মোবাইল, কানে হেডফোন, হাসিবকে দেখেছে কিনা বুঝা গেল না। হাসিব সেই সুযোগ নিয়ে মুগ্ধ অপলক নয়নে রূপের সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগল। আহা! খাঁজকাটা মুখ, তীক্ষ্ণ চিবুক, সরু নাক, পাতলা ঠোঁট- আকাশ থেকে পরী মর্ত্যলোকে নেমে এলে তাকে কি এর চেয়ে বেশি সুন্দর লাগবে? আলোময়ী রূপবতীর পিছনের পর্দাটা সরে যায় হঠাৎ। গুটি গুটি পায়ে একটা ছোট্ট শিশু এসে তরুণীর ওড়নার প্রান্ত ধরে টানতে থাকে। তরুণীও তাকে দেখে হাসিমুখে “মাম্মা” বলে কোলে তুলে নেয়। হৃদয় ভাঙার আওয়াজ হয় না, এই সত্যটা হাসিব এই রাতে আবার উপলব্ধি করল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here