বসন্ত বিলাপ-২,৩
ইসরাত মোস্তফা
০২
নতুন একটা প্রোডাক্ট বাজারজাত করেছে হাসিবের কোম্পানি। দেশব্যাপী এটার ক্যাম্পেইন শুরু করতে হবে। টিভি বিজ্ঞাপনের আগে জেলাভিত্তিক বিটিএল প্রমোশনের কাজ আছে। মোটামুটি দুইমাসের প্রোগ্রাম, এই দুই মাসে হাসিবকে অন্তত দশটা জেলায় যেতে হবে। লাঞ্চ পর্যন্ত এই প্রোগ্রাম তৈরি করা, টিমের লোকজন ঠিক করা, ক্যাম্পেইনের জন্য মার্কেটিং এজেন্সির সাথে কথা বলা এগুলো নিয়েই ব্যস্ত রইল হাসিব। দুপুরের খাবার খাওয়ার সুযোগ পেল বেলা তিনটায়। অবশ্য কর্পোরেট অফিসে এটাই সঠিক সময়, দুপুর দু’টায় লাঞ্চ করার সৌভাগ্য খুব কম মানুষেরই হয়। আজ তো তাও ক্যান্টিনে আসতে পারল, অন্যান্য দিন ডেস্কে বসেই লাঞ্চ সেরে নেয় হাসিব। তবে ডেস্কে বসে লাঞ্চ করাই যে তার জন্য মঙ্গলজনক, সেটা যে আজ ক্যান্টিনে এসে হাড়ে হাড়ে টের পেল। শুকনো মুখে কি আর খাওয়া রোচে? তাই এক্টু-আধটু বিনোদনের দরকার হয়। আজকের বিনোদনের খোরাক হওয়া হাসিবেরই ভাগ্যে ছিল। হাসিবকে ক্যান্টিন থেকে খাবার নিতে দেখে একজন জিজ্ঞেস করল, “আহা! হাসিব ভাই, আজকেও ক্যান্টিনের খাবার। কবে যে আমাদের ভাবী আসবে, কবে যে হাসিব ভাইয়ের কাঁধে একটা টিফিন ক্যারিয়ার ঝুলতে দেখব!” হাসিব অবাক হয়ে বলল, “আপনার ঘরে তো আমার ভাবী আছে, কিন্তু তাও তো আপনার কাঁধে টিফিন ক্যারিয়ার ঝুলতে দেখি না।”
ভদ্রলোক দমে যাওয়ার পাত্র নন, তেলতেলে হাসি দিয়ে বললেন, “আরে এখন তো পুরান হয়ে গেছি, আপনার ভাবীও পোলাপান নিয়ে পারে না, বুঝলেন না? হে হে!”
“তাহলে তো দুই তিন বছর পর পর নতুন কার সন্ধান করা লাগে।”
পাশ থেকে বিলাস বলে, “আরে এই জন্যই তো মিতুল ভাইয়ের চোখ খালি এদিক-ওদিক ঘুরে।” সমস্বরে হাসির রোল উঠল। বিষয়বস্তু মিতুলের দিকে ঘুরে যাওয়ার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে কী ফেলেনি হাসিব, তখনি অন্য আরেকজন বলল, “হাসিব ভাইয়ের শার্টটা তো জোস, তা আজকে পাত্রী দেখার প্রোগ্রাম আছে নাকি?”
“তা ভাই, এই নিয়ে কয় নাম্বার?”
“এই দাঁড়ান দাঁড়ান, আমি বলি, উমম… বিয়াল্লিশ নাম্বার, কি ভাই ঠিক বলেছি?” প্রশ্নটা হাসিবের দিকে ছুঁড়ে দিলো বক্তা।
নাহ! আজ আর রেহাই নেই। কী কুক্ষণে যে ক্যান্টিনে এলো আজ! বিয়ে না করে এখানে আর আসাই যাবে না মনে হচ্ছে। আর ক্যান্টিনে না আসলেই কী! অফিসের ভিতরেও যে যখন পারছে, খোঁচা মারছে। তবে তার উদ্দেশ্যে করা প্রশ্নটায় একটু চিন্তায়ই পড়ে যায় হাসিব। বিয়াল্লিশ? এত কি হবে? এত না হলেও সত্যিকারের সংখ্যাটা নেহাত কমও তো নয়। ছি ছি! এত জন মেয়ের সাথে সে এমনি এমনি দেখা করেছে? মানুষ কি তাকে লুজ ক্যারেক্টার ভাবে নাকি আড়ালে?
প্রশ্নের উত্তরটা পেয়ে গেল আরেকজনের কথায়, “আরে হাসিব ভাইয়ের তো দেখেই সুখ।” লজ্জায় হাসিবের নাক-কান লাল হওয়ার জোগাড়। সহকর্মী অনেক মেয়েরাও আছে ক্যান্টিনে। তারাও টিকা-টিপ্পনী মারছে সুযোগ পেয়ে। একটু তো রাখ-ডাক করবে মানুষ! তার ডিপার্টমেন্টের অমিয় ভাই কাছে আস্তে আস্তে বলল, “এই হাসিব, মার্কেটিংয়ে নতুন একটা মেয়ে এসেছে, আজকে দেখলাম, মাত্র বিবিএ পাশ করে এসেছে। এক্কেবারে…” কথা শেষ না করলেও মুখের ভাবে অমিয় বুঝিয়ে দিলো কী বুঝাতে চায়। হাসিব পাত্তা দিলো না। অন্যদিন হলে সেও সমানে সমানে কথা শুনিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতো, কিন্তু আজকে তার মনটা সকাল থেকেই খারাপ, মা-ও অমন দুর্ব্যবহার করল সকালে। মনমতো মেয়ে না পেলে কি সে যাকে তাকে বিয়ে করে ফেলবে? এটা নিয়ে হাসাহাসির কী আছে? হাসিবের মাঝে মাঝে মনে হয়, এসব দিক থেকে মেয়েরা ভালো আছে। মেয়েদের বিয়ে না হলে মানুষ উঁহু-আহা করে, হাসাহাসি তো আর করে না! ছেলেদের চাকরি না পেলেও হাসাহাসি, বিয়ে না হলেও হাসাহাসি! পুরুষদের জীবনের এই বিড়ম্বনা নিয়ে কেউ গল্প লিখে না। কোনোমতে খাবারটা গলাধঃকরণ করে এখান থেকে পালানোর পাঁয়তারা কষতে লাগল হাসিব। মেন্যুটাও আজ তার অপছন্দের, ডাটা শাক, কাচকি মাছ। শালার জীবনটাই তেজপাতা! খাওয়া শেষ করে ভেন্ডিং মেশিন থেকে কফি নিয়ে নিজের ডেস্কে ফিরে গেল হাসিব। তবে অমিয় ভাইয়ের কথাটা মাথায় ঘুরতে লাগল, মার্কেটিংয়ের নতুন মেয়েটাকে একটু দেখে আসা যায় নাকি?
চলবে
বসন্ত বিলাপ
৩
গুলশানের সবচেয়ে পুরনো ইটালিয়ান খাবারের রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে এটা একটা। এখানকার পাস্তা আর পিজ্জার স্বাদ সহজে ভোলার মতো না। তাই নতুন নতুন সব রেস্টুরেন্ট হলেও হাসিব পাত্রীর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে এখানেই আসে বেশিরভাগ। আরও কিছু কারণ আছে অবশ্য, এই রেস্টুরেন্টটা হাসিবের অফিসের কাছাকাছি হলেও একদম কাছে না, তাই কলিগদের এখানে আসার সম্ভাবনা কম। আর খুব বেশি দূরেও না হওয়ায় হাসিবের আসতে তেমন একটা অসুবিধা হয় না। আজ পাত্রীর রেস্টুরেন্টে আসার কথা সন্ধ্যা সাতটায়। অফিস থেকে বের হতে হতেই সাড়ে সাতটা বেজে গেল। মেয়েটার ফোন নাম্বার ছিল, একটা টেক্সট করে দিলেও মনে মনে বেশ শঙ্কিত হাসিব, এটাও না ছুতে যায় আবার। আবার ইনিয়ে বিনিয়ে বাড়িতে গিয়ে যদি দেরিতে যাওয়া নিয়ে কিছু বলে, তবে তো শেষ! মায়ের কানে গেলে আর রক্ষা নেই। রেস্টুরেন্টের লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তখন ফিরতি মেসেজ পেল মেরিনা, মানে মেয়েটার কাছে থেকে, “নো প্রবলেম, আই উইল বি ওয়েটিং।” বাহ! আলপটকা মেয়ে নয়, অন্যের অসুবিধার খেয়াল আছে। মনে মনে এখনই ইম্প্রেস হওয়া শুরু করেছে হাসিব।
মেরিনাকে বলা ছিল সাত নম্বর টেবিলে বসতে। সে হিসেবে নিজের নামে বুকিং-ও দিয়ে রেখেছিল হাসিব। এই টেবিলটা একটু নিরিবিলিতে, বাইরের ব্যস্ত রাস্তাটাও বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। কথার মাঝে খেই হারিয়ে ফেললে কিংবা পছন্দ না হলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া স্যুপটা দিব্যি গলাধঃকরণ করে ফেলা যায়।
সাত নম্বর টেবিলে শাড়ি পরা এক রমণীকে দেখা যাচ্ছে। হাসিব মনে মনে হিসাব কষছে, শাড়ি পরে আসার কারণ কী? আজকালকার মেয়েরা তো শাড়ি পরে না সচরাচর। সে কি অফিসে রোজ শাড়ি পরেই আসে? নাকি পাত্র দেখা উপলক্ষেই এই বেশ? ঢঙ্গী হবে না তো আবার? দেখা যাবে শুক্রবারে সকাল সকালে ঘুম থেকে উঠে শাড়ি পরে বসে থাকবে বেরাতে যাওয়ার জন্য? তারপর হাসিবের ছুটির দিনের ঘুমটার বারোটা বাজাবে?পেছন থেকে মেয়েটার কোমর ছাপানো চুল দেখা যাচ্ছে, কালো চুলের বন্যা খুব মনে ধরল হাসিবের। এরকম একজনের চুল একবার মনের আকাশে বর্ষা নামিয়েছিল, কিন্তু তা আষাঢ়ের বর্ষণ ছিল না, হুট করে নেমে হুট করেই আবার থেমে গিয়েছিল। কতদিন স্বপ্ন দেখেছিল সেই মেয়েটাকে নিয়ে, কিন্তু হাসিবের স্বপ্ন গুড়িয়ে দিয়ে মেয়েটা তাকে নাকচ করে দিয়েছিল। কিন্তু অফিসে এভাবে চুল খুলে আসা তো ভালো কথা নয়। হাসিব আধুনিকমনস্ক হলেওকর্মক্ষেত্রে বা বাড়ির বাইরে মেয়েদের এত খোলামেলা থাকা পছন্দ করে না সে। এর সাথে বিয়ে হলে তো নারী স্বাধীনতাবিরোধী ট্যাগ লাগবে তার গায়ে।
সাতপাঁচ ভাবতে হাসিব সাত নম্বর টেবিলের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছে হাসিব। এখানকার বেশিরভাগ কর্মচারী তাকে চেনে। একজনকে দেখল মিটিমিটি হাসতে, হাসিবকে দেখে সালাম দিলো। হাসিব বলল, “কী ব্যাপার, তুমি হাসছ কেন আমাকে দেখে?”
লোকটা থতমত খেয়ে বলল, “না না স্যার হাসছি না। এবার অনেকদিন পরে এলেন তো। ভাবছিলাম এতদিনে আপনার বিয়ে, মানে,…”
হাসিব গম্ভীর হয়ে বলল, “তোমার বিয়ে হয়েছে?”
“জি স্যার, আরও পাঁচ বছর আগে। একটা ছেলেও আছে।”
হাসিব চোখ কপালে তুলে বলল, “বলো কী! পাঁচ বছর আগে? তমার বয়স কত?”
“জি, সঠিকটা তো খেয়াল নেই। আইডিতে পঁচিশ দিয়েছি।”
পঁচিশ বছরের একটা ছেলে পাঁচ বছর আগে বিয়ে করে বাচ্চাও পয়দা করে ফেলেছে এটা হজম করতে গিয়ে হাসিবের মুখটা তেতো হয়ে গেল। দুনিয়াতে সবার কপালে বিয়ে আছে, শুধু তার কপালেই নেই।
“সরি, আজকে কাজের অনেক চাপ তো, তাই বের হতে…”
বলতে বলতে মেয়েটির মুখের দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে হাসিবের মুখটা হা হয়ে গেল। এ তো সেই কালোকেশী, যার চিন্তায় হাসিবের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল, এমনকি ডিপ্রেশনে চইলে গিয়েছিল সে। দু’জনের মুখ চিরেই এক সাথেই বেরিয়ে এলো, “আপনি?”
আশেপাশের টেবিল থেকে কিছু উৎসাহী দৃষ্টি ওদের দিকে পড়ল। তবে অফিস পাড়ার ব্যস্ত মানুষদের অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকার এত সময় নেই। আবার সবাই যার যার টেবিলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। হাসিব নিজেকে একটু ধাতস্ত করে নিয়ে বলল, “আপনার না বিয়ে হয়ে গেছে? এখনও পাত্র দেখে বেড়াচ্ছেন?”
মেয়েটা তেড়েমেরে বলল, “কিহ! আমি পাত্র দেখে বেড়াচ্ছি? হ্যাঁ বেড়াচ্ছি, কিন্তু আমার ননদের জন্য। আপনার মতো এখনও আইবুড়ো হয়ে বসে নিই। এক বছরেও আপনি বিয়ে করতে পারেননি? আবার এসেছেন আমার ননদকেই দেখতে?”
“আপনার ননদ?”
“হাই”
সুললিত কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকায় হাসিব। ওহ! এই মেয়েটির ছবিই তো দেখেছিল সে। আসলে হাসিবকে তার মা এত বায়োডাটা আর ছবি একসাথে ধরিয়ে দেন যে প্রায় সময়ই মাথা আর ধড়ের মিল থাকে না। মানে বায়োডাটা আর ছবির মধ্যে গন্ডগোল বেঁধে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিব বলল, “হাই।” অন্যদিকে শাড়ি পরা প্রাক্তন পাত্রী অর্থাৎ মেরিনার ভাবী রাগে রীতিমতো ফুঁসছে বলা যায়। মেরিনা সেদিকে তাকিয়ে বলল, “কী ব্যাপার ভাবী? কী হয়েছে তোমার?” মনে মনে প্রমাদ গুনল হাসিব, যে ঠোঁটকাটা মেয়ে, না জানি কী বলে ইজ্জত মেরে দেয়।
মেয়েটি, সুকন্যা নাম, অবশ্য তাদের পূর্ব পরিচয়ের গোমর ভাঙল না। নন্দের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিছু না, আমি উনাকে বলছিলাম যে আমাদের বুকিং আছে, বুঝিনি যে উনিই পাত্র।”
হাসিবের জহুরি চোখ অবশ্য মেরিনাকে পরখ করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। হালকা সবুজ একটা কামিজ পরনে, চুলগুলো পনিটেল করা, মুখে হালকা প্রসাধনী, হালকা শেডের লিপস্টিক, গড়পরতা উচ্চতা ও গায়ের রঙ, সব মিলিয়ে খুব সুন্দরী না হলেও ছিমছাম চেহারা। হাসিব বসে বলল, “আপনার সাথে কেউ আসবে বলেননি।”
মেরিনা একটু ইতস্তত হাসি হেসে বলল, “না মানে, ভাবীর ভার্সিটি তো কাছেই, বনানীতে, তাই আসার সময় ওকে নিয়ে আসলাম।”
“আপনার আপন ভাবী?”
“না, ভাবী আমার খালাত ভাইয়ের ওয়াইফ। বাট লাস্ট এক বছরে উই হ্যাভ বিকাল রিয়েলি গুড ফ্রেন্ডস।”
হাসিব মনে মনে বলল, “ফ্রেন্ডশিপ না রে পাগলা, বল অভিশাপ।”
দুই রমণীর পছন্দ জেনে একটা পিজ্জা অর্ডার করল হাসিব, যদিও তার পাস্তা খেতে ইচ্ছা করছিল। ওয়েটার চলে গেলে হাসিব বলল, “একটা মজার ব্যাপার হলো কিন্তু।”
দুজনেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। হাসিব বলল, “না মানে, যিনি পাত্রী তিনি পরে এসেছে সালোয়ার কামিজ, আর যিনি নন, তিনি পরে এসেছেন শাড়ি, হা হা হা।” তবে হাসিবের কৌতুকে রমণীদ্বয়কে আমোদিত হতে দেখা গেল না। সুকন্যা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেন? শাড়ি কি শুধু পাত্রীরাই পরতে পারবে?”
মেরিনাও যোগ দিলো, “আর পাত্রীদের শাড়ি পরেই আসতে হবে? আপনি কি আশা করেছিলেন, আমি ঘোমটা টেনে বউ সেযে আসব?তাহলে আপনি আমাদের বাসাতেই আসতেন। কাতান শাড়ি পরে আধহাত ঘোমটা টেনে চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে আসতাম। মোড়ের দোকান থেকে সমুচা বানিয়ে এনে বলতাম বাসায় নিজের হাতে বানিয়েছি।”
যুগল আক্রমণে একেবারে ভড়কে গেল হাসিব। “আরে, এমন চটে গেলেন কেন? মানে আমি তো জাস্ট…”
এরপর আর আলাপ জমল না। হাসিবের পকেট থেকে পনেরশো টাকা বৃথাই খসল। হাসিবের সম্ববত ছাব্বিশতম বিয়ের সম্বন্ধটিও ভেস্তে গেল। কোয়ার্টার সেঞ্চুরি পার করে সে এখন হাফ সেঞ্চুরির পথে।
চলবে