বর্ষার এক রাতে,পর্ব-৮,৯
সাদিয়া
৮
“শুনেছি আমার জন্মের পর মা রক্তশূন্যতার অভাবে মারা যান। আমার শরীর নাকি খুব খারাপ ছিল। অনেক কিছুর পর নাকি আমার দম ফিরে। বাবাই আমাকে বড় করেছেন। তারপর বাবা আবার বিয়ে করলেন। কারণ আমার দেখ শুনার পর বাবা ব্যবসা টা ঠিক করে চালাতে পারছিলেন না। সৎ মা আসেন ঘরে। আমিও বড় হতে থাকি। উনার ঘর থেকে ছোট একটা বাচ্চার জন্ম হয়। তুসি। আমার নিজের বোন। কখনো ওকে আমার থেকে আলাদা করি নি। নিজের মতো ভালোবাসি ওকে। একটু একটু করে বড় করি নিজ হাতে। মায়া আরো বসে পড়ল তার উপর। ভালোই চলছিল দিন। ইন্টারে উঠতে বাবা মারা যান স্ট্রোক করে। তারপর থেকে একেবারে এতিম হয়ে যাই আমি। বাবার দেওয়া যা ছিল আস্তে আস্তে শেষ হতে থাকে। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। ততদিনে অনার্স ১ম বর্ষে উঠে যাই আমি। অনেক খুঁজেও একটা চাকরি পাই নি। সংসার চলে না। আম্মার খুটখুটানি কথা বাড়তে থাকে। উঠতে বসতে কথা। আমি লেখাপড়া করে নাকি সব টাকা নষ্ট করে দিয়েছি। সংসার বোনের ঔষধ আমার পড়া কিছুই চলছিল না। প্রতিদিন যেতাম সব জায়গায় কাজের খুঁজে। অবশেষে যাও একটা চাকরি পেলাম বেতন খুব সীমিত। টেনেটুনে চলে কোনো রকম। বোনের চিকিৎসা তেমন চলে না। একদিনের ঔষধ আনলে অন্যদিনের টা আনা যায় না। তবুও দিন চলছিল। কিন্তু আমার জীবনে কাল চলে আসে এক বর্ষার রাতে। সেই টেন থেকে পাড়ার এক ছেলে বিরক্ত করত আমায়। লেগেই থাকত। বাবা চলে যাওয়ার পর তার পাগলামি আরো বাড়তে থাকে। দিনদিন সে পিছু ঘুরতেই থাকে। বিয়ে করতে চায় আমাকে। বখাটে ছেলে ছিল সে। একদম বখে যাওয়া ছেলে। তাকে আমি সহ্য করতে পারতাম না। আমায় হুমকি দিতে লাগল মেরে ফেলবে, তুলে নিয়ে বিয়ে করবে আরো কত কি। নিজেকে বাঁচাতে এক লাইন বেশি বলে ফেলেছিলাম। তাকে বলেছিলাম আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। আমাকে যেন আর বিরক্ত না করে সে। তারপর থেকেই কিছুদিন সে আর আমার পিছু নেয় না। অবাক হয়ে ছিলাম ভেবেছিলাম আমার কথা সে বিশ্বাস করেছে। কিন্তু তবুও ভেতরে কেমন যেন ভয় হতো। তাকে আমি কয়েক টা চরও দিয়েছিলাম তবুও সে পিছু আসতই। কিন্তু তার এমন নীরব শান্ত থাকা ভয় হতোই। একদিন অফিস থেকে ফিরছিলাম। রাত ৯ টা বেজে গিয়েছিল। সেদিন.. সেদিন..!”
তূবার কথা আসছিল না। শূন্যে তাকিয়ে সে কাঁপছিল। আহফিন খেয়াল করল এত ঠান্ডা বাতাসেও তূবার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে। আহফিন তাড়াতাড়ি করে তার রুমে থাকা ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করল। গ্লাস টা তূবার দিকে এগিয়ে দিলেও সে আগের মতো পলক না পরা চোখে শূন্যে তাকিয়ে রইল। তূবা আরো বেশি কাঁপতে শুরু করেছে বলে আহফিন তার পাশে গিয়ে বসল। তূবার গায়ে হাত দিয়ে তাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকল। তূবা সাড়া দেয় নি। আহফিন বার কয়েক তূবা কে ডেকে গ্লাস টা তার মুখের সামনে ধরল। কাঁপা ঠোঁটে তূবা টগটগ করে সবটা পানি খেয়ে নিল।
“তূবা।”
“…
“তূবা। তূবা শুনতে পাচ্ছো আমার কথা?”
বেখেয়ালি মনে তূবা বলতে লাগল “সেই বৃ.বৃষ্টির রাতে রনি আমাকে.. রানি আমাকে রেপ করল। আমার সব সতীত্ব হারাই সেই রাতে। আ আমার জীবন টা কালো আঁধারে ছেয়ে যায়।” চিৎকার করে বলতে বলতে তূবা কেঁদে উঠল। বাহিরে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে আকাশ ফেটে বজ্রপাত হচ্ছে। সেই সাথে তূবার চিৎকারও ভেসে আসছে। সব মিলিয়ে বিকট শব্দ। আহফিনের কান জ্বলে যাচ্ছে তূবার চিৎকার করা কান্নার শব্দে। তূবা শক্ত করে আহফিনের হাত খামছে ধরে কান্না করছে। আহফিন তূবা কে বুকের সাথে আগলে নিল। শীতল বুক পেয়ে তূবা আজ মন মতো কাঁদছে। গলা চিড়ে কান্না বের হচ্ছে। আহফিনের বুক তূবার চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছে। আহফিনের ভেতরে খুব কষ্ট লাগছে। জ্বালাও হচ্ছে তূবার কান্নায়। একদিকে তূবা চিৎকার করে কাঁদছে। অন্যদিকে আহফিনের কষ্ট গলায় দলা পাকিয়ে শ্বাস রুধ করছে। ঢোক গিলতেও বাঁধা পাচ্ছে সে। তূবা কে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।
দীর্ঘসময় পাড় করে কাঁদতে কাঁদতে তূবা হেচকি তুলে ফেলল। আহফিন কে ঠেলে দূরে সরিয়ে সে ফাঁকা হয়ে বসল। তূবার অবস্থা দেখে আহফিন তাকে আবারও পানি এনে দিলে অল্প একটু পানি খেয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখ মুখ ফুলে একাকার। ভীষণ জ্বালা করছে। নাক টেনে তূবা আবার বলতে লাগল,
“পারায় এই কথা ছড়িয়ে পড়ল। বাড়িতে এসে এসে লোকে বাজে কথা বলত। বাজে ভাবে ইঙ্গিত করত। জীবন টা একদম নাজেহাল হয়ে গিয়ে ছিল আমার কদিনে। নিজেকে ঘর বন্ধি করি। তবুও হলো না। আম্মা লোক তাড়িয়ে দিলেও এসে আমাকে বাজে কথা শুনাতো। একমাত্র তুসি তখন আমার হাতে হাত রেখে কেঁদেছিল। দিন যেতে থাকে। আবার চাকরিতে যাই। ওখানেও রনি বস কে এসব কথা বলে এসেছিল। বস আরো পেয়ে বসে সে আমাকে তারসাথে বেড শেয়ার করতে বলল।”
আহফিন চোখ বন্ধ করে আনল। তূবা কি বলছে এসব? অনেকটা ধকল খেয়ে মেয়েটা এসেছে এখানে।
তূবা বলা শুরু করল।
“আমি সেদিন রাগে দুঃখে বসকে চর মারি। চাকরি ওখানেই ইতি হয়। আবারও কাজ খুঁজতে থাকি। কিন্তু অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট কে তো আর কেউ চাকরি দিয়ে দিবে না। আগের টা না হয় ভাগ্যের জুরে পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাগ্য তো আর সবসময় ধরা দেয় না।”
বলে তূবা তাচ্ছিল্যের ভাবে হাসল। আহফিন সেই হাসির দিকে অপলক তাকিয়ে রইল।
“দিনের পর দিন যায় চাকরি নেই, ঘরে বোনের ঔষধ নেই, খাওয়া নেই, জীবনের এমন হাল আর নিতে পারছিলাম না। অনেকবার চিন্তা করেছি আত্মহত্যা করব। কিন্তু আমি মরে গেলে তুসি আর আম্মা একদম মরে যাবে বেঁচে থেকে। তারা প্রতিদিন মরবে। সে পথে আর হাটলাম না। রাস্তায় বের হলে পশুরা তালিয়ে লালসার হাসি হাসল। আমাকে টাকার বিনিময়ে সেক্স করতে বলত।”
আহফিন কেন যেন তূবার এই কথা গুলি একেবারে নিতে পারছিল না। চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসছিল তার বারবার। আর ভেতরে ফুলঙ্গির মতো আগুন উড়ছিল।
তূবা ঢোক গিলে আবার বলল “অনেক ভেবেছি। সামনে আমার দুইটাই পথ ছিল তখন। হয় নিজে মরে যাওয়া নয়তো নিজেকে ওই পশুদের কাছে স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দিয়ে টাকা আনা। সব দিক ভেবে এটা ছাড়া আমার আর পথ ছিল না। আমি বড্ড অসহায় ছিলাম তখন। পাশে দাঁড়ানোর কেউ ছিল না। মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেওয়া কেউ ছিল না আমার। সারাক্ষণ বুকে কান্নার পাথর নিয়ে থাকতাম। আমার ভেতরটা পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে যাচ্ছিল। বোনের আম্মার না খাওয়া শুকনো মুখ গুলি আমাকে আর বিবেকের সাথে লড়তে দেয় নি। মনস্থির করেই নিলাম। প্রতিদিন ওদের মরার চেয়ে নিজেকে মারার পথ খুঁজে নিলাম লিলা আপার কাছ থেকে। একদিন পর সে কল দিয়ে আমাকে জানাল, আপনার বাসার ঠিকানা দিল। নষ্ট রাস্তার মেয়ের মতো ছুটে এলাম আপনার কাছে। দেহ বেছে টাকা নিতে।”
আহফিন এবার তূবা কে ধমক দিল চুপ থাকতে। তূবা অশ্রুসিক্ত নয়নে খানিক হেসে বলল
“আপনিই না শুনতে চেয়েছিলেন। তবে?”
“সুহহ, আমি আর শুনতে চাই না।” নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বলল আহফিন।
“কেন শুনতে চান না? শুনুন।”
“তূবা শাট আপ। আর কোনো কথা নয়। চলো ঘুমাবে।”
সে আহফিনের কথা শুনল না। বলতে লাগল
“আরেক বর্ষার কালো রাত চলে এলো জীবনে। এই কালো রাত সারাজীবন কে কুলসিত করার রাত ছিল। বর্ষার এক রাতে আমি আপনার কাছে ছুটে এলাম। কেন? দেহ বিলিয়ে টাকা নিতে।”
“তূবা… একদম চুপ। আর একটাও কথা না। এবার মুখ বন্ধ করো।”
“কেন? চাঁদ দেখতে পারেন আর চাঁদের গায়ের কালো দাগ দেখতে পারেন না?”
“…
“আমি একটা বাজে মেয়ে। একজন ধর্ষিতা, প্রস্টেটিউট।”
শেষের কথাটা আহফিনের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল। সে তূবার গাল চেঁপে ধরে বলল
“তুই ধর্ষিতা না। বুঝেছিস তুই ধর্ষিতা না।”
“…
তূবা আহফিনের দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো হাসছিল। আর বলছিল
“আপনি পাগল হয়ে গেছেন। একদম মাথাটা গেছে আপনার। সবাই জানে তূবা ধর্ষিতা আর এই লোক বলে কি না আমি ধর্ষিতা না। হাহা হা হা..”
আহফিন তূবার পাগলামি দেখে তাকে বুকের সাথে ঝাপটে ধরল। আর বারবার বলছিল।
“তুমি ধর্ষিতা না। একদম বাজে কথা বলবে না। তুমি ভার্জিন। তূবা তুমি ভার্জিন ছিলে আমার কাছে আসার আগে। সেদিনের বর্ষার রাতে আমার কাছে আসার আগেও তুমি ভার্জিন ছিলে তূবা শান্ত হোও। শান্ত হোও প্লিজ।”
আহফিন তূবা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চাইছে শান্ত করতে কিন্তু তূবা ছটফট করছে পাখির মতো।
“মিথ্যে বলছেন। আপনি মিথ্যে বলছেন আমার সাথে। তূবা ধর্ষিতা। ধর্ষিতা তূবা।”
তূবার গলার আওয়াজ নিবে আসছিল। চোখ গুলি লেগে আসছিল। তার হাত পা নাড়াচাড়া কম দেখে আহফিন তাকে কোলে তুলে নিল। বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে তারপাশে শুয়ে পড়ল তাকে জড়িয়ে। আহফিন ভাবতে থাকল তূবার পরিস্থিতিটা নিয়ে। তূবা কতটা অসহায় আর বিষাক্ত ব্যথায় জর্জরিত ছিল।
তুসি মায়ের সাথে শুয়ে আছে।
“আম্মা বাহিরে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে আপা কি করছে কে জানে?”
শিরিন কিছু বললেন না। মেয়ের পাশ ফিরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
“আম্মা তুমি তো আপা কে কখনো আমার মতো মাথায় হাত বুলিয়ে দাও না।”
শিরিন বেগম তখনো চুপ। তিনি অতীতে চলে গেলেন। তখন তূবা খুব ছোট। কত আদর করে তিনি তাকে বড় করেছেন। বুকের সাথে মিশিয়ে ঘুম পারিয়েছেন। তূবার ছুটাছুটির কারণে কতবার পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবার পর তিনি বকা দিয়েছেন। তূবার ছোট বেলার কথা মনে হতেই বুকটা কেমন করে উঠল উনার। আর এখন? কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এই তূবাকেই কত কথা শুনান তিনি। শিরিনের চোখে পানি চলে এলো। ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি।
“আম্মা তুমি কাঁদছো?”
“না তুই ঘুমা মা।”
“আম্মা আপারেও তুমি ভালোবাসা তাই না?”
“ওরে জন্ম না দিলেও বড় করছি। এর বেশি কি কইতাম তোরে? এত কতা না কইয়া তুই ঘুমা তো। আমার ঘুম পাইতাছে।”
বলে তিনি পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন।
“আম্মা আপা কিসের কাজ করে?”
শিরিন ভাবনায় পড়ে গেলেন কি বলবে।
“জানি না আমি তুই ঘুমা তুসি। বেশি কতা ভালা লাগে না।”
তুসি আর কিছু বলল না। কিন্তু তার আপা কে খুব মনে পড়ছে। তার খুব ইচ্ছে এমন বর্ষার দিনে আপার সাথে ছুটে বেড়াবে, বৃষ্টিতে এলোমেলো হয়ে দৌড়াবে। ‘কবে জানি তার ইচ্ছে পূরণ হয়।’ না পাওয়া এই আফসোসের যন্ত্রণা নিয়ে তুসি চোখ বন্ধ করল।
মাঝরাতে আহফিন খেয়াল করল তূবার গা কেঁপে জ্বর এসেছে। বিড়বিড় করে সে কি যেন বলছে। অস্পষ্ট কথা। আহফিন গায়ে হাত দিয়ে দেখতে পেল শরীরে জ্বর অনেক। কান তূবার মুখের সামনে পাতল। কিন্তু কিছুই বুঝল না। তূবা কে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল আহফিন। তবুও কাঁপুনি কমার নাম নেই। আহফিন তূবার হাত পা মালিশ করতে লাগল। উপায়ন্তর না দেখে তূবার উপর উঠে জড়িয়ে ধরে গায়ে উম দিতে লাগল। কিছুক্ষণ পর কাঁপুনি কমলেও জ্বরের মাত্রা কমে না। ওদিকে বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকে ধ্বনিও সৃষ্টি হচ্ছে।
আহফিন উঠে নিচ থেকে একটুকরো কাপড় আর বাটিতে পানি নিয়ে আসল। তূবার কাছে গিয়ে তার কপালে জলপট্টি দেওয়া শুরু করেছে। মেয়েটার ঠোঁট গুলি এখনো অনবরত কাঁপছে আহফিন ধ্যান ধরে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
চলবে♥
#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া
পর্ব : ৯
সকালে উঠে তূবা দেখতে পেল আহফিন তার পাশেই চেয়ারে বসে আছে। মাথা বিছানায় হেলান দেওয়া। তার হাতটা ঘুমের ঘোরেও খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে। তূবা উঠতে চাইল। কিন্তু মাথাটা ভার লাগছে ভেতরে যন্ত্রণা হচ্ছে। তূবার নাড়াচাড়া দেখে আহফিনের লেগে আসা চোখ খুলে গেল। সে তূবার কপালে হাত দিয়ে দেখল জ্বর কেমন।
শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি। আহফিন চোখ ডলতে ডলতে গিয়ে থার্মোমিটার আনল। তূবা কে বলল
“হা করো।”
“..
“কি হলো হা করল।”
আহফিনের চোখের দিকে তাকিয়ে সে মুখ খুলল। আহফিন থার্মোমিটার তার মুখে দিয়ে সময় দেখতে লাগল।
তাপমাত্রা আছে একটু বেশি। আহফিন ড্রয়ার খুলে ঔষধ নিল। খুলতে গিয়ে মনে হলো
“ও শিট। ব্রেকফাস্ট তো করা হয় নি। ঔষধ দেই কি করে.”
“….
“উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। দেখি কি করা যায়।”
তূবা এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলছে না। আহফিন ঔষধের পাতা রেখে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।
একটু পর ফিরে এলো একটা ডিম পোচ নিয়ে।
“নাও এটা খেয়ে ঔষধটা খেয়ে নাও। তারপর আন্টি এলে বলব কিছু করে দিতে। নাও খেয়ে নাও।”
“…
“কি হলো তূবা?”
“আমার খিদে নেই।”
“টেনে দিবো একটা।”
আহফিনের মুখে এমন কথা শুনে তূবা কপালের চামড়া এক করে আনল। মনে মনে বলল “আমার মন চায় আপনাকে দিতে এক ঘুষি।”
“কি হলো? কি ভাবছো আমার দিকে তাকিয়ে? নাকি সুদর্শন পুরুষ কে দেখছো?”
আহফিন কে দেখিয়ে তূবা মুখ ভেংচি কেটে অন্য দিকে ফিরল বিরক্ত মুখে। আহফিন ঠোঁট টিপে হেসে টেবিলের কাছে গিয়ে প্লেট টা রাখে বলল।
“উঠবে নাকি বসেই থাকবে?”
“….
“তূবা তুমি বড্ড জেদি। এর ঔষধ কিন্তু আছে আমার কাছে।”
“কেন? কেন করছেন আমার জন্যে এগুলি? আপনার সাথে তো আমার কোনো সম্পর্ক নেই। অন্য একটা মেয়ের জন্যে কেন এসব করছেন?”
আহফিন তূবার দিকে একটু ঝুঁকে ফিসফিসানি কন্ঠে বলল
“কিছু কিছু সম্পর্ক আত্মার হয়। তূবার সাথে আমার ওমনি সম্পর্ক। অদৃশ্য এক সম্পর্ক।”
তূবা কি বলবে ভেবে পায় না। আহফিন তূবার গালে চুমু খেয়ে আবার চলে গেল। আর তূবা তখনো যন্ত্রের মতো বসে ছিল শুধু।
তূবা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল আহফিন শার্ট চেঞ্জ করছে। খালি গায়ে দেখতে তাকে অনেক আকর্ষণীয় লাগছিল। তূবা তাড়াতাড়ি মাথা নিচু করে নিল। কি করবে বুঝে উঠতে সময় নিচ্ছে। আহফিন ঘাড় ঘুরিয়ে তূবা কে বিব্রত অবস্থায় দেখে বাঁকে হেসে উঠল। তার মস্তিষ্ক তাকে কিছু করতে বলছে। আহফিন এগিয়ে গেল খালি গায়ে। তাকে এভাবে আসতে দেখে তূবা হা করে তাকিয়ে আছে। এই লোকের মতিগতি বুঝা ভার। আহফিন কে এগিয়ে আসতে দেখে তূবা পিছনে গেল। আরেক পা পিছনে যেতেই আহফিন তাকে ধরে নিল।
“আরেকটু হলে তো বাথরুমে চলে যেতে। আমার সাথে যাওয়ার ইচ্ছা নাকি?”
আহফিন কে বাঁকা ঠোঁটে হাসতে দেখে তূবার শরীর জ্বলে গেল। দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল
“আমার এখন বাসায় যাওয়ার সময় হয়ছে।”
আহফিন তূবা কে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করাল। এক হাত দেওয়ালের উপর রেখে গভীর দৃষ্টিতে তূবার চোখ মুখ দেখল।
“রাগলে তোমাকে লাল টমেটোর মতো দেখায় নাকি লাল টুকটুকে স্টবেরির মতো। কোনটা?”
“সেটা আমার বিষয় আপনার না।”
“আমি যেহেতু তোমাকে দেখছি সেহেতু এটা আমারও বিষয়।”
“সরুন।”
“উঁহু।”
তূবা আহফিনের দিকে তাকিয়ে বলল “কাল রাতে আমি কিন্তু আপনার কথা শুনেছি। এখন আমাকে আমার মতো যেতে দিন।”
আহফিন তূবার কথায় কান না দিয়ে নিজের মতো বলল,
“আচ্ছা তূবা আমার সংস্পর্শে এলেও কি তোমার কোনো ফিলিংস হয় না? কিছুই কি অনুভব করতে পারো না?”
এবার কি বলবে সে? রাগে লজ্জায় তূবা আহফিনের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।
“আউচ, বুকে ব্যথা কেন দিলে? তোমরা সব মেয়েরা কি শুধু ব্যথা দিতেই জানো?”
গাম্ভীর্য মুখে আহফিনের বলা কথাটাতেও তূবার রাগ হলো। সে আহফিনের চোখে রাগান্বিত হয়ে দাঁত খিঁচে তাকাল। মনে মনে বলল “আপনার প্রতি আমার পিনপিন রাগ টা একদিন দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে।”
তূবা ব্যাগ নিতে গেলে আহফিন তার হাত ধরে আটকাল।
“কোথায় যাচ্ছো? এত কষ্ট করে যে আমি তোমার জন্যে ডিম পোচ করে আনলাম সেটা কি তোমার নানি এসে খাবে?”
“আমার নানির এসে খাওয়ার দরকার নেই। আপনার এটা আপনি খান।”
“না হলে তো আহফিন চৌধুরী যেতে দিবে না কাউকে।”
এই মুহূর্ত তূবার মনে হচ্ছিল ‘লোকটাকে যদি চুলে ধরে টেনে উপরে উঠে আচ্ছা মতো কয়েকটা রামধোলাই দিতে পারতাম তবে শান্তি লাগত।’
মুখে কিছু বলল না ফের রাগি চোখের দৃষ্টি দিয়ে সে দ্রুত কোনো ভাবে ডিম টা মুখে দিল। তারপর আহফিনের দিকে তাকাল। লোকটা ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেসে বোধহয় হাসছে।
“হেয়েছে? এবার তো যেতে পারব?”
“ঔষধ খাওয়া তো হয় নি।”
“এরপর বইলেন আপনাকে খেতে।”
“হোয়াট?”
“…
তূবা ঔষধটা খেয়ে উঠতে গেল আহফিন তাকে ঠেলে আবার বসিয়ে দিল। তূবা তো এবার আহাম্মক হয়ে গেল। উঁচু স্বরে বলল
“আবার কি?”
লোকটা জবাব দিল না। তার দিকে কেমন নেশাভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। তূবার অন্য কিছু ভেবে ভয় হলো। সে আহফিনের চোখের দিকে তাকাল। আহফিন হঠাৎ হাটু গেড়ে ফ্লোরে বসে পড়ল। তূবা পরিস্থিতি বুঝতে পারছিল না। আহফিন নরম হাতে তার দুই গাল স্পর্শ করল। আহফিনের ওমন চাউনি এই এমন স্পর্শে তূবা কেঁপে উঠল। ভেতরের স্পন্দন অদ্ভুত রকম ভাবে বেড়ে গেল। শরীরটাও কেমন বরফের মতো জমে আসছে। আহফিন তার মুখটা নিজের দিকে এগিয়ে আনল। তার ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা ঘন কুসুম টার দিকে আহফিন ঘোর ভাবে তাকিয়ে আছে। আহফিন মুখ বাড়িয়ে ঠোঁটে লেগে থাকা কুসুম টা শুষে নেয়। তূবা তখনি চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। থেমে থেমে নিশ্বাস নিচ্ছে। আহফিন এভাবেই খুব কাছ থেকে তূবা কে দেখতে লাগল। তূবার গরম নিশ্বাসের স্পর্শ অনুভব করতে লাগল। দুই চোখ এদিক ওদিক করে দেখতে লাগল তূবাকে।
তূবার ফোন বাজলে আহফিন কে সরিয়ে দিল সে। দৌড়ে সোফার কাছে থাকা টিটেবিলের উপর রাখা ব্যাগ থেকে ফোন টা বের করল। তুসি কল করেছে। নিশ্চয় না খেয়ে বসে আছে।
“হ্যালো।”
“আপা তুই আসবি না?”
“আ.আসছি আমি।”
তূবা কল কেটে ব্যাগে ফোন রেখে পিছন ফিরল। আহফিন তখনো এক হাটু গেড়ে বসেছিল ওখানে। ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছিল। তূবা ব্যাগ নিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেল। তার ওভাবে দৌড়ে যাওয়া দেখে আহফিন না হেসে পারল না। বিড়বিড় করে বলল “তোমার প্রতিটা স্পর্শ আমাকে শিউড়ে তুলে তূবা। ভয়ংকর শিহরন জাগে ভেতরে।”
চলবে♥