#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৩০
#হুমাইরা_হাসান
চোখ বয়ে দুফোঁটা অশ্রু কখন নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়লো মোহর নূন্যতম আঁচ করতে পারলো নাহ। স্তব্ধ, স্তম্ভিত, বিহ্বলিত মুখাবয়বে স্পষ্টত ভেসে উঠেছে পীড়ন আর মর্মবেদনার ছাপ। ঠিক কতটা, ঠিক কিভাবে প্রকাশ করলে মোহর বোঝাতে পারবে ওর বুকের ভেতরে কোনো দহন চলছে, ঠিক কোন ভাষায় বললে বোঝানো যাবে কতটা ভেঙে পড়েছে সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে।
গাড়িটা যখন এখানে এসে থামালো মেহরাজ, মোহর তখনও বুঝতে পারেনি এতো বড়ো একটা চমক ওর জন্যে অপেক্ষা করছে। মেহরাজ সারপ্রাইজ বলে এভাবে ঝলকে দেবে মোহর কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি।
এতদিনে নিজেকে একটু একটু করে বুঝিয়ে নেওয়া, সামলে নেওয়, গুছিয়ে নেওয়া সত্ত্বা টা যেনো ক্রমশই চুরচুর করে দিলো সামনের ব্যক্তি।
এক লহমা আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না মোহর। নিগূঢ় অভিমান, অভিযোগ, সকল ব্যথা ভুলে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো, হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। জনমানবহীন জায়গাটার পরিবেশ টাও যেন হাহাকারে বুদ হলো মোহরের করুনাময়ী কান্নায়।
– তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ আমার নেই রে। আমি অনেক বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি। আমি কিভাবে তোকে ভুল বুঝলাম। তোর উপরে ওমন জঘন্য একটা অপবাদ দিতে পারলাম, আমাকে ক্ষমা করে দিস, তোর এই নিষ্ঠুর বোনকে ক্ষমা করে দিস পুতুল।
মিথিলা ভেবেছিলো নিজের করা জঘন্যতম ভুলটার কারণে হয়তো আর মুখ ফিরে পাবে না , আদরের বোনটাকে চিরতরে হারাবে স্নেহের ছায়াতল থেকে, ভেবেছিল এই অপরাধী মুখটা নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না, মোহর মুখ ফিরিয়ে নিবে, সেদিনের অপমান দুর্ব্যবহার মনে গেঁথে রেখে সিটিয়ে নেবে মুখ।
কিন্তু এভাবে সব ভুলে এসে বুকের মাঝে আঁছড়ে পড়বে এটা ভাবেনি, নিজেকে নিষ্ঠুরতম, নিচুস্তরের অপরাধী মনে হচ্ছে এখন মিথিলার। আদরের বোনটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে মাথায় পরপর দুইবার স্নেহের পরশ মিশিয়ে বলল
– আমি কি করবো বল, কি করলে প্রায়শ্চিত্ত হবে আমার। আমি পাপ করেছি রে, এই পাপের ক্ষমা আমার নেই। আমি তোকে ভুল বুঝে সবার সামনে অপমান করেছি গায়ে হাত তু’লেছি,বের করে দিয়েছি। মায়ের শেষ যাত্রা টাও চোখ ভরে দেখতে দেইনি। কি করে আমি প্রায়শ্চিত্ত করবো বোন, কি করলে আমি ক্ষমার যোগ্য হবো বলে দে আমায়।
মোহর অশ্রুসিক্ত মুখটা তুলে তাকালো, রক্তাভ চোখে বোনের দুহাত ধরে বলল
– এভাবে ক্ষমা চাস না বুবু, আমার তোর উপর কোনো রাগ নেই। আমি জানি ওই সময় তোর উপরে কোন ঝড় চলছিলো। আমারই দোষ সেদিন যদি আমি বাইরে না যেতাম নাইবা এতকিছু হতো নাইবা মা এতো কষ্ট পেয়ে চলে যেতো। শেষ মুহূর্তে মায়ের পাশে কেও ছিলো না বুবু কেও না, কতটা না কষ্ট পেয়ে মায়ের দম বন্ধ হয়েছে। তোরাই ঠিক ছিলি আমি থাকলে তো এমন হতো না মা ও আমাদের সাথেই থাকতো।
নোনাপানিতে আনন ভিজে জবজবে, কান্নার দাপটে হিচকি উঠে আসছে, গলার ভেতরে শব্দ গুলো কুন্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে। অবিরাম অশ্রুধারায় চোখ দুটি রক্তাভের ন্যায় পরিণত হয়েছে। এতগুলো দিন, ঠিক কতগুলো দিন পরে প্রাণপ্রিয় মানুষটাকে দেখতে পেলো। বুবু মোহরের আদরের আশ্রয়াস্তল, আর মোহর হলো মিথিলার চোখের মণি ওর পুতুল। পরিস্থিতি সাপেক্ষে বাবার পরেই মাকে হারিয়েই মানসিক বিকৃতি ঘটেছিল মিথিলার , সেদিন বাড়ি এসে মায়ের ম’রা মুখটা দেখে এতো বড়ো ধাক্কা পেয়েছিল যে কষ্ট আঘাত গুলো ক্ষোভ হয়ে উপড়ে পড়েছিল মোহরের উপরে।
– এভাবে বলিস নাহ। মায়ের শরীর যে লাস্ট স্টেজে ছিল তা তো ফায়াজ অনেক আগেই বলেছিল, তুই তো তবুও নিজের সমস্তটা দিয়ে চেষ্টা করে গেছিস মাকে টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু নিয়তি তো তা চাইনি। প্রকৃতির নিয়মে সাঁয় দিয়ে মা চলে গেছে, এতে তোর তো ভুল নেই। ভুল তো আমার। আমার যখন ছাঁয়া হয়ে তোর পাশে থেকে আগলে রাখার কথা ছিল আমি অমা’নুষিক ব্যবহার করে তোকে তাড়িয়ে দিয়েছি।
মোহরের দুই চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল মিথিলা। আজ মাস ধরে অপরাধ, গ্লাণি, দুঃখবোধে জর্জরিত অন্তঃসত্ত্বা কুরে কুরে খাচ্ছিলো নিজেকে। সবচেয়ে আদরের স্নেহময়ী মুখটা এতদিন পর দেখলো, কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না মিথিলা। ছোট্ট বোনটাকে বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুম পারিয়েছে, নিজে হাতে খাইয়ে দিয়েছে সেই বোনটাকে আজ এতগুলো দিন চোখের সামনে পাইনি। নিজের দোষে,অন্যায়ে এতটা দূরে ঠেলে দিয়েছিলো।
অসংখ্যবার মোহরের কপালে গালে ঠোঁট ছুঁয়ে আদর করে দিলো মিথিলা। অনুরক্তির গলায় বলল
– পারলে নিজের বোনটাকে ক্ষমা করে দে পুতুল। আমি আর কখনও তোকে ভুল বুঝবো না, দূরে সরিয়ে দেবো নাহ। এবারের মতো আমায় মাফ করে দে না
– কিসব বলছিস বুবু, আমার তোর উপরে কোনো রাগ নেই। আমিতো তোকে মিস করেছি অনেক। এখনো করি, তোকে ছাড়া যে আমার চলে না তুই কি জানিস নাহ। কখনো রাগ করে থাকতে পেরেছি আমি!
মিথিলা কান্নার মাঝেও হেসে দিলো। দু’হাতে আবারও বুকে জড়িয়ে ধরলো মোহরকে। চুলের মাঝে হাত রেখে পরম স্নেহে বুলিয়ে দিলো। ঠিক কতটা আনন্দ, প্রশান্তি লাগছে সেটার পরিমাপ হয়তো ও নিজেও করতে পারবে নাহ। বুকের উপরের সবচেয়ে ভারী বোঝা টা যেন নেমে গেলো। মোহরকে বুক থেকে তুলে পাশে তাকাতেই চোখ গেলো কড়ই গাছটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষ টির দিকে।
মিথিলা বুঝতে পারলো না ঠিক কোন শব্দন্তরে ধন্যবাদ জানাবে, কোন পদ্ধতিতে শুকরিয়া করলে পরিপূর্ণ ভাবে কৃতজ্ঞতা টুকু প্রকাশ করতে পারবে। নিজের চরম দুর্ভোগের ন্যায় বিষণ্ণ সময়ে একফালি আনন্দ প্রশান্তির টুকরো এনে দিয়েছে মেহরাজ ওকে।
মোহর কে ছেড়ে ও মেহরাজের সামনে দাঁড়িয়ে বলল
– ঠিক কিভাবে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো আমি জানি নাহ। কিভাবে শুকরিয়া আদায় করলে তা যথাযথ হবে তা হয়তো আমার জানা নেই। শুধু এইটুকুই আমি বলতে পারবো আমি আপনার কাছে ঋণী। আজীবন, চিরকাল ঋণী-ই রইবো।
– নিজেকে আমার কাছে ঋণী করে পর করে দিচ্ছেন বুবু?
মেহরাজের মুখ থেকে বুবু নামটা শুনে মিথিলা কয়েক লহমার জন্যে হয়তো থমকে গেলো। মিথিলার অভ্যন্তরীণ অভিব্যক্তিটা মেহরাজের ঠাওর করতে অসুবিধা হলো না একেবারেই, মুচকি হেসে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল
– আপনি মোহের বুবু হলে আমারও তো বুবু হন তাই না? নিজের বড়ো বোন থাকলে কি তার জন্য আমার কোনো দ্বায়িত্ব থাকতো না? আমি তো শুধু সেটুকুই করেছি।
মিথিলা না চাইতেও চোখ ভরে এলো। মেহরাজকে যেন সাক্ষাৎ দূত মনে হলো। একজন রঙিন দূত যে সাতরঙা রঙে রাঙিয়ে দিতে এসেছে ওর বোনের জীবনটা, অথচ এই মানুষটাকে নিয়েই কতটা বিপরীত, জঘন্য কথা ভেবেছিল মিথিলা।
– আপনি কিভাবে আমার ঠিকানা বের করে যোগাযোগ করলেন জানি নাহ ভাই, আপনি আজ আমায় জীবনের সবচেয়ে বড়ো দায়টা পরিপূর্ণ করিয়ে দিয়েছেন। মোহরের কাছে ক্ষমা না চাইলে আমি মরেও শান্তি পেতাম নাহ। আজ যদি আপনি ওকে আমি পর্যন্ত না এনে দিতেন তাহলে আমি ওকে কখনো নিজের সামনে পেতাম নাহ, লজ্জা অপরাধবোধ নিয়েই আড়ালে কুরে কুরে শেষ হতে হতো আমার।
মেহরাজ এক পলক তাকালো মোহরের অর্ধভেজা মুখের দিকে, যার অনিমেষ চোখের দৃষ্টিটা এখন তার উপরেই নিবন্ধিত। অধর কোণে বাঁকা হাসিটা মেলে রেখেই বলল
– মোহরকে আমি জনসম্মুখে সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছি। ওর দ্বায়িত্ব নিয়ে বউ রূপে যখন গ্রহণ করেছি তখন সুখ, দুঃখ সেসবের খোঁজ রাখাটাও তো আমারই দ্বায়িত্ব তাই নয় কি? বোনকে ছাড়া ও মোটেও ভালো নেই। আমি শুধু ওর মুখের হাসিটুকুই চেয়েছি। আমাকে বারবার ধন্যবাদ দিয়ে লজ্জিত করবেন নাহ।
মোহর অনড়,স্থির রূপে চেয়ে রইলো মেহরাজের মুখের দিকে। বিমুগ্ধতা, ভালোলাগা, অদ্ভুত আলোড়নে ছেয়ে গেলো অন্তঃস্থল।
এই মানুষটা কি করে ওর মনের অবস্থা বুঝলো? কি করে ওর ভেতরটা শুভ্র কাগজের মতো পড়ে ফেলে ম্যাজিকের মতো মনের সুপ্ত খায়েশ টুকু পরিপূর্ণ করে দিলো? দক্ষিণা বাতাসের ন্যায় চাঞ্চল্যকর নির্মল একটা আবেশ ছুঁয়ে গেল মোহরের অন্তরস্থ। যা ওকে মুখস্থ পাঠের ন্যায় বুঝিয়ে দিচ্ছে এই মানুষটা কি,কেমন কিচ্ছু জানে না ও! শুধু এইটুকুই যানে যে মানুষটা ক্ষণে ক্ষণে, প্রতিটা মুহূর্তে নিজের সমস্ত ব্যবহার কথাবার্তা, আচরণ দিয়ে মোহরের মনে তীক্ষ্ণ তীর গেঁ’থে দিচ্ছে।
ধীরে ধীরে মোহরের সমস্ত জীবনটুকু ওই মেহরাজ নামক ব্যক্তিটির পরশে মিইয়ে পড়ছে। খুইয়ে পড়ছে সমস্ত আত্মকাহিনী, অন্তঃসত্ত্বা। শুধু এই একটা মানুষ, তার চেহারা, তার ঘ্রাণ শরীরে প্রতিটি শিরা উপশিরা দিয়ে বাহিত হয়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যাচ্ছে। আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে, অত্যাধিক সুদর্শন চেহারার মতোই সুদর্শন আবহে পুরো অন্তর টাই মেহরাজময় হয়ে পড়ছে, চক্ষে চক্ষে তৃষ্ণার মারণসম গুণের ন্যায় বর্ণসঙ্করিত হচ্ছে মেহরাজ, মেহরাজ আর মেহরাজ-ই।
প্রায় ঘন্টা খানেক সময় অতিবাহিত করে গাড়িতে উঠে বসলো মোহর। ফুলে থাকা চোখ দু’টো আবারও অশ্রু ফোয়ারাতে টসটসে রক্তাভ প্রলেপ মেখে গেল। এতটা সময় বুবুর সাথে থেকেও এখন বিদায় জানাতে মন চাইনা। কিন্তু কিছুই করার নেই। ফিরতে তো হবেই, সেই সুদূর গ্রাম থেকে এসেছে একা শুধুমাত্র বোনের সাথে দেখা করতে।
মোহর জানতে পারলো মিথিলা তার স্বামী সংসার সমেত বেশ কিছুদিন ধরেই ওর শ্বশুড়বাড়িতে আছে। বাচ্চাটার শরীর খুব একটা ভালো না। মিথিলা নিজেও যে সুস্থ নয় তা ওর ফ্যকাসে পান্ডুর চেহারা দেখেই মোহর বুঝেছে। কিন্তু কারণ জিজ্ঞাসা করলে মিথিলা খুব সূক্ষ্ম ভাবেই এড়িয়ে গেছে। সন্ধ্যার আগ দিয়ে বাড়িতে ফিরতে হবে বলেই মন না চাইলেও বাসে উঠে গেল মিথিলা। বাসে উঠে তা ছেড়ে দেওয়ার পর চোখের সামনে থেকে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্তই দাঁড়িয়ে ছিল মোহর, এতটা দিন পর বুবুর দেখা পেয়ে আবারও দূরে সরে যাওয়ায় ঠিক কতটা কষ্ট লাগছে তা হয়তো ব্যাখ্যা করা সম্ভব নাহ। যাওয়ার সময় মোহরের হাতে একটা র্যাপিং করা বেশ ভারী বর্গাকৃতির একটা বস্তু ধরিয়ে দিয়ে বলল ‘এটা তোত জন্যে, বাড়ি গিয়ে খুলে দেখিস’
মেহরাজ গাড়িতে বসেই স্টার্ট দিলো। বেলা ডুবতে শুরু করেছে প্রায়। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এলো। বাড়ি থেকে এই জায়গা টা বেশ দূরবর্তী, তাই অবিলম্বেই দ্রুতবেগে টেনে নিলো চার চাকার গাড়িটি।
শব্দশূন্য গাড়িটির নিস্তব্ধতায় শুধু থেকে থেকে মোহরের ফোঁপানির আওয়াজ টাই কানে আসছে। মেহরাজ স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বার দুয়েক তাকালো মোহরের দিকে, কোলের উপরে মিথিলার দেওয়ার উপহার টা ধরে মাথা নামিয়ে বসে আছে।
একহাতে টিস্যুবক্স থেকে দুটো বের করে মোহরের সামনে ধরলো। ফলাফল শূন্য, মোহর আজ হয়তো ঠিকই করে রেখেছে শুধু কাঁদবেই। এসে থেকে কেঁদে যাচ্ছে, ওকে কাঁদতে দেখতে চাইনা বলেই এতো কিছু করলো আর সেই কিনা বন্যা বইয়ে দিচ্ছে মেয়েটা। মেহরাজের ভ্রু কুচকে এলো, মনে মনে রুষ্ট ও হয়েছে হয়তো, সামনের দিকে তাকিয়েই ভরাট গলায় রসকষহীন ভাবে বলল
– কাঁদতে কাঁদতে চোখ, ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলেছেন মোহ, ওটা যে ছুঁয়ে দেখতে মন চাইবে না সেই গ্যারান্টি কিন্তু আমি দিতে পারছি না।
ধপ করে কান্না থামিকে ঘুরে তাকালো মোহর। হতবুদ্ধির ন্যায় খানিক চেয়ে রইলো৷ চোখ মুখের অভিব্যক্তি ধপ করে বুঝে যাওয়া মোমবাতির মতো ভোঁতা। মেহরাজের কথার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পাক্কা দুই মিনিট লেগে গেলো ওর।
ঠিক এই মুহূর্তে, ওর পাশে বসে মেহরাজ এরূপ কথাও বলতে পারে তা ওর কল্পনাতীত ছিল। মোহরের গ্রস্ত দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ভীষণ নরম স্পর্শে ওর ডান হাতটা নিজের বাঁহাতের মুঠোয় পুরে নিলো মেহরাজ। উদ্বেগ ভরা চোখে শানিত স্বরে বলল
– কাঁদবেন না মোহ। আপনার চোখে আর এক ফোঁটা পানিও দেখতে চাইনা আমি, এতকিছু করার বদলে এক টুকরো হাসিও কি আমি ডিজার্ভ করিনা? তা না হলে চোখের পানি থামাতে আমি অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করবো যেটার জন্যে হয়তো আপনি এখন মোটেও প্রস্তুত নন।
মেহরাজের কথার প্রথম তিন লাইনে আবিষ্টরকম হলেও শেষোক্ত বাক্য দুটি কান ঝিনঝিন করে তুললো মোহরের, কান্না থামিয়ে নীরব স্থির মাথা ঝুকিয়ে নিলো। এই কথাটির পৃষ্ঠে কোনো উত্তর হয় কি না ওর জানা নেই, তবে এর মর্মার্থ টুকু ওকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য একটু বেশিই যথেষ্ট হয়তো।
মোহরের নতজানু মুখটা দেখেও হয়তো ক্ষান্ত হলো না মেহরাজের চুপসানো মনটা। আদ্র জবানের স্পর্শে ঠোঁট দুটি ভিজিয়ে নিলো। নিরতিশয় আলতো স্পর্শে মোহরের কাঁধে হাত চেপে ওকে নিজের কাছে সরিয়ে আনলো, নিজের বুকের কাছে সঞ্চাপিত করে মাথা টা আগলে রাখলো মোহরের, নিমগ্ন গলায় বলল
– আপনার চোখে আমি তখনই অশ্রু সহ্য করবো যখন তা আনন্দের হবে। আর কখনো কাঁদবেনা না মোহ, আপনি কাঁদলে আমার কোনো একটা লুকায়িত জাগায় খুব কষ্ট হয়,যন্ত্রণা হয়। একটা বার শুধু মুখ ফুটে বলবেন কি চাই আপনার, আমি মেহরাজ আমার সবটুকু এনে হাজির করবো আপনার সামনে। তবুও কাঁদবেন না মোহ এটা আপনার কাছে আমার প্রথম অনুরোধ।
জবাবে নিরুত্তর রইলো মোহর। নাইবা একচুল নড়ার চেষ্টা করলো। নিষ্প্রভ, অক্লিষ্ট হয়ে পড়ে রইলো মেহরাজের বুকের সাথে। চোখ বুঁজে শুধু হৃদপিণ্ডের ছন্দপতন টাই শুনতে থাকলো, তার সাথে কানে বেজে উঠলো বাসে উঠার সময় মিথিলার বলা কথা গুলো
” খুব ভাগ্য করে এমন একটা মানুষ পেয়েছিস পুতুল, তোকে ঠিক পুতুলের মতই আগলে রাখবে দেখিস। তোদের মাঝে সম্পর্কটা ঠিক কেমন আমি জানি না, তবে মানুষটা তোকে ভীষণ যত্ন করে ভালোবাসে, ওর চোখ দুটোই বলে দেয় তুই ঠিক কতখানি ওর জন্যা। আগলে রাখিস, এমন মানুষ হারাতে নেই ”
_________________________
– ভাবী বলছি দেখো না এই জামাটা কেমন লাগবে?
কথাটি বলে গাঢ় বেগুনি রঙের একটা ভারী পুথির কাজ করা গাউন টা গায়ের সাথে মেলে ধরলো সাঞ্জে। মোহর তাকিয়ে অবিচলিত গলায় বলল
– খুব সুন্দর লাগবে তোমাকে
– ধ্যাত্ আমি যেইটা ধরছি সেটাতেই তো একই কথা বলছো তুমি, বুঝবো কি করে
– কারণ তোমাকে সবকিছুতেই সুন্দর লাগে সাঞ্জে
মোহরের সুমিষ্ট কথাটিতেও মনটা শান্ত হলো না সাঞ্জের। এক এক করে জামার পাহার তুলে ফেলেছে সোফার উপরে। সকালে মোহরকে ড্রপ করে সাঞ্জে কে নিয়ে শপিংমলে গিয়েছিল মেহরাজ। কাল বাদে পরশু সাঞ্জের জন্মদিন, বড়োলোক বাড়ির মেয়ে অবশ্যই জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই সেলিব্রেশন করবে। তার জন্যেই এতো কেনাকাটা। বাড়ির প্রতিটি মানুষের জন্যেই জামাকাপড় এনেছে। সেটাই এক এক করে দেখাচ্ছে আর এলোমেলো করছে সাঞ্জে।
– এসব কি করছিস বল তো? রাত কতো হলো সে খেয়াল আছে, এগুলো তো কাল ও দেখানো যায়।
প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বলল তাথই। সাঞ্জে জোর করেই বসিয়ে রেখেছে জামা দেখাবে বলে। কিন্তু না ওর কোনোটা ঠিকঠাক পছন্দ হচ্ছে আর নাইবা কাওকে উঠতে দিচ্ছে।
খুঁজতে খুঁজতে হুট করেই সোনালী রঙের একটা ভারী ব্যাগ বের করলো। ভেতর থেকে হালকা গোলাপি রঙের জরজেটের নজরকাড়া একটা শাড়ি বের করে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল
– এই পেয়েছি! ভাবী এই দেখো এটা তোমার জন্যে নিয়েছি। কি সুন্দর তাই না, কি যে মানাবে তোমাকে!
বলে শাড়িটা টান করলো। হালকা রঙের উপর ভারী কাজ করা শাড়িটি আসলেই ভীষণ নজরকাড়া। যে কেও পছন্দ করবে। মোহর শাড়িটির ধরতে হাত বাড়ালেই হুট করে এক টানে সেটা হাতে তুলে নিয়ে বলল
– ওয়াও, সো প্রিটি! এই শাড়িটা না আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে সাঞ্জে, আমার ওরেঞ্জ কালার টা তুমি রেখে দাও, এটা আমি নেই হ্যাঁ?
বলেই নিজের গায়ে শাড়িটা মেলে ধরলো তিয়াসা। উপস্থিত চোখ জোড়া সব ওর দিকেই বিব্রতভাবে তাকিয়ে। সাঞ্জে অপ্রসন্ন গলায় বলল
– এই শাড়িটা আমার না আপু, এটা ভাবীর জন্যে কেনা।
তিয়াসা হাস্যজ্বল মুখটা ছোট করে মোহরের দিকে তাকালো। মেকি দুঃখিত হওয়ার ভান করে বলল
– ও, তোমার। তাইলে আর কি। নাও দিয়ে দিলাম
বলে শাড়িটা মোহরের কোলের উপরে রেখে দিয়ে সরে যেতে নিলে মোহর ওকে পেছন থেকে ডেকে বলল
– দাঁড়াও আপু। শাড়িটা তোমার পছন্দ হয়েছে তুমিই রেখে দাও। তুমি তো এ বাড়ির মেহমান, তোমার পছন্দ হয়েছে আর ওটা আমি নিয়ে নিলে হয়! এমনিতেও শাড়ি খুব একটা পরিনা আমি। এটা বরং আমি তোমাকেই গিফট করলাম এই বাড়ির পক্ষ থেকে
বলে ভীষণ হাসিমুখে তিয়াসার হাতে শাড়িটা ধরিয়ে দিল। মোহরের সূক্ষ্ম কথার ভাঁজে তিয়াসাকে নিজের অবস্থা টা বুঝিয়ে দেওয়া উপস্থিত কারোই ই বুঝতে অসুবিধা হলো নাহ। তাথই ও মোহরের সুর ধরে বলল
– মোহর যখন ভালোবেসে দিচ্ছে রেখে দাও। এমনিতেও তো তুমি এটাই পছন্দ করেছো।
তাথইয়ের সাথে সাঞ্জেও তাল মিলিয়ে বলল। অগত্যা উপায়হীন হয়ে তিয়াসা মেকি হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে গটগট করে প্রস্থান করলো ওখান থেকে।
.
.
.
চলমান
©Humu_❤️