#প্রিয়_অভিমান🥀🥀
|অন্তিম পর্ব|
|শেষ অংশ|
#ফাবিহা_নওশীন
রুহানির অস্থির চোখগুলো বারবার দরজার দিকে ফালাককে খুঁজছে। রুহানি জানে ঢাকা থেকে আসতে অনেক সময় লাগবে কিন্তু ওর অবাধ্য মনটা মানতে চাইছে না। না চাইতেও বারবার চোখজোড়া দরজার দিকে যাচ্ছে। আজ হটাৎ করেই ফালাককে দেখার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠেছে। এতগুলো মাসেও এতটা অস্থির হয়নি। আজ যেন মনের তৃষ্ণা তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। সে মনের তৃষ্ণা একমাত্র ফালাকই মেটাতে পারে।
এরি মধ্যে ডাক্তার দুবার এসে গেছে। রুহানি কয়েকবার ঘুমিয়েও পড়েছে। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। রুহানি ডাক্তারের কথা কানেই নিচ্ছে না। জেদ ধরে আছে। শরীরের ব্যথাটাও জানান দিচ্ছে সময় হয়তো ঘনিয়ে আসছে। রুহানির ক্লান্ত চোখগুলো বন্ধ হয়ে আসছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজের উচ্ছ্বাসময় শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সময়গুলো ভেসে আসছে। কি না করেছে এ জীবনে। হাসি-আনন্দে কেটেছে ছেলেবেলা। ভার্সিটিতে সবার মাথা চিবিয়ে খেয়েছে। কিভাবে সবাইকে র্যাগিং করতো। ফালাকের সাথে প্রথম দিন কি করেছিল সে-সব ভাবতেই মনের অজান্তেই বন্ধ চোখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল।
.
ফালাক ঘর্মাক্ত মুখ মুছতে মুছতে দৌড়াচ্ছে। ওর পথ যেন ফুরোচ্ছে না। এত দীর্ঘ পথ এর আগে পেরোয়নি। ওর এলোমেলো চুলগুলো কপালে আছড়ে পড়ছে। চোখ খুঁজছে তার প্রিয়তমাকে। রিসিপশনে রুহানির খোঁজ নিয়ে কেবিন নং জেনেছে। ফালাক ঝড়ের বেগে পৌঁছে গেছে ওর গন্তব্যে।
রুহানির কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পা কাঁপছে, বুক ধুকধুক করছে। অজানা অনুভূতি হচ্ছে। আর কয়েক পা এগুলেই রুহানিকে দেখতে পাবে, ছুতে পারবে। অন্য রকক ভালো লাগা কাজ করছে। ফালাক ধীরে ধীরে ভেতরে পা দিলো। ওর চোখ পড়ল বেডে শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে। লেপ্টে বাচ্চাদের মতো শুয়ে আছে। এই কয়েক মাসে অনেকটা বদলে গেছে রুহানি। মুখটা শুকিয়ে গেছে। ফালাক এক দৃষ্টিতে রুহানিকে দেখছে। মাঝবয়েসী মহিলাটি ফালাককে দেখে দাঁড়িয়ে গেল।
ফালাকের দিকে দু’পা এগিয়ে বলল,
“কে তুমি বাবা?”
ফালাক রুহানিকে দেখায় এতটা মত্ত ছিল যে রুমের ভেতরে আর কেউ আছে সেটা চোখেই পড়েনি।
“জি আমি ফালাক। রুহানির হাসব্যান্ড।”
ফালাকের কথা শুনে উনার মুখে হাসি ফুটল। তারপর কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলল,
“তোমার জন্যই মেয়েটা এতক্ষণ অপেক্ষা করছে। যাও বাবা। ওর কাছে যাও।”
উনি চোখ মুছতে মুছতে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
ফালাক রুহানির কাছে গিয়ে ওর পাশে বসে ওর কপালে, গালে, নাকে,চোখে, মুখে অনবরত চুমু খেল। গাল বেয়ে পানি রুহানির গালের উপর পড়ল। রুহানি নড়েচড়ে উঠল। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল,
“ফালাক!”
ফালাক রুহানিকে সাড়া দিতে দেখে চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“রুহানি আমি এসেছি।”
রুহানি ধীরে ধীরে চোখ খুলে ফালাককে দেখে আলতো হাসল। ওর হাসি দেখে ফালাকের বুকে শীতল প্রবাহ বয়ে গেল।
রুহানি হাত বাড়িয়ে ফালাকের হাতটা ধরল। তারপর কেঁদে দিল।
“তুমি এসেছো? আমি তো ভেবেছিলাম তোমাকে আর দেখতে পাব না এ জীবনে। তোমাকে দেখার ইচ্ছে আমার অপূর্ণই থেকে যাবে।”
“এভাবে কেন বলছো রুহানি? কেন চলে এলে আমাকে ছেড়ে? অন্যায় করেছিলাম তোমার সাথে কিন্তু বিশ্বাস করো আমার উদ্দেশ্য সৎ ছিল। তুমি আমাকে ভুল বুঝেছো।”
রুহানি হাত বাড়িয়ে বলল,
“আমাকে একটু উঠিয়ে বসাও।”
ফালাক রুহানির হাত ধরে উঠিয়ে বসাল। রুহানি ওর হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠে বসে। ফালাক ওর কপালের উপর থেকে বেবি হেয়ারগুলো দু’হাতে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“রুহানি কি হয়েছে তোমার? তুমি হসপিটালে কেন? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
রুহানি কোন উত্তর না দিয়ে ফালাককে জড়িয়ে ধরল। জড়িয়ে ধরে অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে বলল,
“কিছু হয়নি আমার।”
ফালাক রুহানির কথায় আশ্বস্ত হতে পারছে না। কিন্তু রুহানি কান্না করায় ফালাক পালটা প্রশ্ন করছে না। ফালাক রুহানিযে আরো জোরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে রুহানি মৃদু চিৎকার করে বলল,
“আহ! আমার পেট। ব্যথা পাচ্ছি।”
ফালাক দ্রুত ছেড়ে দিয়ে এক প্রকার ছিটকে সরে গিয়ে বলল,
“কি হয়েছে তোমার পেটে?”
ফালাকের চোখ গেল ওর পেটের দিকে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি। রুহানির দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
রুহানি মৃদু হেসে বলল,
“একটা কিউট বেবি আছে আমার পেটে। আমাদের বেবি। ডাক্তার বলেছে আমাদের একটা পুতুলের মতো মেয়ে হবে।”
ফালাক রুহানির কথা শুনে রিয়েক্ট করতে ভুলে গেছে। একবার রুহানির দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার পেটের দিকে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। ওর চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। এতদিনের সমস্ত কষ্ট যেন নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। রুহানির উপর রাগ করা উচিত কিন্তু তাও করতে পারছে না। রুহানিকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিল। রুহানিও কাঁদছে।
.
যেদিন রাতে চলে এলাম সেদিন সকালে প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট এলো। আমি খুশি হবো না ভয় পাবো বুঝতে পারছিলাম না। তবে এতকিছুর মধ্যে শান্তির একটা উৎস খুঁজে পেয়েছিলাম। খুব ভালো লাগছিলো। কিন্তু সবাই জানাজানির পর কি হবে সেটা ভেবেই মন খারাপ হয়ে গেল।
আমার বেবিকে খুশি মনে একসেপ্ট না করে সেটাকে ইস্যু করে নতুন ঝামেলা তৈরি করবে সেটা আমি মানতে পারছিলাম না। এছাড়া আমি সবার প্রতি বিরক্ত ছিলাম। এক রাশ অভিমান ছিল সবার উপর। বিশেষ করে তোমার উপর। তোমার কথাগুলো আমাকে ভীষণ হার্ট করে তাই সিদ্ধান্ত নেই আমার জীবনে যে শান্তি বয়ে এনেছে তাকে আমি সবার ধরা ছোয়ার বাইরে রাখবো। ওকে কোনো দুঃখ কষ্ট যেন ছুতে না পারে। তাই ভেবেছিলাম আমি আবার নতুন করে বাঁচব। কারো জন্য ভাবব না। কেউ আমার মূল্য দেয়নি। নিজের কথা আর নিজের সন্তানের কথা ভাবব। কোনো আপনজনের কাছে থাকব না। আর না তাদের কাছ থেকে কোনো আঘাত পাবো। তারপর আমার স্কুল লাইফের এক ফ্রেন্ডের সাথে যোগাযোগ করলাম৷ ওর নাম অনিতা। ওর সাথে আমার হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ ছিল। চট্রগ্রাম ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। ও একটা ফ্ল্যাট নিয়ে এক ফ্রেন্ডের সাথে থাকে। আমি সেখানে নির্দ্বিধায় থাকতে পারি। তারপর চলে গেলাম ওর কাছে। ওখানে থেকেই জব খুঁজতে থাকলাম। অনিতা আমাকে কিছু টিউশনি খুঁজে দিল। ছোটখাটো একটা জবও পেয়ে গেলাম। এক রুমের একটা বাসা নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করলাম। আমার এখানে যে আন্টিকে দেখেছো উনি আমার বাসায় কাজ করতো। উনিই এই কয়েক মাস আমার দেখাশোনা করেছেন৷ যখন চার মাস তখন ডাক্তার ব্যাড নিউজ দিল। আমার শরীরের কন্ডিশন ঠিক নেই। বাচ্চা থাকাটা আমার লাইফের জন্য রিক্স। তাছাড়া হার্টের সমস্যা ধরা পড়ল। শ্বাসের সমস্যাও বেড়ে যাচ্ছিল। তাই এবোরশন করাটা জরুরী। হার্টের অপারেশন করার এডভাইস দিলেন। কিন্তু আমি কিছুই করিনি। যে বাচ্চাটা আমার জীবনে শান্তি বয়ে এনেছে। আমার মানসিক শক্তি জুগিয়েছে তাকে আমি মেরে ফেলব? তাকে ছাড়া আমি এই মৃত শরীর দিয়ে কি করব? কি করব আমার শারিরীক সুস্থতা দিয়ে? ওর জন্য সব ছেড়ে চলে এলাম। ওকে সকল পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে চলে এলাম। আর ওকেই মেরে ফেলব? বাঁচতে পারব আমি? তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যদি মরে যাই দুজন এক সাথেই মরে যাব। নিজেকে নয় ওকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করব। এতগুলো মাস লড়াই করে এসেছি সকল অসুস্থতার সাথে। কিন্তু নয় মাসে এসেই হেরে গেলাম। হটাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। শ্বাস নিতে পারছিলাম না। সেন্স হারাই তারপর নিজেকে আবিষ্কার করি হসপিটালে। ডাক্তার বললেন আমার কন্ডিশন ভালো না। আমার জন্য বাচ্চাও রিক্সে আছে। তাই সিজার করা জরুরী। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করলে আমার সাথে সাথে ওরও ক্ষতি হতে পারে।”
রুহানি থেমে ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাক ওর কথা শুনে শকডে আছে। রুহানি অনুনয়ের সুরে বলল,
“ফালাক আমি মরে গেলেও আপসোস নেই। আমি আমার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে চাই। আমি চাই ও পৃথিবীর আলো দেখুক। হেসে খেলে বড় হোক।”
ফালাক রুহানির হাত ধরে বলল,
“ওর কিছু হবে না। ওর বাবা এসে পড়েছে। তোমার এত সেক্রিফাইজ হেলায় যেতে পারে না। সাহস রাখো।”
রুহানি হালকা হেসে বলল,
“আমি এখন ওটিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমার বাচ্চা আর এখন একা নয়। চলে এসেছে ওর বাবা।”
ফালাক ওর হাত ছাড়িয়ে বলল,
“আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসি।”
রুহানি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে নিল। ফালাক ডাক্তারের সাথে কথা বলতেই ডাক্তার বললেন,
“পেসেন্টের অবস্থা ভালো না। উনার আশা ছেড়ে দিন। উনি নিজেও জানে উনার জীবনের কোনো আশা নেই। তবুও আমরা আমাদের চেষ্টা করব। তবে আপনাদের সব ধরনের খবরের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। উনার বাচার আশা ১% ও নেই। আপনি আগের রিপোর্টগুলো দেখলে বুঝতে পারতেন। উনি নিজেই নিজের জীবন রিক্সে ফেলেছেন।”
ফালাক ডাক্তারের কথা শুনে একদম ভেঙে পড়ল। মনে হচ্ছে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এতদিন রুহানিকে না পেয়েই ভালো ছিল। আজ পেয়ে কি করে হারাবে? কি করে সেই ব্যথা সহ্য করবে?
“আপনি ওর জন্য হসপিটালের সবচেয়ে ভালো ডাক্তার আর ওটির ব্যবস্থা করুন। আর প্লিজ ওকে বাঁচিয়ে দিন। ওকে অনেক দিন পর পেয়েছি। এতদিন অভিমান করে আমাদের থেকে দূরে ছিল। একা একাই অসুস্থতার সাথে লড়াই করেছে। এতদিন পর পেয়ে ওকে হারাতে পারব না। সে শক্তি আমাদের নেই। প্লিজ ডক্টর।” (হাত জোড় করে)
ডাক্তার ফালাকের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমরা চেষ্টা করছি।”
ডাক্তার ওটির ব্যবস্থা করতে যেতেই ফালাক কান্নায় ভেঙে পড়ল। মেঝেতে বসে হাওমাও করে কাঁদছে। রুহানির মা, ভাই রুহান, নুশা, রনক সবাই দৌড়ে আসছে। ফালাককে এভাবে মেঝেতে বসে কাঁদতে দেখে ওরা ঘাবড়ে গেল। রনক ওর পাশে বসে বলল,
“ভাই কাঁদছেন কেন? রুহানি কোথায়?”
ফালাক কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ওটিতে নিয়ে গেছে।”
“আপনি কাঁদছেন কেন?”
সবার দৃষ্টি ওর দিকে। ফালাক কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ওর অবস্থা ভালো না। ডাক্তার বলছে রুহানির বাঁচার সম্ভবনা নেই।” ফালাক আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল। ফালাকের কথা শুনে সবাই হতবাক। রুহানির মা ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল।
নুশা উনাকে সামলাচ্ছে।
“নুশা ও কি বলছে? আমার মেয়েটার কি হয়েছে? কি বলছে ওরা?”
“আন্টি কিছু হবে না। রুহানি ঠিক হয়ে যাবে।” নুশা কাঁদতে কাঁদতে বলল।
ফালাক একটা বেঞ্চিতে বসে কেঁদেই যাচ্ছে আর দোয়া করছে ও যেন সুস্থ হয়ে যায়।
ডাক্তার বেরুতেই সবাই দৌড়ে গেল। নার্স সাদা তোয়ালে পেঁচিয়ে একটা বাচ্চাকে নিয়ে এলেন। রুহানির মা বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলেন। ফুটফুটে মেয়ে শিশুকে কোলে নিয়ে চুমু খেল। ফালাক শুকনো মুখে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল,
“রুহানি…. আমার স্ত্রী?”
ডাক্তার মুখ ভার করে বলল,
“উনার হাতে বেশি সময় নেই। আপনারা দেখা করে নিন। কিছু বলার থাকলে বলে নিন।”
(চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। তাই ভুল ক্ষমা করবেন)
ডাক্তারের কথা শুনে ফালাক অনুভূতি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও যেন হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। রুহানির মা পড়ে যেতে নিলে নুশা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে রনকের কোলে দিয়ে উনাকে সামলাচ্ছে। সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ল।
ডাক্তার ওদের অবস্থা দেখে বলল,
“আপনারা কান্নাকাটি থামান। পেসেন্টের সাথে দেখা করুন। উনি আপনাদের অপেক্ষায় আছেন। উনার সামনে কান্নাকাটি করবেন না। সময় কম।”
ফালাক নিজেকে সামলাতে পারছে না। কি করে সামলাবে? এতদিন যাকে খুঁজেছে তাকে মৃত্যু শয্যায় দেখছে। যে কিছুক্ষণ পরে মারা যাবে। যাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে,যার পাগলামিগুলো ভালোবেসেছে। তাকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবে? বাঁচবে কি করে? ওর বুকের ভেতর তুলুল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। নিজেকেই মুমূর্ষু রোগী মনে হচ্ছে। ফালাক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রনক ছলছল চোখে রুহানির বাচ্চার দিকে তাকাল। তারপর ফালাককে বলল,
“ভাই, নিজেকে সামলান। আপনি এমন করলে এই ফুটফুটে বাচ্চাটার ভবিষ্যত কি হবে? নিজেকে সামলে রুহানির সাথে দেখা করুন। পরে নাহলে পস্তাতে হতে পারে। প্লিজ ভাই যান।”
ফালাক কোন কথা না বলে পাশের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে পড়ল। যে আশা টুকু ছিল তাও নিভে গেল। এমন কিছু কখনো ওর কান শুনবে ভাবতেও পারেনি।
কেউ ভেতরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত না তাই রনক যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। রনক রুহানির মেয়েকে রুহানের কোলে দিয়ে ভেতরে গেল।
রনক ভেতরে গিয়ে থমকে গেল। বেডে যে মেয়েটা শুয়ে আছে তাকে রুহানি মনেই হচ্ছে না। রুহানি একটা ঝড়ের নাম৷ সে এত শান্ত কি করে হতে পারে? রুহানি চোখ বন্ধ করে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। রনকের বুকটা হু হু করে উঠল। যে মেয়েটা পুরো ভার্সিটি জুড়ে রাজ করে বেড়াতো। যার চঞ্চলতায় মুখরিত থাকত আশেপাশ সে এত স্থির হয়ে শুয়ে আছে। কি অদ্ভুত!
রুহানি কারো আসার শব্দে পিটপিট করে চোখ মেলল। রনককে দেখে আলতো করে হাসল। রনক জোর করে একটু হাসল। রুহানি কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না।
রনক ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল,
“আমি একা আসিনি। আন্টি, রুহান, নুশাও এসেছে। ওরা বাবুকে দেখছে। এখুনি চলে আসবে। তোমার মেয়ে মাশাল্লাহ তোমার চেয়েও সুন্দর হয়েছে। আস্ত একটা পরী।”
রুহানি আবারও আলতো হাসল। তারপর জড়ানো গলায় বলল,
“ফা…লা..ক।”
রুহানি যেন কষ্ট করে আর কিছু বলার চেষ্টা না করে তাই দ্রুত বলল,
“ভাইয়াও বাইরে। এখুনি চলে আসবে। তুমি একটু রেস্ট করো। নতুন অতিথিকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত।”
রুহানি মনে মনে বলছে,
“রেস্ট তো করব। সারাজীবনের জন্য দুনিয়ার সব দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাচ্ছি।”
এরি মাঝে রুহানির মা কাঁদতে কাঁদতে ভেতরে ঢুকল। রুহানির কাছে এসে রুহানির হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দে মা। ক্ষমা করে দে। আমার জন্য আজ তোর এই অবস্থা। আমার জন্য এত কষ্ট সহ্য করেছিস। ক্ষমা করে দে। আমি নিজেকে মাফ করতে পারছি না।”
রুহানি কথা বলছে পারছে না। তবুও বলার চেষ্টা করছে,
“এ-সব আমি ভুলে গেছি মা।”
নুশা আর রুহান ভেতরে ঢুকল। আর পেছনে পেছনে ফালাক আসছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব কেঁদেছে। রুহানি, রুহান আর নুশার দিকে চেয়ে আলতো হাসল। রুহানির মা নাতনিকে কোলে নিয়ে রুহানির কাছে দিল। রুহানি নিতে পারছে না। কাত হয়ে দু’হাতে কোনোরকমে নিয়ে চোখের পানি ফেলে ওর কপালে গালে চুমু খেল।
“আমার কলিজাটা। আর কি চাই আমার?”
রুহানি পারছে না তাই ফালাক ওর পাশে গিয়ে বসে এক হাতে বাবুকে ধরল। রুহানি রুহানের দিকে চেয়ে বলল,
“ছবি তোল একটা।”
সবাই ওর কথা শুনে অবাক। রুহানি চায় ওর মেয়ের জন্য একটা স্মৃতি চিহ্ন রেখে যেতে। রুহান সবার দিকে একবার চেয়ে ক্যাপচার করে নিল ওদের সুন্দর মুহুর্তগুলো।
রুহানি ধরে রাখতে পারছে না তাই ফালাক বাবুকে কোলে তুলে নিল। কোলে নিতেই অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায় ওর মনে। কেমন একটা ভালোলাগা অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রাখছে ওকে। ফালাক ওর মুখের দিকে তাকাল। ওর মুখের দিকে চেয়ে যেন ওর সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সমস্ত পৃথিবীর সুখ ওর কাছে ধরা দিয়েছে। ফালাক আলতো হেসে চুমু খেয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে আজান দিয়ে বলল,
“তোমার নাম রুহা। তুমি তোমার মায়ের অংশ তাই তোমার নামটাও তোমার মায়ের নামের অংশেই থাক।”
নাম শুনে রুহানির চোখে খুশিতে পানি চলে এল। ফালাক বুকের কাছে নিয়ে আলতো করে জড়িয়ে রুহানির দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“সুন্দর একটা অনুভূতি হচ্ছে।”
রুহানি ফালাকের হাত ধরে বলল,
“ও এখন থেকে তোমার সবকিছু। ওকে কখনো কষ্ট দেবে না। ওকে তোমার মতো ভদ্র, শান্ত স্বভাবের বানাবে। সুশিক্ষায় মানুষের মতো মানুষ বানাবে। কখনো কোনো সিদ্ধান্ত ওর উপর চাপিয়ে দিবে না। ওকে কখনো একা ছেড়ে দিবে না। সব সময় পাশে থাকবে।”
রুহানি কথাগুলো বলে কেঁদে দিল। রুহানির মা-ও কাঁদছে।
রুহানির মা বেশ বুঝতে পারছে ও কি মিন করছে।
রুহানি কান্না থামিয়ে বাবুর গালে হাত ছুইয়ে দিল। বাবু পিটপিট করে তাকাল রুহানির দিকে। রুহানি আলতো হাসল। তারপর ঢোক গিলে ফালাককে বলল,
“আমাকে জড়িয়ে আমার পাশে একটু শুবে?”
রুহানির আকুতিভরা কথাগুলো ফালাকের সহ্য হচ্ছে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। ফালাক নুশার দিকে ইশারা করল। নুশা বাবুকে কোলে নিয়ে সবাইকে ইশারা করে বাইরে চলে গেল। নুশার পেছনে পেছনে সবাই বাইরে চলে গেল।
ফালাক রুহানির পাশে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রুহানি ফালাকের মুখের দিকে চেয়ে আছে। ফালাককে যেন আজন্মের দেখা দেখছে।
রুহানি হাত বাড়িয়ে ফালাকের সমস্ত মুখে হাত বুলাচ্ছে। ফালাক চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে। ফালাক রুহানিকে হালকা করে তুলে বুকে নিল। রুহানি ফালাকের বুকে নিশ্চুপ হয়ে মাথা দিয়ে রাখল।
“আমি তোমাকে একা রেখে যাচ্ছি না। রুহাকে তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি। তাই আমাকে স্বার্থপর বলো না। ও এতদিন আমার কাছে তোমার আমানত ছিল আজ থেকে ও তোমার কাছে আমার আমানত। ঠিকমত দায়িত্ব পালন করো।”
ফালাক আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না। সব বাঁধ ভেঙে গেল। শব্দ করে কেঁদে দিল।
“রুহানি আমি রুহাকে কখনো কষ্ট দেব না। কিন্তু তোমাকে আমাদের সাথে থাকতে হবে। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। মরে যাব। বলো তুমি থাকবে আমাদের সাথে। রুহাকে আমি কি জবাব দেব? তোমাকে ওর প্রয়োজন রুহানি। আমাদের ছেড়ে যেও না।”
রুহানি টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। শ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে। ওর কাঁদতে কাঁদতে হেচঁকি উঠে যাচ্ছে।
“ফালাক আমি বাঁচতে চাই। আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে। রুহাকে আদর করতে ইচ্ছে করছে। কোলে নিতে ইচ্ছে করছে। ওর বড় হওয়া দেখতে ইচ্ছে করছে। তোমার বুকে মাথা দিয়ে রোজ ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। আমার বাঁচতে খুব ইচ্ছে করছে। আমি বাঁচতে চাই। তোমাদের সঙ্গে থাকতে চাই।”
রুহানি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। ফালাক ওর অবস্থা দেখে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
“রুহানি শান্ত হও। কিছু হবে না তোমার। তোমার কিছু হবে না। চুপ করে থাকো।”
রুহানি চুপ করে গেল। চুপ করে ওর বুকে মাথা দিয়ে রাখল। ফালাক নিঃশব্দে কাঁদছে আর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ এভাবে বয়ে গেল। রুহানি আর সাড়াশব্দ দিচ্ছে না। ফালাক ওর নাম ধরে কয়েকবার ডাকল কিন্তু ও সাড়াশব্দ দিচ্ছে না।
ফালাক রুহানির সাড়াশব্দ না পেয়ে ভয় পেয়ে গেল। ওর বুক কেঁপে উঠল। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। ফালাক রুহানিকে ওর বুক থেকে তুলে ওর গালে হাত দিয়ে বারবার ডাকছে। কিন্তু রুহানি নড়ছে না। ফালাক উঠে ওর নার্ভ চেক করল। কোনো রেসপন্স নেই৷ চিৎকার করে ডাক্তারকে ডাকল। ডাক্তারের সাথে সবাই ভেতরে এলো। ডাক্তার চেক করছে রুহানিকে। সবার বুক ঢিপঢিপ করছে।
ডাক্তার ওকে চেক করে বিমর্ষ মুখে ওদের দিকে নিচুস্বরে বলল,
“সি ইজ নো মোর।”
সবাই ডাক্তারের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ কাঁদতেও পারছে না। ফালাকের পুরো দুনিয়া যেন দুলছে। ও স্থির থাকতে পারছে না। ব্যালেন্স হারিয়ে বসে পড়ে বলল,
“নাহ এ হতে পারে না। রুহানি আমাকে আর রুহাকে একা ছেড়ে কিছুতেই চলে যেতে পারে না। ও আমাকে বলেছে ও থাকতে চায় আমাদের সাথে। তাহলে কি করে?”
সবার আহাজারিতে পুরো রুম ভারী হয়ে গেল। রুহানির মা বুক চাপড়ে কাঁদছে। নুশা রুহাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। ফালাক রুহানির কাছে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। রুহানিকের হাত ধরে বলছে,
“তুমি থাকতে চাও বলে চলে গেলে কেন? আমি কি করে বাঁচব? রুহার কথা ভাবলে না? রুহানি!”
ফালাক রুহানির নাম ধরে চিৎকার করছে। রুহাও কেঁদে উঠল। বাচ্চা মেয়েটাও হয়তো বুঝেছে জন্ম নিতেই মা হারা হয়ে গেল এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে। রুহার কান্না দেখে সবার কান্নার গতি বেড়ে গেল। নার্সরা দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছছে। এ এক ভয়ানক দৃশ্য। হৃদয়বিদারক দৃশ্য। কোনো মানব হৃদয় এ দৃশ্য সহ্য করতে পারবে না।
.
ফালাক বেলি ফুলের গাছের কাছে বসে আছে। সামনেই কবর। রুহানির কবর। ফালাক দু’হাত তুলে ফাতিহা পড়ে দোয়া করে চোখের পানি মুছে বলল,
“আচ্ছা রুহানি তুমি কি আমাদের দেখো? আমাদের যদি দেখে থাকো তবে কি তোমার হিংসা হয় না? রুহা আমাকে এত ভালোবাসে তোমার তো হিংসা হওয়ার কথা। কারণ তুমি ওর কেয়ারগুলো পাচ্ছো না। জানো তো মাঝে মাঝে তোমার প্রতি বড্ড অভিমান হয়। ভাবি আর আসব না। কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করে তোমার কাছে না এসে আমি থাকতে পারি না। তোমার সাথে কথা না বললে মনে শান্তি পাইনা। রাগ করছো? তোমার এত অভিমান,তবে আমি কেন অভিমান করতে পারব না? আমার কি অধিকার নেই? উফফ, তোমার মেয়ে নিশ্চয়ই গাল ফুলিয়ে বসে আছে। আমাকে যেতে হবে। আবার আসব।”
.
রুহা চাঁদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। ফালাক ঘড়ির দিকে তাকাল। মাত্র ৯টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি কি করে ঘুমালো?
ফালাক রুহার পাশে শুয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রুহা অন্যদিকে ঘুরে গিয়ে বলল,
“আজও মাম্মার সাথে একা দেখা করতে গিয়েছো? আড়ি তোমার সাথে।”
ফালাক বুঝল মেয়ের বড্ড রাগ না ঠিক রাগ না অভিমান হয়েছে। ফালাক ব্যস্ত হয়ে পড়ল মেয়ের অভিমান ভাঙাতে।
.
রুহা ফালাকের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। ও রুহানির ডুব্লিকেট হয়েছে। রুহানির চেহারা পেয়েছে। চোখগুলো ফালাকের তথাকথিত বিড়ালের মতো চোখ। সেই সরু নাক। ফালাকের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ফালাক চোখ মুছে ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করল।
“যদি মনে পড়ে আমায় ভীষণ ভাবে
আগলে রেখো প্রিয় অভিমানে….
অনুরাগে সিক্ত তোমার নাম
প্রিয় অভিমান……।”
সমাপ্ত!
Ei lekhata podar jonoo Ami sararat jege a6i, golpota khub I sundor.majher porbe kake be6e nebe Protek ta meye ei situation Tay pode, tokhon sobai vebe pay na ki korbe, kintu sesar porbo ta j eto mormantik Hobe seta bujhte parini. Nijer ojane te chokhe jol chole elo. Jeno Mone hoy6ilo Ami okhane a6i.