প্রিয়_অভিমান🥀🥀পর্ব-৪
#ফাবিহা_নওশীন
||
রুহানি যেতেই রনক বই খুলে বসেছে। ওকে বড় হতে হবে, অনেক বড়। পড়াশোনা ছাড়া অন্যকিছুকে প্রায়োরিটি দেওয়া যাবে না। রনক এক পৃষ্ঠা শেষ করে পরের পৃষ্ঠায় চোখ দিতেই ফালাক চেয়ার টেনে রনকের বরাবর বসল। রনক একবার ফালাকের দিকে চেয়ে বইয়ে মনোযোগ দিল।
ফালাক রনককে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“কোন ইয়ার?”
রনক ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাকের পড়নে এস কালার শার্ট, কালো চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো। শার্টে সানগ্লাস ঝুলানো। চেহারায় ইনোসেন্ট ভাব। সব মিলিয়ে ফালাককে ভদ্রলোক মনে হলো রনকের। তাই নিশ্চিন্তে কথা বলার সাহস পেল।
রনক স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“জি ভাইয়া, থার্ড ইয়ার।”
ফালাক বুঝতে পারল ও রুহানির ক্লাসমেট। তারপর বলল,
“ওহ! গুড। কি নাম তোমার?”
রনক আবারও একটু হেসে বলল,
“রনক হাসান।”
“ওহ,সুন্দর নাম। রুহানির ফ্রেন্ড?” ফালাক উত্তরের আশায় ভ্রু উঁচিয়ে চেয়ে আছে।
রুহানির নাম শুনে রনকের পিলে চমকে গেল।
“জি না, ক্লাসমেট। আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি ওর ফ্রেন্ড হতে পারি?”
“না আসলে তোমাদের এক সাথে বসে আড্ডা দিতে দেখলাম তাই।”
রনক বই বন্ধ করে বলল,
“আড্ডা না ভাই। ও তো আমাকে টাইট দিতে এসেছিল। বিলাই চক্ষুর হাত থেকে বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। কখন যে ওর মাথায় কি চলে বুঝা মুশকিল।”
ফালাক বুঝতে না পেরে বলল,
“টাইট! টাইট মানে? ওয়েট ওয়েট তার আগে বলো বিলাই চক্ষু মানে কি?”
রনক ইতস্তত করছে। মুখ ফস্কে কি বলে ফেলল।
রনক আমতা আমতা করে বলল,
“আপনার, আমার চোখের মণি কালো। সাধারণ সবার চোখের মণি কালো হয় কিন্তু রুহানির চোখের মণি বাদামি রঙের। আমাদের গ্রামে কারো চোখের মণি বাদামি হলে তাকে বলে বিলাই চক্ষু। মানে বিড়ালের চোখ।”
ফালাক এতক্ষণে কাহিনি বুঝতে পারল। তারপর বলল,
“ওহ! আচ্ছা!”
তারপর মনে মনে বলল,”বিল্লি রাণী!” তারপর মুচকি হাসল। রনক ওর মুখের দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছে।
ফালাক সেটা খেয়াল করে স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“ওর থেকে সাবধানে থেকো। তারছিড়া ডেঞ্জারাস একটা মেয়ে।”
রনক শুকনো হেসে বলল,
“সে উপায় নেই।”
ফালাক প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। তারপর রনক সব খুলে বলল। সব শুনে ফালাক বলল,
“সাবধানে থেকো আর পারো তো একটু মানুষ বানানোর চেষ্টা কর।”
“আমি মানুষ বানাব ওকে? ও আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। আমাকে এই শহরে দশবার বিক্রি করে কিনে আনতে পারবে।”
ফালাক ওর কথা শুনে আলতো হেসে পিঠে চাপট মেরে বলল,
“কথা ঠিক। সাবধানে থেকো আর পড়া কেরি অন কর। আমি উঠি।”
ফালাক উঠে গেল আর রনক আবারও বই খুলে বসল।
।
রুহানি নুশার সাথে বসতে গিয়েও ফিরে এসে রনকের বেঞ্চের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর খাতা দিয়ে রনকের পিঠে হালকা করে মেরে বলল,
“সর বসার জায়গা দে।”
রনক তরিঘটি করে সরে বসল। একদম কিনারে গিয়ে বসল। মনে হচ্ছে এই বুঝি পড়ে যাবে। রুহানি বসে বসে চুল ঠিক করছে। ওর সেদিকে খেয়াল নেই।
রুহানি রনকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই তুই আমাকে পড়াবি? মানে টিউশন। পড়াবি? স্যালারি যা চাইবি তাই দেব। তবে কম কম পড়াবি। যাতে পাশটা করে যেতে পারি। বাবা যেসব টিউটর রেখে দেন সবগুলো রাক্ষসের মতো খায় আর বস্তা ভরে পড়া দিয়ে যায়।”
রনক বুঝতে পারছে না কি বলবে। রুহানিকে পড়াতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ওর আচরণের জন্য ভয় পাচ্ছে।
“ওই ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি কি তোকে খেয়ে ফেলব?”
রনক আমতা আমতা করছে। না করার বাহানা খুঁজছে। রুহানি ধমক দিয়ে বলল,
“খবরদার! না করবি না। তুই আমাকে আজ থেকে পড়াচ্ছিস ব্যাস। ছুটির পর আমার সঙ্গে যাবি আমাকে পড়িয়ে তারপর তোর বাসায় ফিরবি।”
রনক কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না। রুহানি রনকের খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ও একটা মেসে থাকে। একটা টিউশনি করে মেসের ভাড়া, খাওয়ার খরচ, পকেট খরচ বহন করে। রোজ হেঁটে ভার্সিটি আসে যায়, টিউশনিতেও হেঁটে যায়, সিংগাড়া,পুরি দিয়ে সকালের নাস্তা করে। একটা টিউশনিতে ওর টানাটানি পড়ে যায় তাই আরো টিউশনি খুঁজছে। রুহানি ওকে সাহায্য করতে চায় কিন্তু রনককে যতটুকু চিনেছে তাতে এটুকু তো জেনেছে ও কারো কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিবে না। তাই এই ব্যবস্থা।
রনক মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ঠিক আছে।”
রুহানি নড়েচড়ে বসে বলল,
“তাহলে সব ক্লিয়ার করি। যে চারদিন ভার্সিটিতে ক্লাস আছে সে চারদিন এক ঘন্টা করে আমার বাসায় গিয়ে পড়াবি। স্যালারি দেব দশ হাজার।”
রনক চোখ বড়বড় করে বলল,
“এত! আমি এত স্যালারি নেব না।”
রুহানি ভেবেছিল কমই বলেছে কিন্তু রনকের কাছে তো অনেক।
“আমাকে কি তোর নরমাল স্টুডেন্ট মনে হয়? আমাকে পড়াতে হলে অনেক ঝামেলা সহ্য করতে হবে, দেখা গেল এক ঘন্টার জায়গায় তোর তিনঘণ্টা চলে গেল তাই… নয়তো আমার কি টাকা বেশি হয়ে গেছে যে তোকে দেব।”
রনক মেনে নিল রুহানির শর্ত। রুহানি আরো হাজারটা শর্ত জুড়ে দিল।
।
রুহানি আজকে রনককে ট্রিট দিবে। রনক পড়েছে জ্বালায়। রুহানির সব কথা ভয়ে মেনে নেয়। রুহানি ফালাককে সামনের টেবিলে দেখল। কানে ফোন। কারো সাথে গম্ভীর সুরে কথা বলছে।
ঠোঁটের নড়াচড়া, চোখের পলক, চেহারার ভঙ্গি বলছে কারো সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে।
“এই সিনিয়র তো দেখি সারাক্ষণ কানে ফোন গুজে রাখে। এত কার সাথে কথা বলে? গার্লফ্রেন্ড না-কি? এই লোকের গার্লফ্রেন্ড? মাই গড! বেচারি!”
ফালাক কানে ফোন রেখেই কফির অর্ডার করল। রুহানি উঠে গেল। ফালাকের কফি রেডি। ফালাক বেখেয়ালি ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি মরিচের গুঁড়োর কৌটা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ফালাক মাথা চুলকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে কিছু বলছে। রুহানি সুযোগের অপেক্ষায় আছে। ফালাক অন্যদিকে ঘুরতেই কফির উপর মরিচের গুঁড়ো দিয়ে দিল। অনেকেরই চোখে পড়েছে কিন্তু কেউ টু শব্দ করার সাহস করে নি। ফালাক কাপ নিয়ে টেবিলে রেখে চেয়ার টেনে বসে। রুহানি শুধু অপেক্ষায় আছে কখন মুখে তুলবে আর মনে মনে প্রার্থনা করছে ফালাক যেন বেখেয়ালি ভাবেই মুখে দেয়। ফালাক চামচ দিয়ে নেড়ে মুখে দেয়। এক চুমুক দিয়ে টেবিলের উপর রাখে। ফোনে কথা বলছে। রুহানি ভ্রু উঁচিয়ে চোখ বড়বড় করে রেখেছে। ফালাকের কোন রিয়েকশন নেই। ফালাক আবার আরেক চুমুক দিল। তারপর কফির দিকে সন্দেহের দৃষ্টি দিল। কেমন ঝাল ঝাল লাগছে। কিন্তু কফি তো এমন লাগার কথা না। গলাটা জ্বলে যাচ্ছে। ফালাক ট্রাই করার জন্য কফি মুখের সামনে এনেও সরিয়ে ফেলে। ওর প্রচন্ড ঝাল লাগছে। সাংঘাতিক ঝাল। ফোন কেটে দিল। ওর কেমন খটকা লাগছে। তারপর কফি নিয়ে গবেষণা করতে লাগল। কিন্তু যেই হারে ঝাল লাগছে তাতে আর সম্ভব হলো না। দ্রুত পানি খেল। তারপর রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। ঝাল কফি কে চেয়েছে? ওর সাথে ফাজলামি করছে না-কি?
তখনই চোখ পড়ল রুহানির দিকে। রুহানি ঘনঘন চোখের পলক ফেলে টেডি স্মাইল দিল। এই কাজ রুহানির তা বুঝতে সময় লাগল না। রুহানি পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল, কফিটা কেমন লাগল জানাবেন।
ফালাক বিল পে করে রুহানির পিছু নিল। রুহানি ফালাককে খেয়াল করে নি। পুকুর পাড়ে গিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে উদাসীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে কেউ নেই। এই জায়গাটা বরাবরই নীরব। স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। রুহানির চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তবে বিষয়টা উপভোগ করছে। কারো পায়ের শব্দে পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। ফালাককে দেখে ঘাবড়ে গেল। ফালাক হিংস্র চোখে চেয়ে আছে। যেন চোখে আগ্নেয়গিরি বইছে। ফালাক রুহানির দিকে এগুচ্ছে। রুহানি প্রথমে অটল ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও পরে পেছনে সরতে বাধ্য হলো। যতই হোক একটা মেয়ে। একটা ছেলেকে এতটা কাছে আশার পারমিশন দিবে না। স্বাভাবিকভাবে ভয়টাও কাজ করছে।
রুহানি পিছনে সরে বলল,
“অসভ্যের মতো আগাচ্ছেন কেন? নূন্যতম কমন সেন্স নেই?”
“তুমি ভয় পাচ্ছো কেন?” (বিদ্রুপ করে)
“কারণ আমি একটা মেয়ে। আর কোন মেয়েই চাইবে না যাকে অপছন্দ করে সে তার ছায়া মারাক।”
ফালাক অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“মেয়ে! সিরিয়াসলি! তুমি মেয়ে? কোনদিক দিয়ে?”
রুহানি ফালাকের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল।
“মানে কি? আমি মেয়ে নই তো ছেলে?”
ফালাক বলল, “দাঁড়াও ভেবে বলি।”
ফালাক রুহানিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ভাবার ভান করছে। রুহানি চোখ মুখ শক্ত করে ওর দিকে চেয়ে আছে যেন এখুনি ওকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে।
ফালাক হুট করে বলল,
“ছেলেই তো মনে হচ্ছে। মেয়ের কোন গুণ তোমার মধ্যে বিদ্যমান নেই। ছেলে মনে হলেও তুমি বিল্লি রাণী।”
রুহানি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।
“বিল্লি রাণী মানে?”
“বিড়ালদের রাণী। তোমার ওই বিড়ালের মতো চোখ তার প্রমাণ।”
রুহানি অপমানিত বোধ করল। ফালাক ওর চোখ নিয়ে কথা বলছে। তাও বিড়ালের চোখ! রুহানি ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“আর আপনি খাটাশ। খাটাশের সর্দার। আপনার চোখ খাটাশের মতো। যা রহস্য আর শিকারের নেশায় ভরপুর।”
ফালাক রুহানির কথা শুনে অবাক হলো। ভিষণ অবাক হলো। ওর চোখের এমন অদ্ভুত সজ্ঞা আজ পর্যন্ত কেউ দেয় নি। রুহানি হনহন করে হেঁটে চলে গেল। ফালাক তখনও দাঁড়িয়ে আছে। রুহানির যাওয়া দেখছে।
চলবে…..