প্রিয়_অভিমান🥀🥀পর্ব-২৪
#ফাবিহা_নওশীন
||
সকালের আলো ফুটেছে। স্নিগ্ধ মিষ্টি রোদ জানালা ভেদ করে রুহানির বিছানায় পড়েছে। পুরো ঘরে আলোর আভা জানান দিচ্ছে সকাল হয়েছে। কিন্তু রুহানির বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। চোখে এখনও ঘুম লেগে আছে। অনেক রাত পর্যন্ত ফালাকের সাথে কথা বলেছে। রুহানি গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় দুম দুম শব্দ। মনে হচ্ছে বাইরে যুদ্ধ লেগে গেছে। আর যুদ্ধের সেই বোমা বারুদ ওর দরজায় পড়ছে।
রুহানির মা বারবার রুহানিকে ডেকে যাচ্ছে। রুহানি আর না পেরে উঠে বসে পড়ল।
“ওহ, মা থামো এবার। উঠে পড়েছি।”
দরজায় আর কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। রুহানি হাই তুলে চোখ বন্ধ করে বিছানায় চুপটি করে বসে আছে। ইচ্ছে করছে বিছানায় শুইয়ে পড়তে। রুহানি চোখ খুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে আটটা বাজছে। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হতে গেল।
।
ইন্সটিটিউটে পা রাখতেই ওর ফোন বেজে উঠল। রুহানি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে স্কিনে তাকাল। ফোনের স্কিনে আহিলের নামটা জ্বলজ্বল করছে। আহিল কি বলতে ফোন করেছে সেটা ভাবতে ভাবতে কেটে গেল। রুহানি নিজেই কল করে নিল।
আহিল অপর পাশ থেকে ফোন রিসিভ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ভেবেছিলাম ইচ্ছে করেই ধরছো না। রাতে অনেক বার ফোন করেছি ব্যস্ত পেয়েছি। নিশ্চয়ই ফালাকের সাথে ব্যস্ত ছিলে।”
রুহানি ছোট্ট করে বলল, “হুম।”
আহিল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। রুহানি কানে ফোন নিয়ে অফিস রুমের দিকে যাচ্ছে।
“রুহানি আমি ফালাকের সম্পর্কে জানতে চাই। যদি ফালাক সব দিক দিয়ে তোমার জন্য পারফেক্ট হয় তবে আমি তোমার বাবা-মার সাথে কথা বলব। ফালাকের ফ্যামিলির সাথেও কথা বলব। আমার কোন আপত্তি থাকবে না। যতই হোক আমার একটা দায়িত্ব আছে তোমার প্রতি সেটা এড়িয়ে যেতে চাই না।”
রুহানি ফালাকের পরিচয় দিল, ওর সম্পর্কে সব কিছু বলার পর বলল,
“আমি আপনাকে ফালাকের পরিচয় দিলাম অন্য কারণে। ভালোবেসেছি কোন ক্রাইম করি নি। লুকানোর কিছু নেই তাই। আমি জানি ফালাক আমার জন্য পারফেক্ট আর হোপফুলি আপনারও সেটাই মনে হবে।”
আহিল মৃদু হাসল। মৃদু হেসে বলল,
“ফালাকের কাছেও নিশ্চয়ই কিছু লুকাও নি।”
“না, ওর কাছে আমার লুকানোর মতো কিছু নেই। আপনার ব্যাপারেও ও সব জানে। আমার পরিবার, আমার জব, আমি কি করি সব জানে। সব জেনেই আমাকে ভলোবেসে আমার পাশে আছে। এমনকি এটাও জানে আমি দু’বার টাকার জন্য হোটেলে নাচ করেছি যেটা আমার পরিবারও জানে না।”
আহিল রুহানির কথা শুনে চমকে গেল। রুহানির ব্যাপারে সব জানলেও এটা জানে না যে রুহানি হোটেলে নাচ করেছে টাকার জন্য। আহিল তখনকার মতো কথা শেষ করল।
.
রুহানি ব্রেক টাইমে ফালাককে ফোন করল। ফালাক অফিসের গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং এটেন্ড করায় রুহানির সাথে কথা বলতে পারে নি। ফালাক মিটিং শেষ করে নিজের কেবিনে রিলেক্স মুডে বসল। ডেক্সের উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে লক খুলে দেখতে পেল রুহানি অনেকবার ফোন করেছে। ফালাক দ্রুত রুহানিকে কল করল।
রুহানি তখন কাজ করছিল। টেবিলের উপরে ফোনটা বেজে চলেছে। রুহানি রিসিভ করে ফিসফিস করে বলল,
“কাজ করছি। তুমি কি আজ ফ্ল্যাটে থাকবে? কথা ছিল।”
“আজকে তো আমাকে বাসায় যেতে হবে। তবে কিছু সময়ের জন্য থাকতে পারি। পাঁচটা নাগাদ আমি ফ্ল্যাটে থাকব। তুমি এসো।”
“আচ্ছা, আমি পাঁচটার পর তোমার ফ্ল্যাটে যাব। এখন রাখছি।”
রুহানি ফোন কেটে দিয়ে নিজের কাজে মন দিল। ফালাকও ল্যাপটপ খুলে বসল। রুহানির সাথে আবার কি হলো সেটা মাথায় ঘুরছে।
.
ফালাক ফ্রেশ হয়ে কিচেনে কফি বানাতে গেল আর তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। রুহানি ক্লান্ত, অবসন্ন দেহে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যে গরম পড়েছে। এটুকু রাস্তা আসতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে উঠেছে। রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিল। দরজা খুলে গেল। ফালাক সাদা টিশার্ট আর টাওজার পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি কোন কথা না বলে সরাসরি ভেতরে ঢুকে ডাইনিং টেবিলের দিকে গেল। ফালাকও ওর পেছনে পেছনে যাচ্ছে। রুহানি জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে পিপাসা মিটিয়ে নিল।
তারপর জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে ফালাককে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পিপাসা পেয়েছিল খুব। বাইরে কি যে গরম।”
ফালাক টেবিলের উপর থেকে টিস্যু নিয়ে রুহানির কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বলল,
“হাত মুখ ধুয়ে নেও ভালো লাগবে।”
রুহানি ব্যাগ রেখে ডাইনিং স্পেসের সাথে লাগোয়া ওয়াশরুমে হাত মুখ ধুতে চলে গেল।
রুহানির এখন একটু রিলেক্স লাগছে। ফালাক বরফের টুকরো গ্লাসে দিচ্ছে। লেবু চিপকে রস পানিতে দিয়ে চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া দিচ্ছে। রুহানির ধীরে ধীরে ফালাকের দিকে এগিয়ে গেল।
ফালাক রুহানিকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
“শরবতটা খাও ভালো লাগবে।”
তারপর গ্লাস এগিয়ে দিল।
রুহানির পিপাসা তখনও মিটে নি। তাই গ্লাস নিয়ে এক ঢুক খেয়ে ফালাকের দিকে চেয়ে বলল,
“বাহ! তুমি দেখছি খুব কাজের। ভালো বানিয়েছো।”
ফালাক ভাব দেখিয়ে বলল,
“অবশ্যই। সবাইকে কি তোমার মতো অকাজের মনে করো?”
রুহানি ফালাকের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি বললে তুমি? পাঞ্চ খেয়ে নাক ফাটাতে চাও?”
ফালাক ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“একদম না। তারপর দেখা যাবে ভাঙা নাকের জন্য বউ পাব না।”
তখনই ফালাকের নাকে পোড়া পোড়া গন্ধ এলো। ফালাক নাক দিয়ে বারবার শুকে রুহানির দিকে চেয়ে বলল,
“গন্ধ পাচ্ছো কোনো?”
রুহানি নিশ্বাস টেনে বলল,
“হ্যাঁ কিচেন থেকে আসছে। কিছু কি পুড়ছে?”
ফালাক ওহ মাই আল্লাহ বলে কিচেনে দৌড়ে গেল। রুহানিও গেল। ফালাক কফির জন্য পানি বসিয়েছিল পানি শুকিয়ে পাত্র পুড়ে গেছে। ফালাক তাড়াতাড়ি চুলা বন্ধ করে দিল। রুহানি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
“এই তোমার ফার্স্ট ক্লাস কাজের নমুনা? কি মশাই এতক্ষণ তো বেশ বড়াই করছিলেন।”
“এসব তোমার জন্য হয়েছে। দরদ দেখিয়ে শরবত খাওয়াতে গিয়ে এই অবস্থা।”
রুহানি ফালাকের কলার চেপে ধরে বলল,
“আমার জন্য দরদ দেখাবে না তো কার জন্য দেখাবে?”
ফালাক রুহানির নাকের ডগা চেপে ধরে বলল,
“বেডরুমে যে আছে তার জন্য।”
রুহানি ফালাকের কলার ছেড়ে বেডরুমের দিকে গেল। রুহানির মনে হচ্ছে বেডরুমে সিক্রেট কিছু আছে। নয়তো সেদিন যেতে দিল না কেন।
ফালাক মিটমিট করে হাসতে হাসতে রুহানির পেছনে পেছনে গেল।
ফালাকের রুমে গিয়ে রুহানির চোখ ছানাবড়া। চোখ বড়বড় করে চেয়ে আছে। কথা বলতে ভুলে গেছে। পুরো রুম জুড়ে যেন রুহানির বসবাস। প্রতিটি দেয়ালে ওর ছবি দিয়ে ভর্তি। বিছানার মাথার কাছের দেয়ালে রুহানির বাঁধানো একটা বড় পেইন্ট। রুহানির বিস্ময় যেন কাটছে না। রুহানি ফালাকের দিকে তাকাল। ফালাক রুহানির বিস্মিত চোখ স্পষ্ট দেখতে পেল। সে চোখে পানি টলমল করছে।
“এসব তুমি কবে করলে?”
ফালাক মাথা চুলকে বলল,
“বহুকাল আগে।”
রুহানি কথা বলছে না। আবারো বড় পেইন্টের দিকে তাকাল। নিজেকে অপ্সরী কিংবা কোনো রাজ্যের রাণী লাগছে। একদম ইমোশনাল হয়ে পড়েছে। ফালাক রুহানির কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বলল,
“তুমি দেখছি ইমোশনাল হয়ে পড়ছো? সামান্য পিকচারই তো।”
রুহানি কোন কথা বলছে না। ফালাক পরিস্থিতি অন্যদিকে নেওয়ার জন্য বলল,
“তুমি কিছু বলতে চেয়েছিলে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু।”
রুহানি ফালাকের বিছানায় বসল। ফালাক ওর পাশে বসল। পূর্ণ দৃষ্টি রুহানির দিকে। রুহানি ফালাককে সব খুলে বলল।
“আহিল আমাকে হয়তো ফলো করত। ও নিজেই সব জেনেছে। রাতের বেলা হুট করে বাসায় চলে আসে। তারপর আমি সব স্বীকার করে নেই। আর সব কিছু ক্লিয়ার করে দিয়েছি। তারপর আজকে সকালে ফোন করে তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। আমি সব বলে দিয়েছি। কিন্তু ও হুট করে তোমার পরিচয়, ঠিকানা কেন চাইল বুঝতে পারছি না। আর ওর বিহেভিয়ারও অদ্ভুত লাগছে আমার।”
ফালাকও ওর কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ল। তারপর রুহানিকে শান্ত করার জন্য বলল,
“সেসব দেখা যাবে। তোমাকে আগামীকাল আমার সাথে যেতে হবে। কেইস ফাইল হবে।”
“আচ্ছা, এখন আমাকে বাসায় যেতে হবে। আগামীকাল ভার্সিটিতে দেখা হবে।”
“আমি যাওয়ার সময় তোমাকে পৌঁছে দেব। আমি রেডি হয়ে নেই।”
.
ফালাক রুহানিকে ওর বাড়ি থেকে একটু দূরে নামিয়ে দিল। ফালাক রুহানির থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে পেছনে পেছনে হাঁটছে। রুহানির কেন জানি অনেক ভালো লাগছে। কেউ ওর কেয়ার করছে। রুহানি গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকার পর ফালাক দাঁড়িয়ে গেল। রুহানি বাড়িতে ঢুকে ফালাককে মেসেজ করে জানিয়ে দিল চলে এসেছে। ফোন থেকে চোখ সরাতেই মায়ের মুখোমুখি পড়ল। ওর মা ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রুহানি দাঁড়িয়ে গেল।
রুহানির মা শক্ত কন্ঠে বলল,
“রাত ৮টা বাজে। এত দেরি হলো কেন? কোথায় গিয়েছিলি?”
রুহানি আমতা আমতা করে বলল,
“একটু কাজ ছিল।”
“কি কাজ শুনি? ওই ছেলেটার সাথে ঘুরে বেড়ানো?”
রুহানি মায়ের কথা শুনে চমকে গেল। ওর মা কি করে জানল। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় বিড়বিড় করে বলল, “আহিল।”
রুহানির মা ওর জবাব না পেয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল,
“যা শুনছি তা কি সঠিক? তোর অন্য জায়গায় পছন্দ আছে?”
রুহানি আর না ভয় পেয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
“কেন থাকতে পারে না? থাকাটা কি অন্যায়?”
রুহানির মা চেঁচিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, অন্যায়৷ অবশ্যই অন্যায়। আহিলের সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে। কিছুদিন পরে ওর বাবা-মা আসবে। আর এখন মেয়ে বলছে তার অন্য জায়গায় পছন্দ আছে। কি করে তুই এমন একটা কাজ করলি? আহিলের বাবা-মার সামনে কোন মুখে দাঁড়াব? আর আহিল? ওর কি দোষ? ওর কাছে আমাদের এভাবে ছোট করলি? আমাদের দুর্দিনে এগিয়ে এসেছে তার প্রতিদান এভাবে দিবি?”
রুহানির মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ওর বাবা হুইলচেয়ারে করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রুহানও পড়া ছেড়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
রুহানিও ভীষণ রেগে গেছে।
“আহিল! আহিল! তোমাদের মেইন প্রায়োরিটি এখন আহিল। আমার কোন দাম নেই? আমি কি তোমার পেটের মেয়ে নই? আর দুর্দিন, কোন দুর্দিনের কথা বলছো মা? আহিল দুর্দিনে নয় সুদিনে এসে আমার সুখ-শান্তি নষ্ট করতে এসেছে। কোথায় ছিলে সেদিন তোমার আর বাবার প্রিয় আহিল, যেদিন আমি কাঠ ফাটা রোদে, ঝড়-ঝঞ্ঝা সহ্য করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি কিছু টাকার জন্য?
কোথায় ছিল সেদিন যেদিন আমি নিজের সম্মান বাজারে তুলেছি? বাবার অসুস্থতার জন্য,ওষুধ কেনার টাকা জোগাড় করার জন্য হোটেলে গিয়ে নাচ করেছি। আমি রুহানি পাঁচ হাজার টাকার জন্য ভরা মজলিসে নাচ করেছি। সে খবর তোমাদের আছে? কাদের জন্য আমি এতকিছু করেছি বলতে পারো মা? “(রুহানি কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল)
কান্না থামিয়ে বলল,
” আজ আমার সেই বাবা-মা আমাকে ভুলে গেছে। আমি ছোট থেকে আরাম-আয়েশে বড় হয়েছি। কষ্ট, অভাব কখনো আমাকে ছুয়ে দেখে নি। কিছু চাওয়ার আগেই পেয়েছি। সেই আমি কিছু টাকার জন্য কি না করছি, নিজের পরিবারের খুশির জন্য নিজের খুশি বিসর্জন দিয়েছি। কাজ করেছি। হ্যা তোমাদেরও এ নিয়ে দুঃখ আছে, আপসোস করেছো কিন্তু মানসিক আর শারিরীক যন্ত্রণা দুটোই আমাকে ভুগতে হয়েছে। কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। মরে গিয়ে মুক্তি পেতে চেয়েছি কতবার কিন্তু তোমাদের কথা ভেবেছি। সব সময় তোমাদের কথা ভেবেছি। তোমরা সেসব দিনের কথা ভুলে গেলেও আমি ভুলতে পারব না। আমার মন-মস্তিস্ক সেটা হতে দেবে না। আমি চাইলেই সে-সব দুর্বিষহ দিনের কথা ভুলতে পারব না। যখন আমার মানসিক সাপোর্ট প্রয়োজন ছিল, সবচেয়ে বেশি আহিলকে প্রয়োজন ছিল তখন আহিল কোথায় ছিল? ভুলে গেলে সেদিনের কথা যেদিন বাবা আহিলের বাবাকে ফোন করেছিল সাহায্যের জন্য আর উনি বিয়ে ভেঙে দিল? তোমরা ভুলে যেতে পারো আমি পারি নি। আর না কখনো ভুলতে পারব। যাইহোক এ-সব বলে লাভ নেই। আমার কষ্টের কথা কেউ বুঝবে না। আমার খুশির কথা আমার বাবা-মার ভাবার সময় নেই। আমি তোমাদের জন্য অনেক কিছু করেছি কিন্তু তোমাদের খুশির জন্য আমি আহিলকে বিয়ে করতে পারব না। আর হ্যাঁ আমি আহিলকে ধোঁকা দেই নি। হয়তো এটা আহিল তোমাদের বলে নি। আহিলের বাবা বিয়ে ভাঙার পরেই আমি ফালাককে ভালোবেসেছি। তাই ধোঁকা দেওয়া কিংবা তোমাদের ছোট হওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। কিন্তু তোমরা যদি তাই মনে করো আমার কিছু করার নেই।”
রুহানি সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। ওর বাবা-মা দুজনেই নির্বাক। একে অপরের দিকে চেয়ে আছে। রুহান তখনও দরজায় দাঁড়িয়ে। নীরবতা ভেঙে রুহান বাবা-মার কাছে এসে বলল,
“নিজেদের সুবিধার জন্য আপুকে বিয়ে করার জন্য জোর করা হলে সেটা অন্যায় হবে।”
রুহান আবার নিজের রুমে চলে গেল।
.
ফালাক বাড়িতে ঢুকতেই ওর মা গম্ভীরমুখে এগিয়ে এসে বলল,
“এত দেরি হলো কেন? তুমি অফিস থেকে সাড়ে চারটায় বেড়িয়েছো আর বাড়িতে এসেছো ন’টায়?”
ফালাক বাহানা খুঁজছে। তখনই ওর মা বলল,
“আমি কি তোমার কোনো খবর রাখি না? তুমি আমার একমাত্র ছেলে ফালাক। তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন, আশা। তোমাকে সেভাবেই বড় করেছি আর তুমি হোটেল নাচনেয়ালি একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করছো? এই তোমার চয়েস? ছিহ!”
ফালাক মায়ের কথা শুনে হতবাক। ওর মা রুহানির কথা বলছে কিন্তু এসব তিনি কি করে জানলেন? কে বলেছে?
“মা তোমাকে এসব কে বলেছে?”
“কে বলেছে সেটা ফ্যাক্ট না। চোখ কান খোলা রাখলে সব জানা যায়, দেখা যায়। আমি সব মেনে নেব কিন্তু হোটেলে নাচ করা মেয়ে আমার বাড়ির বউ হবে না।”
“মা, রুহানি খুব ভালো মেয়ে। ভালো ফ্যামিলির মেয়ে। ওদের পরিবারের সাথে একটা দুর্ঘটনা…..
ফালাকের মা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
” আমি সব জানি। সব খোঁজ আমি করেছি কিন্তু আমার শেষ কথা হোটেলে নাচা মেয়ে আমার বাড়ির বউ হবে না। তুমি ওকে ভুলে যাও। আমি তোমার জন্য মেয়ে দেখছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে বিয়ে দিয়ে দেব।”
ফালাক এতক্ষণ ঠান্ডা মাথায় কথা বললেও শক্ত কন্ঠে বলল,
“কারো চরিত্র একটা ঘটনা দ্বারা বিচার করা যায় না। কেউ শখ করে হোটেলে নাচতে যায় না। আমি রুহানিকে ভালোবাসি। নিজেকে ভুলে যাব কিন্তু ওকে ভুলতে পারব না। বিয়ে করলে ওকেই করব। তোমার কথা রাখতে পারছি না। সরি মা।”
রুহানি বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে। আজ অনেক কিছু বলে ফেলেছে। আর সহ্য করতে পারছে না।
ফালাক ফোন করেই যাচ্ছে রুহানি চোখের পানি মুছে কল রিসিভ করল।
কল রিসিভ করতেই ফালাক হন্তদন্ত হয়ে বলল,
“আহিল কি করেছে জানো? তোমার সন্দেহই ঠিক ছিল। ও আমার বাড়ির ঠিকানা এইজন্যই নিয়েছিল। ও আমার বাড়িতে বলেছে হোটেলে নাচনেয়ালির সাথে আমি প্রেম করি। আমার বাড়িতে ভয়ানক অবস্থা। মা তো আমার উপর রেগে আছে।”
রুহানি ওর থামানো কান্না যেন আর থামিয়ে রাখতে পারল না। রাগে ফেটে যাচ্ছে। রাগ-কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“ও আমার বাড়িতেও ঝামেলা পাকিয়ে দিয়েছে। মা আমাকে অনেক বকাবকি করেছে।”
ফালাকের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। আহিলকে হাতের কাছে পেলে কি করত জানা নেই। রাগে গজগজ করছে। দাঁতে দাঁত চেপে আছে। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে।
“ওকে পেলে আমি মার্ডার করে দেব।”
তারপর ফোন কেটে দিল। রুহানি বিছানায় ফোন রেখে মায়ের ঘরে গেল। ওর বাবা আর মা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। রুহানিকে দেখে থমকে গেল। রুহানির চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ফুসফুস করছে।
রুহানির মা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,
“কি হয়েছে রুহানি, এমন করছিস কেন?”
রুহানি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আহিল কি চাইছে? আমি যেন সভ্য সমাজে না বাস করতে পারি? সবাই যেন আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়?”
“কি করেছে ও?”
“তোমাদের অতি প্রিয় আহিল মানুষের কাছে বলে বেড়াচ্ছে আমি হোটেলে নাচ করা মেয়ে। ফালাকের মায়ের কাছে আমার নামে খারাপ কথা বলেছে। এরপরও আহিল তোমাদের কাছে সেরা? ওকে আমি….”
রুহানির শ্বাস উঠে যাচ্ছে। কথা বলতে পারছে না। ওর মা দ্রুত ওকে ধরে বসিয়ে পানি দিল। ওর মাথায় পিঠে হাত বুলাচ্ছে। যাতে ও শান্ত হয়ে যায়। রুহানি পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করে কেঁদে দিল।
চলবে…….