প্রিয়_অভিমান🥀🥀পর্ব-২২
#ফাবিহা_নওশীন
||
রুহানি টেবিলের উপর মাথা রেখে বসে আছে আর ওর বন্ধুদের বকবক শুনছে। ওর মাথায় একটা কথাই ঘুরছে ফালাক ওকে এড়িয়ে চলে গেল। বুঝতে পারছে না এতকিছুর পর ফালাকের না ওর রাগ করার কথা।
রুহানি মাথা তুলে উঠে বসে। ওর ভালো লাগছে না। মন খারাপ আর তার উপর বন্ধুদের এই বকবকানি বিরক্ত লাগছে।
রুহানি উঠে দাঁড়াল। ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে নুশা বলল,
“কই যাস এত জবরদস্ত আড্ডা ছেড়ে?”
“তোদের এই জবরদস্ত আড্ডায় বিরক্ত লাগছে। হাওয়া খেয়ে আসি।”
নুশা মিনমিন করে বলল,”প্রেমে পড়লে প্রেমিক ছাড়া সব পানসে লাগে।”
রুহানি ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। নুশা মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেসে বলল,”আমি কিছু বলি নি।”
রুহানি ব্যাগ নিয়ে দুম করে বেরিয়ে গেল। রুহানির রাগ লাগছে ফালাক ওকে এড়িয়ে কেন গেল? সেদিন তো ওই ওকে অপমান করেছিল। রুহানি তো একটা প্রতিউত্তর করে নি। এর জবাব ওর চাই।
ফালাক যেখানে যেখানে থাকতে পারে তার সব জায়গায় খোঁজা শেষ। অবশেষে ফালাককে লাইব্রেরীতে পাওয়া গেল।
ফালাক বই খুলে বসে আছে। শুধুমাত্র পড়ার ভান করে যাচ্ছে। মাথায় ঘুরছে অন্য কিছু। নুশা কেন ডেকেছিল? আর সাথে রুহানিও ছিল। ফালাক এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জোর করে পড়ায় মনোযোগ দেওয়া ব্যস্ত। ফালাক পাতা উল্টাতেই রুহানি নিঃশব্দে ওর পাশের চেয়ারে বসল।
রুহানি নিচু গলায় ফালাকের দিকে হেলে বলল,
“ফালাক!”
ফালাক রুহানির দিকে চেয়ে চমকে গেল। ও কখন এসে বসেছে খেয়ালই করে নি।
ফালাককে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে বলল,
“দু-মিনিট কথা বলতে চাই।”
ফালাক ফিসফিস করে বলল,
“এটা লাইব্রেরী, গল্প করার জায়গা না। তাই প্লিজ কথা বলো না।”
“আমি তো চেঁচিয়ে কথা বলব না।”
ফালাক ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“রুহানি বিরক্ত করো না প্লিজ। আমি গুরুত্বপূর্ণ একটা কলাম পড়ছি।”
রুহানি ফালাকের কথা শুনে চুপ করে গেল। তারপর সোজা হয়ে বসে রইল। ফালাক আড়চোখে রুহানির দিকে তাকাল। ও গাল ফুলিয়ে সামনের দিকে চেয়ে আছে। ফালাক পাত্তা না দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিল। দুই লাইন পড়ার পর বুঝতে পারল ওর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কি করে ঢুকবে রুহানি ওর পাশে বসে ওর মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে। ফালাক বই রেখে উঠে গেল। রুহানি ফালাককে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে কনফিউশনে পড়ে গেল ও বসে থাকবে না উঠবে।
ফালাক ওকে বুঝার সময় না দিয়ে হনহন করে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে গেল। রুহানিও দ্রুত লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে ফালাকের পেছনে পেছনে গেল।
রুহানিকে পেছনে আসতে দেখে ফালাক বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কি চাই তোমার পেছনে পেছনে আসছো কেন?”
রুহানি দাঁড়িয়ে গেল। তারপর শুকনো হেসে বলল,
“আমি পেছনে পেছনে আসছি না তুমি আমাকে পেছনে পেছনে ঘোরাচ্ছো?”
ফালাক ওর কথা শুনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
“আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, এটা তোমাকে বলার পর, তুমি জানার পরেও আমাকে কেন ঘোরাচ্ছো? শুনলেই তো হয়।”
ফালাক নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি কি বুঝতে পারছো না আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না? একজন মানুষ যখন বারবার কাউকে এড়িয়ে যায় তার মানে এটাই যে সে মানুষটা তার জন্য বিরক্তিকর। তুমি কি বুঝতে পারছো না তুমি আমার জন্য কতটা বিরক্তিকর?”
রুহানি মাথা নিচু করে নিল। তারপর মাথা উঁচু নিচু করে বুঝাল তার অবস্থান। চোখে পানি চলে এসেছে ওর। এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়াল না। ফালাকের তিক্ত কথাগুলো ওকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। ফালাক তখনও দাঁড়িয়ে আছে। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল।
।
রুহানি বুঝতে পারছে না ওর দোষটা কোথায়। কেঁদেকেটে ভাসাচ্ছে৷ ফোনের অপর পাশ থেকে নুশা ওকে বিভিন্নভাবে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রুহানির একই কথা,
“সেদিন ফালাক আমাকে কত আজেবাজে কথা বলেছে। আমার হোটেলে নাচ করা নিয়ে কটু কথা বলেছে। আমাকে লোভী বলেছে। আমি নাকি টাকার জন্য সব করতে পারি। বাজে ইংগিতও করেছে। এতকিছুর পরেও আমি গিয়েছি ওর কাছে আর ও আমার সাথে কি করলো? নুশা আমি কি এই ব্যবহার ডিজার্ভ করি?”
“একদম না৷ তুই কাঁদছিস কেন? ও তোকে পায়ে ঠেলেছে, ও পস্তাবে। কিন্তু তোকে এর জবাব নিতেই হবে।”
“জবাব নেব কি করে? ও তো আমাকে কিছু বলার সুযোগই দেয় না। এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না। আমি সুযোগ পেলে তো কিছু বলব? কিন্তু সে সুযোগই পাই না।”
“হামলা কর ওকে। ওর বাড়িতে চলে যা। শুনেছি ভার্সিটির এইদিকে কোন এক ফ্ল্যাটে থাকে। সেখানে গিয়ে ধরবি।”
“কিন্তু নুশা…”
“ডোন্ট ওরি, আমি যাব তোর সাথে। বাইরে অপেক্ষা করব৷ আর তুই কবে থেকে কাউকে ভয় পেতে শুরু করলি?”
“এড্রেস?”
“ম্যানেজ করে নেব। এখন তুই কান্নাকাটি বন্ধ কর।”
রুহানি কান্নাকাটি বন্ধ করলেও ফালাকের ফ্ল্যাটে যাবে এটা ভেবে নার্ভাস লাগছে।
.
মাঝে কেটে গেছে আরো দুটো দিন। রুহানি ফালাকের সাথে দেখা করে অপমান আর ইগ্নোর করার জবাব নেবে। সন্ধ্যা বেলায় রুহানি আর নুশা ফালাকের বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে হাজির। দশ তলা বিল্ডিংয়ের আটতলায় একটা ফ্ল্যাটে ফালাক থাকে।
রুহানি ফালাকের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জোরে একটা শ্বাস নিল। নিজেকে শক্ত করে কলিং বেল চাপল। দু’বার বেল বাজাতেই ফালাক দরজা খুলে ভূত দেখার মতো চমকে গেল। রুহানি ফালাকের চাহুনিকে পাত্তা না দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ফালাক তখনও দরজার সামনে বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি হুট করে ওর ফ্ল্যাটে কি করছে?
রুহানি ঘুরে ঘুরে এদিক সেদিক দেখছে। আর উঁকিঝুঁকি মারছে। ফালাক ওর বিহেভিয়ার দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারছে না।
ফালাক দরজা বন্ধ করে রুহানির সামনে গিয়ে বলল,”হুয়াট?”
রুহানি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আর কে থাকে এখানে?”
ফালাক চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
“মানে? কে থাকবে? কেউ থাকে না, আমি একাই থাকি। তুমি এই সময় এখানে কি চাও সেটা বলো। পারমিশন ছাড়া হুট করে কারো ফ্ল্যাটে ঢুকে যাওয়া কোন ধরনের অসভ্যতা?”
রুহানি তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“আমার মতো মেয়েদের আচরণ তো এমনই। সময়, স্থান কিছুই মানে না৷ প্রয়োজনে যেখানে সেখানে চলে যায়। অবাক হওয়ার কি আছে?”
ফালাক রুহানির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিল। তারপর বলল,
“এখান থেকে যাও।”
রুহানি সন্দেহ নিয়ে বলল,”দূর দূর করছো কেন? কে আছে এখানে? কাকে ভয় পাচ্ছো?”
তারপর রুহানি ফালাকের রুমের দিকে যাচ্ছিল। ফালাক ওর হাত চেপে ধরে ফ্লাটের বাইরে বেরিয়ে এলো। রুহানি নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, ছটফট করছে। ফালাক রুহানিকে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে গেল। ছাদে নিয়ে রুহানির হাত ছেড়ে দিল।
রুহানি চারদিকে চেয়ে বলল,
“আমাকে এখানে নিয়ে এলে কেন?”
ফালাক শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমি বুঝেছি তুমি তোমার কথা না বলে আমার পিছ ছাড়বে না। নেও বলো কি বলবে। আমি শুনছি।”
“হ্যাঁ, শুনতে হবে। জবাব চাই আমি। আমার প্রতি তোমার এই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ কি? তুমি আমাকে সেদিন এত এত কথা শুনালে, এত আজেবাজে কথা বললে, আমি অসুস্থ পর্যন্ত হয়ে গেলাম। সেসব নাহয় বাদই দিলাম। তারপর থেকে তুমি আমার সাথে কি আচরণটা করছো? কেন করছো?”
ফালাক রুহানির দিকে আগাতে আগাতে বলল,
“কি করেছি আমি? তোমার থেকে দূরে থাকছি এর বেশি তো কিছু করি নি। না-কি তুমি এটা চাও আমি আগের মতো তোমার পেছনে ঘুরঘুর করি? হাহ! এটাই চাচ্ছো?”
রুহানি পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“আমি এর কথা বলছি না। তুমি ভালো করেই জানো তুমি কি করছো।”
ফালাক হোহো করে উচ্চস্বরে হেসে বলল,
“আমি একটা মেয়েকে ভালোবেসে ছিলাম কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসে নি, অন্য একজনকে ভালোবেসেছে, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে তাই আমি তার থেকে সরে এসেছি, তাকে এড়িয়ে চলছি, ভালোবাসার আগুন চোখের পানিতে নিভানোর চেষ্টা করছি। ব্যাস!”
রুহানি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু এখন আর বলতে পারছে না।
ফালাকের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
রুহানি নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।
“তোমার আমার কথা শোনা উচিত ছিল। সবটা জানা উচিত ছিল। কিছু না জেনে না শুনে কারো সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করা কি ঠিক? আহিলের সাথে দু’বছর আগে থেকেই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।”
রুহানির কথা শুনে ফালাক রিয়েক্ট করতে ভুলে গেল। তার মানে রুহানি অনেক আগে থেকেই অন্য কারো। রুহানির প্রতি অন্য কারো অধিকার। ফালাক শুধুমাত্র তৃতীয় পার্সন হয়ে ওদের মাঝে ঢুকেছিল। ফালাক ছলছলে চোখে বলল,
“বেশ, তাহলে আমিই মাঝে ঢুকে পড়েছিলাম। তোমার এটা আগে বলা উচিত ছিল। রুহানি চলে যাও। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আমার যন্ত্রণা বাড়িও না। প্লিজ চলে যাও।”
ফালাক চোখের কোনা থেকে পানি মুছে ছাদ থেকে চলে যাচ্ছে। রুহানি ফালাককে ডাকছে কিন্তু ফালাক দাঁড়াচ্ছে না। ফালাকের বুকের ভেতরটা হুহু করছে। উত্তাল পাতাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে৷ একটা চাপা আর্তনাদ যন্ত্রণা দিচ্ছে। রুহানির ডাকে সাড়া দিতে ইচ্ছে করছে না।
রুহানি চিৎকার করে বলল,
“ফালাক আই লাভ ইউ।”
ফালাক থমকে দাঁড়িয়ে গেল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে দুঃখে কষ্টে ওর কান গেছে। রুহানি ছাদের মেঝেতে বসে পড়ল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ফালাক আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।”
ফালাক ঘুরে দাঁড়াল। রুহানি বসে বসে কাঁদছে। ফালাক ওর দিকে এগিয়ে গেল। রুহানির পাশে বসে কাঁপা গলায় বলল,
“কি বললে তুমি?”
রুহানি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি বুঝতে পেরেছি আমি তোমাকে ভালোবাসি। যখনই আহিলের সাথে বিয়ের কথা ভাবি দম বন্ধ হয়ে আসে। প্রথমে বুঝতে পারি নি, পরবর্তীতে তোমার মুখটা বারবার ভেসে উঠতো। যখন বুঝতে পেরেছি তোমাকে বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি শুনতে চাও নি।”
ফালাকের হৃদয় জুড়ে আলোড়ন শুরু হয়েছে। প্রাপ্তির অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীর সুখ ওর কাছে এসে ধরা দিয়েছে।
ফালাক রুহানির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“আমি যা শুনতে চেয়েছি তোমার কাছে তুমি বলতে এসেছো অথচ আমি ফিরিয়ে দিয়েছি? কত বড় অপদার্থ আমি।”
“তা তো অবশ্যই। কতবার বলতে চেয়েছি কিন্তু তুমি শুনতে চাও নি। আমি এতটা টানাপোড়েনের মাঝেও তোমাকে বেছে নিয়েছি কিন্তু তোমার সাপোর্ট পাই নি।
ফালাক অসহায় ফেস করে বলল,
“সরি রুহানি, আমার ভুল হয়ে গেছে। এমন ভুল আর হবে না।”
রুহানি চুপ করে আছে৷ ফালাক দাঁড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে দুহাত প্রসারিত করে বলল,
“বাদামি চোখের কণ্যা মনের লেনদেনটা অফিসিয়ালি হয়ে যাবে কি? গ্রহণ করবে কি আমায় বিল্লিরাণী? ”
রুহানি দু’হাতে চোখের পানি মুছে মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াল। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে ফালাককে জড়িয়ে ধরল। শুভ পরিণয়ে একে অপরকে বেঁধে নিল।
চলবে…..