#প্রিয়দর্শিনী
#পর্ব_২৪ (শেষ পর্ব)
#সামান্তা_সিমি
🍁
পরদিন বিকেলের দিকে নিশান এবং যূথী কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠল।বাড়ির সকলে মেইন গেইটে উপস্থিত হয়েছে ওদের বিদায় জানাবার জন্য। নীলুফা চৌধুরী চাইছিল ওরা সাথে ড্রাইভার নিয়ে যাক।কিন্তু নিশান রাজি হয়নি।সে একাই সবটা সামলে নেবে।অন্যদিকে যূথীর উত্তেজনা দেখার মতো।গতরাতে সে নিজেও ঘুমায় নি নিশানকেও ঘুমাতে দেয়নি।সমুদ্র দেখা নিয়ে বিভিন্ন সাহিত্য ভিত্তিক বক্তব্য শুনতে শুনতে নিশান ক্লান্ত হয়ে গেছিল।কিন্তু যূথীর চঞ্চল চেহারার দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারে নি।
গাড়ি কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর যূথী হঠাৎ বলে উঠল,
‘ একটু গাড়িটা থামান তো! আমরা একটা সেলফি তুলে নিই।’
যূথীর কথায় নিশান চোখ রাঙাল।কিন্তু যূথী তা পাত্তা না দিয়ে বলল,
‘ সেলফি তোলার পেছনে একটা যুক্তিযুক্ত কারণ আছে।প্লিজ থামান না গাড়িটা।’
নিশান গাড়ি থামাল।যূথী নিশানের কাছে ঘেষে ফটাফট সেলফি তুলে নিল কয়েকটা।খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
‘ এই সেলফি এখন আমি ফেসবুকের স্টোরিতে দিব।জানেন তো আমার ফ্রেন্ড যাদের বিয়ে হয়েছে ওরা হানিমুনে যাওয়ার সময় এভাবে ছবি তুলে আপলোড দিত।এগুলো দেখে আমি হতাশায় ভুগতাম।ভাবতাম আমারও একটা বর থাকলে আমিও এভাবে ঘুরতে যেতে পারতাম।অবশেষে বর তো পেয়ে গেলাম।এখন আমিও ছবি আপলেড দিব। সবাইকে দেখাতে হবে না যে আমিও ঘুরতে যাচ্ছি! এবার বলুন আমার কথাগুলো যুক্তিযুক্ত কিনা!’
নিশান কিছুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল।কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল তাঁর পাশে বসে থাকা মেয়েটা যূথী।ওর দ্বারা এসব বাচ্চা টাইপের কাজকর্ম অসম্ভব কিছু নয়।কোনোরকমে হাসি চেপে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট দিল।
.
ওরা যখন কক্সবাজারের মাটিতে পা রাখল তখন ঘড়িতে প্রায় একটা বাজতে চলেছে।এতক্ষণ ড্রাইভ করে ভীষণ টায়ার্ড লাগছে নিশানের।হোটেলের রুম আগেই বুক করা ছিল তাই এটা নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই।এখন চটজলদি রুমে উঠে যেতে পারলেই হলো।
ঘুমন্ত যূথীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল নিশান।যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন চারপাশ নির্জনতায় ভরপুর।বহুকষ্টে যূথীকে উঠিয়ে হোটেলে ঢুকল নিশান।
পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বিচের উদ্দেশ্যে বেরোলো দুজন।বিচ থেকে হোটেলের দূরত্ব বেশি নয়।তাই পায়ে হেঁটে চলছে ওরা।হোটেলের রুমের বারান্দা থেকে সমুদ্রের দৃশ্য অনেকটাই দেখা যায়।নিশান অনেকবার যূথীকে ডেকেছিল বারান্দায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে যায়নি।দূর থেকে সমুদ্র দেখে মনের উত্তেজনা নষ্ট করতে চায় না।তাই সকাল হতে না হতেই নিশানের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছে।
সমুদ্রে পৌঁছতে চোখ জুড়িয়ে গেল যূথীর।ঢেউয়ের উথালপাতাল শব্দ মধুর হয়ে কানে বাজছে।শরীরে শিহরণ জাগিয়ে দেওয়ার মত বাতাস চারদিকে।সূর্যের আভা ছড়িয়ে আছে সোনালি চাদরের মত।সকাল হওয়ায় তেমন একটা লোকজন দেখা যাচ্ছে না।তাই সমুদ্রের সবটা ভিউ ভালোমত দেখতে পাচ্ছে।
যূথী চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,
‘ সুন্দর! অসম্ভব সুন্দর। সত্যিই অসম্ভব সুন্দর..! ‘
নিশান মৃদু হেসে যূথীর কর্মকান্ড দেখে চলেছে।বুকের উপর দুইহাত ভাঁজ করে বলল,
‘ অসম্ভব হলে আবার সুন্দর হয় কিভাবে?তোমার বলা উচিত ছিল সম্ভব সুন্দর! ‘
‘ উফ্ থামুন।চলুন না ওইদিকে হাঁটি।’
.
বিচ থেকে ফিরে ওরা দুজন নাস্তা করে হিমছড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।প্রায় চল্লিশ মিনিটের মত লাগল পৌঁছতে।সেখানে পৌঁছে নিশান যূথীকে একপাশ দাঁড় করিয়ে বলল,
‘ এখানে একটু ওয়েট করো।আমি টিকিট নিয়ে আসছি।’
যূথী বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়ল।হিমছড়ি আসার তেমন ইচ্ছে ছিল না তাঁর।মন পড়ে আছে সমুদ্রের পাড়ে।যদি আজ সারাদিন সেখানে বসে কাটিয়ে দেওয়া যেত!
নিশান ফিরে এল টিকিট নিয়ে।যূথীর দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ অনেক উঁচুতে উঠতে হবে কিন্তু! পারবে?’
‘ না পারলে আপনি কোলে তুলে নিবেন।’
‘ তোমাকে কোলে নিতে গেলে হাত-পা ভেঙে এখানেই পড়ে থাকতে হবে।’
‘ একদম ইনসাল্ট করবেন না।রোজ সকালে উঠে মর্নিং ওয়াক জিম এগুলো কিসের জন্য করেন?বউকে কোলে তোলার জন্যই তো নাকি?’
‘ বউকে কোলে তোলার জন্য কিন্তু কোনো আলুর বস্তাকে নয়।’
যূথী রাগে তেতে উঠল।ঘুরতে এসে এভাবে ইনসাল্ট কি মানা যায়?ধপধপ পা ফেলে সে নিশানকে ফেলে এগিয়ে চলল।
নিশান জোর গলায় বলে উঠল,
‘ হ্যালো মিসেস আমাদের এদিক দিয়ে যেতে হবে।ওদিক দিয়ে নয়।’
.
প্রায় বিশ মিনিট ধরে ওরা পাহাড়ের উপর সিড়ি দিয়ে উঠেই চলেছে।যূথীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। একসময় বিরক্ত হয়ে বলে উঠল,
‘ আমার দ্বারা আর হচ্ছে না।উপরে আছেটা কি যে হাজার হাজার সিড়ি দিয়ে রেখেছে?’
নিশান ফিট বডি নিয়ে সিড়ি ভেঙে উঠছিল।যূথীর কথায় পেছন ফিরে বলল,
‘ উপরে ম্যাজিক আছে।দেখতে চাইলে জলদি এসো।আর এত অল্প সিড়ি উঠেই হাঁপিয়ে গেছো তুমি।দেখো ওই যে বাচ্চাটা সে কিরকম লাফাতে লাফাতে উঠছে।’
যূথী মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইল।বজ্জাত লোকটা কি বুঝতে পারছে না তাঁর সত্যিই কষ্ট হচ্ছে।সে কি আর তাঁর মত বডিবিল্ডার যে রোবটের মত ধপাধপ সিড়ি দিয়ে উঠে যাবে।
নিশান যূথীর দিকে হাত বাড়িয়ে কোমল গলায় বলল,
‘ হাত ধরে স্লোলি উঠে আসো বউ। কোনো তাড়া নেই।’
নিশানের মুখে বউ ডাকটা শুনে যূথীর মনের কালো মেঘ নিমিষেই দূর হয়ে গেল।যেন নতুন প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছে।বউ শব্দটায় এত পাওয়ার তা তো জানা ছিল না।তাই দেরি না করে খপ করে নিশানের হাত ধরে পা মেলাল।
উপরে উঠতেই যূথীর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।চারদিকে গাছপালায় ঘেরা পাহাড়ের উপর উথালপাতাল বাতাস।দূর থেকে নীল সমুদ্রের কিনারা নজরে আসছে।নীলের বুকে মুক্তোর মত সাদা জলরাশির ঢেউ।প্রকৃতি এত সৌন্দর্য ধরে রাখে তাঁর মাঝে সেটা এখানে না আসলে সে বুঝতেই পারত না।এতক্ষণ পায়ের হাড়-গোড়ের তেরটা বাজিয়ে এখানে এসেছে সেই কষ্টটা আর মনেই রইল না।
পাশ থেকে নিশান বলে উঠল,
‘ ম্যাজিক দেখলে তো?চলো ওই বেঞ্চে কিছুক্ষণ বসে রেস্ট নাও তারপর চারদিকটা ঘুরে দেখো।’
যূথী হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ আপনি এখানের সব জায়গা চেনেন।আগে কয়বার এসেছিলেন?’
‘ ভার্সিটি লাইফে বন্ধুদের সাথে প্রায়ই আসতাম।’
যূথী ভাবতে লাগল সে -ই তাহলে একমাত্র ব্যক্তি যে এই প্রথম এখানে পা রেখেছে।সবাই কক্সবাজার হিমছড়ি ঘুরে শেষ করে ফেলেছে।
__________________________
দুপুরে রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ শেষ করে ওরা হোটেলে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিল।বিকেল হতে না হতেই আবার হাজির হলো সমুদ্রের পাড়।সকালে যেমন অপরূপ দৃশ্য দেখেছিল এখন তা আরো মনোমুগ্ধকর!
সূর্য হেলে পড়তে চাইছে নিজ গন্তব্যে।সমুদ্রের পাড় জুড়ে মানুষের চেঁচামেচি, হৈ হল্লা।অনেকেই সমুদ্র স্নানে মেতে আছে।কেউ কেউ আবার ভেজা বালির উপর মনের মাধুরী মিশিয়ে আলপনা আঁকছে।পাশের দোকানগুলোতে অগুনিত মানুষের ভীড়।
যূথী নিশানের হাত ধরে ঢেউয়ের পানিতে সিক্ত হয়ে উঠা বালুর উপর খালি পায়ে হাঁটছে।দূর থেকে উথলে আসা ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে উজ্জ্বল চোখে।মুগ্ধ হয়ে দেখছে সবকিছু। হঠাৎই বলে উঠল,
‘ দেখুন ঝিনুক! ‘
যূথীর কথায় নিশান নিচের দিকে তাকাল।হেসে বলল,
‘ এগুলো অহরহ ঢেউয়ের সাথে আসে।এরচেয়েও বড় আছে।মাঝেমধ্যে জীবিতও দেখতে পাবে।’
যূথী নিচু হয়ে গুটিকয়েক ঝিনুক কুড়োতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।এগুলো সে যত্ন করে রেখে দেবে স্মৃতি হিসেবে।নিশান পকেট থেকে ফোন বের করে যূথীর অজান্তেই কতগুলো ছবি তুলে নিল।সমুদ্রের পাড়ে মায়াবতী এক কন্যা ঝিনুক কুড়োচ্ছে এই দৃশ্যটা তাঁর চোখে আটকে যাচ্ছিল বারবার।
.
কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য পশ্চিম দিকে ডুবে যেতেই চারদিকে অন্ধকার নেমে আসতে লাগল।নিশান এবং যূথী হাঁটতে হাঁটতে চলে এল অনেক দূর।এখানে তেমন লোকজন নেই।শুধু সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। সাথে এলোমেলো বাতাস।যূথীর খোলা চুল বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে।গলার স্কার্ফটাকে ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিল সে।
নিশান বলল,
‘ চলো আরেকটু সামনে যাই।’
‘ কি জোরালো ঢেউ দেখছেন! পড়ে গেলে?’
‘ আমার হাত ধরে থাকো।’
যূথী নিশানের বাহু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পা বাড়াল।ঢেউয়ের স্রোত এবার ওদের হাঁটুর উপর পর্যন্ত উঠে আসতে চাইছে।
নিশান যূথীর কোমড় ধরে মাঝখানের ইঞ্চিখানেক ফাঁকা জায়গাটা পূরণ করে ফেলল।যূথী মিষ্টি হেসে বলল,
‘ জানেন ইচ্ছে করছে এখানে দাঁড়িয়ে আপনার হাত ধরে কয়েকযুগ কাটিয়ে দিই।উপরওয়ালাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আপনাকে আমার জীবনে এনে দেওয়ার জন্য। ‘
‘ তাই?’
‘ হ্যাঁ।ওই যে কিছুক্ষণ আগে সমুদ্রের বুকে লালচে সূর্যটা ডুবে গেছে তেমনিভাবে আমিও আপনার ভালোবাসায় ডুবে থাকতে চাই সারাজীবন। ‘
নিশান যূথীর কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘ ভালোবাসি বউ।’
যূথী চোখ বন্ধ করে নিশানের কাঁধে মাথা রাখল।
রাতের সমুদ্রের এমন মনোমুগ্ধকর স্বর্গীয় পরিবেশে দুজন ভালোবাসায় মগ্ন নর-নারী তাঁদের প্রেম উজাড় করে দিচ্ছে।দূর থেকে গর্জে উঠা ঢেউয়েরা নিজেদের ছন্দে সিক্ত করে চলেছে তাঁদের।আকাশ জুড়ে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে জোৎস্নার লুটোপুটি খেলা।শোঁ শোঁ করে বয়ে যাওয়া শীতল হাওয়া জানান দিচ্ছে তাঁদের উপস্থিতি।
সমুদ্র এমন ভালোবাসাময় হাজারো দৃশ্যের সাক্ষী হয় প্রতিনিয়ত। কখনো আবার কারো মনভাঙার গল্প শুনে নীরবে নিভৃতে।কারোর চোখের নোনা অশ্রুকে নির্দ্বিধায় মিশিয়ে নেয় নিজের বুকের নোনাজলে। কেউ কখনো তা জানতে পারে না।কিন্তু সমুদ্র ঠিকই তাঁর প্রাণবন্ত ছোঁয়ায় রাঙিয়ে দেয় সকলকে।
(সমাপ্ত)