#প্রিয়দর্শিনী
#পর্ব_২৩
#সামান্তা_সিমি
🍁
নিশান তাঁর বন্ধুদের খপ্পর থেকে কোনোরকমে ছাড়া পেয়ে রুমের দিকে রওনা দিল।ছেলেগুলো শয়তানের হাড্ডি।এগুলা এত ঝামলো করবে জানলে ইনভাইট না করলেই ভালো হত।হারামির দল সব।
সিড়ি দিয়ে উঠে নিজের রুমের সামনে যেতে আবার থমকে দাঁড়িয়ে যেতে হলো।দরজার একপাশে মনীষা অন্যপাশে বিদীষা প্রহরীর মত ওঁত পেতে আছে।কি জন্য সেটা নিশান ভালোই বুঝে গেছে।হতাশায় ভরা নিঃশ্বাস ফেলল সে।আজ বউয়ের কাছে পৌঁছতে পারবে কিনা কে জানে।বন্ধুদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে এখন বোনেদের জালে পা দিতে যাচ্ছে।
নিশানকে এগিয়ে আসতে দেখে মনীষা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল,
‘ অবশেষে তোমার দেখা পাওয়া গেল ভাইয়া।এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমাদের পা শক্ত হয়ে যাচ্ছিল।’
‘ তোদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছি আমি?বাড়িতে এত জায়গা থাকতে আমার রুমের সামনে কেনো দাঁড়িয়েছিস?চুপচাপ দুইজন নিজেদের রাস্তায় যা।’
‘ যাব তো।তাঁর আগে আমাদের কিছু টাকা পয়সা দিয়ে দাও।নাহলে কিন্তু তোমার বউয়ের কাছে যেতে দেব না।’
‘ হাউ ফানি।বিয়ে করেছি আমি আর আমাকেই বলছিস বউয়ের কাছে যেতে দিবি না।’
নিশান দুবোনের সাথে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক যুদ্ধ চালিয়ে গেল।কিন্তু হার মানতে হলো শেষমেশ।প্রাণপণ চেষ্টা করেও পকেটের তাগড়া নোটগুলোকে বাঁচাতে পারল না।মনীষা বিদীষার হাতে চালান করে দিতে হলো।
রুমে ঢুকতে ঢুকতে নিশান বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
‘ মেয়েরা কি করে এত ঝগড়ুটে হতে পারে!’
ফুলে সাজানো বিছানার কাছে এসে তাঁর চোখেমুখে একঝাঁক অবসাদ এসে ভীড় করল।যার জন্য এত যুদ্ধ করে রুমে হাজির হয়েছে সেই মানুষটিই ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে আছে।তাঁর ফুলশয্যার রাত যে এমন পানসে
হবে তা কি আগে ভাবতে পেরেছিল।
শেরওয়ানী খুলে ট্রাউজার্স নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল নিশান।
ঘড়িতে রাত প্রায় একটা বাজতে চলেছে।রুমে জ্বলতে থাকা ক্যান্ডেল গুলো নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিল নিশান।বিছানায় এসে যূথীকে আস্তে করে শুইয়ে দিল ।যূথী কিছুটা নড়েচড়ে উঠল।দেখলেই বুঝা যাচ্ছে মেয়েটা গভীরে ঘুমে কাদা হয়ে আছে।
নিশান যূথীর হাতের মোটা চুরি এবং গলার ভারী গয়না দুয়েকটা খুলে রাখল বেড সাইডের টেবিলে।
যূথীর ঘুমন্ত চেহারা দেখে প্রশান্তির হাসি দিল নিশান।কি মায়াবী লাগছে মেয়েটাকে! যূথীর সাথে প্রথম দেখা এবং এরপর কি কি ঘটনা ঘটেছে সব স্মৃতিচারণ করতে লাগল নিশান।কখনো ভেবেছিল কি এভাবে কাউকে ভালোবাসবে?কি এক অজানা মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছিল তাঁকে।সেই সূত্র ধরে মেয়েটা এখন বউ হয়ে বসে আছে তাঁর ঘরে।সত্যিই মানুষের জীবন এক নিমিষেই পাল্টে যেতে পারে এই কথাটার সত্যটা খুব উপলব্ধি করছে সে।
যূথীর উপর ঝুঁকে এসে কপালে চুমু খেল সে।আস্তে করে বলে উঠল,
‘ আমার বউ!’
কিন্তু পরক্ষনেই আবার অভিমানের বশবর্তী হয়ে মনে মনে বলতে লাগল,
‘ না ঘুমালে চলতো না তোমার!ফুলশয্যার রাতে কেউ জামাইকে ফেলে রেখে এভাবে নাক ডেকে ঘুমায়?’
_________________________
সকালে আলস্যে ভরা আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠল যূথী।শরীরটা বেশ ভার ভার লাগছে।চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল সে।চারদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।
কালরাতে রেস্ট নেওয়ার জন্য বিছানায় হেলান দিতে গিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি।গায়ে এখনো বিয়ের লেহেঙ্গা। এজন্যই এত ভারী ভারী লাগছিল।
যূথী রুমের চারদিকে ভালোভাবে নজর দিল।নিশানকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।লোকটা কি রাতে রুমে আসে নি?ধুর এটা কি করে ফেলল সে?নিশান না জানি কি ভেবেছে।বর রুমে না আসতেই সে ঘুমিয়ে পগার পা।কাজটা একদমই ভালো হয় নি।ফুলশয্যার রাত নিয়ে সে কত প্ল্যান করে রেখেছিল।শুধুমাত্র ঘুমের জন্য ভেস্তে গেল সব।
যূথী বিছানা থেকে নামতে যাবে এমন সময় নিশান রুমে ঢুকল।নিশানকে দেখতে পেয়ে আবার স্ট্যাচু হয়ে বসে পড়ল যূথী।হাতে কফির মগ নিয়ে নিশান যূথীর সামনের সোফায় বসল।ভ্রু উঠিয়ে বলল,
‘ ঘুম হয়েছে মহারানী?’
যূথী কি বলবে ভেবে পেল না।কালরাতের জন্য তাঁর বর কি রেগে আছে?মনে মনে সে ঘুমের উদ্দেশ্যে গালি ছাড়ল কয়েকটা।
যূথী মেকি হেসে বলল,
‘ হয়েছে।আপনি কালরাতে কখন রুমে এসেছিলেন?’
‘ যখন তুমি বেঁহুশ হয়ে ঘুমাচ্ছিলে।’
‘ আমি…আসলে কিভাবে যে ঘুমিয়ে ফেললাম…স্যরি।’
‘ স্যরি বলতে হবে না।আজ থেকে প্র্যতেকটা রাতই হবে আমাদের ফুলশয্যার রাত।ভালো হয়েছে না আইডিয়াটা?’
নিশান যূথীর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে চোখ মারল।
যূথী মুখ ভেঙচিয়ে বলল,
‘ অসভ্যমার্কা কথাবার্তা! ‘
‘ তোমার সাথে অসভ্যতামির কিছু করেছি?’
নিশানকে উঠে আসতে দেখে শুকনো ঢোক গিলল যূথী।সে কি আবার রাগিয়ে দিল?
আমতাআমতা করে বলল,
‘ না..আমি বলতে চাইনি।আমি তো…’
নিশান যূথীকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল।যূথীর উপর ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল,
‘ অসভ্যতামি করি?’
যূথীর চোখ বড়বড় হয়ে গেল।হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল সে বুঝতে পারছে না।
নিশান যূথীর ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেতেই কেঁপে উঠল যূথী।তাঁর ছোট্ট প্রাণটা ধুকপুক করতে করতে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
কোনোরকমে বলল,
‘ সরুন না!’
নিশানের ছোট উত্তর,
‘ না।’
এমন সময় দরজায় কারো নকের শব্দ পেয়ে হুঁশ ফিরল দুজনের।দরজায় ধুমধাম শব্দে কানে তালা লাগানোর উপক্রম।নিশান মুখ অন্ধকার করে উঠে এল বিছানা থেকে।দরজা খুলে মনীষা বিদীষাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ আসার আর টাইম পেলি না বিচ্ছুর দল! এভাবে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলি কেনো?’
দুবোন নিশানকে পাত্তা না দিয়ে পাশ কেটে রুমে ঢুকে গেল।ততক্ষণে যূথী উঠে বসেছে।নিশান খালি কফির মগ নিয়ে চলে যেতেই বিদীষা বলে উঠল,
‘ আমরা কি অসময়ে এসে পড়েছিলাম নাকি ভাবী?ভাইয়া যেভাবে রেগে তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে মনে হচ্ছে ওর রোমান্টিক মোমেন্টে এন্ট্রি নিয়েছি আমরা।’
যূথী লজ্জায় লাল নীল হয়ে উঠছে বারবার।ভাগ্যিস ওরা এসে পড়েছে নাহলে কি হতে চলেছিল তখন।
মনীষা যূথীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভাবুক হয়ে বলল,
‘ কাল তোমাকে যেভাবে সাজিয়েছিল ঠিক সেভাবেই আছো তুমি।মুখের মেকাপি তুলোনি।কাল ফুলশয্যার রাতে কি করছিলে তোমরা দুজন? কিছু করোনি?’
মনীষার কথায় যূথী হা করে তাকাল।এ কাদের পাল্লায় এসে পড়ল সে।এরা কি মানুষ নাকি এলিয়েন!
বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে মনীষার দিকে ছুড়ে যূথী বলল,
‘ দূর হও অসভ্য ভাইয়ের অসভ্য বোনেরা।’
__________________________
বিয়ের প্রায় এক সপ্তাহের মত কেটে গেছে।নিশানের ছুটি এখনো বাকি আছে।তাই আপাতত সে বাড়িতেই অবস্থান করছে।
যূথীও কলেজ যায় না অনেকদিন হলো।বিয়ের পর তাঁর সবকিছু এত রঙিন লাগে যে পড়ালেখাতে মন বসতেই চায় না।কিন্তু কলেজ যাওয়া দরকার।পড়ায় অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে সে।বিকেলে রুমে বসে এসবই চিন্তা করছিল যূথী।তখনই নীলুফা চৌধুরী হাজির হলেন।শ্বাশুড়িকে দেখতে পেয়ে যূথী বিনয়ের সাথে হেসে বলল,
‘ আম্মু আসো।তুমি ডেকেছিলে আমায়।এখনই যেতাম।তারআগেই তুমি এসে পড়লে।’
নীলুফা চৌধুরী ছেলের বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ কোনে ব্যাপার না।কি করছিস বসে বসে?নিশান কোথায়?’
‘ ও বোধ হয় গার্ডেনে আছে।আমি ডেকে দেব?’
‘ না। তোর সাথে কথা ছিল আমার।নিশানের বাবা বলছিল তোদের বিয়ের এক সপ্তাহ কেটে গেছে তোরা বরং কোথাও ঘুরে আয়।এটা নিয়ে নিশানের সাথে কথা বলেছি সকালে।সে বলেছে তোর সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিবে।’
‘ কই তোমার ছেলে আমাকে কিছু বলেনি তো!’
‘ সময় পায় নি বোধ হয়।তুই যেখানে যেতে চাস বলিস নিশানকে কেমন!’
‘ ঠিক আছে আম্মু।’
নীলুফা চৌধুরী চলে গেলেন।যূথী আনন্দে আটখানা হয়ে সারা রুমে পায়চারি করতে লাগল।সে আর নিশান তাহলে হানিমুনে যাবে।ইস! কি মজা হবে তাহলে! যূথী মনে মনে তাঁর শ্বশুরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালো।
এমন সময় নিশান রুমে ঢুকল।যূথীকে একা হাসতে দেখে অবাক হলো কিছুটা।অতি আদরে মেয়েটা বোধ হয় পাগল হয়ে গেছে।সারাক্ষণ খিলখিল করে হেসে বেড়ায়।এখন তো একা একাই হাসছে।
‘ যূথী!’
নিশানের গলার আওয়াজ পেতে সেদিকে ফিরল যূথী।একলাফে নিশানের সামনে এসে বলতে লাগল,
‘ আমরা ঘুরতে যাব।আম্মু একটু আগে এসে বলে গেছে আপনি আর আমি ঘুরতে যাব।’
নিশান মুচকি হাসলো।এই তাহলে কাহিনী।
যূথীর মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
‘ অবশ্যই। কোথায় যেতে চাও বলো!’
‘ আমি কক্সবাজার যাব।কখনো যাই নি।সবাই নাকি দু তিনবার করে গেছে। আর আমি একবারও যায়নি।’
‘ বেশ তো।লাগেজে কাপড়চোপড় রেডি করে রেখো।আমরা কালই রওনা দিব।’
চলবে…