প্রিয়দর্শিনী #পর্ব_১

গল্পের নামঃ #প্রিয়দর্শিনী
#পর্ব_১
লেখিকাঃ #সামান্তা_সিমি

🍁
গ্রামের মরা গাঙ নামে পরিচিত জায়গাটি তে মানুষের ভিড়।তাঁদের চোখেমুখে নিদারুণ ভয় আর আতঙ্ক বিরাজমান।সকলেই নিচুস্বরে এটা সেটা নিয়ে আলোচনা করছে।স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েগুলো দারুণ উৎসাহ নিয়ে সেই আলোচনা শোনার চেষ্টায় আছে।ছোট বাচ্চারা তাঁদের মা’য়ের কোলে বসে সামনের দৃশ্যটা কৌতুহলী হয়ে দেখছে।
জায়গাটির নাম মরা গাঙ হলেও গাঙটি সম্পূর্ণ মৃত নয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের উত্তাপে গাঙের পানি অর্ধেক কমে গিয়েছে।কিন্তু বর্ষাকালে সেই গাঙ পানিতে টইটুম্বুর হয়ে থাকে।পানি স্বচ্ছ না হওয়ায় গাঙটি প্রায় অব্যবহৃত।

পানির কিনারায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে মাঝবয়েসী এক লোক।তাঁর পেটের কাছ থেকে রক্তের একটা আঁকাবাঁকা স্রোত বের হয়ে মিশে গেছে ঘোলাটে পানির গভীরে।
ভিড়ের মধ্য থেকে সবচেয়ে বৃদ্ধ লোকটি আতঙ্কিত গলায় বলে উঠল,

‘ চেয়াম্যান সাহেবকে খুন করল কে?’

পাশে বাজারের থলে হাতে দাঁড়ানো লোকটির চেহারায়ও ভয়ের চিহ্ন। সে বলল,

‘ খুন কে করছে এটা তো চাচা জানি না।নিশ্চয়ই শত্রুতামি করে করেছে কেউ।এখন বিরাট পুলিশ কেস হয়ে যাবে।কত প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন চেয়ারম্যান সাহেব।উনার খুনের তদন্তও হবে খুব হৈচৈ করে।’

বৃদ্ধ লোকটি নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।গ্রামে এই প্রথম এমন কোনো ঘটনা ঘটল।মারামারি, ঝগড়া ঝাটি হলেও কখনো খুনোখুনি হয় নি।শূন্য দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে রইলেন নিথর দেহটির দিকে।একসময় জিজ্ঞেস করলেন,

‘ গ্রামের কেউ কি দেখেছে খুন হতে?’

‘ জ্বি। ওই যে দেখেন গাছের গোড়ায় যে মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে সে দেখেছে।’

বৃদ্ধ লোকটি সেদিকে তাকালেন।মৃত মানুষ ছাড়াও যে জীবন্ত আরেকজন জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে আছে এতক্ষণ তো সেটা খেয়াল করেননি।দূর থেকে ভালো দেখতে না পেরে দৌড়ে সেখানে উপস্থিত হলেন।ভ্রুকুটি নিয়ে বললেন,

‘ এ তো জামানের মেয়ে।ওর চাচীকে কেউ ডাকো। কখন জ্ঞান হারালো?চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দাও। ‘

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শেফালী নামের মেয়েটি শংকিত কন্ঠে বলল,
‘ দিয়েছি অনেকবার।কিন্তু চোখ খুলছে না।ওর চাচীকে খবর দেওয়া হয়েছে।এসে যাবে এক্ষুনি। ‘

ঠিক তখনই লতিফা বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন।মেয়েটাকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে তাঁর চেহারা ব্যথাতুর হয়ে গেল।নিচু হয়ে ডাকতে লাগল,

‘ যূথী! শুনতে পাচ্ছিস মা?উঠ্!’

যূথী আগের মতই নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে।লতিফা বেগম এবার বেশ ভয় পেয়ে গেলেন।মেয়েটা নিশ্চয়ই প্রচন্ড ভয় পেয়েছে।কিছুক্ষণ আগেই তো যূথী কলেজ যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল।তিনিও প্রতিদিনের মত চুলায় আগুন ধরিয়ে রান্না করতে বসেছিলেন।আর তখনই পাশের বাড়ির খোকন এসে বলল গ্রামের চেয়্যারম্যানকে কেউ ছুড়ি মেরেছে।অন্যদিকে যূথীও নাকি জ্ঞান হারিয়ে গাঙের পাড়ে পড়ে আছে।তিনি রান্নাবান্না সব ফেলে ছুটে এসেছেন।আশেপাশের সবাই বলাবলি করছে যূথী নাকি চেয়্যারম্যান সাহেবকে খুন হতে দেখেছে।সে কারণেই ভয়ে৷ নিজেকে সামলাতে পারে নি।
লতিফা বেগম কয়েকজনের সাহায্যে যূথীকে বাড়ি নিয়ে গেলেন।

.

সকাল গড়িয়ে দুপুরের মধ্যভাগ এখন।পুলিশ এসে চেয়্যারম্যানের লাশ নিয়ে গেছে।তবে পানির ধারে রক্তের দাগ এখনো স্পষ্ট।সূর্যের প্রখর তাপে তা শুকিয়ে খটখটে। গাঙের পাড়ে এখনো কয়েকজন মাঝবয়েসী লোক জটলা পাকিয়ে বসে আছে।সকলের মুখে খুনের বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলছে।তাঁরা বেশ ভয়ে আছেন।খুনি এই গ্রামের নাকি অন্য গ্রামের কিনা কে জানে।
আশেপাশে জনা চারেক বাচ্চা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।ওরা পরস্পরের হাত ধরাধরি করে চক্রাকারে কোনো এক বিশেষ খেলায় ব্যস্ত।দেখে মনে হচ্ছে মানুষ খুন হওয়ার ব্যাপারটা তাঁদের মনে কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি।এই যে বড়রা সবাই গাঙের পাশে বসে উচ্চ শব্দে কথা বলছে,কিছুক্ষণ পর পরই একজন দুজন এসে রক্তমাখা জায়গাটায় উঁকি মারছে এগুলো নিয়ে বাচ্চাদের মনে উল্লাসের সীমা নেই।

হঠাৎ দূরের রাস্তা থেকে কোনো গাড়ির আওয়াজ শুনে সকলের ভ্রু কুঞ্চিত হলো।দেখে মনে হচ্ছে কোনো জীপগাড়ি। এক নিমিষেই সবাই বুঝে গেল পুলিশের গাড়ি এটা।তাঁরা আগেই জানত চেয়্যারম্যানের খুন নিয়ে গ্রামে খুব হম্বিতম্বি হবে।কিন্তু তাঁদের কৌতূহল আরেক ধাপ বেড়ে গেল যখন দেখল পুলিশের জীপের পেছনে সাদা রঙের আরো একটা গাড়ি ধুলো উড়িয়ে এগিয়ে আসছে।
দেখতে দেখতে গাড়ি দুটো গাঙের পাড়ে এসে গেল।জীপ থেকে নামল দুজন পুলিশ।বাচ্চারা এবার খেলা থামিয়ে উৎসুক হয়ে দেখছে পুলিশকে।জটলা পাকিয়ে বসে থাকা লোকগুলোও উঠে আসল।
তখনই সাদা রঙের গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো একজন সুপুরুষ।সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর চেহারায় অতিমাত্রায় বিস্ময়তা ছেঁয়ে গেল।এমন সুদর্শন পুরুষ তাঁরা এই গাঁয়ে কখনো দেখেনি।এ যেন টিভির পর্দায় অভিনয় করা কোনো খ্যাতিমান তারকা।খয়েরী শার্টটা উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের বলিষ্ঠ দেহের সাথে আঁটসাঁট হয়ে লেগে আছে।পরনে গাবার্ডিনের ধূসর প্যান্ট।চোখে রোদচশমা। লোকটা নিজস্ব ভঙ্গিমায় দু হাত বুকের সাথে ভাঁজ করে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

একজন পুলিশ অফিসার চারদিকে নজর বুলিয়ে সামনের লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করল,

‘ সকালে আপনাদের বলে গেছিলাম এই জায়গাটায় এভাবে দল বেঁধে বসে থাকবেন না।কিন্তু আপনারা তা কানেও তুলেননি।আপনাদের অনুসরণ করে এই ছোট বাচ্চাগুলোও হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে এখানে।’

‘ স্যার আমরা তো এমনিই বসে বসে আলোচনা করছিলাম।’

মোটাসোটা পুলিশ অফিসারটি এবার ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন,

‘ আপনাদের বলেছে কেউ আলোচনা করতে?কেন বুঝতে পারছেন না এখানে একটা খুন হয়েছে।কোনো ছেলেখেলা ব্যাপার নয় এটা।গ্রামের মানুষদের নিয়ে এই এক জ্বালা।সবকিছুতেই তাঁরা নিজেদের উদাসীনতা প্রকাশ করবে।’

ধমক খেয়ে লোকগুলোর মুখ চুপসে গেল।কিন্তু ওঁরা আড়চোখে সেই সুদর্শন পুরুষটিকে এখনো দেখে চলেছে।ওই ব্যক্তিটি এখনো আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।চোখে চশমা থাকার কারণে বুঝা যাচ্ছে না সে কোথায় তাকিয়ে আছে।

‘ শুনুন, আলোচনা,তর্ক-বিতর্ক এসব কিছুই আপনাদের করতে হবে না।আপনাদের এই দায়িত্ব দেয়া হয় নি।চেয়্যারম্যান রেজাউল হোসেন যথেষ্ট প্রতাপশালী এবং সম্মানিত মানুষ ছিলেন।তাই উনার খুনের ব্যাপারটা নিয়ে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব ঘেঁটে দেখার।কাল থেকেই তদন্ত শুরু হবে।আর এই দায়িত্ব পড়েছে স্যারের উপর।’

পুলিশ অফিসারটি আঙুল উঁচিয়ে সুদর্শন লোকটির দিকে তাক করলেন।

‘ নাফিজ ইমতিয়াজ নিশান।সিআইডি বিভাগের অ্যাডিশনাল ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল।চিনে রাখুন উনাকে।আপনারা উনাকে সর্বসাকুল্যে সাহায্য করার চেষ্টা করবেন।’

লোকগুলো যন্ত্রের মত মাথা নাড়ল।এবার ওঁরা বুঝতে পারল যে ওই ছেলেটি টিভির পর্দার কোনো তারকা নয়।সে পুলিশের লোক।

পুলিশের পুরো টিম খুনের স্পট টা আরো ভালো করে দেখছে।নিশান এখন তাঁর চশমা পকেটে রেখে চারদিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি বুলিয়ে নিচ্ছে।গাঙের একসাইডে ঝোপঝাড়। খুনি তাহলে ওখান দিয়েই পালিয়েছে। কারণ সামনের দিকে তো ধানের ক্ষেত।তাঁর পাশেই তিন চারটা টিনের ঘর।
সব কিছু দেখার পর পুলিশ অফিসারটি বলল,

‘ চলুন স্যার।আপনাকে পৌঁছে দিই।আপনি তো এই গ্রামে প্রথমবার এসেছেন।’

পুনরায় চোখে সানগ্লাস গলিয়ে নিশান ভারী গলায় বলল,

‘ নো নিড।লোকেশন বলে দিন।আমি চলে যাবো।’

__________________________

বিকেলের সূর্য ছড়িয়ে আছে উঠোনে।উঠোনের একপাশে সুউচ্চ নারকেল গাছের গোড়ায় একটা মুরগি তাঁর বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরঘুর করছে।কিছুদূরেই বাড়ির পোষা নেড়ি কুকুরটি ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঝিমাচ্ছে।
টিনশেড বিল্ডিংটার বারান্দায় মধ্যম সাইজের একটি খাঁচা ঝুলছে।যার ভেতরে দুটো শুভ্র রঙের পায়রা।ওঁরা অস্থির কন্ঠে ডেকে চলেছে।মনে হচ্ছে যেন কাউকে দেখার জন্য ছটফট করছে ওরা।

ঘরের ভেতর যূথী অলস ভঙ্গিতে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে।আজ সারাদিন সে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল।এখনো পর্যন্ত ভালোকরে খাওয়া হয়নি।পেটের ভেতর খিদে চিড়বিড় করে উঠছে।
একসময় বিছানা ছেড়ে বারান্দায় নেমে এল সে।পায়রা দুটো ওকে দেখতে পেয়ে আরো জোরে ডেকে উঠল।মুচকি হাসল যূথী।অবলা প্রাণী দুটো ওর ভীষণ ভক্ত।একবেলা না দেখতে পেলে অস্থির হয়ে যায়।হঠাৎই ওর নজর গেল উঠোন থেকে কয়েক গজ দূরে সাদা রঙের একটা গাড়ি দাঁড় করানো।আশেপাশে কোনো লোকজন নেই।এই গাড়িটা এখানে কি করছে?

লতিফা বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন যূথী নড়নচড়ন ছাড়া দাঁড়িয়ে আছে।তিনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে এসে বলতে লাগলেন,

‘ কখন উঠলি ঘুম থেকে?নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।চল ভাত খাবি।’

‘ এক মিনিট চাচী! আগে আমার কৌতূহল মিটাও।খরগোশ আকৃতির এই বিশাল গাড়িটা এখানে কি করছে?চাচা নতুন গাড়ী কিনেছে নাকি?’

‘ হ্যাঁ তোর চাচা তো লটারি পেয়েছে যে এই গাড়ি কিনবে।কথা না বাড়িয়ে চল তাড়াতাড়ি। নিশান অপেক্ষা করছে তোর জন্য। ‘

যূথী মুখে এবার হাজারো প্রশ্ন এসে ভিড় করল।
‘ নিশান টা কে?’

‘ সবাই বলছিল তুই নাকি চেয়্যারম্যানকে খুন হতে দেখেছিস।এই ব্যাপারে নিশান তোকে কিসব জিজ্ঞেস করবে।আমার খুব ভয় করছে যূথী।তুই কি সত্যিই কিছু দেখেছিস?’

লতিফা বেগমের চেহারায় ভয়ের চিহ্ন ফুটে আছে।তৎক্ষনাৎ যূথীর চোখের সামনে খুন হওয়ার দৃশ্যটা ভেসে উঠল।এতক্ষণ তো তাঁর মনেই ছিল না।এখন মনে পড়াতে শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কথা ঘুরানোর জন্য বলল,

‘ এসব বাদ দাও এখন।আগে বলো নিশান নামক বান্দাটি কে?’

‘ তোর প্রশ্নের চক্করে আমি তো ভুলেই গেছি যে ছেলেটা তোকে ডেকে পাঠিয়েছে। চল তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে ওর সাথে দেখা কর।’

যূথী আর কিছু বলার সুযোগই পেল না।কিন্তু মনের ভেতর হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। চাচীর কথা শুনে বুঝা গেল নিশান নামক ব্যক্তিটি বর্তমানে এই বাড়িতেই আছে।নিশ্চয়ই ওই গাড়ির মালিকও উনি।কিন্তু কেথায় সে?ধারেকাছে তো দেখা যাচ্ছে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here