প্রিয়দর্শিনী,পর্ব_৮,৯

#প্রিয়দর্শিনী,পর্ব_৮,৯
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৮
🍁
‘ পাগল হলে যূথী?যে জিনিস মানুষ দেখলেই ভয় পায় সেটা তুমি হাতে নিয়ে দেখতে চাইছো?’

অনিকের কথায় ভুবন ভুলানো হাসি দিল যূথী যেন মজার কোনো কথা শুনেছে।কিন্তু তৎক্ষনাৎ কাঁদোকাঁদো চেহারা বানিয়ে বলল,

‘ হ্যাঁ।দেখতে চাই।আর আপনি সেটা দেখাবেন।’

‘ যূথী এটা যারতার হাতে দেওয়া যায় না।আর নিশান স্যার দেখতে পেলে নির্ঘাত কয়েকটা রামধমক খেতে হবে।চেনো না উনাকে।’

এবার যূথীর দুই ভ্রু কুঁচকে এল।মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে খুব। চোখ ছোট ছোট করে বলল,

‘ কি বললেন আপনি?আমাকে যারতার বলছেন!এই বাড়ির মেয়েকে যারতার বলছেন?ঠিক আছে আপনার প্রেমকাহিনী শুরু হওয়ার আগেই আমি শেষ করে দিব।রাস্তা ক্লিয়ার করার বদলে সেই রাস্তায় আমি বেলগাছের কাটা বিছিয়ে দেব।তখন বুঝবেন মজা।আর নিশান না ফিশান উনাকে চেনার দরকার নেই আমার।আপনিই আমাকে এখনো চিনেন নি।এই গ্রামে যূথী একপিসই আছে।’

যূথীর কাঠ কাঠ কথা শুনে অনিক দমে গেল।যূথী মেয়েটাকে বেশি একটা সুবিধার লাগছে না।যদি সত্যিই প্রেমকাহিনী শুরু হওয়ার আগে ক্ষতম করে দেয়?এই মেয়েকে এক দন্ডের বিশ্বাস নেই।

‘ এত হাইপার হচ্ছো কেনো যূথী।এমন মিষ্টি মেয়ের চেহারায় রাগ মানায় না।’

‘ পামপট্টি না মেরে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন।’

অনিক অসহায় মুখ নিয়ে হিমেশের দিকে তাকাল।হিমেশ দাঁত খিচিয়ে আস্তে করে বলল,

‘ এভাবে তাকাবি তো ঘুষি মেরে তোর মুখ ভেঙে দেব আমি।’

অনিক পকেট থেকে রিভলবার বের যূথীর সামনে ধরল।যূথীর চোখ আপনাতেই বড় হয়ে গেল।তাঁর কত ইচ্ছে ছিল এই বস্তুটা একবার ছুঁয়ে দেখবে।তাঁর কিসমত এতই ভালো যে সেই বস্তুটি এখন তাঁর চোখের সামনে।আনন্দে উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল,

‘ কি সুন্দর! চকচক করছে।ট্রে টা একটু ধরুন না।আমি একবার হাতে নেই এটা।’

হিমেশ এবং অনিক অবাক হয়ে যূথীর ঝলমলে চেহারা দেখছে।বলতে বাধ্য মেয়েটা অতিমাত্রায় চঞ্চল। সাথে অদ্ভুতও।রিভলবার দেখা মাত্র একটু হলেও ভয় পাওয়ার কথা।তা না করে আনন্দে লাফাচ্ছে।
যূথী অনিকের হাতে ট্রে ধরিয়ে দিয়ে রিভলবার হাতে নিল।

‘ এটা বুঝি সবসময় আপনাদের পকেটে থাকে?ভেতরে গুলি আছে?’

‘ না যূথী।ভেতরে ফাঁকা। হিমেশ এবং আমারটায় গুলি নেই।আমাদের সবার যেখানে সেখানে শুট করার অর্ডার থাকে না।তারজন্য গুলিও রাখি না।তবে নিশান স্যারের টায় গুলি আছে।’

যূথী মুগ্ধ হয়ে রিভলবার উল্টেপাল্টে দেখছে।কাল কলেজে গিয়ে বান্ধবীদের গর্বের সাথে বলতে পারবে যে সে অতি ভাগ্যবতী মেয়ে যে কিনা এমন একটা দূরুহ বস্তু হাতে নিয়েছে।

‘ অনেক হয়েছে যূথী।এবার এটা ফেরত দাও।নিশান স্যার দেখতে পেলে একগাদা বকা শুনতে হবে।স্যার রুমের ভেতরেই আছেন।’

‘ প্লিজ একটু।এখন আমি টিভির মত অ্যাক্টিং করব।আপনারাও আমাকে সাহায্য করুন।’

যূথীর কথা শুনে হিমেশ এবং অনিকা চেহারা ঝুলে পড়ল।এই মেয়ে এসব কি বলছে।অ্যাক্টিং করবে মানেটা কি?
হিমেশ এবং অনিকের কৌতুহল মিটিয়ে যূথী ওদের দিকে রিভলবার তাক করে হঠাৎই বলে উঠল,

‘ হ্যান্ডসআপ বয়েজ! ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।’

হিমেশ অনিক কিছুক্ষণ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।তারপর হেসে উঠল উঠোন কাঁপিয়ে।যূথীর কর্মকান্ডে এবার বেশ মজা পাচ্ছে দুজন।
যূথী চোখ রাঙিয়ে বলল,

‘ হাত উপরে তোলো অপরাধীরা।তোমাদের খেলা শেষ।’

‘ দুঃখিত ম্য্যডাম আমার হাতে তো নাস্তার ট্রে। হাত উপরে তুললে ট্রে ভেঙে যাবে।হিমেশ হাত তুলবে।এই হিমেশ হাত তোল্।

এবার তিনজনই হেসে দিল।ঠিক এমন সময় বারান্দা থেকে আওয়াজ আসলো,

‘ হোয়্যাটস্ হ্যাপেনিং হেয়ার?’

তিনজন হাসি থামিয়ে বারান্দার দিকে নজর দিল।নিশান দাঁড়িয়ে আছে গেইটের কাছে।চোখেমুখে কাঠিন্যতা।
অনিক বিড়বিড় করে বলে উঠল,

‘ আব তো ম্যায় গায়া কামসে।’

যূথীর হাতে এখনো রিভলবার ধরা।এটা দেখতে পেয়ে নিশান বলে উঠল,

‘ ওর হাতে গান কেনো হিমেশ?’

হিমেশ কিছু বলার আগে যূথী বলে বসল,

‘ আমরা চোর পুলিশ খেলছিলাম।অনিক ভাইয়া আমার ট্রে টা দিন।আমি এখন যাই।’

যূথী আর এক সেকেন্ড দেরি না করে ট্রে নিয়ে হাঁটা দিল।কিছুটা গিয়ে আবার পেছন ফিরে বলল,

‘ অনিক ভাইয়া..ফুলের নাম কিন্তু শেফালী!’

যূথী চলে যেতে নিশান ভ্রু কুঁচকে অনিকের দিকে তাকাল।অনিক দুই পাটি দাঁত বের করে মেকি হেসে বলল,

‘ আ..আসলে যূথী একটা ধাঁধা বলেছিল আমায়।সেই ধাঁধার উত্তর শেফালী ফুল।’

‘ অনিক আই হোপ তুমি যে কাজে এসেছো সেই কাজেই ধ্যান দিবে।অন্যদিকে নয়।নাউ লেটস্ গো।একজায়গায় যেতে হবে।’

‘ ইয়েস স্যার।’

অনিক হাফ ছেড়ে বাঁচল।তবে নিশান যে সবটা ব্যাপার বুঝে গেছে তা সে ভালই জানে।

_____________________________

বিকেলে খোকনদের পুকুরপাড়ের সিড়িতে যূথী এবং শেফালী পাশাপাশি বসে আছে।শেফালীর মুখ লজ্জায় রাঙা।যূথীর কাছ থেকে অনিকের ব্যাপারে শুনার পরেই সে যেন এক ভিন্ন গ্রহের প্রাণীতে পরিণত হয়েছে।কিছুক্ষণ পর পর নিজে নিজেই মুচকি হেসে উঠছে।অপলক তাকিয়ে আছে সিড়ির উপর ঘুরে বেড়ানো ছোট্ট শামুকটার দিকে।যূথী সেই কখন থেকে বকবক করে যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে মন নেই তাঁর।
যূথী শামুকটা হাতে তুলে বলল,

‘ কত্তদিন পর জীবিত শামুক দেখলাম বল তো!হাসগুলো তো শামুক দেখলেই পেটে পুরে নেয়।’

‘ হুম’

শেফালীর ছোট করে উত্তর দেওয়া যূথীর পছন্দ হলো না।সে শামুকটা পুকুরে ফেলে দিয়ে বলল,

‘ ওই ফকিন্নির মা! অনিক ভাইয়ার কথাটা বলেছি মাত্র কয়েক মিনিট হবে আর এরমধ্যেই উনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস?’

‘ হাবুডুবু নারে বইনা।আমি তো আপাদমস্তক ডুবে বসে আছি।আমার তো উনাকে প্রথম থেকেই ভালো লাগত।তুই যখন বললি উনি আমাকে পছন্দ করে এরপর থেকে আরো বেশি করে প্রেমে পড়েছি।’

‘ তুই তোর প্রেম নিয়েই থাক।তুই যেরকম আনমনা হয়ে আছিস আমি এখানে না থাকলেও সমস্যা নেই।গুডবায়!’

যূথী উঠে দাঁড়াতে শেফালী ওকে টেনে আবার বসিয়ে দিল।মিনতির সুরে বলল,

‘ বস্ না আমার পাশে!এত মেজাজ গরম করছিস কেনো?প্রেম জিনিসটা তো এখনো বুঝিস না তুই।কখনো কারো প্রেমে পড়লে বুঝবি কেনো আমি আনমনা হয়ে আছি। ‘

যূথী হঠাৎই ভাবুক হয়ে গেল।সত্যিই কি কখনো তাঁর জীবনে প্রেম আসবে?সে কি কাউকে ভালোবাসতে পারবে?ভালোবাসার অনুভূতি নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারবে?তাঁর খুব জানতে ইচ্ছে করে যে ভালোবাসা কেমন হয়!গনিতের সরল অঙ্কের মতো সোজা নাকি কেমিস্ট্রির ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মতো কঠিন।

হঠাৎ শেফালীর চাপা চিৎকারে যূথী ভাবনার জগৎ থেকে বের হলো।

‘ যূথী ওই যে দেখ্! তিন ছোকড়াদের গ্রুপটা না এটা?’

যূথী দূরের রাস্তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিল।শেফালীর কথাই সত্যি। যূথী বুক ফুলিয়ে ভাব নিয়ে বলল,

‘ দাঁড়া উনাদের আসতে দে তারপর অনিক ভাইয়ার সাথে তোর কথা বলার ব্যবস্থা করে দেব।’

‘ না না যূথী।প্লিজ এটা করিস না।আমি লজ্জায় মরে যাব।দোহাই লাগি এমনটা করিস না।’

‘ এমনটাই করব।তোর লজ্জা লাগলে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস।এতক্ষণ তো অনিক ভাইয়ার কথা ভেবে দিনদুনিয়া ভুলতে বসেছিলি।আর এখন নাটক করছিস!’

শেফালীর কথা উপেক্ষা করে যূথী কাঁঠাল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল।নিশানরা যখন কাছাকাছি আসল তখন সে দুম করে ওদের সামনে গিয়ে পড়ল।আচমকা এমন হওয়ায় অনিক ভয় পেয়ে বলল,

‘ তুমি তো আমাদের মেরেই ফেলছিলে যূথী।দেখো আমার হার্ট এখনো ঢিপঢিপ করছে।আমি তো ভাবলাম গাছ থেকে লাফ দিয়ে আবার কোনো ভয়ংকর প্রাণী আক্রমণ করল না তো।’

যূথী আড়চোখে নিশানের দিকে তাকাল।নিশান এই মুহূর্তে ফোনে কারো সাথে কথা বলতে বলতে সামনের দিকে হাঁটছে।তারমানে যূথী ওই লোকটাকে ভয় দেখাতে পারেনি।মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। তাঁর তো উদ্দেশ্য ছিল ওই লোকটাকে ভড়কে দেওয়া।
যূথী বিস্তৃত হেসে ফিসফিস করে অনিককে বলল,

‘ আপাতত আপনার হার্টের ঢিপঢিপ বন্ধ করুন।কারণ এই মুহূর্তে আপনাকে দেখে আরেকজনের হার্ট ঢিপঢিপ করতে করতে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।যান তাঁকে সামলান গিয়ে। ওই যে পুকুর পাড়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ‘

‘ যূথী ইউ আর জিনিয়াস! কিন্তু নিশান স্যার….’

‘ উনাকে আমি দেখে নিব।আপনি হিমেশ ভাইয়াকে নিয়ে যান।’

অনিক হিমেশ চলে যতে যূথী পা চালিয়ে নিশানের সমান হলো।ততক্ষণে নিশানের ফোনে কথা বলা শেষ।পিছন ফিরে যূথীকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।

‘ ওঁরা দুজন কোথায়? ‘

যূথী ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘ এসে যাবে।চলুন আপনি আর আমি হাঁটতে থাকি।’

নিশান কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে ব্যাপারটা বুঝতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ট্রাউজার্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল,

‘ ভালো কাজে মাথার বুদ্ধি গুলো প্রয়োগ করতে পারো না।ইউজলেস কাজে বুদ্ধি ব্যবহার করে মাথার পচন ধরিয়ে ফেলছো তো!’

‘ এই আপনি কোনটাকে ইউজলেস কাজ বলছেন?ওরা প্রেম করছে এটা আপনার সহ্য হচ্ছে না তাই না?নিজেও একটা প্রেম করে ফেলুন দেখবেন অন্যেরটা দেখে আর হিংসা লাগবে না।’

‘ সাট আপ।ক বলতেই কুমিল্লা বুঝে নিচ্ছো তুমি।’

‘ মোটেও না।আমি তো…… ‘

কথা শেষ করার আগেই যূথী গাছের শিকড়ে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়তে নিল।কিন্তু নিশান ওর হাত যথাসময়ে ধরাতে এবারের মতো রক্ষা পেল।যূথী নিঃশ্বাস ফেলছে বড় বড় করে।এখন নিশ্চয়ই পড়ে গেলে তাঁর হাত-পা ছিলে যেত।
নিশান কঠোর গলায় বলল,

‘ আকাশের দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটো।আর এত বকবক করো কেনো?তোমার কথা বলার গতি বাতাসের থেকেও দ্বিগুন!’

যূথী মুখ গোমড়া করে ফেলল।সে তো আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটে নি।সে তো এই লম্বুটার দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল।আর বকবক করলে উনার কি?এতই সমস্যা হলে কানে আঙুল ঢুকিয়ে রাখলেই তো পারে।
বিড়বিড় করতে করতে যূথী সামনের দিকে হাঁটতে লাগল।

চলবে…

#প্রিয়দর্শিনী
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৯
🍁
অবশেষে নিশানদের ঢাকায় ফেরার পালা।গ্রামে যেসব কাজ করা দরকার ছিল তা সম্পন্ন হয়েছে।বাকি কাজ ঢাকায় গিয়ে করতে হবে।তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকায় ফিরতে চায়।
অন্যদিকে যূথীও ঢাকায় যাওয়ার জন্য সকাল থেকেই তোড়জোড় করছে।নানা আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হয়েছিল যূথী নিশানদের সাথেই ঢাকায় পৌঁছে যাবে।দুয়েকদিন তাঁদের বাড়িতে থাকার পর কোনো একটা ভালো হোস্টেলে উঠবে।যূথীও বাধ্য হয়ে তা মেনে নিয়েছে।

বিকেল চারটে নাগাদ ওঁরা নিজেদের ব্যাগ বস্তা নিয়ে উঠোনে জড়ো হলো।যূথী তো পারে না কেঁদেই দেয়।কিন্তু সামনে তিনজন যুবক থাকার কারণে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে পারছে না।লতিফা চাচী সেই কখন থেকে নানা উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। ভালো হয়ে চলতে হবে,ঠিকমতো খাবার খেতে হবে,কোনো সমস্যা হলে সাথে সাথে যেন নীলুফা চাচী অথবা নিশানকে জানিয়ে দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
সকলের থেকে বিদায় নিয়ে যূথী নিশানের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।ড্রাইভিং সিটে নিশান বসে আছে এবং পেছনের সিটে হিমেশ ও অনিক।যূথী নিশানের পাশের সিটে বসে পড়ল।

নিশান বলল,
‘ সিট বেল্টটা বাঁধো যূথী।’

যূথী ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
‘ আমি কখনো সিট বেল্ট বেঁধেছি?’

‘ তাই তো!ওয়েট আমিই বেঁধে দিচ্ছি। ‘

নিশান যূথীর দিকে ঝুঁকে এসে সিট বেল্ট বাঁধতে লাগল।যূথী অদ্ভুত সুন্দর এক ঘ্রাণ পেল নিশানের শরীর থেকে।ইস! এমন মাতাল করা ঘ্রাণে তো তাঁর নেশা ধরে যাচ্ছে। কোনোকিছু না ভেবে ফট করে জিজ্ঞেস করে বসল,

‘ আপনি কোন বডি স্প্রে ব্যবহার করেন নিশান ভাইয়া?’

এমন প্রশ্ন শুনে ভড়কে গেল নিশান।পেছন থেকে হিমেশ এবং অনিকও কথা থামিয়ে দিয়েছে।ওরা নিঃশব্দে হাসছে।যূথী দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,

‘ না মানে অনেক সুন্দর ফ্র্যাগনেন্স।তাই জিজ্ঞেস করলাম।আচ্ছা সমস্যা নেই বলতে হবে না।আপনি গাড়ি স্টার্ট দিন।আজ কিন্তু আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখব আপনি গাড়ি চালাতে পারেন কিনা।😃’

নিশান মুখ গম্ভীর করে গাড়ি স্টার্ট দিল।মেয়েটা যে কি ধাতু দিয়ে তৈরি সেটা তাঁর এই মুহূর্তে খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

.

কিছুদূর যেতেই যূথী হঠাৎ চিল্লিয়ে উঠল,
‘ গাড়ি থামান নিশান ভাইয়া! গাড়ি থামান।’

যূথীর চিৎকারে নিশান সহ বাকি দুজন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।নিশান দক্ষ হাতে ব্রেক কষল।বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করল,

‘ হোয়্যাট হ্যাপেন্ড যূথী?’

‘ আসলে আমার ফ্রেন্ড শেফালীর সাথে দেখা করতে ভুলে গেছি।দেখুন সে আমার সাথে দেখা করার জন্য ওই যে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।’

নিশানের বিরক্তি আরো একধাপ বেড়ে গেল।কোনোরকমে বিরক্তি চাপা দিয়ে বলল,

‘ ওকে যাও।এক মিনিটের মধ্যে ফিরে আসবে।’

‘ থ্যাংক ইউ সো মাচ্।আপনি খুব ভালো।অনিক ভাইয়া আপনি বসে আছেন কেনো?তাড়াতাড়ি যান।’

নিশান হতভম্ব। এই মেয়ে কি পাগল হয়ে গেছে নাকি?তাঁর মত এমন শার্প মস্তিষ্কের মানুষকে চকিতেই ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে। দাঁত কটমট করে জিজ্ঞেস করল,

‘ এক্ষুনি তো বললে তোমার ফ্রেন্ড। সেখানে অনিক কেনো যাবে?’

‘ কেনো যাচ্ছে সেটা তো বুঝতেই পারছেন নিশান ভাইয়া।হিহিহি।কপোত-কপোতী একটু দেখা করবে আর কি।অনিক ভাইয়া আপনি এখনো বসে আছেন?সময় কিন্তু একমিনিট। এরমধ্যেই দেখা সাক্ষাৎ করে ফিরে আসুন।’

অনিক নিশানের দিকে তাকিয়ে মেকি হেসে বেরিয়ে গেল।
নিশান স্থির দৃষ্টিতে যূথীর দিকে তাকিয়ে আছে।এই মুহূর্তে তাঁর মনে হচ্ছে যূথী নামের মেয়েটি তাঁদের বাড়িতে না থেকে হোস্টেলে উঠলে বিরাট আনন্দের ব্যাপার হবে।নাহলে বকবক করে পুরো বাড়ির মানুষের মাথা চিবিয়ে খেত।

.

সন্ধ্যা নেমে এসেছে চারদিকে। জনবহুল রাস্তায় মানুষের চেঁচামেচি এবং যানবাহনের হর্নের আওয়াজ।রাস্তার আশেপাশে হকারের আনাগোনা।বয়স্ক মানুষগুলো সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়েছে।অন্যদের মুখে ব্যস্ততার ছাপ।ওরা চলছে নিজ গন্তব্যে।

জ্যামের মধ্যে আটকা পড়ে আছে নিশানদের গাড়ি।একদিকে প্রচন্ড গরম অন্যদিকে এই জ্যাম।নিশানের মেজাজ বিগড়ে আছে।গাড়ির এসিটা গত দুইদিন ধরে কাজ করছে না এটা মনে হতেই মেজাজ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গরমের যন্ত্রণায় শার্টের উপরের কয়েকটা বোতাম খুলে দিয়েছে।
হঠাৎই যূথীর দিকে চোখ গেল নিশানের।মেয়েটা জানালার কাঁচে মাথা হেলিয়ে ঘুমে বেঁহুশ।কপালে ঘাম জমে আছে বিন্দু বিন্দু। কাঁচ ভেদ করে আসা স্ট্রিট লাইটের হলুদ আলোয় মেয়েটার মুখে মোহনীয় এক ছায়া খেলা করছে।কিছু চুল লেপ্টে আছে গালের সাথে।ঘুমের মধ্যে পাতলা ঠোঁট দুটো হালকা কেঁপে কেঁপে উঠছে।
নিশান চকিতেই অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে নিল।একটা ঘুমন্ত মেয়ের দিকে এভাবে তাকানোয় নিজের কাছেই লজ্জাবোধ হচ্ছে। কিন্তু যেভাবে ঘুমিয়ে আছে গাড়ি স্টার্ট দিলে তো মাথায় আঘাত লাগবে।

ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল নিশান।হিমেশ অনিক দুজন হাত জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে।নিশান অতি সাবধানতার সহিত যূথীর মাথাটা সিটের সাথে হেলিয়ে দিল।কিন্তু সাথে সাথে মাথা আবার কাঁচের সাথে লেগে গেল।নিশান পুনরায় ঠিক করে দিতে একই ঘটনা ঘটল।নিশান যূথীর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল,

‘ ঘুমের মধ্যেও ত্যাড়ামি শেষ হয় না।’

তখনই আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠল যূথী।প্রচন্ড গরমের কারণে অস্থির লাগছে তাঁর।গায়ের জামা ঘামে ভিজে শরীরের সাথে লেগে আছে।এমন বিচ্ছিরি অবস্থায় সে মরার মত ঘুমালো কিভাবে বুঝতে পারছে না।গাড়ি থেমে আছে টের পেতে ঘুমো ঘুমো গলায় বলল,

‘ আমরা কি এসে গেছি নিশান ভাইয়া?তাহলে বসে আছেন কেনো?’

নিশান কোনো উত্তর দিল না।গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে শক্ত হয়ে বসে রইল।যূথী চোখ ডলে ঠিকঠাক হয়ে বসল।বাইরে তাকিয়ে দেখে সব গাড়ি সিরিয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।চারদিকে ধুলোবালি আর ধোঁয়ার কুন্ডলী।তাঁর মনটাই খারাপ হয়ে গেল।কোথায় গ্রাম আর কোথায় শহর!আকাশ-পাতাল ব্যবধান।

‘ ভীষণ গরম লাগছে নিশান ভাইয়া। আমাকে আইসক্রিম এনে দিন।’

যূথীর কথা শুনে মুখে গাম্ভীর্যতা বজায় রাখলেও মনে মনে হাসল নিশান।কি সহজ সাবলীল কথা!কোনো ফর্মালিটি নেই।
নিশান গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে বলল,

‘ অপেক্ষা করো।আসছি আমি।’

নিশান রিকশা,অটো,প্রাইভেট কারের ফাঁক গলিয়ে দোকানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যূথী তাকিয়ে আছে সেদিকে। কেনো জানি এই মানুষটাকে তাঁর খুব ভালো লাগে।কখনো তিনি মুচকি হাসে আবার কখনো গুরুগম্ভীর হয়ে থাকেন।প্রথম প্রথম তো ওর সাথে হেসে কথা বলত কিন্তু ভোরবেলার সেই ঘটনাটার পর থেকে প্রায়ই রেগে থাকে।

নিশান ফিরে এল হাত ভর্তি ফাস্টফুড খাবার নিয়ে।সাথে আইসক্রিমও আছে।যূথী অবাক হয়ে বলল,

‘ আপনি কি পুরো দোকান উঠিয়ে এনেছেন?এত খাবার কে খাবে?’

নিশান যূথীর হাতে কোণ আইসক্রিম ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘ আগে এটা খাও।গরম কিছুটা কম লাগবে।’

যূথী মুচকি হেসে নিশানের দিকে তাকাল।লোকটার কপালের চুলগুলো ঘামে লেপ্টে আছে।চেহারায় অবসাদের ছাপ।শার্টের বোতামের দিকে চোখ যেতেই যূথীর দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল।ফর্সা উন্মুক্ত বুক দেখে তাঁর মাথা ভনভন করছে।ঘামের কারণে শার্ট বেশখানিকটা ভিজে আছে।সাথে সাথে মাথা ঘুরিয়ে নিল। হঠাৎ করে এমন হচ্ছে কেনো তাঁর?একটা মেয়ে হয়ে কোনো ছেলের দিকে এভাবে তাকানোয় তাঁর বেশ অস্বস্তি লাগছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here