#প্রিয়দর্শিনী,পর্ব_১৯,২০
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১৯
🍁
যূথী এখনো ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি।নিশানের এমন আচমকা উপস্থিতি তাঁকে ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে এই মানুষটা তাঁর অবচেতন মনের কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। কারণ নিশানের এখানে উপস্থিত হওয়ার কোনো যুক্তিযুক্ত উদ্দেশ্য তো সে খুঁজে পাচ্ছে না।
যূথী সন্দিহান হয়ে আঙুল দিয়ে নিশানের বাহুতে হালকা খোঁচা দিয়ে নিশ্চিত হলো মানুষটা আসল নাকি নকল।যখন টের পেল মানুষটা আসল তখন আবার আগের মত দীঘির পানিতে দৃষ্টি দিয়ে চুপচাপ বসে রইল।ভাব এমন যেন তাঁর পাশে কেউ বসে নেই।আসল হোক আর নকল সে তো নিশান ভাইয়া থেকে দূরে থাকতে চায়।
যূথীর এমন গা ছাড়া ভাব তেমন গায়ে মাখল না নিশান।সে জানে এটা হওয়ারই ছিল।শুধু এটা নয় তাঁর থেকেও বেশি কিছু হবে।কিন্তু কিছু করার নেই।যা হবে সব মুখ বন্ধ করে সহ্য করতে হবে।
নিশান সামনে পিছনে ভালভাবে নজর বুলিয়ে যূথীর দিকে আরেকটু চেপে এল।নিশানের এমন কান্ডে যূথী ছিটকে কয়েক হাত দূরে সরে গেল।সে নিশানের মতিগতি কিছু ঠাওর করতে পারছে না।লোকটা নিশ্চয়ই ঢাকা থেকে গ্রামে পৌঁছে দীঘির পাড়ে বসে তাঁর সাথে আড্ডা দিতে আসেনি।
যূথী চোখ পাকিয়ে বলল,
‘ আপনি এখানে বসে আছেন কেনো?যে কাজে এসেছেন সে কাজে যান।খামোখা এখানে বসে সুন্দর পরিবেশটাকে নষ্ট করছেন কেনো?’
যূথীর তীক্ষ্ণ কথার ধাঁচ শুনে নিশান চুপ মেরে গেল।এই মেয়ে তো পুরো ঝাঁসি কি রানী হয়ে বসে আছে।একে বাগে আনা খুবই কষ্টকর হবে।কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে সেটা পূর্ণ করা না পর্যন্ত সে ক্ষান্ত হবে না।যূথীর কথাবার্তার স্টাইল শুনে বুঝে গেছে তাঁকে এখন আগের ফরমে ফিরে যেতে হবে।নাহলে এই মেয়ের ধমকের দাপটে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না।
নিশান গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল।দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
‘ অনেক হয়েছে।চলো এবার।সন্ধ্যা হয়ে আসছে।’
‘ তো?সন্ধ্যা কেনো গভীর রাত হলেও আমি রাস্তা চিনে বাড়ি যেতে পারব।আপনার চিন্তা করতে হবে না।’
‘ গভীর রাত পর্যন্ত থাকতে দিচ্ছে কে তোমায়?আর আমি তোমাকে বাড়ি যাওয়ার কথা তো বলিনি!’
‘ মানে?’
‘ রাস্তার শেষ মাথায় আমার গাড়ি দাঁড় করানো আছে।চুপচাপ গিয়ে উঠে পড়ো গাড়িতে।’
যূথী মাথা উঁচু করে রাস্তার দিকে তাকাল।সাদা গাড়িটার সামনের অংশ দেখা যাচ্ছে। কয়েকজন ছোট ছোট বাচ্চা উৎসুক হয়ে গাড়ির চারপাশে ঘুরাফেরা করছে।
‘ আপনার গাড়িতে কেনো উঠতে যাব?’
‘ কারণ তুমি এখন এই মুহূর্তে আমার সাথে ঢাকা যাবে।’
যূথী এবার আকাশ থেকে পড়ল।এই লোক কি পাগল হয়ে গেছে নাকি?নিশ্চয়ই ঘুমের ঘোরে গাড়ি চালাতে চালাতে এখানে চলে এসেছে।
যূথী উঠে দাঁড়িয়ে চড়া গলায় বলল,
‘ আপনি দয়া করে ঘুমের রাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে আসুন।এসব কি পাগলের প্রলাপ বকছেন?ভূতের মত হাজির হয়ে এসে বলছেন ঢাকা যেতে হবে আমায়।ঢাকা কেনো যাব আমি?আপনার এঙ্গেজমেন্টের দাওয়াত খেতে?’
‘ ডোন্ট সাউট।কি জন্য ঢাকা যেতে হবে সেটা গেলেই বুঝতে পারবে।’
‘ কি হাস্যকর কথাবার্তা বলছেন আপনি নিশান ভাইয়া?আপনি বলবেন আর আমি সুড়সুড় করে গিয়ে গাড়িতে উঠব?আপনি কি মনে করেন আমাকে?’
‘ একজন পিচ্চি ঝগড়ুটে কূটবুদ্ধির বালিকা। আমার তোমাকে এটাই মনে হয়।’
যূথীর চোখদুটো বড়বড় হয়ে গেল।এই লোক তাঁকে এভাবে সরাসরি এতগুলো উপাধি দিয়ে দিল?রাগে তাঁর মাথার তালু জ্বলে উঠছে।নিশানের দিকে কঠিন চাহনি দিয়ে উল্টো ঘুরে হাঁটা শুরু করল।কিন্তু দুয়েক পা’র বেশি এগুতে পারল না।নিশান ঝড়ের বেগে খপ করে ধরে ফেলল যূথীর হাত।
যূথী দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল,
‘ কি করছেন! এটা আপনার শহর নয়।ছাড়ুন।যাব না আমি আপনার সাথে।’
‘ না গেলে তুলে নিয়ে যাব।’
যূথীর নিশানের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে বলল,
‘ আমি কিন্তু চিল্লাচিল্লি করে সবাইকে ডেকে এনে বলব আপনি আমাকে কিডন্যাপ করতে চাইছেন।তখন বুঝবেন মজা।গণধোলাই খেয়েছেন জীবনে?আজ সেটা আমি আপনাকে খাইয়ে ছাড়ব।’
‘ ওকে লেটস্ সি।ডাকো তোমার গণধোলাইকারীদের।আ’ম রেডি।’
যূথীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিশান যূথীকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিল।এবার যূথীর প্রাণপাখি যেন খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।নিশান এমন কিছু করবে তা সে ভাবে নি।ভয়ে আতঙ্কে সে বলল,
‘ এগুলো কি করছেন! নামান আমাকে।আল্লাহ্ কেউ যদি এই অবস্থায় দেখে তাহলে এই গ্রামে টিকতে পারব না।সবাই আমাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে।’
নিশান স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘ এমনিতেও এই গ্রামে আমি তোমাকে টিকতে দেব না।আজ এই মুহূর্ত থেকে তুমি আমার নজরে বন্দী। ‘
‘ কারণটা কি? আমি কি অপরাধী? ‘
যূথীর প্রশ্নে নিশান স্মিত হাসল।কিছুটা ঝোঁকে ফিসফিস করে বলল,
‘ তুমি নও।অপরাধী আমি।সাথে ভুলও করেছি অনেকগুলো।আর সেই ভুল শোধরানোর জন্য আমার তোমাকে প্রয়োজন ডিয়ার।’
নিশানের কথায় যূথী একধরনের ধাঁধার মধ্যে ডুবে গেল।লোকটা কোন অপরাধের কথা বলছে?উনার কথার মধ্যে এত রহস্য কেনো?
নিশান গাড়ির কাছে পৌঁছাতে হুঁশ ফিরল যূথীর।ছটফট করে বলতে লাগল,
‘ আপনি এভাবে নিয়ে যাচ্ছেন আমায় চাচী তো কিছু জানে না।বাড়ি না ফিরলে চাচী চিন্তা করবে আমার জন্য।আর আমার জামাকাপড় সব বাড়িতে রয়ে গেছে।’
‘ রিল্যাক্স! আমি এখানে এসে প্রথমেই তোমাদের বাড়িতে গিয়ে খালামণির থেকে পারমিশন নিয়ে এসেছি।আর তোমার ব্যাগ উনিই গুছিয়ে দিয়েছে।গাড়ির পেছনের সিটে ব্যাগ রাখা।’
যূথী হতবাক হয়ে রইল।এই লোক তাহলে সব রকমের প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে।সে আর কোনোভাবেই নিশানকে আটকানোর পথ পেল না।
নিশান যূথীকে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।ততক্ষণে চারদিকে সন্ধ্যার আঁধার নেমে এসেছে।রাস্তাঘাটে লোকজন দেখা যাচ্ছে না।পাশের ঘন ঝোপঝাড় থেকে অনবরত ঝিঁঝি পোকার বেসুরে গান শোনা যাচ্ছে।
যূথী বন্ধ কাঁচের জানালা গলিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিয়ে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।তাঁর সাথে এসব কি হচ্ছে কিছুই সে বুঝতে পারছে না।যার সুখের জন্য সে শহর থেকে চলে এসেছিল সেই মানুষটাই এখন তাঁর সামনে হাজির হয়ে জোর করে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উনি কি ইচ্ছে করেই এমনটা করছে?জানে যে উনাকে অন্য কারো সাথে দেখলে তাঁর ভেতরটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাবে।তবুও কেনো ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই আরো কষ্ট দেওয়ার জন্য।
যূথীর মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল।
কিন্তু হঠাৎ অনুভব করল সে স্থির হয়ে আছে অর্থাৎ গাড়ি চলছে না।নিশান ভাইয়া তো গাড়ি স্টার্ট দিয়েছিল।সে ভ্রু কুঁচকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল নিশানের দিকে।তখনই তাঁর মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল রক্ত বয়ে গেল।নিশান কেমন ভাবে যেন তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।এই চোখের ভাষা অন্যরকম।যেন অনেক কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না।এই চাহনিতে কোনোকিছু আঁকড়ে ধরার তীব্র বাসনা।সুদর্শন মুখে বিরাজ করছে হাজারো মায়া।
যূথী কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘ গাড়ি চালাচ্ছেন না কেনো?কি হয়েছে?’
নিশান কোনো উত্তর করল না।গভীর দৃষ্টিতে আগের মত তাকিয়ে রইল।
যূথী আবারো প্রশ্ন করল,
‘ শুনতে পাচ্ছেন কি?’
নিশান যূথীকে পাত্তা না দিয়ে গাড়ির ভেতর জ্বলতে থাকা লাইটটা নিভিয়ে দিল।সন্ধ্যার অন্ধকার এবার ওদের দুজনকেও স্পর্শ করল।যূথী কিছু বলতে নিবে এমন সময় খুব কাছ থেকে নিশানের শরীরের সেই মাতাল করা সুগন্ধটা অনুভব করল।এই সুগন্ধ জানান দিচ্ছে নিশান তাঁর খুব কাছে।
মস্ত একটা ঢোক গিলল যূথী।মনে সাহস জুগিয়ে আবারো কিছু বলবে তখনই নিজের ঠোঁটে কারো ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ পেল।হাড় কাঁপানো ঠান্ডার মত জমে গেল সে।যে কথাটা বলতে যাচ্ছিল সেটা গলাতেই আটকে রইল।হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
ঠোঁটের উপর টুকরো টুকরো কতগুলো স্পর্শ পেতে আরো নেতিয়ে পড়ল সে।ক্ষনিকের মধ্যেই অনুভব করল সেই স্পর্শ থেমে গেছে।তাঁর কাছাকাছি অবস্থান করা ব্যক্তিটি এবার দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে তাঁকে।এতটা গভীরভাবে জড়িয়ে আছে যেন ছেড়ে দিলেই গায়েব হয়ে যাবে কোথাও।যূথী নিজেকে সামলাতে না পেরে সব শক্তি ছেড়ে দিল।
সেই ব্যক্তিটি একসময় ফিসফিস করে বলল,
‘ খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি কি?’
যূথীর চোখ এবার ভিজে উঠল।নিস্তেজ হয়ে যাওয়া হাতটা আস্তে আস্তে নিশানের পিঠে রেখে বলতে চেষ্টা করল,
‘ আ..আপনি..!’
‘ হ্যাঁ।ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে।তোমার অনুপস্থিতি আমাকে পুড়িয়েছে প্রতিটা মুহূর্তে। তোমার শূন্যতা অনুভব করে পাগল হয়ে গেছি আমি।আমার ভুল তো এটাই ছিল যে আমি তোমাকে এবং তোমার ভালোবাসাকে অবহেলা করেছি।তুমি আমার থেকে দূরে যাওয়ার পর সেই ভুলটা বুঝতে পেরে অশান্তিতে ছিলাম প্রত্যকেটা প্রহর।আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না যূথী?ভালবাসতে দাও আমায় যূথী!’
যূথীর চোখের কোনায় জমে থাকা পানি এবার বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পরল।ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে খাঁমচে ধরল নিশানের শার্ট।নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। অবশেষে সে তাঁর ভালোবাসাকে নিজের করে পেল।তাঁর বিশ্বাস হেরে যায়নি।
যূথীর জড়িয়ে ধরা অনুভব করতেই সব উত্তর পেয়ে গেল নিশান।মুচকি হেসে যূথীর মাথায় চুমু খেল সে।
চলবে…
#প্রিয়দর্শিনী
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২০
🍁
গ্রামের রাস্তা ছাড়িয়ে গাড়ি শহরের ভেতর প্রবেশ করেছে।চারদিকে যানবাহনের উচ্চ শব্দ আর মানুষের কোলাহল।বাতাসের সাথে ধোঁয়ার মত ধুলো উড়ছে।গাড়ির ভেতর চুপচাপ বসে আছে যূথী।আজ আর শহরের দূষণযুক্ত পরিবেশ তাঁর উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না।কারণ সে বর্তমানে বাস্তব দুনিয়ায় নেই।ভাসছে কোনো রঙিন হাওয়ায়।তখনের ঘটনাটা মনে পড়তেই লাজুক হাসি ফুটে উঠছে তাঁর মুখে।চোখের কোনা দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর নিশানকে দেখছে।লোকটা সেই কখন থেকে কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে কারো সাথে কথা বলায় মগ্ন।উনি কি জানেন না গাড়ি ড্রাইভ করার সময় সতর্ক থাকা লাগে।
লুকিয়ে চুরিয়ে দেখতে গিয়ে কয়েকবার নিশানের কাছে ধরাও পড়ে গেছিল।নিশান কিছুই বলেনি শুধু বাঁকা হেসে চোখ মেরেছিল যূথীকে।ব্যস্ এটাই ছিল যূথীর লজ্জা দ্বিগুন পরিমান বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ।আজকের দিনটা তো তাঁর জীবনে সবচেয়ে স্পেশাল হয়ে থাকবে।সকালেও কি ভাবতে পেরেছিল আজ এমন এক আচানক ঘটনা ঘটবে!!
আরও কিছুটা রাস্তা এগিয়ে যাওয়ার পর গাড়ি জ্যামে আটকে পড়ল।যূথী বিরক্তমুখে খোলা জানালা দিয়ে মাথা বের করে সামনে পিছনে গাড়ির সিরিয়াল পর্যবেক্ষণ করল।এই লম্বা জ্যাম কখন ছাড়ে কে জানে।নাকি আজ সারারাত রাস্তাতেই কাটাতে হয়।
নিশান এখনো ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বুঝা যাচ্ছে জরুরি কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে।যূথী ক্লান্ত ভঙ্গিতে সিটের সাথে মাথা হেলিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
হঠাৎ দেখল ওদের থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে যে প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে সেটার বন্ধ জানালা ধীরে ধীরে খুলে গেল।সামনের সিটে দুজন ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। যারা এই মুহূর্তে যূথীর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলাবলি করছে।আবার মুচকি মুচকি হাসছে।যূথীর বিরক্ত আরো বেড়ে গেল।ছেলেগুলো হয়তোবা এতক্ষণ বন্ধ জানালার ভেতর থেকে খেয়াল করছিল তাঁকে।কিন্তু সে তো বাইরে থেকে ওদের দেখতে পায়নি।মনে মনে ছেলেগুলোকে উদ্দেশ্য করে গালি ছাড়ল কয়েকটা।বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
‘ অসভ্য ছেলেপুলে কোথাকার।জ্যামে আটকে আছে তবুও মেয়ে দেখলে অসভ্যতামি করা ছাড়ছে না।এগুলোকে তো গাড়ির নিচে পিষে ফেলা দরকার।’
যূথী সোজা হয়ে বসে রইল।কিন্তু তাঁর খুব আনইজি ফিল হচ্ছে। জানালা দিয়ে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে ছেলেগুলো এখনো আগের মত ফাজলামো করার তালে আছে।যূথী ঘাড়টাকে হালকা এঙ্গেল করে সেদিকে তাকাতেই ছেলেগুলো ওর দিকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে মারল।এটা দেখে তাঁর হুঁশ উড়ে যাওয়ার পালা।ছেলেগুলো তো চরম বেয়াদপ।দেখতে ভদ্র পরিবারের মনে হলেও আসলে একেকটা বদের হাড্ডি।ওদের বাবা মা কি জানে ওরা রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে বেড়ায়!
যূথী কাঁদকাঁদ চেহারা নিয়ে নিশানের দিকে ফিরল।নিশান মাত্রই ফোনে কথা বলা শেষ করে পানির বোতল থেকে পানি খাচ্ছে। যূথীর এমন চেহারা দেখে প্রশ্ন করল,
‘ এনিথিং রং?’
যূথী বলবে কি বলবে না সেটা ঠিক করতে না পেরে চুপ করে রইল।ততক্ষণে জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে।নিশানও আর কোনো প্রশ্ন না করে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিল।কিন্তু কিছুদূর যেতেই যূথী টের পেল নিশান প্রচন্ড স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে। এত স্পিড মনে হয় যেন কোনো প্রতিযোগিতা চলছে।
যূথী অস্থির হয়ে বলে উঠল,
‘ কি করছেন?গাড়ি কি হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাবেন?দয়া করে একটু আস্তে চালান।’
নিশান যেন যূথীর কথা শুনতেই পায়নি।বাতাসের বেগে গাড়ি চালাতে লাগল।যূথী নিশানের কর্মকান্ড কিছুই বুঝতে পারছে না।সে ভয় পেয়ে সিটের সাথে মিশে রইল।একসময় আচমকা ব্রেক কষার আওয়াজ পেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে।গাড়ি থেমে আছে কোনো ফাঁকা রাস্তায়।পাশে তাকিয়ে দেখে নিশান হুড়মুড় করে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল।
যূথী সিট বেল্ট খোলার চেষ্টা করতে করতে বলল,
‘ আরে আপনি আমাকে ফেলে যাচ্ছেন কোথায়?আপনার উদ্দেশ্য কি বলুন তো!!আমাকে মেরে টেরে ফেলবেন নাকি?’
‘ সাট আপ।চুপচাপ বসে থাকো ভেতরে।বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করলে সত্যি সত্যিই এখানে ফেলে চলে যাবো।’
যূথীকে হুমকি দিয়ে নিশান সামনে হাঁটতে লাগল।যূথী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জানালা দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল নিশান কোথায় যাচ্ছে। ওদের গাড়ি থেকে কয়েক গজ দূরে আরো একটা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে অবাক হলো সে।কারণ নিশান সেদিকেই যাচ্ছে। আরো অবাক হলো যখন দেখল গাড়ির ভেতর থেকে তখনের ফাজিল ছেলেগুলো বেরিয়ে আসছে।যূথী মাথা বের করে পুরো ঘটনা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল।
দুজন ছেলের একজন নিশানকে উদ্দ্যেশ্য করে চিল্লিয়ে বলছে,
‘ আব্বে পাগল হয়ে গেছিস নাকি?হিরো ভাবছিস নিজেকে?এভাবে মাঝরাস্তায় গাড়ি আটকানোর মানে কি?’
নিশান কোনো উত্তর না দিয়ে ছেলেটার গাল বরাবর কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারল।মারের চোটে ছেলেটা কয়েকপা পিছিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।অন্য ছেলেটা এসে নিশানের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগল,
‘ থাপ্পড় মারলি কেন? এত সাহস কই পেলি?জানিস কে আমরা?’
নিশানের রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ছেলেটার গালে চড় বসিয়ে বলল,
‘ রাস্তায় মেয়েদের ডিস্টার্ব করতে খুব মজা লাগে না?কি করছিলি তখন? ফ্লাইং কিস ছুড়েছিলি তাই না।এদিকে আয় তোদের কিস ছুড়ার শখ আমি মিটিয়ে দিই। রাস্কেল কোথাকার!!বড়লোক বাপমায়ের বিগড়ে যাওয়া ছেলে! টানতে টানতে যখন লকাপে নিয়ে ঢোকাব তখন টের পাবি আসল মজা।!
কথাগুলো বলতে বলতে নিশান ছেলেদুটোকে আরো কয়েকটা চড় থাপ্পড় মেরে দিল।ছেলেগুলো এবার ভয় পেয়ে ভেজা বেড়ালের মত মিইয়ে গেল।বারবার অনুরোধ করে বলতে লাগল,
‘ স্যরি স্যার।মাফ করেন।ভুল হয়ে গেছে।আর মারবেন না।প্লিজ স্যার।’
নিশান আরো কিছুক্ষণ ওদেরকে শাসিয়ে ফিরে এল নিজের গাড়ির কাছে।যূথী সমস্ত ঘটনা বুঝতে পেরে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।ছেলেগুলো তখন যা করেছিল সেই সম্পূর্ণ দৃশ্য তাহলে নিশান দেখে নিয়েছে।আর ওদের শায়েস্তা করার জন্যই এভাবে ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে ছেলেদুটোর পথ আটকিয়েছে।
নিশান গাড়িতে ঢুকতেই যূথী ভয়ে সিটিয়ে পড়ল।কারণ নিশানকে দেখতে খুব ভয়ংকর লাগছে।ফর্সা মুখ লালে লাল।চোখ দিয়ে যেন অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। নিশান স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগল।
যূথী আস্তে আস্তে বলল,
‘ সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে কেনো এভাবে মারামারি করতে গেলেন?’
যূথীর এই কথাটাই যেন নিশানের রাগ আরো বাড়িয়ে দিল।যূথীর দিকে তীব্র চাহনি দিয়ে দাঁত কটমট করে বলল,
‘ ওদের যতগুলো থাপ্পড় মেরেছি তারচেয়েও বেশি মারার দরকার ছিল তোমাকে।ইডিয়ট কোথাকার।ওরা তখন যা করেছে সেটা আমাকে বলোনি কেনো?আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তো নাকি?কিন্তু তুমি চুপ করে ছিলে।হোয়াই?ওরা যেটা করছিল তা ইনজয় করছিলে খুব তাই তো?’
নিশানের ধমকে যূথী মুষড়ে পরল।এসব কি বলছে নিশান ভাইয়া! অবশ্য সে বুঝতে পারছে লোকটা ভীষণ রেগে আছে।তাই এখন তর্ক না করাই ভালো।নাহলে দেখা যাবে সত্যি সত্যিই থাপ্পড় মারা শুরু করবে।উনার মাসলওয়ালা হাতের একটা চড় খেলেই তো সে কুপোকাত।ছেলেগুলো কিভাবে সহ্য করেছে কে জানে।নিশ্চয়ই গালের হাড় ভেঙে চুরচুর হয়ে গেছে।
যূথী শুকনো ঢোক গিলে মেকি হেসে বলল,
‘ আচ্ছা বুঝতে পারছি আ..আমার ভুল হয়ে গেছে।এমনটা আর হবে না।আপনি প্লিজ রাগ করে থাকবেন না।আপনি রাগ করলে ভালো লাগে না আমার।’
নিশান যূথীর কথা পাত্তা না শক্ত মুখ করে বসে রইল।যূথী পারে না কেঁদেই দেয়।আজ এত স্পেশাল একটা দিন আর আজই উনি এভাবে রাগ করে থাকবে?এটা হতেই পারে না।সে ওই পাথর মানবের রাগ ভেঙেই ছাড়বে।
‘ আপনি কিন্তু এটা ঠিক করছেন না নিশান ভাইয়া।একটা সামান্য ঘটনা নিয়ে….’
নিশান চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই থেমে গেল যূথী।মেকি হেসে বলল,
‘ না মানে এটা কোনো সামান্য ঘটনা নয়।খুবই অসামান্য ঘটনা।তাই বলে এখনো রেগে থাকবেন?আজ এত স্পেশাল একটা দিন আর আপনি আমাকে এভাবে ধমকাবেন?ইটস্ নট ফেয়ার।’
যূথীর ইমোশনাল ডায়লগ টলাতে পারল না নিশানকে।যূথীর এবার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ কতক্ষণ রেগে থাকবেন আপনি?আমি আপনাকে রেগে থাকতে দিব না।এবার দেখুন কি করি আমি।আমিও দেখি কত রাগ আপনার।’
যূথী মনে সাহস জুগিয়ে চোখের পলকে নিশানের রাগে লাল হয়ে যাওয়া গালে সশব্দে একটা চুমু খেয়ে নিল।মুহূর্তেই চোখ দুটো গোলগাল হয়ে গেল নিশানের। যূথী এমন কিছু করবে সে তো ভাবেই নি।যূথী ঠোঁট টিপে হেসে শান্ত হয়ে বসে রইল।
নিশান বাঁকা হেসে বলল,
‘ বাহ্ ভালোই বুদ্ধি প্রয়োগ করেছো তো!এমন হলে তো আমি সারাক্ষণই রেগে থাকব তোমার সাথে।’
যূথী চোখ ছোট ছোট করে বলল,
‘ আস্ত একটা বদমাশ।’
‘ কি বললে?আরেকবার বলো তো!’
‘ না কিছু না।’
নিশান এক ঝটকায় যূথী টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এল।হঠাৎ এমন হওয়ায় ভয় পেয়ে গেল যূথী।নিশানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
‘ আরে কি করছেন।এখনি আমার হাতের কলকব্জা খুলে যেত।আপনি কি আমাকে মানুষ মনে করেন না?’
নিশান যূথীর কপালের চুলগুলো সরিয়ে চুমু খেয়ে বলল,
‘ একটা কথা বলে রাখি শোনো।যাই হয়ে যাক আমার থেকে কখনো কোনো কথা লুকাবে না।তোমার দেখভাল করার দায়িত্ব আমার উপর।আমি থাকতে কোনো ক্ষতি হতে দেব না তোমার!কোনোরকম হেজিটেশন ছাড়া আমার কাছে নিজের সব সমস্যার কথা খুলে বলবে।মনে থাকবে? ‘
যূথী বিস্ময় নিয়ে মাথা দুলাল।সে কি কোনো স্বপ্নের দুনিয়ায় আছে নাকি বাস্তবে?তাঁর মন শুধু বলছে অবশেষে ভরসা করার মত একজনকে সে তাঁর জীবনে পেয়েছে।যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়।যূথীর চোখের কোনার পানি পড়তে গিয়েও পড়ল।একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সে বিশ্বজয় করা হাসি হাসল।
চলবে…