#প্রিয়দর্শিনী,#পর্ব_১৬
#সামান্তা_সিমি
🍁
সকালে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ পেতে ঘুম ভেঙে গেল যূথীর।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল মাত্র সাতটা বাজে।এত সকালে কে রুমে ঢুকতে চাইছে তা সে পাঁচ মিনিট বসে ভেবেও বের করতে পারল না।দরজার আওয়াজ এবার আগের চেয়ে তীব্র হলো।
যূথী গায়ে উড়না জড়িয়ে দরজা খুলে দেখতে পেল রেশমি খালা হাতে পানিভর্তি বালতি এবং কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘর মোছার জন্য।
রেশমি খালা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
‘ আইজ বাড়িতে কাম আছে তাই সক্কাল সক্কাল ঘর মোছা শেষ কইরা যামু গা।আপনার ঘুম নষ্ট হইল মামণি।’
‘ না না আন্টি।আপনি আপনার কাজ করুন।’
যূথী রুম থেকে বাইরে এসে নিচতলায় নজর দিল।এখনো কেউ উঠেনি।তবে কিচেন থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে।নিশ্চয়ই নীলু চাচী ব্রেকফাস্ট বানানোয় হাত দিয়ে ফেলেছে।
যূথী ঠিক করল কিছুক্ষণ ছাদ থেকে ঘুরে আসবে।এবাড়িতে আসার পর তো ছাদে এখনো পা রাখেনি।মনীষা বলেছিল ছাদে নাকি একটা দোলনা বসানো আছে।
সাতপাঁচ না ভেবে যূথী রওনা হলো ছাদের দিকে।কিন্তু সে কি আর জানতো আজ দোলনায় দোল খাওয়া তাঁর ভাগ্যে নেই!
কারণ ছাদে পা রাখতে না রাখতে নিশানকে দেখে থেমে যেতে হলো।নিশান স্লিভলেস কালো গেঞ্জি পড়ে ছাদের মাটিতে পুশআপ দিচ্ছে। ঘামের কারণে গেঞ্জি জবজবে হয়ে ভিজে শরীরের সাথে লেগে আছে।মাথার চুলগুলোও আধভেজা।যূথীর বুক ধকধক করতে লাগল।নিশানের এমন রূপ দেখবে তা সে কখনো কল্পনাই করে নি।এতদিন শুধু শার্টের উপর দিয়েই নিশানের বডি লক্ষ্য করে এসেছে।আর আজ সরাসরি নিশানকে এমন অবস্থায় দেখে তাঁর গলা শুকিয়ে আসছে।কোন কুক্ষণে সে এখন ছাদে আসলো?
তাঁর ব্রেইন সিগন্যাল দিচ্ছে এখান থেকে চলে যেতে কিন্তু অবাধ্য চোখদুটো স্থির হয়ে আছে সামনের মানুষটির উপর।
পুশআপ শেষ করে উঠে দাঁড়াল নিশান।নিচ থেকে পানির বোতল উঠিয়ে ঘর্মাক্ত মুখে উপুর করে ঢেলে দিল।সে এখনো যূথীকে লক্ষ্য করেনি।কিন্তু রুমে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়াতেই স্ট্যাচুর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা যূথীকে দেখতে পেল।নিশানের দুই ভ্রু কুঞ্চিত হলো।
যূথীর সামনে এসে কঠোর গলায় বলল,
‘ এখানে কি করছো তুমি?’
এতক্ষণে হুঁশ আসলো যূথীর।নিশানকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হৃৎপিণ্ডের গতি আরো বেড়ে গেল।
কোনোরকমে বলল,
‘ এমনিই একটু হাঁটতে এসেছিলাম।ঘুম ভেঙে গেছে তাই…’
নিশান কিছুক্ষণ যূথীর দিকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগল।তখনই,
‘ এক মিনিট নিশান ভাইয়া!’
যূথীর এমন তীক্ষ্ণ গলার ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল নিশান।যূথী দরজার মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।কিছুক্ষণ আগে মেয়েটার চেহারায় যে ঘুমো ঘুমো ভাব ছিল এখন সেটা রুক্ষতায় রূপ নিয়েছে।হঠাৎ কি হলো কে জানে।
যূথী কোনো জড়তা ছাড়াই জিজ্ঞেস করে বসল,
‘ কেনো আমাকে ইগনোর করছেন নিশান ভাইয়া?কি দোষ আমার?’
‘ হোয়্যাট?’
নিশানের ধমকে একটুও দমল না যূথী।গলা উচিয়ে বলল,
‘ আপনি খুব ভালো করেই জানেন আমি আপনাকে কতটা পছন্দ করি।আপনার নজর থেকে এই ব্যাপারটা এড়ানোর কথা নয়।সব জানার পরও আপনি আমার সাথে এমন বিহেভ করছেন।আমার দোষটা কোথায় আমি জানতে চাই।আপনাকে পছন্দ করি এটাই কি আমার দোষ?’
নিশান স্থির চাহনিতে দেখছে যূথীকে।এ যেন এক নতুন যূথী।এই যূথীর চেহারায় কোথাও চঞ্চলতার ছিটেফোঁটা নেই।আছে শুধু চোখভরা অভিমান।
‘ আপনার কি মনে হয় এই যে আমাকে এভাবে অবহেলা অপমান করেন এগুলো আমার গায়ে লাগে না?লাগে খুব কষ্ট লাগে আমার। প্রিয় মানুষটার সব কিছু সহ্য করা যায় কিন্তু অবহেলা নয়।আমি যদি আপনাকে খুব বেশি বিরক্ত করে থাকি তাহলে আজ থেকে আমি নিজেই আপনার থেকে দূরত্ব বজায় রাখব।সেধে সেধে কারো বিরক্তির কারণ হতে চাই না।’
যূথীর কথায় নিশানের কোনো হেলদুল হলো না।সে এখনো আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে।যূথীকে কিছুক্ষণ সূক্ষ্ম নজরে পর্যবেক্ষণ করে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।
যূথীর চোখে এবার প্রায় পানি আসার উপক্রম। নিজেকে সামলে নিয়ে কান্নাভেজা গলায় বলল,
‘ আপনি কিন্তু এখনো আমাকে এড়িয়ে গেলেন নিশান ভাইয়া।আমার মনের কথা নির্দ্বিধায় বলে দিয়েছি আপনাকে।কিছু তো একটা বলুন।’
‘ এসব প্রেম ভালোবাসা আমার পছন্দ নয় যূথী।তুমি আমার থেকে যত দূরে থাকবে ততই তোমার নিজের জন্য ভালো হবে।নাহলে কষ্ট পেতে হবে প্রতিনিয়ত। ‘
নিশান ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেল নিচে।যূথীর চোখের কোণায় জমে থাকা পানি টুপ করে গড়িয়ে পড়ল।কি করে পারল উনি মুখের উপর এই কথাগুলো বলতে!কিন্তু পরক্ষণেই চোখের পানি মুছে মনে মনে বলল,
‘ কিছুদিন না হয় দূরত্ব বজায় রাখব।কিন্তু হাল ছাড়ব না।জীবনের প্রথম ভালোবাসা আপনি।এত সহজে ছাড়ছি না।
__________________________
প্রায় এক সপ্তাহের মত কেটে গেল যূথী নিশানের সাথে যথেষ্ট পরিমান দূরত্ব রেখে চলছে।কথা বলার সুযোগ পেলেও কথা বলছে না।আগের মত আর নিশানকে রাগিয়ে দেয় না।কলেজে যাওয়ার সময় মনীষাকে জোর করে টেনে নিয়ে অটো করে চলে যায়।নিশান সমস্ত ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করলেও কোনো প্রতিক্রিয়া করল না।অথচ যূথী মনেপ্রাণে চাইছিল নিশান কিছু একটা করুক,কিছু একটা বলুক।
সেদিন সকালে মনীষা কলেজ যাওয়ার পথে যূথীকে জিজ্ঞেস করল,
‘ ভাইয়া আর তুমি দুজন দুইদিকে।কি করে তোমাদের মিল হবে আমি কিছু ভেবে পাচ্ছি না যূথী।ভাইয়া কেন এমন করছে তোমার সাথে?’
যূথী শুকনো হেসে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আসলে কি জানো কেউ কেউ সময় থাকতে সঠিক জিনিসের কদর বুঝে না।অবহেলা করে দূরে ঢেলে দেয়।যখন জিনিসটা হারিয়ে যায় তখন তার মর্ম বুঝে।দেখবে কোনো একদিন আমি উনার থেকে হারিয়ে যাব।সেদিন হাজার ডাকলেও আর আসব না।তবে কি জানো আমি উনাকে হৃদয়ের গভীরতম স্থান থেকে ভালোবাসি।আমার বিশ্বাস উনি খুব তাড়াতাড়ি আমার ভালোবাসায় সাড়া দিবেন।’
‘ তাই যেন হয় যূথী।তোমাকে এভাবে বিষন্ন দেখতে আমার ভালো লাগে না।তোমাকে হাসিতেই মানায়।’
_________________________
কেটে গেছে আরো দুটো দিন।দুপুরের দিকে যূথী কলেজ থেকে বাড়ি পৌঁছল।আজ মনীষা কলেজ যায়নি তাই একা একাই তাঁকে অটো করে আসতে হয়েছে।
গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একটা কালো প্রাইভেট কারের দিকে নজর গেল।যূথী গাড়িটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।এটা তো এই বাড়ির গাড়ি নয়।তাহলে নিশ্চয়ই বাড়িতে কোনো মেহমান এসেছে।
বাড়ির বাগানে মালী নিড়ানি দিয়ে মাটিতে কি যেন করছিল।যূথীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঝলমলে চেহারায় বলল,
‘ অবশেষে এই বাড়িতে বিয়ের আমেজ লেগে গেল।এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো মা।তাড়াতাড়ি ভেতরে যাও।’
যূথী ঘটনা কিছু বুঝতে না পেরে এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ বিয়ের আমেজ মানে?কার বিয়ে?’
‘ ভেতর গিয়ে নিজেই সাক্ষী হও।’
রহমত চাচা খুশিতে গদগদ হয়ে ফিরে গেল আবার নিজের কাজে।বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে এই লোকটির আনন্দের সীমা থাকে না।কারণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে কয়েকদিন ইচ্ছেমত পেটপুরে ভোজন করা যায়।
যূথী ধীর কদমে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে দেখল ড্রয়িংরুমে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ এবং মহিলা বসে আছে।দুজনের গায়ে আভিজাত্যের ছোঁয়া।সৌজন্যমূলক হেসে কথা বলছে নীলুফা চৌধুরী এবং তাঁর স্বামীর সাথে।মনীষা এবং বিদীষার বাবা মাও উপস্থিত আছেন। যূথী প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও যখন নিশানকে তাঁদের পাশে বসে থাকতে দেখল তখনই অজানা আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠল তাঁর।রহমত চাচার কথা মাথার ভেতর বারংবার ঘুরপাক খেতে লাগল।দুয়ে দুয়ে মিলাতে গেলে অনাসায়ে চার হয়ে যাচ্ছে। যূথীর পেটে মোচড় দিয়ে উঠছে।এসব কি হচ্ছে তাঁর চোখের সামনে?
দোতলার করিডোরে নজর যেতে দেখল মনীষা বিদীষা ওকে হাত নাড়িয়ে ডাকছে।ওদের চেহারা ভয়াবহ কিছুর জানান দিচ্ছে। যূথী ড্রয়িংরুমের সকলের আড়ালে চলে গেল সিড়ির কাছে।কি মনে করে পিছন ফিরে একবার তাকাতে দেখল নিশান চেয়ে আছে তাঁর দিকে।যূথী পুনরায় মাথা ঘুরিয়ে নিল।তাঁর শরীর ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সিড়ি দিয়ে উঠার শক্তিও পাচ্ছে না।
মনীষা বিদীষা যূথীকে দেখতে পেয়ে পাগলের মত বলতে লাগল,
‘ কেলেংকারী হয়ে যাচ্ছে যূথী।ওই যে উনাদের দেখছো?উনারা উনাদের মেয়ের সাথে নিশান ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে এসেছে।আমরা এতক্ষণ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলাম।অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে বাড়ির সকলেরই মত আছে। ‘
যূথী শুকনো ঢুক গিলে বলল,
‘ আর নিশান ভাইয়া?উনি কি রাজি?’
মনীষা বিদীষা কেউই কোনো উত্তর দিল না।
চলবে…