প্রলয়ে_প্রণয়ের_সুর #লেখা: জবরুল ইসলাম #পর্ব_৯

#প্রলয়ে_প্রণয়ের_সুর
#লেখা: জবরুল ইসলাম
#পর্ব_৯
.
‘আপনার না মাথা ব্যথা?’ তরু ভ্রু-কুঁচকে প্রশ্ন করলো।

‘আপনি কি যাবেন?’ নির্জনের গলায় বিরক্তি।

– ‘হ্যাঁ যাব।’

‘তাহলে গিয়ে বলে আসুন। আমি রুমে অপেক্ষা করছি’ বলে নির্জন চলে গেল।

তরু ওর কথা বলার রূঢ়ভাব লক্ষ্য করেছে। তবুও কিছু না বলে কেয়ার রুমের দিকে গেল। দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে বললো, ‘কে? আসো।’

তরু ভেতরে গেল। কেয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটা নতুন ড্রেস পরে নিজেকে দেখছে আর গুন-গুন করে গাইছে “কি মায়ায় বেঁধেছো আমায়, পিয়া গো..।”
তরুর দিকে না তাকিয়েই খানিক পর বললো, ‘কেমন লাগছেরে এই ড্রেসে? এর আগে পরিনি এটা, এখন দেখছিলাম কেমন লাগে।’

তরু মনে মনে ভাবছে ‘এই রোদ, এই বৃষ্টি’ বলতে যা বুঝায় সেই অবস্থা হয়েছে তার ফুপুর। কখনও একেবারে মোলায়েম গলা, হাসিখুশি মুখ, পরক্ষণেই উধাও। সে ভালোভাবে তাকিয়ে বললো, ‘সুন্দর লাগছে ফুপু আর আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।’

– ‘তাই না-কি? একা?’

– ‘না নির্জন ভাই যাবে। একটু ঘুরে আসি।’

– ‘সাবধান কিন্তু, তোদের দু’জনকে এক সাথে দেখলেই মনে হয় কিছু একটা হবে তোদের মাঝে।’

– ‘বুঝিনি।’

কেয়া পুনরায় গুন-গুন করে আয়নায় রূপচর্চায় মনযোগ দিয়ে বললো, ‘বুঝতে হবে না, যা।’

তরু বের হয়ে এলো। ফুপুর খোঁচাট বুঝতে পারছে। অদ্ভুত! তাদের দু’জনকে একসাথে দেখলে এমন মনে হবে কেন? মুচকি হেসে রুমে এসে সে কাপড় পালটে, চুল আঁচড়ে, ঠোঁটে খানিক লিপস্টিক দিয়ে বের হয়ে নির্জনের দরজার সামনে গিয়ে নক দিল।

– ‘আসছি আমি আপনি নিচে যান।’

তরু নিচে না গিয়ে আবার রুমে এলো। আয়নায় আরেকবার নিজেকে দেখলো। হুট করে মাথায় এলো সে আসলে দেখতে কেমন? তার গল্পের নায়িকার মতো বর্ণনা করতে গেলে কি বলবে সে? থুতনির ঠিক মাঝখানে একটা ছোট্ট গর্ত আছে তার। কোনো দূর্ঘটনায় নয়। গালের টোলের মতো জন্ম থেকে পাওয়া। ঘন কালো জোড়া ভ্রু। ঠোঁট চিকন না হলেও বড়ো বলা যাবে না। চুল যন্ত্রণাদায়ক ঘন। বারবার সামনে এসেও উৎপাত করে। কখনও বাসে, সিএনজিতে পাশে নায়কোচিত চেহারার কেউ বসেনি৷ বসলে হয়তো চুল জ্বালাতন করার সুযোগ পেত। এযাবৎকালে যা যন্ত্রণা দেয়ার তাকেই দিয়েছে। সে মোটেও লম্বা নয়, তাহলে কি খাটো? নির্দয় কোনো মানুষ মুখের উপর তাকে খাটো বলে ফেললেও মন খারাপ করা ছাড়া কিছু বলার থাকবে না। তবে মোটামুটি চলার মতো। নির্জন এসে দরজায় নক দিয়ে বললো, ‘চলে গেছেন না-কি আছেন?’
তরু ভ্যানিটিব্যাগ আর মোবাইল হতে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে এলো। নির্জনের গায়ে এখনও সাদা পাঞ্জাবি। কবজির ওপরে ব্লু বেল্টের ঘড়ি। পায়ে সেই স্লিপার জুতো। কালো খাড়া খাড়া চুলগুলো রাগি পুরুষেরই পরিচয় জানান দিচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তরু ভেবেছিল দেখবে একজন লম্বা ছেলের পাশে তাকে কতটুকু খাটো দেখায়। পাশাপাশিই নামছিল। কিন্তু নির্জন একটা সিঁড়িতেও স্থির নেই। দ্রুত নেমে যাচ্ছে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আবার বুঝে যাবে তাই তরু আশাহত না হয়ে ঠিক করলো রাস্তায় দেখবে। দু’জন বের হয়ে এলো। রিকশা দাঁড় করালো নির্জন। উঠে বসলো তারা। বিকেলের খোলা আকাশ। ছোপ ছোপ শুভ্র মেঘ। তরুর বেশ ভালো লাগছে। সামনে গিয়ে খানিকটা জ্যামে পড়লো তারা। থামলো রিকশা। তখনই পিছু থেকে ধাক্কা খেল। ঝাঁকুনির সঙ্গে আঁতকে উঠে তরু নির্জনের হাত খামচে ধরলো। ‘উফ’ বলে ক্ষীণ আর্তনাদ করে হেসে ফেললো নির্জন।

– ‘স্যরি, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ব্যথা পাননি তো?’

– ‘না ঠিক আছে।’

তরু চোরা চাহনিতে তাকিয়ে দেখে ওর হাতে নখের আঁচড়ের দাগ পড়ে গেছে। চুপ করে রইল সে। রিকশা এসে থামে। নেমে যায় দু’জন। নির্জন তাকে নিয়ে এসে একটা সুন্দর ঝকঝকে ব্রিজে। নিচ দিয়ে বয়ে গেছে টলটলে জলের ঝিল। দুইপাশের ফুটপাতে অসংখ্য মানুষ। লুফে নিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। গোধূলির আকাশ। ইট-পাথরের ব্যস্ত শহরের ভেতরেই যেন খানিক মন ভরে শ্বাস নেয়ার মতো জায়গা। সন্ধ্যার আকাশের লালিমার ছায়া পড়েছে পানিতে। দূরের লাল-নীল বাতিগুলো মৃদু ঢেউয়ের সঙ্গে নৃত্য করছে। সে নির্জনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বেশ সুন্দর তো।’
মাথা নাড়লো নির্জন। উদাস দেখাচ্ছে তাকে। খানিক পর বললো, ‘ওইদিকে চলুন গিয়ে বসি।’

দু’জন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। বাদামওয়ালা দেখে নির্জন বললো, ‘খাবেন?’

– ‘খোসা ছাড়ানো একটা বিরক্তিকর কাজ।’

স্মিত হেসে নিল বাদাম। দু’জন এসে বসলো একটা বেঞ্চে। নির্জন কয়েকটি বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘নিন।’

তরু হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মুখ ফসকে বলে ফেললো, ‘আপনি এত ভালো হলেন কবে থেকে?’

ওর হাতে বাদাম দিয়ে নির্জন বললো, ‘খারাপের কি করলাম?’

– ‘প্রথম দেখা থেকেই তো শুরু করেছিলেন।’

– ‘ওহ, ওইদিনের কথা।’

তরু নিজের মুখে বাদাম নিয়ে বললো, ‘ওইদিনের কথা নর্মাল? প্রথমদিনেই এত বাজে আচরণ।’

নির্জন খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘এমনিতেই ওইদিন মেজাজ ভালো ছিল না। এর মাঝে আপনার উপরও কিছু কারণে রাগ ছিল।’

– ‘ওমা আমার উপরে রাগ কেন?’

– ‘আজ যে কারণে ডেকেছি সেই একই কারণে একদিন আপনাকে ফেইসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়েছি, মেসেজ দিয়েছি, রিপ্লাই পাইনি।’

– ‘তাই না-কি খেয়াল করিনি তো। তাছাড়া শুধু কারণে রাগ? ব্যাপারটা শিশুসুলভ হয়ে গেল না?’

রাগটা যে শুধু এই কারণে নয়, সেটা নির্জন বলতে গিয়েও আঁটকে গেল। বিয়ের প্রথমদিকে কেয়াকে নতুন আইফোন কিনে দেয়া হয়েছিল। নানান কারণে কিছু না পারলে তার কাছে নিয়ে ছুটে আসতো। একদিন এরকমই এসেছিল। নির্জন মোবাইল হাতে নিতেই হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এলো, ‘আপনার পুত্র নির্জন সাহেবকে আমি দেখেছি, আর বলতে হবে না, পুরাই গুন্ডার মতো দেখতে, চোখ দুইটা মার্বেলের মতো।’

নির্জন বুঝতে পারছিল এটা তরুর মেসেজ। হয়তো তাকে নিয়েই কথা হচ্ছিল ফুপু-ভাইঝির। কেয়া কাছে থাকায় সে মেসেজ ওপেন করেনি। কিন্তু তরুকে খুবই ফালতু মনে হয়েছিল। চেনা-জানা নেই এরকম একটা ছেলেকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করে বসবে? কয়েকমাস আগে কেয়ার সংসারের প্রতি উদাসীনতা দেখে, খিটখিটে স্বভাব দেখে, একদিন তার ফুপু তাকে বললেন, ‘নির্জন, আমার কেন যেন মনে হয় বাবা এই মেয়ে তোর বাপকে জ্বালিয়ে মারবে।’

সে বরাবরের মতোই বললো, ‘কিন্তু কেন?’

– ‘আরে মেয়েটা তো কচি একেবারে। তোর বাপের বয়স তো দেখিসই। ওর হয়তো পছন্দ না।’

– ‘তাহলে বিয়ে বসেছিল কেন? একজন বয়স্ক মানুষ ইচ্ছা হয়েছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। তাকে তো জোর করে বিয়ে করে নাই।’

– ‘বড়লোক দেখে ওর ফ্যামিলি হয়তো জোর করে বিয়ে দিয়েছে।’

– ‘তাহলে তোমরা ওর ফ্যামিলিকে জানাও। ওদের মেয়ে বিয়ে দিল। এখন টালবাহানা কেন করছে।’

– ‘তোর বাপের কথা ধীরে ধীরে ঠিক হবে।’

– ‘তাহলে দেখো কি হয়।’

– ‘শোন, ওদের কারও সঙ্গে কথা বলা দেখ। জোর করে বিয়ে দিল কি-না। মেয়েটার আর কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল কি-না।’

– ‘এসব কি বলছো ফুপু?’

– ‘ঠিকই বলছি, আমি তো বাসায় থাকি, তুই আর তোর বাপ বাইরে। মেয়েটা একা একা কারও সাথে ফোনে কথা বলে। দিনে-দুপুরে বাইরে যায়। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেই দূর্বব্যবহার করে।’

– ‘ও আচ্ছা, কিন্তু বাবা যদি এগুলো নিয়ে কথা না বলেন আমরা কি করবো?’

– ‘ও তো অন্ধ হয়ে আছে। মাথা খেয়ে ফেলেছে মেয়েটা। একবার ভেবে দেখ যদি এখান থেকে মেয়েটা পালিয়ে যায় কারও সঙ্গে? এজন্য খোঁজ নিয়ে আগে জানলে সতর্ক থাকা যেত। ওদের ফ্যামিলিতেও যদি জানাই যে আপনাদের মেয়ে বিয়ের পর থেকে এরকম-সেরকম করছে। ওরাও জোর করে বিয়ে দিয়ে থাকলে বুঝবে, মেয়েকে বুঝাবে। কিছু একটা করবে।’

– ‘কি যে বলো ফুপু, এরকম ঝামেলা বাড়তে পারে। বাবা এগুলো নিয়ে কথা বললে একটা ব্যাপার ছিল।’

তার ফুপু তখন উশখুশ করে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকদিন পর অবস্থা আরও বেগতিক দেখে নির্জন ফুপুর কথাটি পুনরায় ভাবে৷ আসলেই যদি জোর করে বিয়ে দিয়ে থাকে? যদি এখান থেকে কারও সাথে পালিয়ে চলে যায়? তখন তো তাদের বদনাম হবে। কারও সঙ্গে কথা বলা দরকার। তখন তার মাথায় আসে তরুর কথা। কারণ তার বাবার কথামতো কেয়ার সঙ্গে অনেক বেশি সময় কাটাতো
নির্জন। তখন প্রায় কথাবার্তা থেকে বুঝেছিল তরুর সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল কেয়ার। সে হিসাবে এই মেয়েটি সবই জানবে। ওর সঙ্গে অল্প-বিস্তর কথা বলে সম্মুখ ধারণা নেয়া যেতে পারে। সে হিসাবে আগের বিরক্তি ভুলে ওকে ফেইসবুকে বের করে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দেয়। মেসেজও দেয়। তরু রিকুয়েস্ট গ্রহণ বা মেসেজ সিন কিছুই করেনি। ভাব দেখে আবার তার রাগ হয়। এখন সবকিছু তো আর তরুকে বলতে পারবে না। সে ইতস্তত করে বললো, ‘আচ্ছা ওসব বাদ দিন, আর কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি স্যরি। মন থেকে বাদ দেবেন। কিন্তু আপনাকে ওইদিন যে কারণে মেসেজ দিয়েছিলাম। আজ একই কারণে নিয়ে এসেছি।’

তরু ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘কি এমন কারণ?’

– ‘আসলে কীভাবে নিবেন ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।’

তরু এবার একটু ঘুরে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বলুন তো কি বিষয়।’

– ‘আপনার ফুপুর ব্যাপারগুলো তো দেখছেন? উনি কি আগে থেকেই এরকম? না-কি বিয়ের পর এমন হয়েছেন?’

তরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর ঝিলের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বিয়ের পর, আগে এরকম আচরণ করতো না।’

– ‘কিছু মনে না করলে আমি আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি।’

– ‘কি?’

নির্জন আরও কয়েকটি বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিয়ে ওর হাতে দিয়ে বললো, ‘তন্ময় আপনাদের কেমন পরিচিত?’

– ‘আসলে তেমন কেউ না। আমাদের স্কুলের একজন স্যারের ছেলে আর ফুপুর ক্লাসমেট।’

– ‘ও আচ্ছা।’

তরু কপালের চুল কানে গুঁজে বললো, ‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন ক্লিয়ার করে বলুন তো। মনে হচ্ছে আরও কিছু বলতে চাচ্ছেন পারছেন না।’

নির্জন বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বললো, ‘কীভাবে এগুলো বলবো বুঝতে পারছি না। আপনি আবার আম্মুকে গিয়ে বললে কিংবা বাড়িতে বললে যদি ঝামেলা হয়।’

তরু মুচকি হেসে বললো, ‘আমি কেন বলতে যাব? ইচ্ছা না হলে প্রশ্নেরই উত্তর দেবো না।’

নির্জন এবার বলেই ফেললো, ‘আপনার ফুপুর কি আগে কোনো রিলেশন ছিল? কিংবা বিয়েতে রাজি ছিলেন না৷ কিন্তু ফ্যামিলি জোর করে বিয়ে দিয়েছেন এরকম কিছু হয়েছে?’

তরু কি বলবে বুঝতে পারছিল না। ক্রমশই পরিবেশ জটিল হয়ে উঠেছে। সে ইতস্তত করে বললো, ‘উনি বিয়েতে রাজি ছিলেন।’

– ‘কোনো রিলেশন ছিল?’

তরু চুপ হয়ে গেল। সে এখন কীভাবে তারই ফুপুর বিয়ের আগের সম্পর্কের কথা স্বীকার করবে? কীভাবে বলবে এই তন্ময়ের সঙ্গেই ছিল ফুপুর প্রণয়ের সম্পর্ক?

নির্জন তাড়া দিয়ে বললো, ‘কিছু বলছেন না যে? বলুন।’

মুচকি হাসলো তরু। তারপর বললো, ‘কি যে বলেন, সম্পর্ক থাকলে কি আর বিয়েতে রাজি হতো?’

___চলবে____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here