#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
#লেখা: জবরুল ইসলাম
#পর্ব_৬
.
এবার চিনতে পারলেন ইশহাক সাহেব। নাম শুনেই চেনা উচিত ছিল। তবুও আজকাল কেমন মনভোলা হয়ে যাচ্ছেন তিনি। উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, ‘ছেলেটিকে আসতে দাও।’
খানিক পর দরজা ঠেলে তন্ময় এসে ভেতরে ঢুকে সালাম দিল, ‘আসসালামু আলাইকুম দুলাভাই।’
সালামের জবাব দিয়ে তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন হ্যান্ডশেকের জন্য। তন্ময় হাত মিলিয়ে বললো, ‘আপনি আমার নাম শুনে চিনতে পারেননি?’
– ‘না সমস্যা হয়েছি কি, আমি ভেবেছি অফিসেরই কেউ। আপনি আসবেন ভাবিনি তো।’
– ‘আমি এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম দুলাভাইকে দেখে যাই। জানেন তো আমরা গ্রামের মানুষ, পাড়া ঘুরে আপন মানুষদের দেখার একটা অভ্যাস আছে।’
প্রসন্নমুখে ইশহাক সাহেব হেসে বললেন, ‘খুব ভালো করেছেন। চা না কফির কথা বলবো?’
– ‘এগুলো লাগবে না দুলাভাই।’
ইশহাক সাহেব ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বেল টিপলেন। একটি ছেলে এসে ঢুকলো। কফি আনতে বলে দিলেন তিনি। তন্ময়ের সঙ্গে ইশহাক সাহেবের পরিচয় হয় মাস সাতেক আগে। কেয়াকে নিয়ে তিনি একটি শপিংমলে গিয়েছেন। লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। তখনই হঠাৎ একটি তরুণ দ্রুত এসে উঠে। চোখাচোখি হয় কেয়ার সঙ্গে। প্রাণচঞ্চল ছেলেটি হেসে বললো, ‘আরে কেয়া তুমি?’
কেয়া ইতস্তত করে সংক্ষিপ্তভাবে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, তুমি এখানে কোথায় যাচ্ছ?’
– ‘ছয়তলায় আমার এক বন্ধুর কাছে যাব।’
কেয়া আর কথা না বাড়িয়ে বললো, ‘ও আচ্ছা।’
– ‘তুমি কি শপিং এ এসেছো? শুনেছিলাম বিয়ে হয়েছে তোমার।’
– ‘হ্যাঁ শপিং এ এসেছি।’
তন্ময় ইশহাক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘উনি কে?’
কেয়া ইতস্তত করে বললো, ‘আমার হাসবেন্ড।’
তন্ময় হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘তাহলে তো আমার দুলাভাই বলা যায়।’
কেয়ার পরিচিত বুঝতে পেরে ইশহাক সাহেব অস্থির হয়ে গেলেন। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বললেন, ‘আপনার বাড়ি কোথায়? কেয়ার সঙ্গে পরিচয় কীভাবে?’
তন্ময় মিষ্টি হেসে বললো, ‘আমার বাড়ি খানপুর, রূপগঞ্জের কাছেই। কেয়া আর আমি একই স্কুলে পড়েছি।’
ইশহাক সাহেব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘আরে আপনি খান পুরের ছেলে। খানপুর স্কুল এন্ড কলেজে পড়েছেন?’
– ‘জি, কেয়া ওই স্কুলেই ডিগ্রিতে পরে ভর্তি হলো আমি চলে এলাম ঢাকায়।’
– ‘বাহ, তাহলে তো ঢাকায়ই আছেন। কি সর্বনাশ, কেয়া জানতে না তুমি? ক্লাসমেটদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। আচ্ছা এই নিন আমার কার্ড। আমার নাম্বারও আছে, অবশ্যই বাসায় একদিন আসবেন।’
তন্ময় কার্ড হাতে নিয়ে মজার ছলে বললো, ‘কেয়া তো বাসায় যেতে বলছে না। একেবারে চুপচাপ যে।’
ইশহাক সাহেব হেসে বললেন, ‘বিয়ের পর মেয়েরা খুবই সাবধান হয়ে যায় তন্ময় সাহেব। ভাবে হাসবেন্ড কখন কি ভেবে বসে। আমি এমন না কেয়া, পুরনো বন্ধুদের সাথে, ক্লাসমেটদের সাথে দেখা হলে কি যে ভালো লাগে আমি জানি।’
কেয়া হেসে বললো, ‘আরে না কি বলো এসব। তোমরা কথা বলছিলে তাই চুপচাপ ছিলাম।’
লিফট চলে এলো তিন তলায়। ইশহাক সাহেব বের হওয়ার আগে বললেন, ‘বেশি জরুরি কাজ না থাকলে আসুন না। কোথাও বসে কফি-টফি খাই।’
‘তেমন জরুরি কোনো কাজ নেই’ বলে তন্ময় নেমে এলো। এরপরই তাদের দীর্ঘ কথাবার্তা শুরু হলো। কেয়ার নতুন নাম্বারও নিল তন্ময়। ক’দিন পর বাসায়ও গেল। সেই থেকে ইশহাক সাহেবের সঙ্গে পরিচয়ের সুত্রপাত। এই অফিসে তন্ময় প্রথম এসেছে। সে মুচকি হেসে বললো, ‘তা দুলাভাই আরও মোটা হয়ে গেলেন মনে হচ্ছে।’
ইশহাক সাহেব হেসে বললেন, ‘তাই না-কি? আর হওয়ারও কথা। বয়সও তো কম না।’
– ‘আপনার কি এমন আর বয়স হয়েছে দুলাভাই? পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন হবে। এর বেশি তো না?’
– ‘এই বয়সই বা কম কীসের?’
– ‘কি যে বলেন দুলাভাই। শাহরুখ, সালমান, আমির খানের বয়স কত জানেন তো? সবার ষাট ছুঁইছুঁই। তবুও এত ইয়াং কীভাবে বলুন।’
– ‘ওরা তো হিরো, তাদের সঙ্গে আমাদের মিলালে হবে?’
‘অবশ্যই হবে’ তারপর খানিক ঝুঁকে নিচু গলায় বললো, ‘আপনাকে তো বুঝতে হবে, নিজেকে এখনই বয়স্ক ভাবলে হবে? বাসায় সুন্দরী তরুণী স্ত্রী।’
ইশহাক সাহেব হেসে রসিকতার সুরে বললেন, ‘তা ইয়াং হওয়ার জন্য কি করতে পারি?’
– ‘জিম করতে পারেন।’
– ‘তার সময় কোথায় বলুন। আর এই বয়সে জিম সেন্টারে ছোটাছুটি কি ভালো লাগে?’
– ‘তাহলে বাসায় ব্যবস্থা করে নিন৷ প্রতিদিন অফিস থেকে গিয়ে ব্যায়াম করলেন। দৌড়ের মেশিন সহ সবকিছু বাসায় নিয়ে নিলেন। তাছাড়া ভাগনা নির্জনও বাসায় জিম করতে পারবে।’
– ‘বুদ্ধিটা মন্দ দেননি। পেট আর ওজন একটু কমলে খারাপ হতো না। কিন্তু কি করি বলুন তো, এগুলো তো বুঝি না। ছেলের সাথে কি এখন এসব করবো না-কি? আপনি কি কোথাও জিম করেন?’
তন্ময় হেসে সরল গলায় বললো, ‘তা কি আর সম্ভব বলুন। মেসে থাকি, জিমে যাওয়া তো বিলাসিতা।’
– ‘তন্ময় সাহেব, তাহলে তো হয়েই গেল। আপনি আমার সঙ্গেই প্রতিদিন জিম করবেন। এগুলো কখন কেনা যায় বলুন।’
– ‘আজ সন্ধ্যায় আপনার বাসায় যাই, নির্জনও আছে। তার সঙ্গে কথা বলে করা যাবে।’
– ‘হ্যাঁ তা ঠিক বলেছেন। তাহলে সন্ধ্যায় বাসায় আসবেন।’
ছেলেটিও কফি নিয়ে এলো। তাদের কথাবার্তা চলতে লাগলো বিরামহীন।
*
নির্জন ভার্সিটি থেকে সোজা গানের রিহার্সেলে এলো। সবাই গোল হয়ে বসে আছে। সনিয়া তাকে দেখে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে উঠে এসে বললো, ‘কিরে তোর ঠোঁটে এসব কি লেগে আছে?’
নির্জন অবাক হয়ে বললো, ‘কি?’
সনিয়া নীরবের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বললো, ‘ওর ঠোঁটে কিছু একটা লেগে আছে তাই নারে?’
– ‘হ্যাঁ, কিরে নির্জন এগুলো কি ঠোঁটে?’
সে হাত দিয়ে মুছতে যাবে সনিয়া হাত ধরে বললো, ‘আরে লেপটে যাবে। আমি ঠোঁট দিয়ে তোর ঠোঁট মুছে দেই?’
– ‘কাছ থেকে সর, না হলে থাপ্পড় দেবো। তুই একটা ব্যাটা।’
সনিয়া আহত গলায় বললো, ‘আমি ব্যাটা মানে?’
– ‘ছেলেদের সঙ্গে বসে সিগারেট খাবি, শার্ট প্যান্ট পরে চুল খাটো করে হাঁটবি। আর ব্যাটা বললেই জাত যায়? সর কাছ থেকে।’
‘আচ্ছা আঙুল দিয়ে মুছে দিচ্ছি’ বলেই ঠোঁট ঘষে দিল আঙুল দিয়ে সনিয়া। তারপর অদ্ভুত এক চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে নিজের আঙুল মুখে পুরে নিল। নির্জন রেগে গিয়ে বললো, ‘আমার ঠোঁটে কিছু লেগে থাকলে তুই সেটা মুছে মুখে আঙুল দিলি কীভাবে?’
নীরব সহ সবাই হেসে উঠলো। ঘটনাটা বুঝতে পেরে প্রচণ্ড রেগে গেল নির্জন। বের হয়ে চলে এলো সে। পিছু থেকে সবাই ডাকলেও আর কাজ হলো না। এদিক-ওদিক ঘুরে বাসায় ফিরে এলো সন্ধ্যায়। রোজকার মতো উঁকি দিল কেয়ার রুমে৷ তার বাবার খুব করে বলা আছে, যখনই সময় পাও মায়ের সঙ্গে গিয়ে বসবে, গল্প করবে। সেও চায় তার বাবা সুখে থাকুক। জীবনটা একাই কাটিয়ে দিল মানুষটা। তার মা মারা গিয়েছিলেন রোড এক্সিডেন্টে। তখন সে খুবই ছোট। মা-বাবার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সে রাস্তার মাঝখানে চলে গেছে। আচমকা তার মায়ের খেয়াল হয়, এবং দেখতে পান একটা গাড়ি তার দিকে আসছে৷ তিনি দৌড়ে গেলেন তাকে ধরতে। অদ্ভুত ব্যাপার, তার দিকে ছুটে আসা গাড়ি থেমে গেল। কিন্তু আরেকটি ট্রাক এসে পিষে ফেলে চলে গেল তার মমতাময়ী মা’কে। সেই থেকে তার বাবা আর বিয়ে করলেন না। প্রচণ্ড ভালোবাসা দিয়ে তাকে বড়ো করলেন, মানুষ করলেন। শেষ বয়সে এসে প্রেমে পড়ে গেলেন। বিয়ে করতে চাইলেন। নির্জন বাবার ইচ্ছাকে স্বাগত জানালো। শেষ বয়সটা যদি মানুষটির অর্থবহ হয়? আনন্দে কাটে, তাতে সমস্যা কি? বিয়েই তো করবেন, আর তো কিছু না। কিন্তু এখন তার বাবা কতটুকু সুখে আছেন তা নিয়ে নির্জন সন্দিহান। দরজায় নক দিল। খুলে দিল তরু। ভেতরে গিয়ে দেখে বিছানায় লুডো মেলা।
– ‘কি করছো আম্মু?’
– ‘এইতো লুডো খেলি তরুর সঙ্গে। তুমিও আসো।’
লুডো এটা তার বাবা একদিন এনে দিয়ে হুস্না আর তাকে বললেন, ‘যখনই ফ্রি থাকো কেয়ার সঙ্গে খেলতে যেও তোমরা।’
সে মাঝেমধ্যে অনাগ্রহ নিয়ে খেলেছেও।
– ‘কি হলো আসো।’
তাড়া দিল কেয়া। নির্জন গিয়ে বিছানায় উঠে বসে বললো, ‘তিনজনে কি খেলা হয়?’
– ‘হবে না কেন, হয়, তবুও তুমি আর তরু খেলো আমি দেখি।’
– ‘না না আম্মু তুমিই খেলো তাহলে।’
‘হারার ভয়?’ তরুর শান্ত কণ্ঠ।
কেয়া হেসে ফেললো শুনে। নির্জন ভালোভাবে বসে হলুদ গুটিগুলো নিয়ে বললো, ‘আসুন, দেখি কে হারে।’
তরুর ঘরে সবুজ গুটি। প্রথমেই দান চালায় সে। এবং ছক্কা উঠে। নির্জন ভ্রু কুঁচকে ওর দান চালানো দেখছে। পুনরায় ছক্কা উঠে গেল। সে অবাক হয়ে তরুর হাত ধরে থামিয়ে কেয়াকে বললো, ‘আম্মু এটা কেমন খেলা? উনি গোটা না দিয়ে দান চালাচ্ছে কেন? আগেই ছক্কা উপরদিকে রেখে ডিব্বায় নিচ্ছে। তারপর গোটা না দিয়ে আলগোছে ছেড়ে দিয়ে ছক্কা তুলছে।’
কেয়া কোনো কথা না বলে খিলখিল করে হেসে উঠলো। তরু অবাক হয়ে বললো, ‘দুইটা ছক্কা উঠতেই চোখ উলটে গেছে আপনার? ব্যাটা মানুষরাই এমন। সবকিছুতেই নেগেটিভ চিন্তা করবে। আপনি যেরকম বলছেন দেখি ছক্কা তুলুন তো, পারবেন? গোটা না দিয়েই তুলুন দেখি।’
নির্জন টান দিয়ে ওর হাত থেকে এনে অবিকল ওর মতো দান চালায়। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত উঠে তিন। তরু হাসতে হাসতে বললো, ‘কি? এখন পারলেন না কেন?’
– ‘পারি নাই কারণ আমি চু*রি করে অভ্যস্ত নই। আপনি প্রফেশনাল চু*ন্নি। এভাবে না গোটা দিয়ে খেলে?’
তাদের এই হইচইয়ের মধ্যে কেউ
দরজায় নক দিল।
___চলবে……