#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
#লেখা: জবরুল ইসলাম
#পর্ব_৫
.
বিব্রত চেহারা প্রকাশ পাওয়ার আগেই নিজেকে সামলে নিতে চাইলেন ইশহাক সাহেব। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘অবশ্য তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভালো আছো। এত রূপবতী একটা মেয়েকে ‘কেমন আছো’ জিজ্ঞেস করার মানেই হয় না।’
বিদ্রুপের গলায় কেয়া বললো,
– ‘ও রূপবতী মেয়েরা সব সময় ভালো থাকে? ওদের কোনো অসুখ-বিসুখ হয় না? ডাক্তার, হসপিটালে জীবনে তাদের পা পড়ে না? কেন ওভার স্মার্ট সাজতে চাও? যা মানায় না তা করতে যাও কেন?’
ইশহাক সাহেব প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইলেন। কেয়ার সামনে মাঝে মাঝে ভুলভাল বকতে শুরু করেন। বিশেষ করে যখন ওকে কোনো কারণে একটু বেশিই সুন্দর লাগে। আজও লাগছে, কি অদ্ভুত স্নিগ্ধ, মায়াময় চেহারা। ওর সামনে নিজেকে বড়ো তুচ্ছ লাগে। চোখ ফেরালেন, বিছানার উপর দেখতে পেলেন পলিথিনের ব্যাগ। এগিয়ে গিয়ে খুলে দেখে কেয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা আমি গাড়িতে ফেলে চলে এসেছিলাম, কে আনলো?’
– ‘ড্রাইভার হুস্নাকে দিয়ে পাঠিয়েছে।’
‘ও আচ্ছা’ বলে ইশহাক সাহেব আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। মাঝে মাঝে কেয়ার মন ভালো থাকলে টাই খুলে দেয়। খুবই ভালো লাগে তখন। এখন এসে খুলে দিলে ভালো হতো, সোজাসুজি ওকে কাছ থেকে দেখতেন৷ বেশি সুন্দর লাগলে বারবার তাকাতে ইচ্ছা করে। কিন্তু রেগে থাকলে তাকাতেও হয় সাবধানে। এখন তিনি টাই খোলার ভঙ্গি করে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ওকে দেখছেন। বিছানায় বসে মোবাইল টিপছে কেয়া। তিনি তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ কেয়াও মাথা তুলে ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘কি হয়েছে? টাই খুলতে এতক্ষণ লাগে?’
– ‘একটু দেখবে তুমি? খুলছে না কেন যেন।’
‘খুলছে না না-কি বুড়ো বয়সের ভীমরতি ধরেছে, চুকচুকানি বেড়েছে’ বলে কেয়া বিছানায় মোবাইল রেখে উঠে এলো। ইশহাক সাহেবের ওর কথায় হাসলেন। একটুও রাগ হলো না। কেয়ার এই মেজাজ, কাটা কাটা কথাও যেন রূপেরই অংশ। এই যে এখন উঠে এসেছে টাই খুলে দিতে। এটাই হলো আসল কেয়া। ওর ভেতরে মমতা আছে৷ অবশ্যই আছে। সেটা টের পান ইশহাক সাহেব। কেয়া কাছে এসে টাই এ হাত দিল। অদ্ভুত এক সুবাস পেলেন তিনি। এটা ওর কাছ থেকে সব সময় পান। ধীরে ধীরে হাত তুলে ওর কপালে আসা চুলগুলো সরালেন। শিরশির করে উঠলো বুক। একেবারে তরুণ বয়সের সেই অনুভূতি। কেয়া হাত সরিয়ে দিয়ে বললো, ‘কি হয়েছে?’
– ‘তুমি এত সুন্দর কেন? আরও দশ-পনেরো বছর আগেও তো আমাদের দেখা হতে পারতো।’
– ‘স্বীকার করছো তাহলে এখন তোমার পড়ন্তবেলা?’
ইশহাক সাহেব আর কিছু বললেন না। কেয়াই পুনরায় ফিক করে হেসে বললো,
‘তাছাড়া দশ-পনেরো বছর আগে আমি তো ফ্রক পরে স্কুলে যেতাম।’
মিষ্টি এই হাসিতে বিমোহিত হয়ে ওকে বুকে টেনে নিলেন ইশহাক সাহেব। কেয়ার মেজাজটা খারাপ হতে যাচ্ছিল। এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিবে নিজেকে। তখনই তরুর কথাটা মনে পড়লো, ‘আত্মীয়-স্বজন সবাই তো এখন তোমার গুণকীর্তনে অস্থির৷ এত ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে। ফুপারও অনেক নামডাক চারদিকে। সবার কথা হলো কেয়ার মতো হও…।’
*
সকাল দশটার আগে নির্জনের সঙ্গে তরু বের হলো। তাকে কোচিংএ ভর্তি করাতে নিয়ে যাবে। আকাশে ঝকঝকে রোদ। দু’জন গেইটের বাইরে এসে দাঁড়ায়। নির্জন একটা রিকশা দেখে হাত তুলে দাঁড় করিয়ে তরুকে বললো, ‘দুইজন কি একই রিকশায় যাব?’
তরু রিকশায় উঠে গিয়ে বললো, ‘তাহলে কি আমি একা রিকশায় যাব আর আপনি পিছু পিছু দৌড়ে আসবেন?’
রিকশাচালক হেসে ফেললো। নির্জন তরুর দিকে দাঁত কটমট করে তাকিয়ে রইল।
‘আসুন, রোদে দাঁড়িয়ে থাকবেন না-কি?’
তাড়া দিল তরু। নির্জন কোনো জবাব না দিয়ে উঠে বসলো। রিকশা চলছে। তরু খানিক পর রিকশার হুড টেনে তুলতে যাবে তখনই সেটায় উলটো হাতে ঘুসি মেরে ফেলে দিল নির্জন। রিকশাচালক পিছু ফিরে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে না পেরে আবার প্যাডেল চাপতে শুরু করে। তরু ফিসফিস করে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললো, ‘এটা কি হলো? হুড তুললে সমস্যা বলতেন আমাকে। এভাবে ধাক্কা মারলেন কেন? ব্যথা পেয়েছেন?’
– ‘আপনি একটু কথা কম বললে খুশি হই।’
– ‘আমি কথা বলতে পারলে খুশি থাকি। তাছাড়া অন্যদের সুখে রাখার দায়িত্বও আমি নিইনি।’
নির্জন প্রচণ্ড রাগান্বিত চেহারায় তাকিয়ে নিচুস্বরে বললো, ‘তরু আমি কিন্তু এখনই রিকশা থেকে নেমে চলে যাব।’
‘মিস তরু’ হবে বলে মিটমাটে হেসে তাকিয়ে রইল তরু। যার অর্থ আমি আপনার শিশুসুলভ রাগ দেখে খুবই আনন্দ পাচ্ছি।
– ‘হাসছেন কেন? আমার সঙ্গে কি আপনার ইয়ার্কির সম্পর্ক?’
– ‘ঝগড়ারও না। রাগারাগিরও না।’
– ‘আপনি বাড়াবাড়ি করছেন।’
তরু চেয়ে রইল। একমাত্র সে বলে এত সাহস নিয়ে এভাবে এই ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পারছে। না হলে এই রাগান্বিত লুকের সামনে যেকোনো মেয়ে ভয়ে ঠান্ডা হয়ে যেত। এমন লম্বা, সুদর্শন ছেলের সামনে যেকোনো মেয়ে কথা বলতে ইতস্তত করতো। কিন্তু সে করবে না, উলটো ওকে নাস্তানাবুদ করবে। ‘চুম্মাচাটির গল্প’ লেখিকাও যে কি জিনিস হাড়েহাড়ে টের পাওয়াবে।
‘রিকশা থামান তো মামা’
নির্জনের ঠান্ডা অথচ ভয়ানক গলা শুনে
তরু ভাবনা থেকে বের হলো। রিকশা চালক পিছু ফিরে বললো, ‘রিকশা থামাইব কইলেন না-কি?’
নির্জন কিছু বলার আগেই তরু তাকে থামিয়ে বললো, ‘আপনি যান মামা।’
তারপর নির্জনের দিকে তাকিয়ে আস্তে-আস্তে বললো, ‘আপনি রাস্তায় এত সিনক্রিয়েট করছেন কেন?’
– ‘আমি করছি না, আপনি করছেন।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমারই সকল দোষ তো? স্যরি। এখন আর কি করার আছে আমার। আপনি যেতে চাইল, চলে যেতে পারেন। আমি পারলে একাই ভর্তি হব।’
নির্জন উশখুশ করতে শুরু করলো। খানিক সময় পর বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমিও বোধহয় একটু বেশি রেগে গিয়েছিলাম..।’
থামিয়ে দিল তরু, ‘থাক স্যরি বলবেন না প্লিজ, আপনি তবুও বয়সে বড়ো।’
নির্জন কিছু বললো না। তরু খানিক পর পুনরায় রিকশার হুডে টান দিল। নির্জন ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘আবার এটা তুলছেন কেন?’
– ‘আপনার জন্যই তুলছি। কেমন রোদ দেখছেন? সোজা এসে মাথায় পড়ছে। আমার মাথায় ওপর ওড়না আছে। আপনি তো ওড়না আনেননি…।’
– ‘মানে ওড়না আনিনি মানে?’
– ‘স্যরি, বলতে চাইছি আমার মাথায় ওড়না আছে আপনার তো কিছু নেই। মানে ক্যাপও নেই।’
– ‘মিস তরু, আপনি কি এখনও ইয়ার্কি করছেন? আমি কনফিউজড।’
‘আমার চেহারা দেখে কি মনে হচ্ছে ইয়ার্কি করছি বলুন? সত্যিই ভুলে মুখে ওড়নার কথা চলে এসেছে।’ কথাটি বলে তরু পুনরায় হুড টেনে বললো, ‘আসছে না তো হেল্প করুন।’
বিভ্রান্ত চোখে নির্জন তাকিয়ে থেকে হুড টেনে তুলে বললো, ‘আসলে আমার মাথা লেগে যায় বলে হুড তুলি না।’
– ‘নিজেকে এত লম্বা ভাববেন না৷ একা রিকশায় গেলে আপনি মাঝখানে বসতেন। তখন হুড মাথায় লাগতো না।’
নির্জন পুনরায় রেগে গিয়ে কিছু বলতে গিয়েও চুপ থেকে সামনের দিকে তাকায়। রিকশা এসে থামে কোচিং সেন্টারের সামনে। নির্জন নেমে ভাড়া দিতে যাবে তরু সিট থেকে উঠে বললো, ‘আমাকে আগে একটু ধরেন। রিকশাটা কেমন যেন মনে হচ্ছে, নামতে গিয়ে পড়ে যাব।’
নির্জন আশেপাশে তাকিয়ে অনেক ছেলে-মেয়ে দেখে চুপচাপ হাত বাড়িয়ে ওকে নামিয়ে ভাড়া দিতে গেল। তরু বাঁধা দিল। কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না নির্জনের মাঝে।
– ‘জোর করে ভাড়া দিলেন, টাকা দেখাচ্ছেন না-কি?’
নির্জন একটু মুখ এগিয়ে এনে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, ‘আপনি বোকা বলেই এখানে চেঁচামেচি করছেন। আমি নেহাতই ভালো বলে হাত ধরে নামিয়েছি। ভর্তি হবার পর আশেপাশের এই ছেলে-মেয়েরা আপনার সহপাঠীই হবে। হাত ধরে নামানোর কথা বলার পর যদি না নামাতাম। ওরা আপনাকে নিয়ে হাসতো। নিজেকে অতি চালাক ভাবেন, অথচ কত বড়ো বোকামিটাই না করতে গিয়েছিলেন।’
তরু ‘হা’ করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নির্জন তাকে ফেলে হেঁটে গেইটের কাছে চলে গেল।
*
বেলা সাড়ে এগারোটা৷ কেয়া গোসল করে বের হয়ে দেখে তন্ময়ের ধারাবাহিক অনেকগুলো মেসেজ।
– ‘কেয়াজান কি করছো? গতকাল যাওয়ার পর থেকে কোনো খবর নেই যে? এদিকে আমাকে নিষেধ করে রেখেছো রাতে মেসেজ না দিতে, যখন তখন কল না দিতে। তাহলে নিজেও তো একটু খোঁজ নেবে, তাই না?’
কেয়া মেসেজগুলো দেখে বিছানায় বসে। কি বলবে সে ভেবে পাচ্ছে না৷ বরাবরের মতোই দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। খানিক সময় ভেবে কাঁপা কাঁপা আঙুলে টাইপ করলো, ‘তন্ময়, জান আমার। প্লিজ একটু বুঝার চেষ্টা করো। আমাদের আসলে এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি? পাপ হচ্ছে৷ আমি মাঝে মাঝে খুবই গিল্টি ফিল করি।’
মেসেজ সিন করে সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই দেয় তন্ময়, ‘তুমি না বললে এই বিয়েতে তোমার সম্মতি ছিল না৷ তাহলে গিলটি ফিল হবে কেন? তাছাড়া আমি তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি কেয়া। ভবিষ্যতে কি করবো সেটা সময়ই বলে দেবে। তুমি একবার ভাবো, পুরো জীবন-যৌবন কি তুমি ইশহাক সাহেবের সাথে কাটিয়ে দেবে? এ হয়?’
কেয়া কোনো রিপ্লাই না দিয়ে বিছানায় মোবাইল রেখে কপালে হাত দিয়ে বসে রইল। তন্ময় কল দিতে থাকে। কেয়া রিসিভ করে না।
দীর্ঘ সময় পর মোবাইল হাতে নিয়ে মেসেজ দেয়, ‘তন্ময় প্লিজ, আমাকে কয়েকদিন একা থাকতে দাও, আমি সত্যিই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। প্লিজ কিছু মনে করো না।’
সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এলো, ‘কল রিসিভ করো কেয়া।’
– ‘না প্লিজ, তোমার সঙ্গে কথা বললেই আমি আরও দূর্বল হয়ে যাই।’
– ‘তুমি কি আমার থেকে দূরে সরে যেতে চাচ্ছ?’
– ‘আমি জানি না তন্ময়। এজন্যই বলছি কয়েকদিন আমাকে একা থাকতে দাও।’
– ‘তুমি একা থাকবে কীভাবে? বুইড়া তো তোমার পাশে থাকে।’
কেয়া কোনো রিপ্লাই দেয় না৷ তন্ময় পুনরায় মেসেজ দিল, ‘আচ্ছা একা থাকবে ভালো কথা। তোমাদের ছাদের উপরে আসো বিকেলে, একটু দেখবো শুধু দূর থেকে। খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।’
– ‘তন্ময়, আমরা গতকালই মাত্র দেখা করেছি। এত ঘন ঘন দেখা করা সম্ভব না জান। প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো।’
তন্ময়কে আবার টাইপিং এ দেখায়। কেয়া ওয়াইফাই অফ করে দিল। তন্ময় এবার ডায়রেক্ট কল দিতে শুরু করে। কেয়া ফোন অফ করে কপালে হাত দিয়ে বিছানায় বসে রইল।
বিকেল চারটা। ইশহাক সাহেব একটা ফাইল দেখছেন। টেলিফোনটা বেজে উঠলো। তিনি রিসিভ করলেন। নিচ থেকে কল এসেছে। ছেলেটি বললো, ‘স্যার তন্ময় নামে একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’
– ‘তন্ময় কে?’
– ‘ম্যাডামের না-কি বন্ধু।’
____চলবে…..