#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
#জবরুল_ইসলাম_হাবিব
#পর্ব_১৩
.
তরুর ঘুম ভাঙলো ঘণ্টা দেড়েক পর। চোখ মেলে বুঝতে পারছে না কোথায় শুয়ে আছে সে৷ সবকিছু কেমন অন্ধকার লাগছে। কোনো গাড়ি যেন খানিকটা দুলছে আর তাকে নিয়ে পেছনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তরু মাথা নাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। বস্তা জাতীয় কিছু একটা যেন তার মুখটা চেপে ধরে রেখেছে। ধীরে ধীরে সবকিছু মনে পড়ে গেল তরুর। বাসে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছিল, এক্সিডেন্ট হয়, বমি করে সে, নির্জন তাকে নিয়ে কারে উঠেছে। মুচকি হাসলো এবার, অনেক বছর পর এই সমস্যাটা হলো। কোথাও বেড়াতে গেলে ঘুম থেকে হঠাৎ উঠে সে রুম দেখে প্রথমে অবাক হয়ে যেত, এখানে কীভাবে এসেছে বুঝতে পারতো না। একটু সময় পর ঠিক হতো। আজও এমন হলো। কিন্তু তার মুখ এভাবে কি দিয়ে ঢাকা? কোমরের দিকে ভারী কিছু আছে মনে হচ্ছে। আস্তে-আস্তে পাশ ফিরলো তরু। সঙ্গে সঙ্গে কোলে কিছু একটা পড়লো। কি সেটা বুঝতে দেরি হলো না, উষ্ণ একটা শ্বাস পড়ছে কোলে। তারমানে কি? সে নির্জনের কোলে ঘুমিয়েছে আর সেও অজান্তেই ঘুমিয়ে তার কোমরকে বালিশ বানিয়েছে? পুনরায় মুচকি হাসলো তরু। ডান হাতটা ধীরে ধীরে মুখে আনলো। মুখ ঢেকে রেখেছে কিছু একটা। সে মাথা ফাঁক করে আস্তে-আস্তে টেনে সরিয়ে নিল। নির্জনের ব্লেজার। আন্দাজে সেটা রাখলো ওর পিঠে। গাড়ির মৃদু দুলুনিতে এবার নির্জনের পেট বারবার তরুর চোখে, মুখে ঠেসে ধরছে। অদ্ভুত এক অচেনা অনুভূতি। তরুর জীবনে এরকম কখনও হয়নি। নিজে নিজেই লজ্জায় ক্ষীণ সময় শক্ত করে চোখবুজে রইল। কি করবে এখন? মানুষটা ঘুমিয়ে আছে যে। আবার এখনই না তুলে দিলে তরু মরে যাবে একদম। এই অসহ্য অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেয়া পাপ। গাড়ির দুলুনির সঙ্গে কোলে নির্জনের মাথাও নড়ছে, ভুস ভুস করে ছাড়ছে উষ্ণ শ্বাস। তরু পা ভাজ করে এনে শুকনো ঢোক গিলে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। তারপর আস্তে-আস্তে নির্জনের পেটে ধাক্কা দিয়ে ডাকলো, ‘একটু উঠুন প্লিজ, ঠিক হয়ে ঘুমান।’
নির্জনের শরীর খানিকটা নড়লেও আবার চুপ করে ঘুমিয়ে রইল সে। তরু এবার একটু জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকলো, ‘নির্জন ভাই উঠুন, উঠুন তো।’
নির্জনের ঘুম ভাঙলো তখনই। নিজেকে তরুর কোলে দেখে সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসে চোখ কচলাতে কচলাতে বললো, ‘স্যরি, আমি বুঝতে পারিনি কীভাবে ঘুমিয়েছি।’
তরু কিছু না বলে সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে বুকে হাত বেঁধে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। কেমন একটা অস্থিরতা নিজের পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। নির্জন মোবাইল বের করে দেখে সন্ধ্যা সাতটা হয়ে গেছে। তরুকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বললো, ‘ঘুম কেমন হয়েছে ম্যাডাম।’
তরু না তাকিয়েই বললো, ‘ভালো।’
– ‘শুধু ভালো?’
– ‘হুম, আপনার হয়েছে?’
– ‘আমি বোধহয় বেশিক্ষণ আগে ঘুমাইনি।’
– ‘ও, তাহলে আবার ঘুমান।’
– ‘আর ঘুম আসবে না। এখন চা বা কফি কিছু খেতে পারলে দারুণ হতো। আচ্ছা এখন শরীর ঠিক লাগছে তো তোমার?’
– ‘হ্যাঁ।’
নির্জন খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তরুকে চুপ থাকতে দেখে ভালো লাগছে না। তাও অন্যদিকে তাকিয়ে বসে আছে। মেয়েটির মধ্যে কিছু একটা আছে। যখন কথা বলে দেখতে ভালো লাগে, হাসলে ভালো লাগে। চুপ করে থাকলে মনে হয় আকাশে মেঘ করেছে। মনে হয় বিরক্তিকর অবসর সময় কাটতেই চাইছে না।
সামনে একটা টং দোকান ফেলে যাচ্ছে দেখে নির্জন ড্রাইভারকে বললো, ‘একটু সাইটে রাখুন ভাই, ওইখানে চা আছে মনে হচ্ছে।’
ড্রাইভার গাড়ি থামায়। নির্জন তরুকে ইতস্তত করে বললো, ‘চলো চা খেয়ে আসি, ভালো লাগবে।’
তরু তবুও ওর দিকে তাকালো না। কিন্তু গলাটা ভীষণ কোমল, আন্তরিক লাগলো তরুর কাছে। সে কেবল সম্মতি জানিয়ে বললো, ‘হুম চলুন।’
নির্জন গাড়ি থেকে নামতে নামতে ড্রাইভারকে বললো, ‘আপনিও আসুন ভাই চা-টা খেয়ে আসি।’
– ‘আপনারা যান ভাই, আমার একটা জরুরি কল আছে৷’
‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে নির্জন সরে এসে দাঁড়ায়। নেমে আসে তরু। নির্জনের গায়ে এখন ব্লেজার নেই, শুধু গেঞ্জি, খুব লম্বা লাগছে দেখতে। তরু কাছে যাওয়ার পর নির্জন ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘এত নীরব কেন?’
– ‘এমনিই।’
– ‘ভয় লাগছে এখনও?’
– ‘না।’
– ‘মাথা ব্যথা আছে এখনও?’
– ‘না।’
– ‘কপালে হাত দিয়ে দেখি জ্বর-টর এলো কি-না। তোমাকে এত নীরব দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে।’
তরু কিছু বললো না। নির্জন সত্যি সত্যিই কপালে হাত দিল। রাস্তায় আবছা আলো। তরু চোখবুজে নিল স্পর্শে। তারপর নির্জনের হাত ধরে আস্তে করে সরিয়ে বললো, ‘চলুন চা দেখুন আছে কি-না।’
– ‘হ্যাঁ চলো।’
দু’জন রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছে। গাড়ি চলতি থাকায় দোকানটা ফেলে কিছুটা দূরেই চলে গিয়েছিল। সন্ধ্যার ফুরফুরে মিহি বাতাস এসে গায়ে লাগছে৷ নির্জন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে তরুকে দেখছে। অস্বাভাবিক ঘুমের কারণে মুখ ওর খানিকটা ফোলা ফোলা লাগছে। দুই গালের পাশ দিয়ে কয়েক গোছা চুল বেয়ে পড়েছে৷ বারবার কেন যেন ইচ্ছা করছে হাত দিয়ে ওর চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। বুকের ভেতর কিছু একটা ঘটতে চলেছে তার। এরকম লাগছে কেন তা যে বুঝতে পারছে না তা নয়। তবে এরকম হওয়াটা তার স্বভাববিরুদ্ধ৷ প্রেম-ভালোবাসায় কখনওই সে ছিল না। বান্ধবীদের কেমন ছেলে বন্ধুদের মতোই মনে হতো। তরু তার পাশাপাশি হাঁটছে৷ লম্বায় তার কাঁধ অবধি হবে। সেদিন সিঁড়িতে এটাই দেখতে চেয়েছিল মেয়েটি। এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। মুচকি হাসলো সে। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বাহ, তুমি লম্বায় আমার কাঁধ অবধি চলে আসো।’
তরু ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘কেন, আমাকে দেখতে আরও বেশি খাটো মনে হয় না-কি?’
কি জবাব দেবে সে বুঝতে পারলো না। ইতস্তত করে বললো, ‘সেরকম কিছু আসলে বুঝাতে চাইনি। হঠাৎ এখন খেয়াল হলো তাই বললাম।’
খানিকক্ষণ চুপ থেকে তরু বললো, ‘আপনার নিশ্চয় অনেক লম্বা মেয়ে পছন্দ তাই না?’
– ‘এটা কেন মনে হলো?’
– ‘এমনিই।’
– ‘খুব লম্বা মেয়ে দিয়ে কি আমি বাসার ফ্যান পরিষ্কার করাবো?’
তরু ফিক করে হেসে বললো, ‘সেটা না, তবুও তো মানুষ চায়।’
– ‘লম্বা মেয়ে চাই বলে ছেলেরা গোঁ ধরে বসে থাকে বলে আমার মনে হয় না। হ্যাঁ, সুন্দর চাইতে পারে। সেটা সবকিছু মিলিয়েই হয়। খাটো মানেই অসুন্দর কিংবা লম্বা মানেই সুন্দর তা কিন্তু না।’
– ‘আপনি বড্ড প্যাঁচিয়ে কথা বলেন।’
টং দোকানের কাছে চলে এসেছে। নির্জন উত্তর দিল না এখন। পরে কথাগুলো সে নিজেই চুইংগামের মতো টেনে লম্বা করবে। কেন যেন প্রচণ্ড ভালো লাগছে ওর সঙ্গে অকারণ কথা বলতে। দোকানের সামনে এসে দেখলো ফ্ল্যাক্স আছে। এটাই দেখেছিল গাড়ি থেকে।
– ‘মামা চা আছে?’
– ‘হ ভাইজান, লিকার চা।’
– ‘দিন দুই কাপ।’
দোকানি চা দিল দু’জনকে। নির্জন চা দু’টা হাতে নিয়ে বললো, ‘ওদিকে আছি আমরা।’
তরু ভ্রু- কুঁচকে বললো, ‘বেঞ্চেই বসি।’
– ‘আরে না, গাড়িতেই তো সারাক্ষণ বসা ছিলাম।’
তরু উঠে এলো। টং দোকান থেকে একটু দূরে আসার পর নির্জন ওর হাতে কাপ দিয়ে বললো, ‘নিন ম্যাডাম।’
– ‘এটা কি হলো, দেখুন দোকানদার মিটমিট করে হাসছে।’
– ‘হাসুক তাতে কি আসে যায়। আমার নাম নির্জন। আমি নির্জনতাই পছন্দ করি।’
– ‘তাহলে আমিও চলে যাই। একা থাকুন।’
– ‘আরে না দাঁড়াও, একটু কাব্য করতে চেয়েছি শুধু।’
– ‘ও আচ্ছা তাই।’
নির্জন চায়ে চুমুক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আগে তুমি কিছু একটা বলেছিলে। আমি সোজা উত্তর দেই না।’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘কি সোজা জানতে চাও শুনি।’
– ‘বলেছিলাম লম্বা মেয়ে পছন্দ করেন কি-না।’
– ‘যদি হ্যাঁ বলি তার মানে কি খাটো মেয়ে অপছন্দ করি ধরবে তুমি?’
– ‘আবার প্যাঁচানো উত্তর।’
– ‘প্যাঁচানো না, সোজা কথাই বলেছি। লম্বা মেয়ে আমার পছন্দ ঠিক আছে। এদিকে দেখো, তুমি খুব একটা লম্বা না, অথচ দেখতে কি ভীষণ মিষ্টি, মায়াবী চেহারা। তোমার মতো চোখ, হাসি, চুল। তা তো অনেক লম্বা মেয়েরও নেই।’
তরু ভেতরে ভেতরে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। নাক উঁচু লোকটা তার প্রশংসা করছে? বাবা বিশ্বাস করা যায় না৷ তবুও সেটা প্রকাশ না করে বললো, ‘আমার চোখ, হাসি, চুল বুঝি সুন্দর?’
– ‘শুধু তা নয়, তোমার চঞ্চলতাও সুন্দর। তোমার নীরবতা শুধু খুবই বিশ্রী রকম বাজে।’
তরু চায়ের কাপে ঠোঁট নিয়েছিল চুমুক দিতে। থেমে গেল সে। তাকিয়ে রইল নির্জনের চোখের দিকে। এই নির্জন একেবারেই অন্যকেউ। যার সম্পর্ক তার বাইরের কাঠিন্যের সঙ্গে নেই। তরুর বুকটা কেমন করে যেন উঠলো।
____চলবে…..