পুনম,পর্বঃ৩০
আয়েশা_সিদ্দিকা
রাজু ডালে ফোঁড়ন দিচ্ছে। রান্না করা যে এতটা জটিল বিষয় তা রাজুর জানা ছিল না।রান্না বান্নাকে আগে ছোট চোখে দেখার জন্য বার বার নিজের কান ধরে বলতে মন চাইছে,” হে আগুনে উত্তপ্ত রান্না ভাই, পূর্বে তোমাকে নিয়া উপহাস করিয়া অনেক বড় মার্জনা করে ফেলিয়াছি। আমাকে ক্ষমা করো!”
একহাতে ফোঁড়ন নাড়ছে কড়াইতে আর এক হাতে নাকের উপর বরফ চেপে ধরেছে রাজু।নাকের উপর মোটামুটি বড় সড়ো ঠোস পরেছে তেলের ছিটায়।অসহ্য!
তানভীরকে কিচেনে ঢুকতে দেখে রাজু প্রশ্ন করে,
—কে এসেছে স্যার?বাড়ি ওয়ালার বেয়াদব কাজের মেয়েটা এসেছে নাকি?ও আসলে এক থাপ্পড় দিয়ে বিদায় করবেন।
তানভীর বিরক্ত! চরম বিরক্ত! রাজু যে এতটা ঝগড়াটে তা ওর জানা ছিল না।
—চোখের সামনে থেকে এখনি আউট হবে তুমি রাজু।যাও নাকের উপর মলম দেও।তোমাকে দেখতে হাস্যকর লাগছে!
রাজু দুঃখ পেল স্যারের কথায়।তখনই রাজু খেয়াল করলো কিচেনের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তারুণ স্যার মিটমিটিয়ে হাসছে।দুই ভাইয়ের হাসিতে রাজুর দুঃখ আকাশ ছুলো।কাঁদো কাঁদো মুখে কিচেন থেকে বেড়িয়ে গেলো রাজু।
তারুণ কিচেন প্রবেশ করতে করতে বললো….
—তা এই আজব চিড়িয়া কি তোমার সাথে পার্মানেন্ট?
তানভীর কপাল কুঁচকে চাইলো ভাইয়ের দিকে।ডালটা নামিয়ে রেখে ভাত বসিয়ে দিয়ে সালাদ কাটতে কাটতে বললো,
—তাই তো দেখছি।তা তুমি এখানে কি মনে করে?
—হুট করেই তোমায় দেখতে মনে চাইলো ভাই। এখানে কেন থাকছো ভাই?
—স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিলাম!কেন ভালো করি নি?হায়দার হোসেন ঝামেলা থেকে মুক্ত!
—ভাই এত কষ্ট কেন করছো?বাবা বলে তুমিও নাকি বুবুর মত একটা মেয়ের কারণে আমাদের ছেড়ে এসেছো? ভাই কথাটি কি সত্য? আমাদের থেকে সেই মেয়েটি তোমার কাছে বেশি আপন?
তানভীর ছোট ভাইয়ের অভিমান ভরা কথায় হাসে। তারুণ রাগ কন্ঠে বলে,
—একদম দাঁত কেলিয়ে হাসবেনা ভাই।তোমাকে দেখতে রাজুর থেকেও বিদঘুটে লাগছে।
তানভীর মুখের হাসি বিস্তৃত করে বলে,
—-অথচ আমি তো জানি আমার হাসিটা তোমার ভীষণ পছন্দ। তবে একটা কথা বলতেই হয় তুমি কিন্তু বড় হিংসুটে!
—আমি মোটেও হিংসুটে নই ভাই।ঐ আজব চিড়িয়াটাকে আমার অসহ্য লাগে।
—রাজু কিন্তু তোমাকে বেশ পছন্দ করে।
—ভাই তুমি আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছো।কেন করলে এমনটা।
—-তুমি যে মেয়েটির কথা বলছো সে আমার প্রাণভোমরা তারুণ।বলতে পারো তোমার ভাই তৃপ্তির সাথে এই পৃথিবীতে হাসতে পারছে কেননা মেয়েটি এই পৃথিবীতে আছে বলে।তারুণ আমার কথা গুলো হয়তো খুব সিলি লাগছে কিন্তু আমার কিছুই করার নেই।আর যদি বলো কেন এসেছি তোমাদের ছেড়ে তবে বলবো ঐ মেয়েটি কারন হিসেবে দ্বিতীয়। প্রথম কারণ হলো আমি শান্তিতে বাঁচতে চাচ্ছিলাম। এই যে দুই রুমের বাসা দেখছো তারুণ। এটা শুধু আমার জন্য দু’রুমের বাসা নয়।এক টুকরো স্বর্গ!যা হায়দার হোসেনর অট্টালিকায় ছিলনা।আমার এত টাকা, এত সম্পদের দারকার নেই।একটু শান্তি দারকার।
ঘুম ঘুম চোখে সকাল হলেই জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায় ।সারাদিন কাজের পিছনে ছুটে রাত হলে কাচা হাতে রান্না করে একপেট খেয়ে শক্ত পোক্ত তোশকে যখন শরীর এলিয়ে দেই তখন জানালা গলে জোছনা এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় আমায়!আমার চোখে শান্তির ঘুম নেমে আসে। তুমি জানো না তারুণ,ওই বাড়িতে আমার রাতগুলো কাটতো নির্ঘুমে আর দিনগুলো এক নিশ্ছিদ্র অভিশাপে!
তারুণ ভালো করে তাকায় ভাইয়ের দিকে।তার ভাইকে সত্যিই খুব সুখী মনে হচ্ছে। মৃদুস্বরে তারুণ বলে,
–আর দ্বিতীয় কারণটি ভাই?
—তুমি জানো তোমার বাবা পুনমের সাথে দেখা করেছে। তাকে বিশ্রী ভাবে অপমান করেছে তোমার বাবা।যে মেয়েটিকে তার ছেলে ভালোবাসে সেই মেয়েটিকে ডেকে তাকে টাকা অফার করে কিভাবে?হাউ? পুনম এমনিতেই আমাকে সহ্য করতে পারে না তারউপর হায়দার হোসেন ষোলকলা পূর্ণ করেছে তাকে অপমান করে।পুনম যদি এরপর আমার মুখে জুতা মারে তাতে আমি আশ্চর্য হবো না!
তারুণ ভীষন অবাক হলো।তার ভাই একটা মেয়ের প্রতি যে এতটা ডেসপারেট তা ও জানতো না।
—তোমার মত ছেলেকে কোন মেয়ে অসহ্য ভাবতে কি করে পারে ভাই?
—আর কেউ না পারুক।পুনম নামের মেয়েটি পারে।পুনম নামের মেয়েটি তোমার ভাইকে দেখে বিরক্ত হয়,কপাল কুঁচকায়,কটু কথা বলে,গাল ফোলায়!তোমার ভাইকে সে গোনায় ধরে না।পুরো ডেম কেয়ার ভাব নিয়ে চলে।সে সব পারে…দু একটা থাপ্পড়ও সে দিতে পারে তোমার ভাইকে। পুরাই বোম্বাই মরিচের ঝাল সে! এতকিছু করার পরও তোমার ভাই তাকে চায়…খুব করে চায়…এক পৃথিবী সমান চায়!
শেষে কথাটি বলার সময় তানভীরের গলা ধরে আসে! এই নিষ্ঠুর মেয়েটিকেই কেন এত চায় অসভ্য মনটা?কেন?
তারুণের চোখে তখন বিস্ময়! তার ভাই যে কাউকে এতটা ভালোবাসবে তা কি কেউ জানতো?
*********
রাতের খাবার খাচ্ছে রুমার পরিবার।রুমা চুপচাপ খাবার গলগ্রহ করছে।ইষ্টি মিষ্টির খাওয়া শেষ।তারা চুপচাপ টেবিল থেকে উঠে পড়ে।দু’বোন এতদিনে বুঝে গেছে বাবা মা কোন কারণ বঃশত খুব রেগে আছে।তাই ওরাও বাড়তি প্রশ্ন করছে না।প্রশ্ন করলেই যে মার হাতের থাপ্পড় খেতে হবে তা নিশ্চিত।
মেয়েরা চলে যেতেই হারুন রুমার দিকে তাকায়। রুমাকে এখন মেয়ে বলা যায় না মহিলা বললেই বরং বেশি মানাবে। সাড়া শরীরে চর্বি জমেছে,ত্বক রুক্ষ।রুমাকে দেখে হারুন এখন আর আকর্ষিত হয় না।বরং বিরক্ত হয়।হারুন গমগমে স্বরে বলে ওঠে,
—রুমা আমি এখন একটা কথা বলবো।মন দিয়ে শুনবে।কোন মতামত চাইছি না।আমার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি….আর এ সিদ্ধান্ত কারো কথায় টলবে না।সিদ্ধান্ত শোনার পর যদি তোমার মনে হয় তুমি থাকবে না হলে তুমি চলে যাবে। কিন্তু আমার মেয়েরা কোথাও যাবে না।আমি আবার বিয়ে করবো শীঘ্রই।
রুমা শুনলো।কথাটি শুনে রুমার কোন ভাবান্তর হলো না। অস্বাভাবিক বিষয়টাও স্বাভাবিক লাগলো রুমার কাছে।
মৃদুস্বরে জানতে চাইলো,
—এই সিদ্ধান্তের কারণ?
—কারণ তোমাকে এখন আর ভালো লাগে না।তুমি আমার খুশি নয় বরং অরুচির কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছো।
এই কথাটি রুমার বুকে লাগলো। পুরো শরীর জ্বলে উঠলো। যাকে ভালোবাসে তার মুখ থেকে একথা শুনা বিষের সমান।রুমা মুহুর্তেই হিংস্র পশুতে পরিণত হলো যেন।চোখের ভিতর আগুন জ্বলে উঠলো।এটোঁ হাতে ঝাপিয়ে পড়লো হারুনের উপর।হাতের লস্বা নখ দিয়ে আঁচড়ে দিলো হারুনের মুখের উপর।রুমার উপর যেন অশরীরী ভর করেছে।টেবিলের খাবার মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এলোপাতাড়ি থাপ্পড় আর খামচে খুবলে হারুনের মুখ ক্ষতবিক্ষত করে ফেললো।এক থাবায় গলার কাছের নরম মাংস উঠিয়ে ফেললো।
এই আতর্কিত হামলায় হারুন বিহ্বলিত। সে যখন সবটা বুঝে উঠতে পারলো ততক্ষণে হারুণের পরিস্থিতি দফারফা! হারুন নিজেকে বাঁচাতে ধাক্কা মারে রুমাকে…রুমা ছিটকে টেবিলের উপর পড়ে।মাথার কোণ দিয়ে রক্তের চিকন ধারা গড়িয়ে পড়ে মুহুর্তেই!
ইষ্টি মিষ্টি দরজার পর্দার ধারে দাঁড়িয়ে বাবা মায়ের এরুপ আচরণ দেখে ভয় পায়।কেঁদে ওঠে নিঃশব্দে।বাবা মা দুজন দুজনকে মারছে কেন? পরক্ষণেই ইষ্টি হাতে মোবাইল তুলে নেয়,
—-চাচ্চু তুমি এখখুনি বাড়ি আসো….ফোঁফাতে ফোঁপাতে বলে ছোট্ট মেয়েটা।
**********
ফ্লোরে মাদুর পেতে খাবার খেতে বসেছে রাজু তানভীর তারুণ।রান্নার আইটেম হলো ইলিশ মাছ ভাজা,পানি ডাল,ভাত আর সালাদ।তানভীর দুজনকে দু’পাশে বসিয়ে খাবার পরিবেশন করছে।তারুণ রাজুর দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে আছে। ভাই কেন রাজুকে এত ভালোবাসবে?
সবাই মাছ দিয়ে খাওয়া শুরু করে।খেতে খেতে তানভীর বলে,
—-আমার কেন মনে হচ্ছে তারুণ তুমি কিছু বলতে চাও আমাকে?
তারুণ ইতস্তত করে বলে,
—- আমি বাহিরের দেশে পড়তে চাচ্ছি কিন্তু বাবা কেন এলাউ করছে না বলতে পারো ভাই?
তানভীর অবাক হয় না।মুখের নলা শেষ করে বলে,
—উনি কখনো তোমাকে বাহিরের দেশে পড়তে পাঠাবে না তারুণ।তাহলে তার উদ্দেশ্য ভেস্তে যাবে।
—-কি উদ্দেশ্য ভাই?
—তুমি বুঝবে না ভাই।শুধু এতটুকু জানো হায়দার হোসেন তাই করবে যা উনি চান।
—ভাই আমি বড় হয়েছি।প্লিজ টেল মি।আমি খেয়াল করে দেখেছি বাড়ির অনেক কিছুই আমি জানি না বা জানতে দেওয়া হয় না।কেন ভাই?তুমি বুবু আমি এই তিনজন ছাড়া বাবা কার জন্য সম্পত্তির পাহাড় গড়ছে? অথচ সেই সম্পত্তির প্রতি আমাদের কোন টান নেই কেন?
—-বলবো তারুণ।তোমাকে সবটা খুলে বলবো একদিন। নিজেকে একটু গুছিয়ে নেই।আর তুমি চিন্তা করো না।বাহিরের দেশে যাওযার জন্য প্রস্তুতি নেও টাকা আমি দিবো।দাদা বেঁচে থাকতে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে ছিল…সেগুলো এমনি পড়ে আছে।কিছু টাকা নিজের কাজের জন্য খাটাবো আর কিছু টাকা তোমায় দিবো।
—-ভাই বাবাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।বাবার অবাধ্য হলে বাবা কষ্ট পাবে ভীষণ।
তানভীর নিরবে ভাইয়ের দিকে তাকায়। মনে মনে বলে, তারুণ তোমার এদেশে থাকা যে বড় অনিরাপদ।কিন্তু মুখে হাসি রেখে বলে,
—আমিও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি তারুণ।ট্রাস্ট মি।আমার ব্রিলিয়ান্ট ভাই যখন ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করবে বাহিরের কলেজে তখন তোমার বাবা আর কষ্ট পাবে না।
—-সত্যি বলছো ভাই!
—একদম তিন সত্যি!
—-ভাই?
—বলো তারুণ।
—-বাবা কি প্রায়ই মায়ের শরীরে হাত তুলে।এর জন্যই কি তুমি বাবাকে পছন্দ করো না?
কথাটি শুনে তানভীর থমকে যায়! ভাতের লোকমা মুখে নেয়ার বদলে তা আবার প্লেটে পড়ে যায়।চোখের ভিতর পানি চিকচিক করে।কিছুক্ষণ থম মেরে থাকে তানভীর। রাজুর খাওয়াও থেমে যায়। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে তানভীর বলে,
—-তারুণ তুমি কি জানো আমাদের তিন ভাই বোনের মধ্যে মা তোমাকে বেশি ভালোবাস?
তারুণ বুঝতে পারে ভাই কথা এড়াতে চাইছে তাই নিরবে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
তানভীর ইলিশ মাছের ডিম দুভাগ করে রাজু আর তারুণের প্লেটে তুলে দেয়। রাজু অবাক হয়ে বলে,
—না না স্যার আপনি খান।
তানভীর চোখ গরম দিলে আর কিছু বলতে পারে না রাজু। রাজু মাথা নত করে ডিমের টুকরা নিয়ে প্লেটে তাকিয়ে থাকে।অকারণেই চোখ ভিজে আসে।রাজু বড় স্যারের চাকরিটা কেবল করছিল বাবার জন্য। প্যারালাইসিস বাবার চিকিৎসার খরচ উঠাবার জন্য। দেড় মাস আগে বাবা তাকে মুক্তি দিয়ে চলে গেলো।এরপর রাজু চাকরি ছেড়ে দিলো।রাজু অনেক ভেবেও বাবার পরে কে আপন খুঁজে পায়নি একমাত্র তানভীর স্যার ছাড়া।সৎ মা, ভাই বোন কবেই বা তারা রাজুর জন্য ছিল?
*********
পুনমের বিকেল শিফটের কাজ প্রায় শেষের দিকে।গুছগাছ করে বের হবে এখন রাফিদের বাসার উদ্দেশ্য। ছেলেটার দুদিন পর পরিক্ষা। একটু বেশি সময় আজ পড়াতে হবে।
মোবাইল সেন্টার থেকে বের হয়েই দেখে তারিন দাঁড়িয়ে আছে।কোলে মিতু।মা মেয়ে দুজনেই একরাশ হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
পুনম এড়িয়ে যেতে পারলো না।সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করলো।তারিন ছটফটে স্বভাবের মেয়ে।রাস্তায় দাঁড়িয়েই জোরে জোরে কথা বলছে।পুনম ভদ্রতা নিয়ে বলে,
—-আপা পাশে একটা রেস্টুরেন্ট আছে।চলুন সেখানে বসি।
পুনম মনে মনে অবশ্য চাইছিলো যাতে তারিন রাজি না হয়। কিন্তু আপা হাসি মুখেই মেয়ে নিয়ে এগিয়ে চললো।অগ্যতা পুনমকেও এগোতে হলো।হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পুনম বিড়বিড় করে, আল্লাহ আজ আবার লেট!
রেস্টুরেন্টে এক কোণায় বসেই তারিন বলে,
—মিতু মামিকে হাই বলনি কেন এখনো? সে হাই…
মিতু দুই ঝুটি নাড়িয়ে বলে, হাই।
পুনম অস্বস্তিতে এদিকে সেদিক দৃষ্টি ঘুরায়।
–আপা কি খবর বলেন?
—আপা কি পুনম?তুমি বুবু বলবে আমায়।ঠিক আছে।
–আচ্ছা বুবু।তারপর বুবু আমি এখানে আছি আপনি জানলেন কি করে?
—ওমা তানভীরই তো বললো।যে তুমি এখানে কাজ করো।
পুনম চোখ বড় বড় করে চাইলো।তানভীর জানে পুনম এখানে কাজ করে?তারমানে কি…?
— ওহ!
তারিন ইনিয়ে বিনিয়ে বললো, আমার মেয়ের জন্মদিন এক সপ্তাহ পড়ে। তুমি একমাত্র মামি হিসেবে কিন্তু অবশ্যই সেখানে উপস্থিত থাকবে।ঠিক আছে ভাই।
পুনমের আবার অস্বস্তি হয়।তানভীরের সাথেই তো যোগাযোগ নেই সেখানে কি করে ও তার বোনের বাসায় যায়?
—আসলে বুবু হয়েছে কি…
—শোন পুনম সম্পর্কে মান অভিমান তো থাকবেই তাই বলে কি দুজন দুজনকে এড়িয়ে চলবে?
—না না বুবু আসলে…
—আচ্ছা সেসব কথা বাদ।তুমি কি তানভীরের নতুন বাসায় গিয়েছো?ছেলে মানুষ কেমন জায়গায় থাকে তুমি ওর কাছের মানুষ হিসেবে তো সেসব খবর রাখা উচিত।
—মি.তানভীর নতুন বাসা নিয়েছে?
—সে কি তুমি জানতে না।বাবার সাথে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে সে আলাদা বাসায় থাকছে।ভালই হলো কি বলো? আমার বাপের বাসাকে আমার কাছে মৃত্যুপুরী মনে হয়।
—হ্যা হ্যা।বুবু বলছিলাম কি…রাশেদ ভাই তো অনেক কিছু করতেছে সুমন ভাইয়ের জন্য। তার উপকার….
তারিন পুনমের কথা শেষ হতে দেয় না…তার আগেই বলে,
—আরে রাখো তোমার উপকার…আইনের মার প্যাচ তো চিনো না।তুমি শুধু বলে দিয়েছো আর সে হাত মুখ ডুবিয়ে কাজে নেমে পড়েছে।আর আইনের লোক তো….. এরা একবার ঘাপলা পেলেই শোল মাছ যেভাবে ছাই দিয়ে চেপে ধরে সেভাবে ধরে মক্কেলকে…. তোমার বড় দুলাভাইকে কি করে খালি দেখো….
পুনম হাসে।কিছু বলে না।তারিন পুনরায় বলে, তুমি আসবে তো পুনম?তুমি না আসলে কিন্তু আমার মেয়ে কেক কাটবে না। ঠিক না মামণি?
মিতু দুই ঝুটি দুলিয়ে সম্মতি জানায়।
পরক্ষণেই তারিন আবার বলে,—পুনম আমার ভাই তোমাকে খুব ভালোবাসে।আমি চাই আমার ভাইয়ের বউ হয়ে তুমিই আসো…আমার তানভীরের বাচ্চা হবে, সংসার হবে…তা আমি দেখতে চাই!তুমি ছাড়া কিন্তু আমার ভাই মরে যাবে পুনম….বলতে বলতে তারিন কেঁদে দেয়।
পুনম ঘাট হয়ে বসে থাকে।কি বলবে ও?
তারিন যাওয়ার সময় আবার বলে,আমরা মা মেয়ে তোমার অপেক্ষা করবো পুনম।তুমি আসবে তো?
পুনম চোখের ইশারায় বুঝায় সে আসবে।মানুষ সবকিছু উপেক্ষা করতে পারলেও মমতাপূর্ণ ডাক উপেক্ষা করতে পারে না!আল্লাহ সে ক্ষমতা মানুষকে দেয়নি!
*****
পুনম একটা রিকশা নেয়….হেঁটেই যেতো।এখন লেট হওয়ার জন্য রিকশা নেওয়া! রিকশা বসেই পুনমের কিছুদিন আগের কথা মনে পড়ে..
পুনম একমনে কাজ করছিল।তখনই একজন কর্মচারি এসে বলে, পুনমের সাথে কে যেন কথা বলতে চায়।রুফটপে যে রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে বসে আছে। পুনম একদম অনিচ্ছা নিয়ে সেখানে যায়।গিয়ে দেখতে পায় কাঁচ ঘেরা রেস্টুরেন্টের এক কোণার টেবিলে একজন লোক বসে আছে।আভিজাত্যের ছোঁয়া তার অঙ্গ ভঙ্গিতে! কালো কোট টাই পড়নে ব্যক্তিকে দেখতে খুবই কঠিন ব্যক্তি মনে হলো পুনমের।চোখদুটো সাপের চোখের মত শীতল!লোকটাকে চিনতে না পারার কারণে পুনমের কপাল কুঁচকে এলো। পুনম সামনে যেয়ে দাঁড়াতেই লোকটা আঙুলের ইশারায় বসতে বলে।যেন কোন নিম্নবর্গের কর্মচারিকে আদেশ দিচ্ছে। হাতের পাঁচ আঙুলে আংটি।আশ্চর্য মেয়েদের মত এতগুলো আংটি কেন পড়েছে?
লোকটির পরিচয় শুনে তো পুনম অবাকের সপ্তম পর্যায়ে! তানভীরের বাবা কি চায় তার কাছে? পুনম শাড়ির আঁচল ভালো ভাবে গায় জড়ায়!লোকটি তখন থেকে পুনমকে পর্যবেক্ষণ করছে।পুনম নিজেই বলে,
—-আসলে আমি বুঝতে পারছিনা।এখানে এভাবে আমাকে কেন ডেকে আনা হলো?
হায়দার হোসেন এতক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিল পুনমকে।মেয়েটা আসলেই অনেক সুন্দরী! সচারাচর এরকম চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য কোথাও দেখা যায় না।তানভীরের এত ঘায়েল হওয়ার মানে বুঝা যাচ্ছে।
—না বুঝার মত কিছু নেই মেয়ে।তুমি আমার সম্পর্কে যদি জেনে থাকো তবে তোমার জানা উচিত এই হায়দার হোসেন কারো সাথে যেচে দেখা করতে যায় না।মানুষ যেচে পড়ে পায় পড়ে আমার!
লোকটার অহংকারি কথায় পুনম বিরক্ত হয়।তাই কিছুটা রেসিয়ে বলে,
—হটাৎ সেই সৌভাগ্য আমার হওয়ার কারণ?
—আমি তোমার সাথে একটা ডিলে আসতে চাই।আমার ছেলে বুঝতে চায় না তোমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা আমাদের মত বড়লোকদের ফাঁসায় শুধু লোভের জন্য!
—-তারমানে আমাদের মত অনেক মেয়ের দ্বারা আপনি ফেঁসেছেন?আই সি…মারাত্মক বিষয়!
হায়দার হোসেন বুঝে যান সামনে বসা মেয়েটিকে কথায় হারাতে পারবেন না।তাই টেবিলের উপর রাখা একটা চেক বই পুনমের দিকে ঠেলে দেয় তিনি।সাথে কলম।
তারপর বলে,
—-এখানে যত খুশি এমাউন্ট বসিয়ে নেও।তারপরও আমার ছেলের থেকে দূরে থাকো।আমি জানি তোমাদের অর্থ সঙ্কট আছে।আর টাকার কাছে সবাই কাবু।
পুনম একপেশে হাসে।চেকবইটা হাতে নিয়ে নাড়িয়ে বলে,
—আসলে আপনার ছেলের থেকে আমিও দূরে থাকতে চাই।সুতরাং…. পুনম চেকবইটা ঠেলে আবার হায়দার হোসেনের দিকে পাঠায়।তারপার আবার বলে, সুতরাং আসুন আমি আপনার সাথে ডিল করি।আপনার ছেলেকে আমার থেকে দূরে রাখবেন তার বিনিময়ে আপনার কি চাই বলেন?আমি নিজেও আপনার ছেলের উপর বিরক্ত! এরকম বেহায়া ছেলে হয়?কত অপমান করলাম তবু পিছু ছাড়ছেনা।কিরকম নির্লজ্জ ছেলে আপনার?
হায়দার হোসেন হকচকিয়ে যান।মেয়েটা যে এরকম ঠোঁটকাটা কথা বলবে কে জানতো।মেয়েটার চোখে কোন ভয় বা উত্তেজনা নেই।
—-এতবড় সুযোগ হাতছাড়া করছো পরে আফসোস করবে।
—আমি নিজের সিদ্ধান্তে কখনো আফসোস করি না!
—এই হায়দার হোসেন কখনো হারে না।তাই তোমার মত থার্ডক্লাস মেয়ের কাছে তো কখনো হারবে না।দেখো এমন না হয় এই টাকার জন্য তোমার আমার কাছে আসা লাগে। ডেস্টিনি হু নো?
—এক্সিলেন্ট! ঠান্ডা মাথায় থ্রেট।আই’ম ইমপ্রেসড।….বলে পুনম উঠে চলে যায়। পুনম তখন রেগেছিল ভীষণ!আর হায়দার হোসেন আকস্মিক পুনমের চলে যাওয়াতে চিন্তিত। এই মেয়ে দেখছি গভীর জলের মাছ!একে অন্য ভাবে বড়শিতে গাঁথতে হবে।
ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে পুনম।নিজেকে নিজের বিশ্রী গালি দিতে মনে চায়।কোন কুক্ষণে যে এই তানভীরের সাথে দেখা হয়েছিল? ছেলে বলে ভালোবাসো না কেন? বাপ এসে বলে ছেড়ে দাও? বোন এস বলে বাচ্চা চাই বিয়ে করো?….এরা আসলে কি চায়?এদের যন্ত্রণায় পুনম মরে যাক!অসহ্য! এই তানভীরের বাচ্চাকে সামনে পেলে খবর আছে…কচ্ছপের মত ঘাপটি মেরে আছে….আবাল একটা!
*******
সুমন হসপিটালের করিডোরে পায়চারি করছে।আপাতত ভাবির জ্ঞান নেই।আর ভাইজানের ড্রেসিং চলছে।সুমনের সিগারেট খেতে করতে মনে চাচ্ছে। সুমন ব্যস্ত হাতে চুল ব্যাকব্রাশ করে…পাগল পাগল লাগে সুমনের।কোর্ট কাচারি যে এত ঝামেলার তা সুমন জানতো না।এ নথি এ পথি কত কি? ভাগ্যিস রাশেদ ভাই ছিলো।এত ভালো মানুষকে পুনম কোথা থেকে জোগার করলো কে জানে?
ইষ্টি মিষ্টি কাঁদছে করিডোরের চেয়ারে বসে। সুমন তাদের সামনে যেয়ে বলে, –এই হানি বানি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছিস কেন?কাঁদার মত কি হলো?
—চাচ্চু বাবা মা এরকম কেন করলো?
—আরে বোকা তোর বাবা মা বক্সিংয়ে নাম লিখিয়েছে তার প্রেক্টিস করছিল।আর কিছু না।দুইজনেই ফাউল বুঝছিস। এখন না কেঁদে আমার পিছু পিছু আয় হাঁসের ছাওর মত। আইসক্রিম খাবি আয়।
ইষ্টি মিষ্টি আইসক্রিম খাচ্ছে।তাদের মন এখন কিছুটা ভালো। সুমন কল করে পাবনীকে। সুমনের কল দেখে তখনি পাবনী বোকা হয়ে গিয়েছে। রিসিভ করতেই সুমন বলে,
—-এই পাবনী তোমারও কি রাগ টাগ হলে কামড়ানোর অভ্যেস আছে?
—মানে?
—-থাকলে চেঞ্জ করে নাও। এসব কাঁমড় ফামড় আমি নিতে পারি না।
—আপনি এসব কি বলছেন সুমন ভাই?পাগল হয়ে গেছেন?
—মন হয়।আচ্ছা পাবনী সুন্দরী মেয়ে কামড়ালে কি ইনজেকশন নেওয়া লাগে?নাকি তার জন্য আলাদা ট্রিটমেন্ট?
—আপনি পাগল?
—তাই তো মনে হচ্ছে!
পাবনী কেঁদে দেয়।
—আপনি ঠিক আছেন সুমন ভাই?
তার উত্তর সুমন দেয় না।কট কল কেটে সিগারেট ধরায়…জ্বলন্ত সিগারেটে পোড়াতে থাকে নিজের ঠোঁট আর নিজের ভিতরটা!
********
টিউশনি শেষে পুনম বাড়ি ফেরার জন্য হাঁটা ধরে।তখনি মেজ আপা কল করে।
—পুনু বাড়ি ফিরছিস?
—হ্যা
—আসার সময় একটা ডিমওয়ালা বড় ইলিশ মাছ আনতি পারবি।প্লিজ প্লিজ!
—আপা মেজাজ খারাপ করবি না।রাত কত হয়েছে দেখেছিস।এই রাতের বেলা মাছ কই পাবো?দুলাভাই কই তারে বল।
—সে তো কারখানার কাজে নারায়ণগঞ্জ গেছে।দুদিন পর আসবে বনু।প্লিজ মাছ না নিয়ে বাড়ি আসবি না পুনু।
,—আপা জেদ ধরিস না কাল আনবো।
—না না এখখুনি চাই।তোর পুচকু বাবু খেতে চাইছে।
—আপা বাচ্চা খালি তোর একার হবে তাই না।যত্তসব ঢং! এত ঢং না করে ফোন রাখ।
ঝুমা কল কেটে দেয়।পেটে হাত বুলিয়ে বলে,লক্ষ্মি সোনা খালামণি মাছ নিয়ে ফিরবে এখনি।তারপর আমরা চেটেপুটে খাবো!
শোন বাবু…বড় হয়ে তোর আমায় ভালো না বাসলেও চলবে কিন্তু তোর বাবাকে আর পুনুমাকে ভীষণ ভালোবাসবি।পারবি তো বাবু?
পুনম একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঢুকে মাছের বাজারে।শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে আসতে চাইছে।অসুস্থ বোনের জন্য মাছ না নিয়ে ফিরতে সে পারবে না।আজ একটা টিউশনের টাকা পেলো আজই আপা তোর মাছ খেতে মনে চাইলো।
মাছের দাম শুনে চক্ষু চড়কগাছ পুনমের।ডিমওয়ালা একটা মোটামুটি বড় ইলিশের দাম চাইছে একুশো। দরদাম করে আঠারোশ টাকা দিয়ে মাছ কিনে পুনম হাঁটা ধরে বাড়ির পথে। এতগুলো টাকা খরচের জন্য হিসেবে গরমিল হয়ে যাবে পুনমের।মাস শেষে চলতে কষ্ট হবে।চাপা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পুনম!
চলবে,