পুনম,পর্বঃ১৬,১৭

পুনম,পর্বঃ১৬,১৭
আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৬

লাবণ্য নাকমুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে মুরগির দোকানের সামনে। সে মনে মনে শতবার তওবা পড়ে ফেলেছে, আর কখনো সে বাজারে আসবে না। ইশ! কি দুর্গন্ধ! ওয়াক! বমি আসছে….
মরিচা লাবণ্যর অবস্থা দেখে বলে ওঠে, — ও ছুডু আফা বমি কইরেন না,নাকে ওড়না চাইপা ধরেন।গন্ধ লাগবো না।
পুনম লাবণ্যর অবস্থা দেখে মুচকি হাসে।পুনম লাবণ্য কে বলে,—-মুরগী রান্না হলে তো তোর হাত পা রান থান মাথা সবই লাগে এখন দেখ সেই মুরগীর হাত পা কোথায় থাকে….
লাবণ্য ওদের পরিবারে ছোট, নিজেদের যতটুকু সাধ্য তার মধ্যেই ওকে আহ্লাদ দেয়া হয়েছে বেশি।কিন্তু এখন বড় হচ্ছে, বাস্তবতা বুঝতে হবে।পুনমও প্রথম যেদিন বাজারে আসলো সেদিন ওর অবস্থাও আধমরা হয়েছিল।
বৃষ্টির পানিতে বাজারের চারদিকে কাদা কাদা হয়ে রয়েছে। লাবণ্য সালওয়ার হাত দিয়ে উচু করে ধরে
হাঁটছে। বাজার করা যে এত প্যারার তা জানতো না আগে কিন্তু নয়াপু কি সুন্দর বাজার করছে,দোকানীদের সাথে দরদাম করছে,ভালো পন্য বেছে বেছে নিচ্ছে। আর এই মরিচা বু প্রতেক দোকানদারদের সাথে চোটপাট চালাচ্ছে। মরিচা বু বার বার নয়াপুর কাছে অভিযোগ করছে,হাইজা আফা আমনে তো ঠইগে যাচ্ছেন। এই কল্লির এত দাম!গলাকাঁটা দাম রাখতেছ।এই ঢেড়স মোগো এলাকায় পথে ঘাটে পইড়া থাকে।হুহ! পয়সা কি গাছে ধরেনি?দোহান তো নয় বাটপারীর কারখানা খুলে বইছে এক একটা।
পুনম মরিচার কথায় কান দেয় না।এই শহরে পানি টুকুও কিনে খেতে হয় সেখানে খাদ্য পন্য সহজলভ্য হয় কি করে?
কিছু মুদি বাজার, সবজি আর চারটা মুরগি কিনে রিকশায় চেপে বসে পুনমেরা।গত বার ঈদ ও তার আগের ঈদেও পুনমদের বাসায় শুধু মরগির ঝাল মাংস রান্না করা হয়েছে।কিন্তু এবার বাসায় দুলাভাইরা আছে চারটা মুরগি কিনছে রোষ্ট করার জন্য। বাবা অবশ্য এবার বলেছিল শুধু গরুর গোছ কিনে আনবে কিন্তু তা দিয়ে কি হয়? বাসায় ইষ্টি মিষ্টি আছে। রোষ্ট ছাড়া ঈদ আর গরুর গোছ ছাড়া কোরবানির ঈদ নাকি হয়ই না! তাই পুনম নিজেই কিনে নিল।

*******************
পাবনী সকাল থেকে একা একা কাজ করে যাচ্ছে। রোজার মাস হলে কি হবে সকালেও রান্না করা লাগছে যারা রোজা রাখে নি তাদের জন্য। এখন আবার ইফতারি আর রাতের রান্না করছে।একে তো একটা পায়ে সমস্যা তার উপর এত কাজ একলা করা খুব কষ্টকর!সারা শরীর ঘামে চিটচিট করছে। সকালে পুনম লাবণ্য আর মরিচা একসাথে মার্কেটে গিয়েছে।মা মরিচাকে যেতে নিষেধ করেছিল কিন্তু পাবনীই পাঠিয়েছে।মেয়েটার শহরের মার্কেট দেখার খুব শখ ছিল। আর বড় আপা সহসা রান্না ঘরে আসে না যে হেল্প করবে। মার হাত পা কেমন ফুলে যায় বিকেল হলেই।তাই মাকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে পাবনী ঘরের সব কাজ একাই করছে। ইষ্টি মিষ্টি দুজনেই দৌড় দিয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করে। খালামণিকে খুব ব্যস্ত হাতে কাজ করতে দেখে বলে ওঠে, —-তোমার কোন হেল্প লাগবে খালামণি?
পাবনী ওদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে।
—-না সোনা।
—-কিন্তু তোমার তো খুব কষ্ট হচ্ছে।
—–মোটেই না।তোমাদের কিছু লাগবে? এখানে কি জন্য আসা দুজনের?
ওরা দুজনেই একসাথে বলে ওঠে,
—–খালামণি,মেঝ খালামণির পেটের মধ্যে নাকি চোট একটা পুচকু বাবু আছে। সে কি আমাদের ভাই নাকি বোন? তুমি বলতে পারবে?
পাবনী ডালে ফোঁড়ন দিতে দিতে জানতে চাইলো,—- কেন জানতে চাইছো?
—ভাই হচ্ছে বিপরীত পক্ষ। ভাই হলে আমরা তার সাথে কাট্টি করবো আর বোন হলে আমরা তার সাথে ভাব করবো।
—–প্রতিটি বোনের জন্য ভাই হলো সুরক্ষিত বন্ধন। তাই ভাই হলে নো কাট্টি, ঠিকাছে?
ওরা দুজনেই বিজ্ঞদের মত মাথা ঝাকিয়ে বুঝায় সব বুঝেছে। পাবনী জিজ্ঞেস করে ওদের,
—–তোমাদের চাচ্চু কোথায়?
—–চাচ্চু তো ছাদের চিলেকোঠার রুমে।
পাবনী ওদের কে চলে যেতে বলে চুলায় পুই শাকের তরকারি বসিয়ে চুলার আঁচ ধিম করে ছাদের দিকে পা বাড়ায়।সুমন ভাই এই বাড়িতে ক’দিন ধরেই আছে তবে তা না থাকার মত।পুনম যেতে দেয়নি কুমিল্লা।বিকেল হলে বের হয় যায় আর আসে পরদিন সকালে।আর এসেই ঘুম।কোথায় ইফতার করে আর কোথায় সেহরি খায় কিছুই বলে না।জিজ্ঞেস করলে বলে, কাজ করে। সারা রাত ভর কি কাজ পাবনী ভেবে পায় না। পাবনীর মায়া হয় সুমন ভাইয়ের প্রতি।মানুষটার আপন বলতে কেউ নেই, যারা আছে তারা শুধু নামেই আত্মীয়।মা বাবা ছাড়া পৃথিবীর বুকে একটা মানুষের বেড়ে ওঠা বড়ই কষ্টের।

ছাদে সিড়ির কাছ থেকে লাগোয়া ছোট্ট একটা রুম আছে।একেবারেই ছোট্ট রুম।এই রুমটিতে যত ধরনের অপ্রয়োজনীয় জিনিস ছিল তা রাখা ছিল।মধ্যবিত্তদের অবশ্য অপ্রয়োজনীয় জিনিস কম থাকে, যা থাকে তা কেবল প্রয়োজনীয়!
রুমিটিতে ছোট একটা জানালা আছে। তা দিয়ে হাওয়া বাতাস আসে।পাবনী দরজার কাছে গিয়ে বলে,
—-সুমন ভাই আসবো?
কোন সাড়া শব্দ নেই, হয়তো ঘুমে।তারপরও পাবনী বারকয়েক ডাকে।সুমনকে নড়াচড়া করতে দেখে আবার বলে —সুমন ভাই, আসবো?
সুমন ধরফরিয়ে উঠে বসে।ফ্লোরিং করা বিছানায় সুমন ঘুমিয়ে ছিল।পড়নে শুধু একটা লুঙ্গি। কি লজ্জাজনক ব্যাপার!লুঙ্গি ঠিকমত আছে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। পাবনী দরজায় দাঁড়ানো। তাকে তো আর বলা যায না,তুমি এসো না….সুমন কাঁথা টেনে গায়ে জরায়।
—তোমাদেরই তো ঘর পাবনী, তাহলে অযথা পারমিশন চেয়ে লজ্জা কেন দিচ্ছ।
—-এ ঘরে এখন আপনি আছেন তাই এঘর আপনার।আর অনুমতি ছাড়া কারো রুমে প্রবেশ করা অসভ্যতা।
—-সুমন ভাই আপনি কাঁথা কেন জরিয়েছেন জ্বর আসেনিতো?
—–আরে না না জ্বর আসে নি….এমনিই…অস্বস্তিতে কথা জরিয়ে আসে সুমনের।
পাবনী সুমনের কথা বিশ্বাস করে না। সে চিন্তিত কন্ঠে বলে ওঠে, —দেখি সুমন ভাই,এদিকে আসুন।কপালে হাত দিয়ে দেখি জ্বর আছে কিনা?
সুমন নড়তে ভুলে যায়।বড় বড় নেত্রে তাকিয়ে থাকে। সুমন এগিয়ে আসেনা।পাবনী এগিয়ে আসে সুমনের দিকে।
সুমন বিড়বিড় করে, এতো কাছে এসো না পাবনী…..আমাকে ছুঁয়েও না! তোমার স্পর্শে আমার নিশ্চিত জ্বর হবে…ভীষণ জ্বর!
পাবনী সুমনের আত্মকথন শুনতে পায় না।সে সুমনের কপালে হাত রেখে চমকে ওঠে।
—–আপনার তো জ্বর এসেছে সুমন ভাই।
—–ও হালকা একটু গরম তাতে কিছুই হবে না।
পাবনী সুমনের কথায় পাত্তা দেয়না। শাসনের সুরে বলতে থাকে,—-এতটা কেয়ারলেস কেন আপনি?পুনম ঠিকই বলে।আপনি হচ্ছেন মেরুদণ্ড হীন।নিজের ভালো নিজে না বুঝলে কে বুঝবে।কে আছে আপনার ভালো বুঝার জন্য বলুন?
সুমন মনে মনে বলে, —এই তো তুমি আছো…
—–আজ আর কোন কাজে যাবেন না।এখন রেষ্ট নিন।ইফতার করে নাপা খাবেন।আর খালি গায়ে শুয়ে আছেন কেন….বলে পাবনী রশিতে ঝুলানো সুমনের শার্ট নিতে যায়। কিন্তু হাতে নেওয়ার পর ঘামের গন্ধে নাক ছিটকে আসে।
—–উঁ–কতদিন হলো শার্ট পরিষ্কার করেন নি বলেন তো? আমি নিচে গিয়ে মিষ্টির কাছে বাবার জামা পাঠিয়ে দিচ্ছি আর এই দুটো শার্ট আর প্যান্ট নিয়ে যাচ্ছি ধোঁয়ার জন্য। আর একটু পর এসে এক বালতি পানি দিয়ে যাবো।তা ছাদের কোণে বসে মাথায় ঢালবেন।ঠিকাছে?
সুমন বহুকষ্টে বলে ওঠে, থাক না।তোমার কষ্ট হবে পাবনী।
পাবনী সে কথায় কর্ণপাত না করে নিচে নেমে যায়। পাবনী যদি আর একবার ফিরে তাকাতো তবে দেখতে পেতো, ছলছলে গভীর দুটো চোখ এক সমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে প্রেয়সীর গমন পানে!

****************
মরিচা বাজার নিয়ে আর লাবণ্য বাসার সবার নতুন কাপড় চোপড় নিয়ে হইহই করতে করতে বাসায় প্রবেশ করে। পুনম রিকশাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢুকতে যাবে তখনই ফোনে মেসেজের শব্দ আসে। পুনম মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে নবাবপুত্র ওরফে তানভীর টেক্সট পাঠিয়েছে,
“”””” রাগলে নাকি সুন্দরীদের নাকের ডগা লাল হয় পুনমি? তোমার কেমন হয়? লাল, নীল নাকি বেগুনি?”””!!!

পুনমের রাগের চোটে শরীর কিড়মিড় করে। ও যদি সামনে পেতো এই বেটার এত ঢঙ বের করে দিতো।তেল মসলা ছাড়া পুরাই কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো।এতেও সন্দেহ আছে,এই বেটা পেটের মধ্যে যেয়েও গন্ডগোল পাকাতো!
আগে থাকতো মান্দা মেরে আর এখন হিরো সাজতে এসেছে। পুনমের নিজের মাথায় নিজের বাড়ি দিতে মনে চায়।ওর একটা ভুল এই তানভীর কে আরো অবাধ্য করে তুলেছে। সেদিন যদি হসপিটালে এ লোককে চুমু না দিতো তবে আজ এতোটা অবাধ্য তানভীর কখনোই হতো না।
কি করবে পুনম?
পুনম সেদিন বেধে রাখতে পারেনি ওর ভিতরের অনুভূতিকে।জ্বরের ঘোরে যখন তানভীর ওর কাছে এই নিষিদ্ধ আবদার করছিল তখন পুনম পুরোপুরি ভাবে কেঁপে উঠেছিল। কি মায়া নিয়ে তাকিয়ে ছিল। সেই দৃষ্টি ওকে বার বার নিষ্টুর বলে আখ্যা করছিল। ও প্রতাখ্যান করে চলে আসছিল ওই আবদার।তানভীর চোখ বন্ধ করে বারবার একটা কথাই আওড়াচ্ছিল…তুমি এতটা নিষ্ঠুর কেন পুনমি? একটা চুমু দিলে কিইবা হয়? তুমি চুমু না দিলে এ অসুখ সারবার নয় পুনমি…..

পুনম কেবিনের দরজা ঠেলে বের হয়ে যায় কিন্তু কি আশ্চর্য ওর পা দুটো ওর সঙ্গ দেয় না।কেমন টলমল করে ওঠে। যেন বিদ্রোহ করছে ওর বিপক্ষে! কি অসহ্য যন্ত্রণা শরু হয়েছিল বুকের ভিতর!তা নিয়ে পুনম সেই দরজায় ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল,অনেকক্ষণ! পুনম সেদিন বুঝতে পেরেছিল শুধু তানভীর নয় খুব অযত্নে ওর মনের ভিতরও বেড়ে উঠেছে এক অব্যক্ত অভিন্ন অনুভূতি!
পুনম কেবিনের দরজা ঠেলে আবার ভিতরে প্রবেশ করেছিল।তানভীর চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল।তানভীরকে ঘুমন্ত ভেবে খবুই চুপিসারে তানভীরের শিয়রের কাছে দাড়িয়ে কপালে পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলোতে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল।নিচু হয়ে খুবই কোমলতার সহিত পুনমের অধর ছুঁয়েছিল ওই উত্তপ্ত ললাটকে!সাথে সাথেই তানভীর চোখ মেলে তাকিয়েছিল। সেই চোখে তখন বিস্ময়, প্রেম, আর কিছু সুখের মেলা দেখতে পেয়েছিল পুনম।
আর তখনই পুনম একছুটে বেড়িয়ে এসেছিল ওই হসপিটাল থেকে আর সাথে সাথে এও বুঝতে পেরেছিল বড্ড ভুল করে ফেলেছে।এ ভুল শোধরাবার নয়!

নিজেকে বারবার ধিক্কার দিয়েছিল।এক মুহূর্তের ভুল ভেবে নিজেকে শুধরিয়েছিলো পুনম।নিজের অনুভূতিকে পর্যন্ত ভুল বলে স্বীকার করে নিয়েছিল পুনম। যা কখনো হবার নয় তা নিয়ে আশা করাও বোকামি।
কিন্তু তানভীর সেই মুহূর্তটাকে সারা জীবনের সঞ্চয় ভেবেছে।তার বেঁচে থাকার কারণ জেনেছে। ঠিক সেদিনের পর তানভীর বদলে গেছে।নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে।যেন কোন কিছুই আর সে পরোয়া করে না। যে বাবাকে ভয় পেয়েছে সেই বাবাকে দেখলে ওর কোন অনুভুতিই কাজ করে না।
আর সেদিন থেকেই পুনমের বেঁচে থাকা হারাম করে দিয়েছে তানভীর।কখনো হুটহাট টেক্সট কখনো বা কল করবে।ইফতারির সময় টেক্সট করে পাঠাবে তাতে লিখা থাকে, “”””শরবতের বদলে কেন তোমার চুমু খেতে মন চাইছে বলতো পুনমি?””” বা কখনো লিখেছে, “””তুমি কি চুপিচুপি শরবতে ঠোঁট ছুঁয়েছ,এত কেন মিষ্টি বলতো পনমি?”””
কি অশ্লীল কথাবার্তা!
পুনম রাগ করেছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারে নি। ওর একটা ভুল এর জন্য দায়ী।
দেখা গেছে পরিবারের সাথে পুনম সেহরি করছে তখন হুট করে কল করে বলছে,””” খাওয়ার রুচি কেন পাচ্ছি না বলতো পুনমি? একটা রুচি নামক চুমু দাও তো।””” আর পুনম নাকে মুখে বিষম খেয়ে বসে থাকতো তখন।

কখনো কল করে বলতো, “””” শরীরে শক্তি পাচ্ছি না পুনমি, একটা এনার্জি চুমু দাও তো।””” বা বলতো,
“”” খুব ক্ষুধা লেগেছে পুনমি,একটা চুমু খাওয়াতো।”””””

কি পরিমাণ যে জ্বালিয়েছে এই লোক তা শুধু পুনম জানে। একটা ভুলের দায় যে এত কঠিন তা পুনম জানতো না। তাইতো শেষে কল রিসিভ করেনি, দেখা হলে না চেনার ভান করে কথা বলেনি পরে বল্টুর সাহায্যে তার সাথে দেখা করেছে। পুনম জানে না তানভীর তার প্রতি কতটা বেগবান কিন্তু পুনম এতটুকু জানে শুধু ভালোবাসা দিয়ে কখনোই সুখী হওয়া যায় না!

চলবে,

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৭

রাতের শেষে স্নিগ্ধ একটা ভোর।তানভীরের রুমের জানালার পাশে দুটো পাখি বসে কিচিরমিচির করছে।ঘুম কাটিয়ে চোখমেলে পাখি দুটোর খুনসুটি দেখে তানভীরের খুব ভালো লাগলো।পাখি দুটোর জায়গায় নিজেকে আর পুনমকে ভেবে কল্পনাও করা হলো এক মুহূর্তে! ওদের সকালও হবে এমন খুনসুটিময় কিচিরমিচিরে!
সর্বনাশ করেছে এই মেয়ে! পুনম ছাড়া কিছুই মাথায় আসে না আর! তানভীর বালিশের পাশথেকে মোবাইল নিয়ে টুক করে একটা ছবি তুলে ফেলে পাখিদের।তানভীরের ইচ্ছা জাগে পুনমকে এই ছবি পাঠাতে কিন্তু এই মেয়ে যে একটা ভাঙাচোরা মোবাইল চালায় তাতে যে কথা বলা যায় তাই সৌভাগ্য মনে হয় তানভীরের।
চট করেই মাথায় আসে পুনমকে একটা মোবাইল কিনে দিলে কেমন হয়?পরমুহূর্তেই মুখ ভার হয়ে আসে তানভীরের,যে কঠিন রাগী মেয়ে.. মোবাইল দিয়েই মুখে না মেরে দেয় শেষে! এর দ্বারা সবই সম্ভব। কেবল ভালোবাসা ছাড়া!
ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হতেই তানভীর শুনতে পায় মায়ের রুম থেকে গানের আওয়াজ আসছে…. অনেকদিন পর মায়ের কন্ঠে গান শুনে বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো তানভীরের।মায়ের গানের গলা খুব সুন্দর। তানভীর শব্দহীন পায়ে হেঁটে রুমে প্রবেশ করে।দেখতে পায় খাটের উপর আয়েশ করে বসে চোখ বুজে একমনে নজরুল সংগীত গাইছে মা।পড়নে একটা ধূসর সুতি শাড়ি।শরীরের কোন স্থানই গহনা নেই।চোখের নিচে কালো দাগ। রুক্ষ ঠোঁট মৃদু হাসির রেখা।মাকে তারপরও খুব সুন্দর দেখায় তানভীরের কাছে। চুপচাপ মায়ের পাশে গিয়ে খাটে বসে তানভীর। মার কন্ঠে তখন নজরুল সংগীতের সুর….

কেউ ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি।
কেউ দুখ লয়ে কাঁদে কেউ ভুলিতে গায় গীতি।।

কেউ শীতল জলদে হেরে অশনির জ্বালা,
কেউ মুঞ্জুরিয়া তোলে তার শুষ্ক কুঞ্জ – বিথী।।

কেউ কমল – মৃণালে হেরে কাঁটা কেহ কমল।
কেউ ফুল দলি’ চলে, কেউ মালা গাঁথে নিতি।।

কেউ জ্বালে না আর আলো তার চির – দুখের রাতে,
কেউ দ্বার খুলি’ জাগে চায় নব, চাঁদের তিথি।।

গজল সঙ্গীত – ( মান্দ – কাহারবা )

সংগীত থেমে গেছে অনেকক্ষণ। শায়লা হক চোখ বন্ধ করে একই ভাবে বসে থাকে।তানভীর মায়ের কোলে মাথা রাখে।মায়ের হাতটি টেনে এনে হাতের পিঠে আলতো করে চুমু খায়।শায়লা হক ছেলের দিকে মমতাভরা দৃষ্টিতে তাকান, মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।তানভীর আর সহ্য করতে পারে না।মায়ের কোলে মুখ গুজে শক্ত করে কোমর জরিয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠে বলে,
—-মা কেন তোমাকে বাবা পাগল বলে? কেন সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেয় মানসিক ভারসাম্যহীন রোগী হিসেবে? বলো মা?কেন তুমি প্রতিবাদ করনা মা?কেন তুমি নিজেকে আড়ালে রাখো মা? আমার মা তো পাগল নয়।তবে কেন মা আমি প্রতিবাদ করতে গেলে তুমি থামিয়ে দিতে?কেন তুমি এত ভীতু মা?কেন তোমার মত ভীতু বানালে মা আমায়? বল মা?…
——কারণ তোর মা বড় ভীতুরে খোকা!
—-আমি তোমায় এখান থেকে নিয়ে যাবো মা।আর কিছুদিন…তারপর আর কোন কষ্ট তোমায় পেতে দেবো না।
শায়লা হক হাসে ছেলের কথায়।ছেলেটা এতদিন রাগ করে তার রুমেও আসতো না।কত অভিযোগ তার মায়ের প্রতি? কিন্তু ও কি জানে কতটা বদ্ধ কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে ওর মা!
—-তোর বাবা তো আজকে দেশে ফিরছে।এত অবাধ্যতার কি কৈফিয়ত দিবি খোকা?
—-কিচ্ছু দিব না।
—রুমে বদ্ধ করে রাখবে।
—রাখুক।
—-তারুণ আমার কাছে একটুও আসে না।ও ওর পাগল মাকে ভয় পায়, তাই নারে খোকা?
তানভীর একথার উত্তর দেয় না।তারুণ নিজেও জানে মা পাগল নয় তবে ও বেশি একটা মিশে না মার সাথে।খাবার টেবিলে দেখা হয় সবার।এছাড়া মায়ের রুমে সচারাচর কেউ আসে না।
—-খোকা এবার তোর বাবার ভ্রমণ সঙ্গী কে রে?
—– আর আই কোম্পানি গ্রুপের মালিকের দ্বিতীয় স্ত্রী পলি আক্তার।
শায়লা হকের সমস্ত শরীর ঘৃণায় রী রী করে ওঠে।আগে এসব দেখে কষ্ট পেতো কান্না করতো।প্রতিবাদ করে বেধর মার খেতো। কিন্তু সব হারানোর পর এখন আর কিছুই আসে যায় না শায়লার।হায়দার হোসেন নামক ব্যক্তিটিকে সে অসম্ভব ঘৃণা করে।মৃত্যু ছাড়া তার রেহাই নেই তা সে জানে তাই প্রতিটি মুহুর্তে মৃত্যুর দিন গুনে।নিজের মেয়ের বয়সী মেয়েদের সঙ্গে যে পুরুষ রাত কাটাতে পারে তাকে ঘৃনা ছাড়া আর কি করা যায়?টাকা, নারী, মদ এই তিন নিয়ে যার জীবন সে সব কিছু করতে পারে,সব! তাই এত ভীতু শায়লা।তানভীর, তারিন হায়দার হোসেনের এই দিক জেনে এত ঘৃণা করে যেদিন বাকিটুকু জানবে সেদিন কি করবে?আর তার তারুণ সে তো বাবাকে আইডল মানে।সে এর এক অংশও জানে না।তারুণ যেদিন জানবে কি বলবে তার আইডল বাবা সম্পর্কে?
—-মা বুবুর কাছে যাবে?বুবুর তোমার জন্য খুব কাঁদে মা।
শায়লার যেতে মনে চায় কতবছর দেখে না মেয়েটাকে কিন্তু আজ যে হায়দার বাড়ি ফিরছে তাকে দেখতে না পেলে তো… ভেবে শিউরে ওঠে শায়লা!
—না থাক খোকা।
আগের তানভীর হলে বলতো,ঠিকাছে।কিন্তু এই তানভীর পুনমের জন্য বদলে যা-ওয়া তানভীর। যে ভয় পায় না কাউকে।
—-মা তুমি যাবে,কেউ তোমার শরীরে আর হাত তুলতে পারবেনা।এই তোমার ছেলে তোমায় ছুঁয়ে বলছে।তোমার খোকা দায়িত্ব কিভাবে নিতে হয় শিখে গেছে…
—–তুই প্রেমে পড়েছিস খোকা…
তানভীর ঠোঁট কামড়ে লাজুক ভাবে হাসে।মায়ের হাত ধরে বলে,—–তুমি কিভাবে বুঝলে?
—-অনেকের জীবনে প্রেম হলো পায়ে শিকলের বেড়ির মতন।আর অনেকের জীবনে প্রেম আশির্বাদ হয়ে আসে।যেন সম্পর্কের আকাশে উড়ন্ত পাখিদের মুক্তির গান! বাধভাঙা, নিয়মভাঙা বেপড়োয়া প্রেম সবার জীবনে আসেনা, যার ক্ষেত্রে আসে সে সকল নিয়মভেঙে প্রেমে পড়ে!
তোর জীবনে এসেছে।তোর চোখেমুখে সেই প্রেমের বিদ্যুৎ বিচ্ছুরণ আমি দেখতে পাই খোকা।সেই মেয়ে তোকে বদলে দিয়েছে।
—-মা খুব নিষ্ঠুর তোমার বউমা।আমার হতে সে চায় না।
—-তাতে কি হয়েছে তুই তো নিয়ম ভাঙা,বেপরোয়া প্রেমিক। ডাইরেক্ট তুলে নিয়ে এসে তোর ঘরে বন্দি করে রাখবি।তোর না হয়ে যাবে কোথায়…বলে হেসে ওঠে মা।
তানভীর সঙ্কিত চোখ বলে,
—-যদি রাগ করে, যদি অভিমান করে বসে। আমার ঘরে যদি থাকতে না চায়…..
—-তবে খুব ভালোবাসবি।ভালোবেসে রাগ অভিমান সব মুছে দিবি।পারবি না?
—-পারবো খুব পারবো।
—–মাকে দেখাবিনা সেই সাহসী মেয়েটিকে।
—–দেখাবো যেদিন আমার সকল কেনর উত্তর তুমি দিবে।
—-তবে তাই সই। তবে তার নাম কি?
—-পুনম…….
*******************
মায়ের ডাকে পুনমের ঘুম ছুটে যায়।কি সুন্দর শান্তিতে একটু ঘুমাচ্ছিল তাও পারবে না।আর তিনদিন পর ঈদ।সব টিউশন বন্ধ তাই একটু ঘুমাচ্ছিল তাও যদি পারে।
মুখের উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে চেচিয়ে বলে ওঠে পুনম,
—-কি হয়েছে মা? এত ডাকছ কেন?
মায়ের চোখে মুখে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। পুনম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে, —এত কাচুমাচু কেন করছো?কেন এত ভোরে ডাকলে সেটা বল না?
—তোর মেজ মামা এসেছে,জানিসই তো তার আলসারের সমস্যা রোজা রাখতে পারে নি….তাই
পুনম বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায় বিছানা থেকে। মায়ের কথা ফিতা কাটার মত মাঝখান থেকে কেটে দিয়ে বলে,
—–তোমার ভাইয়ের আলসারের সমস্যা থাকুক আর পা…….র সমস্যা থাকুক। আমার জানার দরকার নেই।এখন কি লাগবে সেটা বলো?
—-দু হালি ডিম আনবি আর নুডলস এর প্যাকেট।
—-কেন ঘরে বিস্কুট চানাচুর নেই? চা- দাও তাদের।এত আইটেম দেয়া লাগবে কেন?
—-তুই আর তোর বাবা আমার বাপের বাড়ির আত্মীয় দেখলে গায়ে ফোঁসকা পড়ে।তোর বাবা নাক মুখ কুঁচকে তাদের সামনে বসে আছে আর তুই এমন কথা বলতেছিস।
পুনমের মেজাজ সহসা চড়ে না।যখন চড়ে তখন হুশ থাকে না।ও রাগের সাথে বলে ওঠে,
—-কেন বলবো না এমন কথা? তোমার এই বাপের বাড়ির আত্মীয় স্বজন গুলো কোথায় থাকে সারা বছর? যখন রোগে পড়ে কাতরাও তখন আসে তারা?কোন খোঁজ খবর রাখে তোমাদের?আমার নানা তোমার নামে জমি দিয়ে গেলো তাও জোচ্ছুরি করে নিয়ে গেছে তোমার ভাইরা।বছরের এই দুই ঈদে আসে বোনের প্রতি দায়িত্ব দেখাতে।তোমার জন্য একটা কাপড় আর বাবার জন্য পাঞ্জাবি নিয়ে। তাদের বলে দিও এসব ফেতরা তোমাদের চাই না।তোমাকে কাপড় দেয় না বাবা?তাদের গুলো কেন লাগবে? এই কাপড় দেয়া পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব শেষ। সবগুলো স্বার্থপর!আমার বাবার অধিক টাকা নেই বলে যে তারা সবসময় নিচু চোখে দেখে তা তুমি দেখ না।মা তোমায় বলে দিচ্ছি আমি সব সহ্য করবো কিন্তুর বাবার অসম্মান সহ্য করবো না।

মা ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,—আমার ছেলে বেঁচে থাকলে তোর এত ঝামটা আমার সহ্য করতে হতো না।লাগবে না তোর বাজার।
—না লাগলেই ভালো। আর সব কিছুতে কেন আমাকে লাগবে তোমার।যখন দুই জামাইকে আদর করে খাওয়াও তখন তারা ছেলের মতন আর কাজের বেলা তারা জামাই হয়ে যায়, তাই না?বাসায় এতগুলা মানুষ থাকতে সবকিছুতে কেন এই পুনমকেই করতে হবে? বলতে পারো?
আর শুনো মা তারা দুটাকার জিনিস নিয়ে আসে আর বাবা যে তাদের হাতে টাকা দিয়ে দেয় কিছু কেনার জন্য তা তোমার চোখে বাজে না?শুধু শুধু চোখের সামনে কাঁদবা না।

এরই মধ্যে রুমে ঝুমা প্রবেশ করে।তল পেটে হাত দিয়ে বলে ওঠে পুনমকে,—হ্যা রে পুনু আমার কি হলো বলতো? কাল থেকে পেটে চিনচিন ব্যাথা করছে।তোর দুলাভাই তো বাবুর চিন্তায় খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিছে।আমায় একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি পুনু?

একেতো পুনমের মেজাজ খারাপ তার উপর মেজ আপার এই কথা তার আরো মেজাজ খারাপ করে দেয়। কি আশ্চর্য সে কি টাকার গাছ লাগিয়েছে।যে নাড়া দিলেই টাকা পড়বে?
—মেজ আপা তোর জামাইর যখন এত চিন্তা তখন তাকেই বল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে,আমাকে বলছিস কেন?
না হলে বাপের বাড়ি এসেছিস তোর বাবা, মা কে বল।
ঝুমার চোখ ছলছল করে ওঠে। একদম মায়ের মত স্বভাব।….তোর দুলাভাইর চাকরি নাই দেখেই তো তোকে বলছি না হলে কি বলতাম।
—-শোন মেজ আপা, মন দিয়ে খুঁজলে বাঘের চক্ষুও পাওয়া যায় তারপর তো চাকরি।চাকরি না পেলে ঠেলাগাড়ি ঠেলতে বল তোর জামাই কে…..বলে পুনম ওড়না মাথায় পেচিয়ে হাতে পার্স ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয় যায়।ওর রাগ লাগে,এত দায়িত্ব আর ভালো লাগে না।যেন সবই ওর ঠেকা।
সবার এত প্রয়োজন! অভাব গুলো বাক্স বন্দি করে রাখতে ইচ্ছে করে পুনমের।সবাই ওর কাছে বলতে পারে, ওর প্রয়োজন গুলো বলবে কার কাছে?কে আছে?
পাবনী ওয়াশরুমে বসে এতক্ষন সবই শুনতে পেয়েছে।সে বের হয়ে মাকে আর মেঝ আপাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
—রাগ করো না তোমরা।ওর মেজাজ ঠিক নেই। সারাদিন টিউশন করেছে আবার সারা রাত পড়ে সেহরি খেয়ে শুয়েছে তাই ঘুম হয় নি মা।তুমি কাঁচা ঘুম ভেঙে দিয়েছো তাই রাগ করেছে।আর ঠিকই তো বলেছে ও। ও একা কত দিক সামলাবে? এই যে বের হয়েছে দেখ মা তোমার বাজার নিয়েও আসবে আর আপা তোমার ডাক্তারের সিরিয়াল দিয়েও আসবে। ও মুখে যাই বলুক ওতো সবই করছে আমাদের জন্য।

বাসায় ডিম নুডলস আর কিছু সবজি পাঠিয়ে দিয়ে ও এক্সিম ব্যাংকের দিকে হাঁটা শুরু করে।একটা স্টুডেন্ট ডিপি এস করেছিল।যখন যা পারতো টাকা রাখতো। এখন দেখতে হবে সেই একাউন্টে কত টাকা হয়েছে? ও চেয়েছিল কিছু টাকা উঠিয়ে একটা ভালো টাচ ফোন কিনবে। তা আর হলো কথোয়?এত অভাবের ভিতর আবার শখ! ও ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ক্লিনিকের রিসিপশনে ফোন দিয়ে একটা গাইনী বিভাগে আর একটা অর্থোপেডিক্সের ডক্টরের সিরিয়াল নেয়।কাল রাতে সেজ আপাকে পায়ে ওড়না বেঁধে ঘুমাতে দেখেছে।হয়তো পায়ের ব্যাথা বেড়েছে কিন্তু আপা তো মুখ ফুটে কখনোই তা বলবে না।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here