পুনম,পর্বঃ১৪,১৫
আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৪
পড়ন্ত বিকেলের শেষ তখন,চারদিকে আলো অন্ধকারের মিশেল!আর কিছুক্ষণ পরই পৃথিবীতে ঝপ করে রাতের আধার নামবে।সেই পড়ন্ত সন্ধ্যার সন্ধিক্ষণে তানভীর মুগ্ধ হয়ে দেখছে ঘুমন্ত পুনমকে।এত মায়া কেন এই মুখে? প্রথম যেদিন এই মুখ দেখেছিলাম সেদিনই এই মায়ায় আটকে গেছি, আর সেই মায়া প্রখর ভালো লাগায় পরিণত হলো সেদিন যেদিন এই মেয়েটিকে তার বাবার হাত ধরে হাঁটতে দেখেছিলাম।সন্তানরা বড় হলে পিতা মাতার সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হয় বিশেষ করে বাবার সাথে। আর সেখানে পুনম যতক্ষণ তার বাবার সাথে ছিল বাবার হাতটি অবুঝ ছোট্ট মেয়ের মত ধরেছিল যেন ছেড়ে দিলে হারিয়ে যাবে সে! আর যেদিন দেখলাম ঝুম বৃষ্টিতে পুনম তার নিজের ছাতা এক অসহায় বৃদ্ধ ভিক্ষুকের হাতে দিয়ে নিজে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরেছিল সেদিন আমার ভিতরের ঘুমন্ত হৃদয়টা বারবার বলছিল, এই মেয়েটিকেই আমার চাই! খুব করে চাই!
তানভীর ঘুমন্ত পুনমের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের জন্য অবাক হয়।তার জীবনের উনত্রিশটা বসন্ত চলে গেলো কিন্তু কোন মেয়ে তাকে এভাবে বসন্তের বাতাসে রাঙিয়ে দিতে পারে নি।বাবার টাকা পয়সার জন্য হোক বা নিজের লুকের জন্য হোক কত মেয়ে তার জন্য প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে কই কেউতো এভাবে হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায় নি। কই কারো জন্য তো এভাবে হৃদয় তোলপাড় হয়নি… সবসময় কেন পুনমি পুনমি করে বুকের ভিতরটা… কেন এই মেয়েটিকে একটু সুখ দেওয়ার জন্য পুরো পৃথিবীর সাথে লড়তে মনে চায়….কেন এই মেয়েটির জন্য সকল শাস্তি মধুর লাগে…কেন গোমড়া মুখো এই মেয়েটির মুখে হাসি ফুটাতে মনে চায়….কেন মেয়েটিকে এক নজর দেখার জন্য চোখদুটো বারবার বেহায়া হতে চায়….. কেন এই মেয়েটির জন্য বেপরোয়া হয়ে সকল দূর্বলতার বিরুদ্ধে লড়তে মনে চায়…. কেন কেন কেন?
এত কেনর কি শুধুই একটি উত্তর… ভালোবাসি! তবে এই ভালোবাসাই আমার নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে হোক! এই সুখেই আমার মরণ হোক!
তানভীর ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে এসে পুনমকে আবার ডাকে,……পুনমি, এই পুনমি…
পুনম গভীর ঘুমে অবস্থায় শুনতে পায় কেউ তাকে ডাকছে, পুনম কপাল কুঁচকায়,নড়েচড়ে ফের আবার ঘুমায়….
তানভীর হেসে ওঠে,তার ইদানীং পুনমের সাথে প্রচুর দুষ্টামি করতে মনে চায়।এই যে নড়েচড়ে পুনম ঘুমাচ্ছে ওর গলার কাছে ওড়না সরে গিয়ে একটা কালো তিল দেখা যাচ্ছে।তানভীর না চাইতেও ওর দৃষ্টি বারবার সেদিকে চলে যাচ্ছে। ওহ মাই গড!কি ভয়ংকর!
দুষ্টু বাতাসে পুনমের কপালের চুল এলোমালে ভাবে গালের সাথে লেপ্টে রয়েছে। তানভীর অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে দেয়।নাকের উপর মুক্তোর মত বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে রয়েছে।তানভীরের হিংসে হয়! সে কেন এভাবে ছুঁয়ে দিতে পারে না তার পুনমকে।পরক্ষণেই মনে হয় সত্যিই কি পুনম আমার? এই অদৃশ্য অধিকারবোধ কবে তৈরি হলো তার?
তানভীরের সবথেকে পছন্দ হলো পুনমের কপালে টিপের মত ছোট্ট কালো তিলটা।এই কালো বিন্দুটি পুনমের সৌন্দর্যকে আকর্ষনীয় করে তুলেছে!অবাধ্য মনটা চাইছে তিলটাকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিতে! তানভীরের বিবেক স্বত্বা বলে ওঠে, তুমি কি দিন দিন বেহায়া হয়ে যাচ্ছো না? আমার তো মনে হয় তোমার চরিত্রে ঘাপলা আছে…
তানভীরের মন নামক স্বত্বাটি এই কথার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তার মতে, পৃথিবীর সকল প্রেমিকই একটু আধটু বেহায়া!কিছুটা বেহায়া না হলে প্রেমিক হওয়া যায় না!
আজানের সময় হয়েছে, রাজু ইফতারি দিয়ে গিয়েছে।পুনম কিছুতেই উঠছেনা।তানভীর জোরে জোরে ডাকে, পুনমের ঘুম হালকা হয়। তানভীর বুঝতে পেরে দুষ্টমি করে বলে ওঠে, —- এই পুনমি তুমি কি উঠবে? নাকি আমি চুমুবর্ষিত করে উঠাবো….
পুনম তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বলে,
—-না, না, প্লিজ চুমু দিবেন না।
তানভীর হো হো করে হেসে ওঠে,ঘুম ঘুম চোখে ভয় নিয়ে পুনম বোকার মত তাকিয়ে আছে তানভীরের দিকে। তানভীর আবার বাকহারা হয়, ঘুম থেকে উঠলেও বুঝি কাউকে এত সুন্দর লাগে?
পুনমের ঘোর এখনো পুরোপুরি কাটেনি।পুনম এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে চারপাশে চোখ বুলায়।সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আর তার সামনে বল্টু নয় তানভীর বসে আছে আর মিটিমিটি হাসছে।পুনমের নিজের প্রতি রাগ লাগছে,উহু রাগ নয় লজ্জা লাগছে। কি একটা কাজ তার দ্বারা হয়ে গেলো? ও কি না শেষমেষ এই উজবুকের কোলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিল….ইয়া আল্লাহ!
পরক্ষণেই নিজেকে সামলে কঠিন চোখে তাকিয়ে তানভীরকে প্রশ্ন করে,
—–আপনি এখানে কেন? আর বল্টু কোথায়?
তানভীর উত্তরের বদলে পুনমের হাতে একটি ছোট চিরকুট ধরিয়ে দেয়….
“”””” স্যরি দোস্ত, রাগ করিস না।তোর শরীর টা যে ভালো ছিল না তা আমি দেখেই বুঝেছি,তুই আমার কাঁধের উপর ঘুমিয়ে পড়েছিলি।এতটা ক্লান্ত তুই কবে হলি? বাদ দে, তানভীর ভাইয়ের উপর রাগ করিস না।সে তোর সাথে মিট করতে চাইছিল তাই আমি তাকে আসতে বলি আর এসে সে তোকে ঘুমে দেখে।এবং তোকে জাগাতে নিষেধ করে। আর আমাকে তুই বন্ধু কম ভাই মনে করিস বেশি সেই দাবীতে বলছি, তানভীর ভাই খুবই ভালো মানুষ! তাকে উপেক্ষা করিস না পুনু…লাইফে সঠিক মানুষ একবারই আসে আর তাকে অবহেলা করতে নেই।
এগেইন স্যরি আন্ধার রাইত।মাইর খাওয়ার জন্য বান্দা সদা প্রস্তুত…. “”””
উফফ এই ছেলে শেষে কিনা তার বন্ধুকেও হাত করে নিল!
পুনমের অস্বস্তি হয়, বাবা আর বল্টু ছাড়া কোন পুরুষের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেশেনি আর সেখানে কিনা ও মি. তানভীরের….. উফফ ভাবতেই কেমন অদ্ভুত লাগছে! বল্টু ঠিকই বলেছে, এ বেটা আসলেই কচ্ছপ…
পুনম লক্ষ্য করে তানভীর তার দিকেই তাকিয়ে আছে,পুনম ভুরু নাচিয়ে ইশারায় জানতে চায়, কি…
—–পুনমি, ঘুমিয়ে থাকলে কি তোমার নাক ঘামে?
পুনমকে ফের একরাশ অস্বস্তি ঘিরে ধরে,বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করে,হাঁসফাস লাগে সবকিছু! এ কেমন প্রশ্ন? এটা ঠিক যে শীত বা গরম নেই সকল সময়ে তার ঘুমন্ত অবস্থায় নাক ঘামে। ফের পুনম নিজেকে সামলে বলে ওঠে , —আমায় ফিরতে হবে,বাবা চিন্তা করবে।
—-ইফতার করে তোমাকে পৌঁছে দেবো।চিন্তা করো না।
—-আমি একাই যেতে পারবো,ধন্যবাদ।
—-আমার দায়িত্ব নিশ্চয়ই আমি পালন করবো পুনমি?
—-কথায় কথায় এত পুনমি পুনমি করবেন না।মাই নেইম ইজ পুনম,অনলি পুনম।আর আমার আর আপনার মধ্যে দায়িত্ব শব্দটা কেন আসবে? আর আপনাদের মত নবাবপুত্রেরা দায়িত্ব শব্দের অর্থ বুঝেন?
তানভীর কোন জবাব দেয় না।আজানের ধ্বনিতে চারপাশে মুখরিত হয়।আজানের শব্দে পুনম ওড়না উঠিয়ে ঘোমটা দেয়।তানভীরের কাছে পুনমকে দেখতে বউ বউ লাগে। তার চোখে পুনমকে অপার্থিক লাগে।যেন স্বর্গ থেকে নেমা আসা কোন জান্নাতি হুর! তানভীর জুসের প্যকেটটা বাড়িয়ে দেয় পুনমের দিকে। দুজনেই ইফতার করে চুপচাপ। যেন হটাৎ করেই চারপাশটা ভুতুরে লাগে। তারা উঠে দাঁড়ায় গাড়ির দিকে হাঁটা ধরে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে পুনম সামনে হাঁটছে আর তানভীর পিছনে। আর তখনই পিছন থেকে তানভীর পুনমের হাত ধরে। পুনম জিজ্ঞেসা দৃষ্টি নিয়ে ফিরে তাকায়।তানভীর কয়েক পা হেঁটে পুনমের কাছাকাছি চলে আসে, হাতের মুঠোয় তখনও পুনমের হাত শক্ত করে ধরে রাখা।মায়াবী চোখের তাকিয়ে তানভীর ঘোরলাগা কন্ঠে বলে ওঠে,
—–তুমি এত সুন্দর কেন হলে পুনমি? দেখো মেয়ে,এই পূর্নিমার আলোতে আমার মরণ যেন না হয়!
পুনম কেঁপে ওঠে, এতকাছ থেকে এই ছেলে কথা বলছে যে তার গরম নিঃশ্বাস পুনমের সাড়া মুখে আছড়ে পড়ছে।চোখদুটো আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেছে পুনমের,পায়ের পাতা থরথর করে কাঁপছে, চারপাশে বাতাস থাকা স্বত্বেও পুনমের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে! পুনম বুঝতে পারছে তার বড্ড ভুল হয়ে গেছে।ও আসলে বুঝতেই পারেনি তানভীর নামক মানুষটিকে, বিশাল বড় আন্ডার ইস্টিমেট করে ফেলেছে।এই ছেলে উজবুক বা গাধা নয়…. এ বড় চালাক লোক…. তবে পুনমও কম যায় না।সে অতিদ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে তানভীরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
—-ভীতু বিড়াল থেকে বাঘ হওয়ার শখ জেগেছে নাকি মি. তানভীর…..
তানভীর কথা শুনে মুচকি হাসে,আর একটু কাছঘেঁসে দাঁড়ায় পুনমের,
—–কে বলেছে বাঘ হতে চাই?আমি তো সিংহপুরুষ হতে চাইছি! বুঝেছেন পুনমি…..বলে পুনমির মুখের সামনে পড়ে থাকা ক’গাছি অবাধ্য চুল ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে হনহনিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটা দেয় তানভীর। আর পুনম বোকার মত স্তব্দ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে!
রাজু তার স্যারের আলাপন শুনতে না পেলেও দেখতে পেল সবকিছু।তার নিজেকে অসহায় মনে হতে লাগলো। তার স্যার কিনা শেষে প্রেমে পড়েই গেলো।তারিন ম্যাডাম যে ভুল করলো সেই একই ভুলে কিনা তার স্যারেও জরিয়ে পড়লো আর সে কিছুই করতে পারলো না….এসব ভেবে রাজুর চোখ ভিজে আসে। সে টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে মনে মনে অভিশাপ দেয় পুনমকে……
*********************
পুনম যখন বাসায় ফিরে তখন পুনম পুরোপুরি মানসিক ভাবে ভিতর থেকে বিধ্বস্ত। চুপচপা বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ভাবনায় ডুবে যায়। কি করবে পুনম? এত এত দায়িত্ব সামনে?আর সেখানে তানভীর নামক নতুন অনুভূতিকে গ্রহণ করা তার পক্ষে অসম্ভব।আর তানভীরের পরিবার?আর তাদের পরিবেশ ও পুনমদের পরিবেশ যে সম্পূর্ণ আলাদা। এই অসম সম্পর্কের কি চাইলেও কোন নাম দেয়া যায়? শুধু ভালোবাসা দিয়ে একসাথে থাকা যায় না, যদি সম্মান না থাকে।উচু স্তরের সমাজ কখনো নিচু স্তরের সমাজকে সম্মানের সহিত গ্রহণ করে না। আর সমাজ বাস্তবতার কাছে হেরে যায়। পুনম বাস্তবতা জানে।বাস্তবতা বড় কঠিন!হয়তো অনেকই বলবে, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে ভালোবাসাই যথেষ্ট কিন্তু শুধু ভালোবাসাই যদি যথেষ্ট হতো তবে এত ভাঙনের গল্প কখনোই সৃষ্টি হতো না।
কিন্তু বুকের ভিতর নড়েচড়ে প্রতিবাদ করে ওঠে মন নামক স্বত্বাটা। কিছু অবাধ্য অনুভূতিকে পশ্রয় দিতে চায়।পুনম চোখের পাতা বন্ধ করে।চোখের কোন ঘেঁসে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এ কান্না কিসের?পূর্ণতার নাকি অপূর্ণতার?সুখ নাকি দুঃখের?পুনম জানে না….আর পুনম জানতেও চায় না!
মরিচা এসে খবর দিয়ে যায়, তাকে বাবা ডাকছে। পুনম ফ্রেশ হয়ে যখন বাহিরে নামে তখন দেখতে পায়, উঠোনে বড় মাদুর পাতা হয়েছে সেখানে সবাই বসা।মরিচা আর লাবণ্য মিলে কাঁচা আম তেল মরিচ লেবু পাতা লবন দিয়ে মাখানোর ব্যবস্থা করছে।কাঁচা আমের ঘ্রাণে চারপাশ মোঁ মোঁ করছে।সুমন ভাইয়ের কোলে ইষ্টি মিষ্টি বসে আছে।আর বাবা তার দুই নাতনিকে গল্প শুনাচ্ছে।বড় আপা বড় দুলাভাই মোড়া পেতে বসে আছে।মেজ আপা দুলাভাইয়ের হাত ধরে বসে আছে। সেজ আপা মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।মা হালকা ভাবে আঙুল নেড়ে সেজ আপার মাথায় বিলি কাটছে। কি সুন্দর পরিবেশ….পুনমের সকল খারাপ লাগা দূর হয়ে যায়।তার কাছে তার পরিবার সবার আগে।পুনম ভালোবাসে এই মানুষগুলোকে, তারা যেমনই হোক না কেন? বাবা হাতের ইশারায় পুনমকে কাছে ডেকে পাশে বসতে বলে। পুনম বাবার কাঁধে মাথা রেখে ডান হাতটা জরিয়ে রাখে।বাবা হাসে!স্নেহময় হাসি!পুনমের মনে হচ্ছে সারা উঠোন জুরে সুখেরা লুটোপুটি খাচ্ছে। মধ্যবিত্তদের স্বচ্ছলতা,বিলাসিতা কম থাকলেও তারা অল্পতেই সুখী হতে জানে।
পুনম আবদারের সুরে বলে, —–সেজ আপা একটা গান গাও না…..
সবাই অনুরোধের সুর তোলে।সুমন আকুলতা নিয়ে চেয়ে থাকে পাবনীর মুখপানে।এই শান্ত মুখের মায়া তাকে বেঁধেছে এবার না হয় কোকিল কন্ঠের সুর দিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে রাখুক।
পাবনী সুললিত কন্ঠে গান ধরে।
—-দূর দ্বীপবাসিনী, চিনি তোমারে চিনি।
দারুচিনিরও দেশে………
চলবে,
#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৫
গত কাল থেকেই বৃষ্টি ভেজা প্রকৃতি।রোদের তাপদহনে অতিষ্ট শহর যেন বৃষ্টির পরশে স্বস্তি পাচ্ছে।কিছু মানুষের জন্য এই বৃষ্টি হলো খিচুড়ি আর ইলিশ উদযাপন আর দিনভর কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানো বা কারো জন্য বৃষ্টি বিলাস আর সাথে চায়ের পেয়ালায় রোমান্টিক মুহুর্ত! আবার কারো জন্য স্বস্তি তো কারো জন্য দূর্ভোগ।সবাই বৃষ্টি বিলাস করতে পারে না ঘরে বসে, কর্মের জন্য বের হতে হয় তখন তাদের জন্য বৃষ্টি মানেই ঝামেলা!
সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। পুনম লাবণ্য আর মরিচাকে নিয়ে মার্কেটের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে।একই রিকশায় ওরা তিনজন উপর নিচ করে বসেছে।আজ শুক্রবার তাছাড়া এক সপ্তাহ পর ঈদ,বাসার সবার জন্য ঈদ মার্কেট করার উদ্দেশ্যে এই যাত্রা। লাবণ্য আর মরিচা বিরতিহীন কথা বলছে।পুনমের কপাল কখনো বিরক্তিতে কুঁচকে আসে আবার কখনো ওদের কথা শুনে মুচকি হাসে।মরিচা শহরে আসার পর পুরাই বদলে গেছে আর লাবণ্য যেন তার কথার মেশিন চালানোর জন্য যোগ্য একজন মানুষ পেয়েছে।
পুনম প্রথমে লাবণ্যর জন্য ড্রেস কিনতে যায়…বাড়ির সব চেয়ে ছোট সদস্যদের ঈদের প্রতি আগ্রহ থাকে বেশি।ইষ্টি মিষ্টি যদিও ছোট কিন্তু লাবণ্যর আগ্রহ সবচেয়ে বেশি।
লাবণ্য একটার পর একটা ড্রেস দেখছে কোনটাই তার পছন্দ হচ্ছে না।পুনম ধমক দিয়ে বলে,
—–আহা লাবণ্য এসব কি? এর জন্যই বাবা তোকে নিয়ে মার্কেটে আসতে চায় না…
লাবণ্য ভেংচি কাটে।মনে মনে বলে, হুহ! ঈদ ছাড়া দামী ড্রেস কেনা হয় নাকি…ওর সবচেয়ে বেস্টটা দরকার।
দোকানী কাচুমাচু মুখ করে চেয়ে থাকে পুনমের দিকে, এপর্যন্ত গোটা বিশেক জামা দেখিয়ে ফেলেছে এই মেয়েকে কিন্তু কোনটাই তার পছন্দ হচ্ছে না।
মরিচা পাশ থেকে বলে,–ও ছুডু আফা, আমনে না কইলেন ছরারা ডেস নিবেন… আর ও ভাই আমনে খাম্বার মত খারাইয়া রইছেন কে?ছরারা দেহান আমার আফারে।ওই যে পায়ের দারে ফের আলা ডেস…..
—- মরিচা বু ছরারা না,সারারা ড্রেস হবে।তুমি ঠিক করে কেন কথা বল না।
—-যা ছরারা তাই ছা–রারা।
লাবণ্য অনেক বেছে গোলাপি আর সাদার মিশ্রনে একটা ড্রেস পছন্দ করে।পুনমের চোখ জুরিয়ে আসে।তার বোনটাকে সবাই কালো বলে অথচ তারা কি জানে শ্যামবর্ণের এই মেয়েটি যে একটা মায়াবতী!হাসলে মনে হয় পুরো পৃথিবী হাসছে! দোকান থেকে বের হওয়ার সময় লাবণ্যের মুখটা খুশিতে জ্বলজ্বল করে… পুনম মরিচার জন্যও একটা গোলাপি রঙের থ্রি-পিস কেনে।লাবণ্য খুশিতে বলে ওঠে,
—ঈদের দিন আমরা একই রঙের ড্রেস পড়ব মরিচা বু।খুব মজা হবে।
মরিচার অতি খুশিতে চোখ ছলছল করে, এই মানুষ গুলা এত ভালা কেন?
—- ও হাইজা আফা মেন্দি নিবেন না।
পুনমের এই মানুষগুলোর মুখে হাসি দেখে ভালো লাগে।ওর কষ্ট সার্থক মনে হয়…
—-অবশ্যই নিব।তোমার আর কিছু লাগবে মরিচা?
মরিচা কাচুমাচু করে, মিন মিন করে বলে,দু মুঠ চুড়ি লাগবো হাইজা আফা…ওই যে রেশমি চুড়ি…হাডলেই কি সুন্দর ঝুনঝুন আওয়াজ দেয়….
—-আমিও কিন্তু নিব মরিচা বু… লাবণ্যের আদুরে আবদার। ড়
পুনম অন্য দোকানের দিকে হাটা শুরে করে,ও হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পায় পিছনে কুটুর কুটুর করে ফিসফিসিয়ে কথা চলছে দুজনের মধ্যে। যার টপিক হচ্ছে ঈদের দিন কিভাবে সাজবে আর কিভাবে মেহেদী দিবে।পুনম ফিরে ধমক দেয়, জোরে পা চালাতে বলে কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না….
অনেক ঘুরে পুনম মায়ের জন্য তাতের শাড়ি,ইষ্টি মিষ্টির জন্য একই ডিজাইনের টকটকে লাল দুটো ফ্রক, দুলাভাইদের জন্য পান্জাবী, বড় আপার জন্য এপ্লিকের কাজ করা একটা কাপড় আর মেজ আপার জন্য একটা একটা কমলা রঙের শাড়ি কিনে। মেজ আপা নিশ্চিত কমলা রঙের কাপড় দেখে খুব খুশি হবে…আর মেজ আপার মতে, তার বরও নাকি তার দিকে গাধার মত চেয়ে থাকবে কমলা রঙের শাড়িতে তাকে দেখে……
বাহিরে তখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।কাঁচের দরজা ঠেলে পুনম বাটার শো রুমে প্রবেশ করে।অনেক বেছে ১৮৫০ টাকা দিয়ে বাবার জন্য একজোরা জুতা কিনে পুনম।খুব যত্নের সাথে পুনম জুতার খোলের উপর হাত বুলায়।ওর চোখ ছলছল করে ওঠে।সেদিন বাবার জুতোর পায়ের গোড়ালির অংশের কাছ থেকে একটা ফুটো দেখেছে পুনম।জুতার সেই ছোট্ট ফুটো পুনমের মস্তিষ্কে খুব করে আলোড়ন তুলে ছিল…হু হু করে উঠেছিল বুকের ভিতরটা….বাবারা এমন কেন হয়? তাদের প্রয়োজন এত সীমিত কেন থাকে? কেন পুরানো পাঞ্জাবিই সব ঈদে তাদের কাছে নতুন লাগে? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তরে আমারা একটি কথাই জানি …”প্রত্যেক বাবা মানেই স্বভাবে খুব কৃপণ!তারা না কিনে দিতে জানে, না নিজে কিনতে জানে!” কত অভিযোগ?
***************
জামাল বসে বসে টিভি দেখছিল আর চা পান করছিল। সে রোজা রাখে নি কারণ তার স্ত্রী ঝুমা বাচ্চা হবে বলে রোজা রাখতে পারেনি।তাই সেও রাখেনি।জামালের স্বভাব হলো তার বউ যদি গু ভর্তা খায় তবে সেও গু ভর্তা খাবে। সেটা কিসের ভর্তা বা কেন খাবে তা তার জানার কোন দরকার নেই।
নিয়াজ উদ্দিন এসে সোফায় বসে।তাকে দেখে চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েও রেখে দেয় জামাল।রোজার দিনে রোজা রাখেনি বলে এই লজ্জায় সে চায়ের কাপ রাখে নি, রেখেছে কারণ সে চা পান করার সময় গড়গড় শব্দ হয়। যা শশুড়ের সামনে করা শোভা পায় না।এতটুকু জ্ঞান তার আছে।
—–তা জামাল তোমার চাকরির কি খবর?
—এই তো চেষ্টা করছি আব্বা।
নিয়াজ উদ্দিন বিড়বিড় করে বলে, তা তো দেখতেই পাচ্ছি তোমার চেষ্টা… হাত পা গুটিয়ে আমার মেয়ের কোলে বসে চাকরি খুঁজার চেষ্টা… গাধা!
—-চেষ্টা চরিত্রটা একটু জোর দিয়ে করো বাবা। এখন যে বাবা হচ্ছো সে কথা মাথায় রেখো।
—জ্বি, আব্বা।ঝুমুর টেনশনে তাকে একা ছেড়ে যেতে পারি না, নইলে….
—–আমরা আছি,তোমার বউ আমার মেয়ে। তাই ফালতু টেনশন করো না।ভবিষ্যতের টেনশন করো।বুঝেছো?
—-জ্বি আব্বা।
—-নাও এখন চা খাও।চা ঠান্ডা হলে আর খেয়ে স্বাদ পাবে না….বলে উঠে রুমের দিকে চলে যান নিয়াজ উদ্দিন। তার শান্ত মেজাজ বিগড়ে গেছে এই গাধার জন্য।
সালেহা বেগম বিছানায় বসে গুনগুন করে কোরআন পড়ছে।স্বামীকে রুমে ঢুকতে দেখে কোরআন পড়া থামাতে গেলে নিয়াজ উদ্দিন চোখের ইশারায় না করে।বিছানার অপর পাশে শুয়ে স্ত্রী কোরআন পড়া শুনতে থাকে চোখ বন্ধ রেখে।কোরাআন পাঠ শুনলে বুকটা প্রশান্তিতে ভরে আসে।
—-মা আসবো? দরজার ওপাশ থেকে রুমা বলে ওঠে।
সালেহা কোরআন শরীফ বন্ধ করে একপাশে রেখে তার বড় মেয়েকে আসতে বলে।
রুমা এসে মায়ের কাছে বসে বলতে শুরু করে,
—–মা জিজ্ঞেস করতো বাবাকে, সে কোন আক্কেলে পুনমকে টাকা দিয়ে ঈদের মার্কেট করতে পাঠায়। আমি তো বড় আমাকে দিলে কি হতো।এখন যদি সস্তার জিনিস নিয়ে আসে বা পছন্দ না হয় তোমার জামাইর তবে তোমার জামাইর কাছে আমি ছোট হবো না বলো?
সালেহার উত্তর দেয়ার আগে নিয়াজ উদ্দিন বলে ওঠে,
—তোমার বাবার সামর্থ্য যদি থাকে দু টাকার তবে তুমি আমার মেয়ে হিসাবে তা হাসি মুখে গ্রহণ করা উচিত।
—বাবা তুমি এভাবে বলছো কেন? পুনম সম্পর্কে কিছু বললেই তুমি কেন সহ্য করতে পারো না।
—-শোন রুমা,আমার পুনম সম্পর্কে কোন কথা তোমরা বল না।শুধু তারই দায়িত্ব আমার প্রতি তোমার নেই।মাত্র পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছে সে আমার কাছ থেকে অথচ দেখো গিয়ে তোমার ছোট বোনই কেনা কেটা করেছে কত টাকার।আর সব টাকা আমার মেয়ের।কোথায় পেয়েছে জানো?রাত দিন টিউশন করিয়ে, কোচিং করিয়ে, বাড়তি টিউশন করে।তারপরও তুমি বলছো, পুনম সস্তা জিনিস কিনবে? তুমি বড় স্বার্থপর রুমা।কিসের এত রাগ তোমার পুনমের প্রতি।তুমি কেন ভুলে যাও সে তোমার ছোট বোন।
রুমা জবাব দেয় না কোন বাবার কথার কিন্তু মায়ের দিকে রাগান্বিত চোখে চেয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
সালেহা বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে,
—-মেয়েটাকে এভাবে না বললেও পারতেন।নাইওরি এসেছে ওরা।দুদিন পরতো চলেই যাবে।
নিয়াজ উদ্দিন কঠিন চোখে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলেন,
—–তুমি চুপ থাক নির্বোধ মেয়ে মানুষ। পুনমের মুখের দিকে তুমি তাকিয়ে দেখেছো? মেয়েটা যে ভালো নেই তা কি তুমি জানো? কেমন মা তুমি?
সালেহা স্বগোতক্তি করে, আমার হয়েছে যত জ্বালা!
চলবে,