পুনম,পর্বঃ২৬,২৭
আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৬
পাবনী ছাদের ফুলগাছ গুলোতে পানি দিচ্ছে।সাথে গুনগুন করে কিন্নরকণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীতের সুর…..
পাবনীর মনটা আজ খুব খারাপ। অবশ্য পাবনীর মন কোনদিনই ভালো থাকেনা।মন খারাপের মাত্রা কোনদিন বেশি কম।এই যা!
আজকের মন খারাপের কারণ হলো সুমন ভাই। কেন যেন পাবনীর মনে হচ্ছে…. সুমন ভাই তার সাথে রাগ করে কুমিল্লা চলে গেছে…..ফুলগাছে পানি দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে ওর নজর ছাদের চিলেকোঠার দিকে যাচ্ছে….
এমনটা হবার কথা নয়…তবুও হচ্ছে! এর জন্য পাবনীর একদিকে মেজাজ খারাপও হচ্ছে…. আর একদিকে বিষন্ন লাগছে!
নিয়াজ উদ্দিন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে….
—-পাবনী
—জ্বি বাবা!
—তোমার কি কোন কারণে মন খারাপ?
পাবনী বাবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে।যার মানে তার মন খারাপ না!
তিনি অবাক হলেন না।এই মেয়ে অসম্ভব রকমের চাপা স্বভাবের। নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগা খুব সহজেই চেপে রাখতে পারে।পুনম নিজের কষ্টের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে কিন্তু পাবনী নিজের কষ্ট চেপে রাখে!
—তোমার উচিত আবার পড়াশোনা শুরু করা।
—লেখা পড়া ভালো লাগে না বাবা।
বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে।
পাবনী বুঝতে পারে বাবা রেগে যাচ্ছে… কিন্তু ওর নিজের কি করার আছে?পড়াশোনা ভালো লাগে না এটা মিথ্যে কথা। কেননা পাবনী লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল….
কিন্তু স্কুল কলেজে এতটা বুলিইং শিকার হয়েছে পাবনী যা ওর মনোবলে প্রচুর আঘাত করেছে।সেই ভাঙা মনোবল কখনো জোড়া লাগেনি!পাবনীর চোখে জল এসে যায়….ভার্সিটিতে পড়ার সময় ওকে অনেকেই পিশাচী বলে ডাকতো ওর পায়ের জন্য! ওর ডান পা কিছুটা বাঁকানো, যা নাকি পিশাচীনীদের হয়!এরপর থেকে পড়াশোনা বন্ধ করে দেয় পাবনী।নিজেকে ঘরের চার দেয়ালের মাঝে বন্ধী করে রাখে।পাবনী কখনো পুনমের মত প্রতিবাদী হতে পারেনি।সবাই সব কিছু পারে না।যেমন পাবনী পারেনি….ছোটবেলা থেকে সবার কটু কথা শুনে পাবনীর ভিতরের স্বত্বাটা মরে গেছে!অনেকেই বলে লোকের কথায় কান দিতে নেই।কিন্তু যার উপর দিয়ে সেই লোককথা যায় শুধু সেই বোঝে কি অসহ্য যন্ত্রণামূলক কথার তীর বিদ্ধ করে তারা!
—-বাবা দেখেছো কত ফুল ফুটেছে আমার গাছে?
বাবার বুক ফুঁড়ে চাপা নিশ্বাস ছাড়ে।পাবনী কথা এড়াতে চাইছে।
—-আসলেই গাছ গুলো ভালো লাগছে দেখতে!লাবণ্যের থেকে ফুল সামলে রেখো।ফুলগুলো পুনম দেখলে খুব খুশি হতো।
—বাবা তোমার কি পুনমের জন্য খুব মন খারাপ লাগছে?
—হুম!
—আমারও!
********************
রুমা শব্দ করে চায়ের কাপ রাখে সুমনের সামনে।রুমার মন মেজাজ খুব খারাপ!হারুন কাল থেকে বাড়ি আসছে না। তার উপরে আবার এই সুমনের অত্যাচার… অসহ্য!
সুমন চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁয়েই নাকমুখ কুঁচকে ফেলে।চিনি দিয়ে শরবত বানিয়ে ফেলেছে চা!কাল রাতে বাসায় এসে পোঁছাইছে সুমন।খালিপেটেই ঘুমিয়ে ছিল।এখন সকালে নাস্তা খেতে এসে দেখে বুয়া লেট করে এসেছে তাই নাস্তা দিতে লেট হবে।তার বদলে চা চাওয়াতে এই বিদঘুটে চা জুটেছে ওর কপালে!পাবনীর হাতের চা পান করতে মন চাইছে সুমনের।মেয়েটা অসম্ভব ভালো চা বানায়।মনে হয় মেয়েটা চায়ের সাথে একচিমটি ভালোবাসা মিশিয়ে দেয়..না হলে এত সুস্বাদু চা হয় কি করে?
পাবনীর কথা মনে হওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে যায়। সেদিন এককাপ চায়ের বদলে কি কড়া কথাই না বললো?
সুমন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,….এর শাস্তি পাবনীকে সে দিবেই দিবে।বিয়ের পরে প্রতি দশমিনিট অন্তর চা বানানোর শাস্তি! তাতে যদি সুমনের ডায়াবেটিস হয়, হোক!তবুও পাবনীকে ছাড়বে না……
—-ভাবি তোমার গালে কি হয়েছে…..?হালকা দাগ পড়েছে কেন?
রুমা কথার জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।সুমনের অবশ্য তাতে মন খারাপ হয় না।ও হচ্ছে এই পরিবারের আগাছা… আর আগাছা হলো মূল্যহীন! মূল্যহীন মানুষের সকল কথার জবাব জানতে হবে এমন কোন কথা নেই!
************
রিসোর্টের নামি দামি কক্ষে শুয়ে আছে হায়দার হোসেন।শরীরের অর্ধভাগ নগ্ন!কোমড়ের কাছে একটা তোয়ালে পেচানো। হাতে ওয়াইনের গ্লাস….নেশায় বুদ! চোখের সামনে ভাসছে নারী দেহের অঙ্গ! উফফ! এই বয়সে এসেও হায়দার হোসেন কামুকতা কোন যুবকের থেকে কম নয়!
মুন্নি নামের মেয়েটি ওয়াশরুম থেকে ভীত মস্তকে এসে সামনে দাঁড়ায়! মেয়েটির শরীর কাঁপছে….চোখে জল এসে জমা হয়েছে!ছুটে পালিয়ে যেতে মন চাইছে।সামনের পুরুষটির চাহনি ওর শরীরের প্রতিটি ভাঁজ পর্যবেক্ষণ করছে…অসহায়! মুন্নি চরমতম অসহায়! টাকার কাছে ও হেরে গেছে!ওর সন্তানটি হসপিটালের বেডে পড়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে…. ওকে পারতেই হবে….সব পথ বন্ধ ওর!
হায়দার হোসনে হাসছে…বড় বিশ্রী সে হাসি! মুন্নি দুচোখের পাতা বন্ধ করে….দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে….
—কাম ডার্লি!কাম….
মুন্নি ধীরপায়ে এগিয়ে যায় বেডের দিকে…..এই নরম তুলতুলে বেডে আজ ওর সমাধি রচিত হবে…..
মুন্নি চোখ বন্ধ রেখেই টের পায়… ওর শরীরের কাপড় খুলে পড়ছে….একটা বৃদ্ধ হাত সারা শরীরে ঘুরপাক খাচ্ছে…. বড় জঘন্য সেই স্পর্শ! ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে মুন্নি…এতটা অসহায় হয়ে কেন পৃথিবীতে আসলো?…..
—-এই মা..* চোখ খুল! এত টাকা দিচ্ছি তোর নখরা দেখার জন্য….
মুন্নি তাকায়…আশ্চর্য! কোন পুরুষ নয়, ও নিজেকে যেন বেশ্যা রুপে দেখতে পায়!
*********
সালেহা বেগমের শরীরটা ভালো লাগছে না।হাত পা আবার ফুলে উঠেছে।হাত পায়ে পানি এসেছে….একটু আগে মরিচা সরিষার তেল গরম করে মেজে দিয়ে গেছে হাত পা…নিয়াজ উদ্দিনের ভয় হচ্ছে! কেমন নিস্তেজ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে সালেহা…
—ও পুনমের মা,তোমার শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?
সালেহা চোখ মেলে তাকান।স্বামীর ভীত চাহনি দেখে মৃদু হাসেন…
—-পুনম কবে ফিরবো?
—তোমার স্বভাব পাইছে তোমার মেয়েরা।কথা একটা কইলে উত্তর দেয় আর একটা!
—এখন আমার মেয়েরা…
—মুখে মুখে কথা বলবা না…শরীর ভালো না তোমার!
সালেহা চুপ হয়ে যান…এত বছরের সংসারে এই মানুষটাকে তিনি বুঝতে পারেননা….সবসময় বকাঝকা করবেন কিন্তু একটু অসুস্থ হলেই আবার বিচলিত হন…বড়ই আজব মানুষ!
—-পুনমের বাবা?
—হুম!
—না থাক…
—শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে? বলো চুপ হইয়া থাইকো না…
—-আপনেরে আমার একটা কথা বলা হয় নি….
—কি?
—-আপনেরে… গোঁফে পুরাই শজারুর মত লাগে!
নিয়াজ উদ্দিন বিরক্ত চোখে তাকান…মেজাজ খারাপ হয়!
সালেহা মুখের উপর কাঁথা চেপে হাসেন….নিয়াজ উদ্দিন উঠে পড়েন…অবশ্য যাওয়ার সময় সালেহার উদ্দেশ্য বলেন,বেক্কল মহিলা!
*********
মরিচা রাতের বেলা ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক দিয়ে ঘুরছে।ঝুমা অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে,
—-মাইজা আফা আমি আর ছুডু আফায় এখন টিকটক করুম…বুঝছেন…ওই যে গানের তালে নাচানাচি করা… সেই রহমের…
পাশ থেকে পাবনী বলে,
—কিছুদিন পর ওর পরিক্ষা আর এসব করে বেড়াচ্ছে… পুনম আসলে ওর কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে যেতে বলবো।
সে কথা শুনে মরিচা ভেঙচি কাটে…এরা সবাই ওর আর ছুডু আফার শত্রু…হুহ! এত পইড়া হইবো ডা কি?
লাবণ্য কোথা থেকে ছুটে আসে। পাবনী ঝুমা অবাক হয় দেখে….লাবণ্য পুরাই গ্রাম্য সাজ দিয়েছে….মেয়েটাকে ভালো লাগছে…শ্যামগায়ে বড় বড় চোখে কাজলের ছোঁয়া…মারাত্মক! দুপাশে বেণী, তাতে লাল ফিতা…ঠোঁটে লাল রঙ….কি সুন্দর!
—-মেজ আপা দুলাভাই কই?
—কেন?
—-উফফ! বলোনা।
—সে তো রুমে…
—মরিচা বু দুলাভাইরে ডেকে নিয়ে আসো….
কিছুক্ষণ পর দেখা যায়,
ড্রয়িং রুমে জামাল বসে আছে আর তার দুপাশে লাবণ্য আর মরিচা বসে টিকটক করছে……মোবাইলে গান বাজছে….
দুলাভাই, ও আমার দুলাভাই
চলনা সিনেমা দেখিতে যাই
সিনেমার নাম নাকি তোমাকে চাই
তোমাকে চাই দুলাভাই!
পাবনী আর ঝুমা এই দৃশ্য দেখে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে….আর জামালের অবস্থা পুরাই কাহিল!
*************
রাত এগারোটা বাজে….কক্সবাজার হোটেলের ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই….কাল চলে যাবে সবাই যে যার গন্তব্য স্থানে…এরপর আবার সেই ধরাবাধা ব্যস্ত জীবন!।
এক্সাম শেষ হলেই সবাই একটা জবের পিছনে হন্যে হয়ে ঘুরবে…বন্ধুত্বরের এই বন্ধনে তখন না চাইতেও দুরত্ব এসে যাবে!
এই দুটো দিন সবচিন্তা বাদ দিয়ে বন্ধুরা সবাই প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেছিল।সবারই মনটা খারাপ!যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তি দূর হয়েছে এখানে এসে পুনমের।প্রথমে আসতে না চাইলেও পরবর্তী সময়টা বন্ধুদের সাথে ভালো কেটেছে!
তানভীর বল্টুদের থেকে সিনিয়র হলেও এখানে এসে সবার সাথে ফ্রি ভাবে মিশেছে….সাকিবের হাতে গিটার টুং টাং শব্দ হচ্ছে… শিমুল বলে, সাকিব্বা গান ধর…চুপচাপ ভালো লাগে না। সবাই গাই বো….
সাকিব গিটারের তালে সুর তোলে সাথে নাহিদ গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে…সবাই হাত তালির সাথে কন্ঠ মিলায়,
আকাশে মস্ত বড় চাঁদ।পূর্ণিমার আলো আর হোটেলের ঝকমকায় আলোয় একদল ছেলে মেয়ের গাওয়া গানে অল্পতেই মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ….
ছোট ছোট কিছু টুকরো গল্পে বাঁধা
এলোমেলো কিছু স্মৃতিতে সাজানো
তুমি আমি আর ঐ হারামী সার্কেলটা
কিলো হেঁটে হেঁটে ভাবছি কত শত
টিনশেড ছায়া ছোট্ট টংটা ঘিরে
বসে মনে পড়ে ফেলে আসা দিনগুলো
ক্লাস, ড্রপ আর হাজারো গানের ফাঁকে
মামা, শুধু চা, নাকি আরও কিছু?
হুট করে ট্যুরে সবগুলো রেডি
বাসে গলা ছেড়ে কেউ জেমস, কেউ AB!
পরদিন টার্ম টেস্ট, আরে পেরা নাই
আগে ফটো আপলোড শেষ করি!
ক্লাস দিয়ে ফাঁকি
সিনিয়রের ঝাড়ি
সিজির গুল্লি মেরে রাতভর পার্টি
হঠাৎ কাউকে দেখে ক্রাশ খেয়ে ফিদা
পাশ থেকে ফ্রেন্ড বলে ওটা তোর ভাবি!
এই সেদিনই তো র্যাগ খেয়ে চুরমার
মা’কে ফোন দিয়ে “থাকবোনা আমি আর!”
আজ দেখি কেটে গেছে হাজারো দিন
খুব চাইলেও ফেরা তো যাবেনা আর!…….
সবার চোখে অজান্তেই জল এসে যায়।বন্ধুরা তো এমনই…
চলবে,
#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৭
শান্ত প্রকৃতি যখন অশান্ত হয় তখন পৃথিবীর নিজস্বতা এলোমেলো হয় যায়।তেমনি স্বভাবে শান্ত মানুষগুলো যখন রেগে যায় সে রাগ বড় ভয়ংকর হয়।বড় ভয়ংকর!
তানভীর রেগে আছে…এ রাগের সূত্রপাত কোথায় আর শেষ কোথায় তা পুনম জানে না। বর্তমানে পুনম বন্দী তানভীরের দুই হাতের মাঝে…. কি রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে মানুষটা! পুনমের হাঁসফাঁস লাগে!দৃষ্টি এলো মেলো হয়ে আসে ! পুনমের জিজ্ঞেস করতে মনে চায় কিসের এত রাগ আপনার?কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয় না। উদ্ভ্রান্ত কঠোর দৃষ্টিতে পুনম নিজেকে হারিয়ে ফেলে!
কিছুক্ষণ আগে আড্ডার মাঝখান থেকে হঠাৎই তানভীর উঠে যায়।আড্ডা শেষে পুনম দেখতে পায় তানভীর ফোন ফেলে গেছে।রাজুকেও দেখতে পায়না আশেপাশে। বল্টু রিমিকে নিয়ে ব্যস্ত..তাই পুনম নিজেই মোবাইল ফেরত দিতে আসে।আর সেই আসাই পুনমের কাল হয়।
ডোর নক করার পর তানভীর যখন দেখে পুনম দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে…তানভীরের হুট করেই অশান্ত মেজাজ আরো অশান্ত হয়!এই মেয়েটা ওকে কি পেয়েছে?
এই যে দিনরাত সব কিছু ছেড়ে মেয়েটার পিছনে পড়ে থাকে তাতেও বিন্দুমাত্র কোন ভ্রুক্ষেপ নেই!এতই ঠুনকো ও পুনম নামের মেয়েটির কাছে?এতই সস্তা ওর অনুভূতি? আজকে এর হিসাব চাই তানভীরের…. তানভীরের চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে আছে…যেন এখনই আগুনের ফুলকি বের হবে….
তানভীর দরজায় দুই হাত মেলে কটমট করে জিজ্ঞেস করে,
—-কি চাই?
—আপনার মোবাইল….
—তো…
—মি.তানভীর আপনি মোবাইল ফেলে এসেছিলেন…
—আমি,আমার মোবাইল জাহান্নামে যাক….তাতে তোমার কি?
পুনম কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে…ওর মাথার উপর দিয়ে যায় তানভীরের কথা…
পুনম চুপচাপ মোবাইল এগিয়ে দিতে গেলে হটাৎই হ্যাচকা টানে তানভীর পুনমকে রুমের ভিতর নিয়ে যায়।পুনম তখন অবাকের উচ্চপর্য়ায়ে….মুখ ফুটে কিছু বলতে নিলেই তানভীর চিৎকার করে ওঠে…কি চাই?হ্যা কি চাই? জ্বলে পুড়ে শেষ করে তবে তুমি শান্তি পাবে পুনমি…..
পুনমকে ধাক্কা দিয়ে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে ফেলে তানভীর। পুনম ব্যথা পায়..চোখমুখ বুজে ব্যথা সহ্য করে।এতক্ষনে পুনম বুঝে গেছে তানভীর স্বাভাবিক নেই…. যে তানভীর ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে বড় অস্থির, এলোমেলো! পুনম নিজেকে শান্ত করে… চোখ মেলে তাকাতেই দেখে তানভীর ওর খুব কাছে…দেয়ালের দুপাশে হাত রেখে ওকেই দেখছে….মানুষটা শরীর দিয়ে চেপে ধরেছে ওকে…পুনম সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তানভীরের দিকে….কি অবস্থা মানুষটার….শান্ত চোখদুটো রক্তবর্ণ…রাগে কপালের দুপাশের রগ ফুলে উঠেছে..ঠোঁটের ভাজে রুক্ষতা!কালো শার্টটা বুকের কাছ থেকে দুটো বোতাম খুলা…কি অসহ্য দৃশ্য! পুনম চোখ ফিরিয়ে নেয়…..
পুনমের চোখ ফিরিয়ে নেয়া যেন তানভীরকে আরো কষ্ট দেয়… বুকের কাছটায় অসংখ্য পোকা খামচে ধরে…কন্ঠমণি রোধ হয়ে আসে..তানভীরের নিজেকে পাগল পাগল লাগে….পুনম নামের মেয়েটি কি জানে? তার গভীর চোখ, ঠোঁট চেপে হাসা,নাক ফুলিয়ে রাগ করা,কপাল কুঁচকে রাখা,দুই ভ্রুর মাঝখানের ওই কুচকুচে কালো তিল, ছিপছিপে গড়নে কঠোর পা ফেলে চলা…সব.. সব কিছু তানভীরকে মুগ্ধ করে! জানে না… কিচ্ছু জানে না!নিষ্ঠুর হৃদয়ের অধিকারীণির কাছে ও হৃদয় সমার্পণ করেছে…. এই মেয়েটিকে দেখলে বুকের জমিনে ঝুপঝপিয়ে পাথর পড়ে…অসহ্য ব্যথায় জর্জড়িত হয় বুকের কাছটা!
তানভীর ভেবে ছিলো কটাদিন পুনমের সাথে কথা না বললে হয়তো দুরত্ব থেকে বুঝবে তানভীরের অনুভুতি। না কিন্তু হয় নি।সবসময়ের মত পুনম স্বাভাবিক…. যেন তানভীরের থাকা না থাকায় কিচ্ছু যায় আসে না…এক্সিডেন্টের খবরটা পর্যন্ত দেয় নি। মেয়েটার এক্সিডেন্টের খবর যে কারো কাছে মৃত্যুসম তা কি করে বুঝবে নিষ্টুর মেয়েটা….
পুনম ধাক্কা দিয়ে তানভীরকে সরিয়ে দিতে চায় কিন্তু সফল হয় না….রাগ নিয়ে আরো চেপে ধরে দেয়ালের সাথে… তানভীর না ছাড়লে এখান থেকে পুনম নড়তে পারবেনা…চিৎকার চেচামেচি করলে আরো হিতে বিপরীত হবে…পুনম ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে…শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
—-কি চাই আপনার?
তানভীর একটু ঝুকে আস্তে করে নিজের কপাল ছোঁয়ায় পুনমের কপলে…পুনম চমকে ওঠে… সে কি? মি.তানভীরের তো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে… কি গরম!
পুনম কিছু বলতে নেয়…. তানভীর পুনমের ঠোঁট আঙুল দিয়ে চেপে ধরে,কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
—তোমাকে চাই পুনমি! তোমাকে চাই….. দিনশেষে এই হেরে যাওয়া আমি তোমাকে জয় করতে চাই!
পরক্ষণেই পুনমের মাথাটা বুকের বা পাশে চেপে ধরে তানভীর…
—এই পুনমি শুনতে পাচ্ছো…কানপেতে শুনো.. বুকের ভিতর ঝড় উঠেছে…পথহারা অনুভুতির দল আজ তোমার নীড়ে ফিরতে চাইছে….তুমি শুনছো তো পুনমি…..আমার বুকের ভিতর তুমি নামের ধুকপুকানি!
পুনমের সহ্য হয় না…এত অসহায় কন্ঠে কথা কেন বলছে মানুষটা…. শক্ত খোলসে আবরিত পুনম হু হু করে কেঁদে ওঠে।তানভীরের বুকের কাছে শার্টটা খামছে ধরে….
তানভীর পুনমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়….
—বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন?এতটুকুতেই তুুমি কাঁদছো পুনমি….আর এই আমি বেঁচে থেকেও যে রোজ মরে যাচ্ছি… তারবেলা?
পুনম চুপটি করে সরে যায়… তানভীরের আবার রাগ ওঠে..পুনমের হাত শক্ত করে চেপে ধরে… পুনম হেরে যাওয়া কন্ঠে বলে,
—আপনার জ্বর এসেছে মি.তানভীর… ভীষণ জ্বরে আপনি ভুলভাল বকছেন…
তানভীরের চোখের মণি ক্রোধে ধ্বক করে ওঠে… কি সাহস পুনমের….ওর অনুভুতিকে জ্বর ফর বলে অবহেলা করছে….
পুনমের হাতছেড়ে দেয় তানভীর…
—-আপনার এখন ঔষধের প্রয়োজন।
—আমার তোমায় প্রয়োজন পুনমি!
—আপনি অস্বাভাবিক আচরণ করছেন মি.তানভীর।
—আমি তোমায় খুন করবো নিষ্ঠুর মেয়ে!
তাই করুন… বিড়বিড় করে বলে পুনম। পুনম ধীরপায়ে চলে যায় দরজার কাছে…তানভীরের মেজাজ চুড়ান্ত রকমের খারাপ হয়…জ্বরঘোড়ে তানভীর যেন পাগল হয়ে গিয়েছে… বাজপাখির মত ক্ষীপ্র ভাবে টেনে আনে পুনমকে নিজের কাছে…মুহুর্তেই দুই হাতে তালুবন্দি করে পুনমের সুন্দর মুখটি…তানভীরের চোখ ছলছল করে… ঐ চোখ যেন কতকিছু বলতে চায় পুনমকে! পুনম অসহায় কন্ঠে বলে,
—আমাকে ছাড়ুন মি.তানভীর। ছাড়ুন বলছি..
তানভীরের কর্ণকুহুরে সে কথা পৌছায় না…সে আজ প্রেয়সীর অবহেলায় উন্মাদ প্রেমিক…যে কিছুর মুল্যে আজ তার প্রেয়সীকে চাই…!
সবসময় থাকা শক্ত মেয়েটা তানভীরের এই আচরণে ভয় পেয়ে যায়…বেসামাল প্রেমীপুরুষকে কি করে সামলাতে হয় সে শিক্ষায় সে অনভিজ্ঞ? তাই পরাস্ত সৈনীর মত হু হু করে কেঁদে ওঠে…!
তানভীরের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠে…কি সুন্দর তার পুনমির কান্নামাখা মুখশ্রী! ভেজা চোখ, লাল নাক,ভেজা ঠোঁট মুহুর্তেই তানভীরকে পাগল করে দেয়…
দুই হাতে তালুবন্দি রাখা মুখটির সবচেয়ে নিখুঁত অধরে পূর্ণচুম্বন করে তানভীর! নিজের অধর দিয়ে যেন পিষে ফেলতে চায় প্রেয়সীর অধর!শুষে নিতে চায় পুরো পুনমকে…তার পুনমিকে!
পুনম বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে।কি হচ্ছে তা বুঝতে সময় লেগে যায়।যখন বুঝতে পারে বাঘিনীর মত ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে পুনম।সোচ্চার হয় পুরো মস্তিষ্ক…. ছিটকে সরে আসতে নেয়… বাঁধা পেয়ে তানভীর যেন আরো ক্ষেপে যায়…আষ্টেপৃষ্ঠে শক্ত করে জরিয়ে ধরে পুনমকে….
প্রথমে ঠোঁটে তারপর নাকে গালে চোখে কপালে সবখানে চুম্বনে সিক্ত করে… আস্তে আস্তে নেমে আসে পৌরুষালী ঠোঁট পুনমের কন্ঠমণিতে…পুনম বাঁধা দেয়…তাতে কিছু যায় আসে না তানভীরের….অবহেলায় সিক্ত তানভীর যেন আজ তার সব রাগ এভাবেই মেটাতে চায়….
শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে পুনম ধাক্কা মারে তানভীরকে…তানভীর কিছুটা দূরে সরে যায়…পুনমের চোখে তখন অবিশ্বাস…সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে অচেনা লাগে…প্রচন্ড রাগে তানভীরের বুকে ধাক্কা মারে…শার্টের কর্লার দু হাতে খামচে ধরে….বুকে বসিয়ে দেয় অজস্র থাপ্পড়!
চোখে জল আর ধরে আসা কন্ঠে বলে,
—-কেন করলেন আপনি এমনটা?কেন করলেন?
তানভীর হাসে…সে হাসি দেখতে বড় রুক্ষ!ঠোঁটের ভাজে কঠোরতা আর চোখে চিকচিক করা জল নিয়ে বলে,
—তবে কে করলে খুশি হতে পুনমি?ঐ সাকিব নামের স্কাউন্ড্রালটা….
—-আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন…. স্রেফ বদ্ধ উন্মাদ…ও আমার বন্ধু…
তানভীর রাগে হিসহিসিয়ে বলে,
—-কে বন্ধু তা আমি তোমার কাছ থেকে জানবো না।কই বল্টু নাহিদ শিমুল এরা কেন তোমার দিকে ঐভাবে তাকায় না..
—-সব আপনার মনের নোংরা জেলাসি মি.তানভীর!
—-কোনটা জেলাসি? তোমাকে জরিয়ে ধরা নাকি তোমার কাছে বসে তোমার শরীর থেকে ঘ্রাণ নেওয়া? নাকি যখন তুমি বিচের পানিতে গোসল করো তখন তোমার ভিজা শরীরের লুকিয়ে ছবি তোলা?
—ছিঃ!
তানভীর এগিয়ে এসে পুনমকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে,
—একমদ ছিঃ! করবেনা..তখন কেন ছিঃ! বলনি?
পুনম চোখ বন্ধ করে ফেলে, দুচোখের বন্ধ পাতার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনা অশ্রু….পুনম বিচের পাথরের উপর থেকে পড়ে যেতে নিলে সাকিব ধরে ফেলে…তখন জরিয়ে ধরে…হ্যা তবে সাকিবের চাহনি পুনমের প্রতি অন্যরকম। তবে সাকিব পুনমের সামনে কখনো বাজে আচরণ করেনি..সবমসময় পুনমের কাছাকাছি থেকে পুনমকে সাকিব বুঝাতে চায় তার ফিলিংস….পুনম জাষ্ট ইগনোর করতো…ট্যুরে এসে সাকিব আঠার মত লেগেছিল পুনমের পিছে…পুনম কিছুই বলেনি কেননা সে ট্যুরে কোন ঝামেলা চায় নি…এখন সেটাই কাল হয়েছে!
—আমার কাছে এই মুহুর্তে আপনি আর সাকিব একই!…বলে পুনম তানভীর কে সরিয়ে ছুটে চলে যেতে নেয়….তানভীর পুনমকে আটকাতে নেয়…কিন্তু ভুলবশত তানভীরের হাতে পুনমের জামার পিছনে গলার কাছে টান লাগে….পিছন গলার কাছ থেকে অনেকক্ষানি ছিড়ে যায়।তানভীর নিজেও হতভম্ব চোখে তাকায় আর পুনম অবিশ্বাসের চোখে….পুনমের মাথা ফাঁকা হয়ে যায়… পুনম ঝট করে পিছনে ফিরে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় তানভীরের গালে!
জ্বরগোরস্থ তানভীর ভেঙে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকায় আর পুনম কঠোর চাহনিতে কতক্ষণ তানভীরের চোখে তাকিয়ে থাকে…. তানভীর স্পষ্ট পড়তে পারে…পুনমের চোখ যেন বলছে, আপনি একদম আপনার বাবার মত
তানভীর! একদম!
তানভীর এলোমেলো ভাবে মাথা নাড়ায়….পুনম তার কাছে কি? একথা ও বলবে কার কাছে?পুনমের অপমান জেনে-বুঝে তানভীরের দ্বারা অসম্ভব!
জবাব দেয়ার আগেই দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে পুনম…আর পিছনে ফেলে যায় হতবিহ্বল এক পাগল প্রেমিককে!
প্রচন্ড রাগে যখন হোটেল কক্ষের জিনিস ভাঙচুর করছে তানভীর তখন পুনম ওয়াশরুমের দরজা আটকে কান্নায় ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে……
চলবে,