#পঁচিশটি_মোমবাতি
#পর্ব:- ০৩
নিধির এমন ভয়ঙ্কর কথা শুনেও সফিক চুপচাপ স্বাভাবিক ভাবে বসে রইল। এরকম কথার প্রসঙ্গে কি বলতে হয় সেটা হয়তো জানা নেই। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সফিক বললো,
– প্রশ্নটা তো আমার করা উচিৎ তাই না?
নিধি চোখমুখ কঠিন করার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। তার চেহারায় রাগান্বিত ভাব হলেও ঠোঁটের আগায় হাসি দেখা গেল।
– সফিক সাহেব!
– বলেন।
– আপনার কি ধারণা যে আমি আমার বাবাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি?
– অনেকটা তাই। তিনি সবসময় একটা মানসিক কষ্টের মধ্যে থাকতেন।
– আপনার যুক্তি পুরোপুরি সত্যি না হলেও কিছুটা সত্যি।
– আমরা কি কাজের কথায় আসতে পারি?
– হ্যাঁ অবশ্যই।
– তাহলে বলুন।
– হাসপাতালের কাজ যেদিন থেকে শুরু হবার কথা সেদিনই শুরু হবে। মনে হয় ২৫ তারিখে শুরু হবার কথা ছিল তাই না?
– হ্যাঁ।
– আপনি সেখানকার সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করতে বলেন। দরকার হলে সবকিছু গুছিয়ে চলে যান। ২৪ তারিখ বিকাল তিনটায় আমি সেখানে থাকবো।
– আপনাকে একদিন আগে যেতে হবে কারণ সকালে রওনা দিলে পৌঁছে তারপর ক্লান্ত হয়ে যাবেন।
– হেলিকপ্টার প্রস্তুত করা যায় কিনা দেখেন।
– ঠিক আছে।
– সফিক সাহেব, আপনাকে আমি চাকরি থেকে বের করেছিলাম কেন জানেন?
– না, আপনি অবশ্য সবাইকে ছোট্ট কিছু কারণ দেখিয়েছেন। কিন্তু সেটা যথাযথ নয়। আপনার অন্য কোনো কারণ ছিল বলে আমার ধারণা।
– আমি ভেবেছিলাম আপনি আসবেন না।
– বেশ কিছুদিন আগে আপনার বাবা আমাকে বলেছিলেন, ” আমি যদি হঠাৎ করে মারা যাই তাহলে তুমি আমার মেয়েকে সাহায্য করো। কারণ আমার মেয়ে ছোট তাছাড়া কাজের প্রতি তার মনোযোগ খুব কম। সে একটু রাগী স্বভাবের তাই অনেক কিছু বলতে পারে। তাই বলে রাগ করে চলে যেও না। ”
– আমি দেশ ছেড়ে চলে যাবার পরে বাবার সঙ্গে কথা বলতাম না। বাবা আমাকে প্রায়ই তখন চিঠি পাঠাতেন। ৩/৪ পৃষ্ঠার বড়বড় চিঠি লিখে তিনি পাঠিয়ে দিতেন অস্ট্রেলিয়া। বাবাকে আমি বছর খানিক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি কিন্তু তার থেকে চিঠি পাবার জন্য আমি সেটা প্রকাশ করিনি।
সফিক চুপ করে রইল। তার কথা বলার কোনো পজিশন নেই, যখন পজিশন পাবে তখন কথা বলতে পারবে। এমনিতেই সে কম কথা বলে।
– বাবার চিঠির মধ্যে প্রায় সময় আপনার কথা লেখা থাকতো। বাবার সবগুলো চিঠিতে আপনার স্থান আছে, কিছু না কিছু থাকবেই।
– এগুলো কি কাজের কথা?
– হ্যাঁ কাজের কথা। দু বছর আগে আমি বাবার চিঠি পড়ে বুঝতে পারি যে তিনি আপনার সঙ্গে আমাকে বিয়ে দিতে চায় সরাসরি বলে নাই কিন্তু তার ইঙ্গিতের অর্থ পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম। তিনি আপনাকে তার মেয়ের জামাই বানানোর স্বপ্ন দেখতেন।
– আমি এসব জানতাম না। তাছাড়া আমার স্ত্রী ছিল সুতরাং এসব কথা স্যার বলতে পারে না।
– আপনার স্যার বলেছেন, আমার কাছে চিঠি আছে। আপনাকে একদিন পড়তে দেবো।
সফিক জবাব দিল না।
– আমি অফিসে আসার পর থেকে আপনার কথা মনে হলেই আমার বাবার কথা মনে পড়ে। বাবার স্বপ্ন ছিল আপনি তার মেয়ের জামাই হবেন, এসব ভাবতে গেলে আমার খারাপ লাগে। অস্বস্তি বোধ শুরু হয়ে যায় তাই আপনাকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
– ওহ্।
– হাসপাতালের কাজের জন্য গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত দুটো কারণে নিলাম। প্রথমত আপনি এখন একা আছেন তাই ঢাকার বাইরে গেলে সমস্যা নেই। দ্বিতীয়ত আপনার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা কম তাই সমস্যা হবে না।
– আমি এবার উঠতে পারি?
– জ্বি পারেন, আপনি ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে আরেকবার দেখা করে তারপর যাবেন।
– আচ্ছা যাবো।
সফিক উঠে দাঁড়াল। নিধি পিছন থেকে বললো,
– বাবার মৃত্যুর জন্য কে দায়ী সেটা আমি জানি। তবে তাকে খুঁজে বের করার জন্য আমি একজন বুদ্ধিমান লোককে অফিসে নিয়োগ দেবো। সে সবার মতো স্বাভাবিক ভাবে ডিউটি করবে কিন্তু তার প্রধান উদ্দেশ্য থাকবে বাবার খুনিকে খুঁজে বের করা। সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে সে খুঁজে বের করবে।
সফিক ঘাড় ফিরিয়ে বললো,
– আপনি খুব অদ্ভুত মানুষ।
|
|
নিধির রুম থেকে বের হয়ে রূপার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল সফিকের। মেয়েটা কি এতক্ষণ এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল নাকি? কি সর্বনাশ!
রূপা বললো,
– স্যার আপনি কি আবার চাকরি করবেন?
– হ্যাঁ করবো, চাকরি করার জন্য আবার আমাকে ডেকে আনা হয়েছে।
– সত্যি বলছেন? তাহলে তো খুবই ভালো হয়, ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতেই আমার ভয় লাগে। যদিও কখনো কিছু বলে না কিন্তু কেন জানি তাকে দেখলে আমার রাগ ওঠে।
– রাগ কেন হবে?
– তিনি আপনাকে চাকরি থেকে বের করে দিল। এতবড় অফিস আপনি নিজেই সবকিছু দেখে রাখতেন অথচ আপনাকেই বাদ দিল।
– তার বাবার অবর্তমানে তিনি অফিসের মালিক রূপা। সুতরাং যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তার ছিল এবং আছে।
– আপনি কবে থেকে অফিসে আসবেন? আজ থেকে ডিউটি করবেন নাকি কাল সকাল থেকে।
– আমি অফিসে আর ডিউটি করবো না রূপা। স্যারের শশুর বাড়ির এলাকায় তার স্ত্রীর নামে যে হাসপাতাল হচ্ছে সেখানে যাবো। হাসপাতালের যাবতীয় লেনদেন কাজকর্ম সবকিছু আমি দেখাশোনা করবো।
– বলেন কি…!
– হ্যাঁ।
– তাহলে তো আমাকে সেখানে রুম ভাড়া করে থাকতে হবে। বাবাকে নিয়ে যেতে হবে, স্যার সেই গ্রামের মধ্যে কি বাসা ভাড়া পাওয়া যায়?
– তুমি কেন যাবে সেখানে?
রূপা তাকিয়ে রইল। যেন অবিশ্বাস করার মতো একটা প্রশ্ন তাকে করা হয়েছে। সে কণ্ঠ খানিকটা নরম করে বললো,
– আপনার সঙ্গে আমি যাবো না স্যার? আপনি তো আপনার সকল কাগজপত্র রেডি করা খেয়াল করার জন্য আমাকে রাখতেন।
– হুম কিন্তু সেটা এই হেড অফিসে।
– সেখানে কি অন্য কেউ থাকবে?
– জানি না, সেই বিষয় এখনো কোনো সিদ্ধান্ত করিনি। আগে যাই তারপর যদি দরকার হয় তাহলে একজন রেখে দেবো।
রূপা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সফিক তাকে কিছু না বলে হাঁটতে শুরু করলো। সে এখন ম্যানেজার এর সঙ্গে দেখা করতে যাবে।
রূপা বসে আছে নিধির সামনে। নিধির চোখের দিকে রূপা কখনো তাকায় না। নিধি বললো,
– আমি একটু পরে গাজীপুরে আমাদের একটা ফ্যাক্টরিতে যাবো। তুমি আমার সঙ্গে যাবে।
– আচ্ছা।
– তুমি কি কিছু বলতে চাও?
– ম্যাডাম গ্রামের বাড়িতে যে হাসপাতালের কাজ শুরু হবে সেখানে কি কি কাজ থাকে? মানে এই অফিসে যেমন কাজ আছে সেরকম?
– কেন বলো তো?
– এমনি।
– ওখানে ইঞ্জিনিয়ার, মিস্তিরি ডিজাইনার আরো অনেকে কাজ করবে। তাদের সবার কাজ তো আলাদা, আমাদের অফিসের কাজের সঙ্গে তো কোনো মিল নেই।
– সফিক স্যার বললেন তিনি নাকি সেখানের দায়িত্বে যাচ্ছেন। তাই ভেবেছিলাম এখানকার মতো কাজ আছে মনে হয়।
নিধি হেসে উঠলো, তারপর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললো,
– তুমি আমার সঙ্গে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নাও। হাতে কাজ থাকলে অন্য কাউকে সেটা বুঝিয়ে দিয়ে তারপর চলো। আর একটা ফ্লাক্স করে চা নিয়ে যাবে, এখানের চা খুব ভালো লাগে।
★★★
রূপার বাবার পাশে তার ভাবিও বসে আছে। রূপা ভাবির পাশে বসলো। ভাবি বললেন,
– কি হয়েছে রূপা?
– কিছু হয়নি ভাবি, বাবার শরীর কেমন?
– ভালো আছে, তোমার অফিসের অবস্থা কি? মালিককে কারা খুন করেছে কিছু জানা গেল?
– না এখনো জানি না। ভাবি তুমি কি আমাকে একটু লবন দিয়ে চা বানিয়ে দেবে? আমার খুব গলাব্যথা করছে।
– ঠিক আছে, তুমি বসো আমি যাচ্ছি।
রূপা চুপচাপ বসে আছে, তার বাবা রূপার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ছেলেটার সাথে আজও কথা হয়নি?
– হয়েছে বাবা, কিন্তু এরকম কথা হবার চেয়ে না হওয়া অনেক ভালো।
– কেন কি বলেছে?
– অফিস থেকে স্যারকে গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হবে, সেখানে অনেক বড় হাসপাতাল হবে। স্যার দু একদিনের মধ্যে সেখানে চলে যাবে।
– তো কি হয়েছে?
– আমি বলেছিলাম স্যার আমি যাবো না? তখন তিনি বলেন আমার নাকি সেখানে কাজ নেই। নতুন কাউকে নিয়োগ দেবেন।
– ঠিকই তো, গ্রামের বাড়িতে তুই কীভাবে যাবি? সেখানে কি শহরের মতো বাসা ভাড়া পাওয়া যায় নাকি? তাকবি কোই?
– তাহলে স্যার কোথায় থাকবে? আমি জানি স্যার ইচ্ছে করে আমাকে নেবেন না বাবা। তিনি ভালো করে জানেন আমি তাকে পছন্দ করি, সে যতই বকাবকি করে আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। সে বুঝতে পারে বলেই ইচ্ছে করে আমাকে নিবে না।
– পাগলামি করিস না, তুই এমন ভাবে কথা বলিস মনে হয় যেন তুই বাচ্চা। তোকে কমপক্ষে দশ বছরের কম মনে হচ্ছে।
রূপা তার বাবার বুকে মাথা রেখে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। রূপার বাবা লক্ষ্য করে দেখলেন রূপার কান্না একদম তার মায়ের মতো হয়েছে। এভাবে রূপার মা কান্না করতেন।
আগামীকাল ২৫ তারিখ।
সফিক সিগারেট হাতে নিয়ে লঞ্চের ছাঁদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাতের মুগ্ধতা উপভোগ করছে। বাতাসে হাতের সিগারেট এক টান দিতেই অর্ধেক ফুরিয়ে গেছে। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার, চাঁদের পাশে অসংখ্য তারার মেলা। সফিক তার মালপত্র সব কেবিনে রেখে ছাদে এসেছে। কালকে সকালে পৌঁছে তেমন কাজ নেই। সবই সেখানে বলা আছে, কালকে থেকে কাজের শুরু হবে। নিধি নাকি কালকে যাবে।
প্রায় ঘন্টা খানিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে সফিক। হঠাৎ করে মেয়েলি কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকালো।
– বাহহ চমৎকার পরিবেশ, সেজন্য বুঝি একা একা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?
নিধি দাঁড়িয়ে আছে। সফিক ভাবলো হয়তো তার চোখের ভুল হতে পারে। নিধির তো ঢাকায় থাকার কথা, সে আসবে কীভাবে? কিন্তু একটু পরে তার ভুল ভেঙ্গে গেল। সত্যি সত্যি নিধি চৌধুরী।
– অবাক হচ্ছেন?
– হ্যাঁ।
– হঠাৎ করে কেন জানি ইচ্ছে করছিল রাতের এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে। মায়ের কাছে সবসময় শুধু গল্প শুনতাম, নীরব রাতের আধারে এভাবে ভ্রমণ করার আনন্দ নাকি অন্যরকম।
– আপনি কি জাননি কখনো?
– না, বাবা যেতে দিতেন না। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বাবা আমাকে নানা বাড়ির এলাকায় যেতে দিতেন না। মা নিজেও কোনদিন মুখ ফুটে বলেনি নিয়ে যাবার কথা। কারণ বাবাকে প্রচুর ভয় পেতেন তিনি।
– তো আমাকে বললেই পারতেন।।
– ভাবলাম একটু চমকে দেই আপনাকে। তাই ম্যানেজারকে বলেছিলাম আপনি যেভাবে যাবেন সেভাবে যেন ব্যবস্থা করা হয়।
– জিন্সের প্যান্ট আর টিশার্ট পরে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। উপভোগ করতে হলে শাড়ি পরে খোলা চুলে এসে দাঁড়াবেন তখন মৃদু বাতাসে আপনার চুল উড়বে। আপনি বেশ আনন্দ পাবেন।
– ঠাট্টা করছেন?
– আপনার কি মনে হয় আমি ঠাট্টা করতে পারি?
– আপনি কি জানেন আমি একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসি।
– না জানি না। আমার জানার কথা নয়।
– ঠিকই বলেছেন। ওরা নাম লিমন, পড়াশোনা করতে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সেখানেই পরিচয়। সে আমার বাবার পরিচয় জানতো। বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ সবকিছু আমি তাকে বলতাম।
– লিমন সাহেব এখন কোথায়?
– দেশেই আছে।
– ওহ্।
– লিমন আমাকে সবসময় বলতো বাবার সাথে এসব রাগারাগি বন্ধ করে দেশে আসতে। তারপর বিয়ে করে আমরা দুজন সংসার করতাম, কিন্তু আমি আসতে চাইনি।
– কেন?
– একদিন লিমনকে কথা বলতে বলতে আমি বলেছিলাম, বাবা যতদিন বেঁচে আছে ততদিন আমি বাংলাদেশে যাবো না।
– কঠিন প্রতিজ্ঞা, অবশ্য আপনি আপনার সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছেন।
– সফিক সাহেব..!
– জ্বি।
– লিমনকে আমি বলেছিলাম বাবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি বাংলাদেশে আসবো না। তাই আমার ধারণা লিমনই দেশে এসে পরিকল্পনা করে এই কাজটা করেছে। সেজন্য আমি পুলিশকে খুব প্রেশার দেইনি। তবে ছদ্মবেশে একজনকে নিয়োগ দেবো যেন পুরোপুরি সত্যিটা জানতে পারি।
– আপনি তো খুব সাংঘাতিক মেয়ে!
– রূপা নামের মেয়েটা কেমন সফিক সাহেব?
– ভালোই মনে হয়, শ্রদ্ধা করে খুব।
– রূপার সঙ্গে আমার বয়ফ্রেন্ড লিমনের পরিচয় আছে।
লিমন ও রূপা একে অপরকে চেনে, জানেন?
চলবে…
~~~ মো: সাইফুল ইসলাম