#নেকড়ে_মানব,পর্ব:-১০
#আমিনা_আফরোজ
ভোর ছয়টা। দরজায় কারো হাতের মৃদু শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল নিলয়ের। বিছানা থেকে মাথা তুলে সামনে তাকাতেই চোখে ভেসে উঠল ডঃ আয়মানের রুগ্ন মুখখানা। গতরাতেই ডাঃ আয়মানকে রাঙামাটির সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। লোকটির মাথাসহ হাত ,পা এমনকি সারা গায়ে রয়েছে অসংখ্য ক্ষতের চিহ্ন। ক্ষতগুলো দেখে মনে হচ্ছে কোন ধারালো নখ দিয়ে কেউ আচড়ে দিয়েছে ডাঃ আয়মানের পুরো শরীর। ডক্টরের বাড়ির কারো সাথে গত রাতে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি আর এই প্রত্যন্ত অজ পাহাড়ি গ্রামেও ডক্টর আয়মানের নেই কোন আপনজন। তাই অগত্যা নিলয়কেই থাকতে হয়েছে ডক্টর আয়মানের সাথে। নিলয় চোখ মেলে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল রমজান মিয়া দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। নিলয়ের সাথে চোখাচোখি হতেই রমজান মিয়া ইশারায় ডাকল নিলয়কে। রমজান মিয়ার ইশারা পেতেই নিঃশব্দে ডাঃ আয়মানের পাশ থেকে উঠে এলো নিলয় । অতঃপর রমজান মিয়াকে নিয়ে চলে গেল লম্বা করিডরের শেষ মাথায়। কাক ডাকা ভোর এখন। লোকজনের ঘুম এখনো ভাঙ্গে নি তবে ধরনীতে পাখিদের কলরব শুরু হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। রমজান মিয়ার সাথে মিনিট দশেক কথা বলে নিলয় আবারো ফিরে এলো বারো নাম্বার রুমটিতে। ততক্ষণে ডাঃ আয়মানকে দেখতে এসেছেন এক নার্স। নার্সটা অবশ্য গত রাতেও এখানেই ছিলো। নিলয় নার্সকে দেখে বলল,
–” রুগীর অবস্থা কেমন এখন?”
নিলয়ের কথায় নার্স মেয়েটি মৃদু হেসে বলল,
–” আমি তো রুগীর খবর বলতে পারবো না, রুগীর শরীর অবস্থা স্যার বলতে পারবেন। তবে এতটুকু বলতে পারি রুগী মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন।”
নিলয় ক্ষনকাল আয়মানের দিকে তাকিয়ে বলল,
–” আপনার স্যার কখন আসবেন?”
–” নয়টা বা সাড়ে নয়টার পর আসবেন। ”
নিলয় এক ঝলক তাকালো রমজান মিয়ার দিকে। তারপর নার্স মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
–” শুনুন মিস…….
–” নিলা , নিলা রহমান আমার নাম।”
–” আচ্ছা আচ্ছা। তাহলে শুনুন মিস নিলা, আমাদের এই মুহূর্তেই পুলিশ স্টেশনে ফিরে যেতে হবে। খুব প্রয়োজন, না হলে যেতাম না……
নিলয়কে কথা শেষ করতে না দিয়েই নিলা নামের মেয়েটি আবারো বলে উঠলো,
–” আপনি যেতে পারেন ,কোন সমস্যা নেই। ”
মেয়েটির বাঁধা পেয়ে এবার মেজাজ বিগড়ে গেল নিলয়ের । মেয়েটি প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই কথা বলে। নিলয় এবার একটু গম্ভির স্বরেই বলল,
–” আপনি কি দয়া করে আমাকে কথা বলতে দিবেন। প্রয়োজনীয় কথা আছে কিছু আর আমার হাতে সময়ও খুব বেশি একটা নেই। ”
নিলয়ের ঝাড়ি খেয়ে মেয়েটি মৃদু স্বরে বলল,
–” জি বলুন।”
–” যা বলছিলাম, ডাঃ আয়মানের আপনজন কেউ থাকে না এখানে তাই ওনার সব দায়িত্ব আমি আপনাকেই দিয়ে গেলাম। আমি ফিরে না আসা অব্দি আপনার স্যার ব্যতিত অন্য কাউকেই এই কেবিনে আসার অনুমতি দিবেন না। আর যদি সতর্কতা অবলম্বন করার পরেও কিছু ঘটে তবে আমার নাম্বারে কল দিবেন। আপনি আমার নাম্বারটা লিখে নিন 01734……….। ঠিক আছে সাবধানে থাকবেন,আর রুগীর খেয়াল রাখবেন।”
কথাগুলো বলেই কেবিনে আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করে নি নিলয়। রমজান মিয়াকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে। দুজন গার্ডকে অবশ্য কেবিনের বাহিরে পাহারারত অবস্থায় রেখে এসেছে ও তবে ওদের ওপর কোন বিশ্বাস রাখতে পারছে না নিলয়।
এদিকে সকাল বেলা মাঠে পড়ে থাকা সেই ছেলেকে নিয়ে ধানায় এসেছে নিভৃত। ছেলেটি বেশি আহত হয় নি। সারারাত নিভৃতদের সাথেই ছিলো সে। ছেলেটির নাম অন্তু। বছর দশ বছর। নিভৃত থানায় এসে জানতে পারলো থানায় দুজন কনস্টেবল ছাড়া আর কেউ নেই। এখানকার কর্মরত ইন্সপেক্টর নিলয় মাহমুদ গত রাতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিয়ে একটা অপারেশনে বেরিয়েছন। ফিরবে ঘন্টাঘানেক এর মধ্যে। অগত্য নিভৃত অন্তুকে নিয়ে থানার ভেতর রাখা একটা বেন্ঞ্চে বসে পড়লো। আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে নিভৃত। তাই অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই। হঠাৎ মনে পড়ল অন্তু গত রাত থেকে ভয়ের কারণে কিছুই খায় নি। তাই নিভৃত অন্তুকে বলল,
–” অন্তু তুমি এখানে বসতে পারবে? আমি পাশের দোকান থেকে কিছু পাউরুটি আর কলা কিনে আনবো। ”
নিভৃতের কথা শুনে ভয়ে ভয়ে তাকালো নিভৃতেই দিকে। গতরাতে এই লোকটার সাথে সেই মাঠে দেখা হয়েছিল ওর। রাতে লোকটার বাসাতেও থেকেছে অন্তু । নিভৃতের দিকে তাকিয়ে বলল,
–” আমারে একা রাইখা যাইয়েন না ভাই। আমার ডর লাগে। ঐ পিশাচ আবার আইবো। ও হামার বাপ-মারে মাইরা ফালাইছে, আমাগোর বস্তি শেষ কইরা দিছে। ও আমারেও মাইরা ফালাইবো। ”
কথাগুলো বলেই কান্না করতে লাগলো অন্তু। ছেলেটার প্রতি এক রাতেই বড্ড মায়া পড়ে গেছে নিভৃতে। তাই ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে বলল,
–” হুস কাঁদে না। তুই না সাহসি ছেলে। সাহসি ছেলেরা কি এভাবে কাঁদে? কাদিস না , এখানে কেউ আসবে না। আমি আছি তো তোর পাশে।”
নিভৃতের সহানুভূতিতে অন্তুর কান্না যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল। নিভৃতকে ছোট দুটি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
–” আমি কি হামার বাপ-মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিবার পারুম? ঐ নর পিশাচরে মারতে পারুম?”
–” অবশ্যই পারবি। আমি আছি না। আমরা সবাই মিলে ঐ পিশাচটাকে শেষ করবো।”
অন্তু নিভৃতের কথার প্রতিউত্তরে কোন কথা বলে না । শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জাপটে ধরে নিভৃতকে যেন এই মুহূর্তে নিভৃতকে ছাড়া আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
প্রায় ঘন্টাখানেকের মাথায় বাক পড়লো নিভৃতদের। নিভৃত অন্তুকে সাথে নিয়ে এগিয়ে গেলো নির্দেশিত ঘরটির দিকে। নিভৃত দেখল একটি কাঠের টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে আছে একজন সুদর্শন পুরুষ। কাঠের টেবিল জুড়ে ঠাসা রয়েছে অসংখ্য ফাইল আর কটিকতেক কলমে। টেবিলের বাম পাশের দিকে কালো রঙের নেমপ্লেটে জ্বলজ্বল করছে নিলয় মাহমুদ নামটা। নামটা নিভৃতদের চক্ষুগোচর হতেই পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সুদর্শন যুবকটির দিকে। তারপর মুচকি হেসে বলল,
–” কি রে ব্যাটা, শেষ পর্যন্ত পুলিশ হয়েই ছাড়লি তবে। আমি তো ভাবিই নি এভাবে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে তোর সাথে।”
পরিচিত কন্ঠস্বর শুনেই ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকালো নিলয়। হাসপাতালে থাকতে থানা থেকে ফোন এসেছিল যে ওর সাথে কেউ একজন দেখা করতে চায়। খুব জরুরী তলব বিধায় এক প্রকার হন্তদন্ত হয়েই বের হয়েছিল নিলয় কিন্তু থানায় এসে যাকে দেখছে তাতে মুখের বিরক্তি ভাবটা বদলে সেখানে হাসির ঝলক ফুটে উঠতে লাগলো নিলয়ের মুখ। চেয়ার থেকে বেরিয়ে নিভৃতেই কাছে এসে জাপটে ধরে বলল,
–” কোথায় হারিয়ে গেছিলি তুই? কত খুঁজেছি তোকে, জানিস? ভালো আছিস তো?”
নিভৃত নিলয়কে ছাড়িয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,
–” আরে আরে মেয়ে মানুষের মতো এতো জড়াজড়ি করছিস কেন ? এমন মেয়েলি স্বভাব কিভাবে পেলি তুই? নাকি তুইই মাইয়া হইয়া গেছোস? এই দোস্ত শোন ,দেখ তো তোর এখানে কোন ফাঁকা ঘর আছে কি না?
নিভৃতেই কথায় নিলয় অবাক হয়ে বলল,
–“কেন? ফাঁকা ঘর দিয়ে কি করবি?”
–” তোরে পরিক্ষা করুম। তুই মাইয়া না পোলা দেখন যাইতো না। তাইলে শিউর হইতে পারতাম ।”
নিলয়কে এমন আবারো বোকার মতো ত কালো নিভৃতের দিকে। তারপর চোখের দৃষ্টি কঠোর করতেই নিভৃত আবারো বলে উঠল,
–” আহ্ না মানে তুই এতো কান্না করছিস কেন? তোর কান্না দেখে মনে হলো যে তুই পুলিশের চাকরি পেয়ে বোধহয় মেয়ে হয়ে গেছিস ।”
নিলয় কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
–” এখনো শুধরালি না তুই। সেই আগের মতোই রয়ে গেলি। ”
কথাগুলো বলার পর নিলয়ের চোখ পড়ল অন্তুর ওপর। অন্তু তখন চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে। নিলয় অন্তুর দিকে তাকিয়ে নিভৃতকে আবারো বলল,
–” ছেলেটা কে রে? আগে তো দেখি নি ওকে?”
–” আরে ওর জন্যই তো তোর কাছে আসা। চেয়ারে বস তোর সাথে জুরুরী কথা আছে আমার।”
নিলয় কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। তারপর মনোযোগ দিয়ে নিভৃতের ঘটনাটা শুনল। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” চল আমার সাথে, তোকে কিছু দেখানোর আছে আমার। ”
–” কিন্তু অন্তু?”
–” ওকেও সাথে নিয়ে চল। ”
কথাগুলো বলেই তিনজনে বেরিয়ে পড়ল থানা থেকে।
অন্যদিকে বড়কল গ্রাম সংলগ্ন সেই গহিন অরণ্যের একটি ভগ্ন পুরোনো বাড়ির এক কামড়ায় কাঠের বিছানায় শুয়ে আছে একটি লোক। ব্যথায় কাতরাচ্ছে লোকটি। আহত লোকটিকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন লোক। সবার মুখেই দুঃচিন্তার চাপ। আহত লোকটি এবার নড়েচড়ে ওঠল। ব্যথায় কাতরানো ধরা গলায় বলল,
–” একটা মেয়েকে ধরে আনো? যুবতী মেয়ে আনবে। এই মুহূর্তে রক্ত চাই আমার। যে আমার জন্য একটা মেয়ে আনবে তাকে পুরস্কৃত করবো আমি।”
লোকটার কথা শেষ হবার আগেই ঘরে উপস্থিত সকলে হাওয়ার তোড়ে মিলিয়ে গেল ক্ষনিকের মাঝেই। আহত লোকটি এবার কষ্ট করে ওঠে বসল বিছানার কোল ঘেঁষে। পিছনে বালিশ দিয়ে দেহটা ছেড়ে দিলো বালিশে। তারপর বুকের ডান পাশে হাত রেখে হাঁফাতে হাঁফাতে বলতে লাগলো,
–” সামান্য একটা বুলেটে আমাকে মারবে? হা হা হা। এতো সহজ, এত দ্রুত আমাকে শেষ করতে পারবে না তোমরা। তোমাদের সবাইকে এর উচিত শিক্ষা দিবো আমি। শুধু একবার একবার সুস্থ হতে দাও আমাকে।”
কথাগুলো বলেই নেকড়ের হুংকার ছাড়ল লোকটা। পুরো অরণ্য কেঁপে উঠল তার হুংকারে।
চলবে