নেকড়ে_মানব,পর্ব:- ০৮

#নেকড়ে_মানব,পর্ব:- ০৮
#আমিনা_আফরোজ

নিরবতা আর কৌতুহল উদ্দিপনায় গুমোট হয়ে আছে একতলার পরিবেশ। ঘরে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। ছোট্ট কামরার বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে রহস্যের গন্ধ। মোমবাতির আলোটা আরো ম্রিয়োমান হয়ে আসছে সময়ের সাথে সাথে। বাহিরে থেকে ভেসে আসছে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ। ডক্টর আয়মান কিছুটা নড়েচড়ে আবারো দৃষ্টি ফেললেন সামনে বসে থাকা লোকটির দিকে। লোকটি থেকে থেকে কেমন যেন কেঁপে ওঠছে। কম্পমান শরীরের সাথে সাথে কেঁপে ওঠছে কাঠের চেয়ারটা। ক্ষনকাল নিরবতা। তারপর কামরাটা গমগমে হয়ে ওঠল ধরা কন্ঠে। ডঃ আয়মান আবারো মনযোগ দিলেন ভদ্রলোকের কথায়।

–” সেদিন বাড়িতে ফিরে নন্দিনী আর মাকে কিছু জানাই নি আমি। জানালে ওরাও ভয় পেয়ে যেতো। মেয়ে মানুষের কথা জানেনই তো ,অল্পতেই কেমন অস্থির হয়ে পড়ে। পাহাড়ি এলাকার মানুষ আমরা। ছোট বেলা থেকেই জন্তু-জানোয়ারের সাথে বড় হয়েছি। এতো অল্পতে ভয় পেয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবার মানুষ আমি নই। তাই পরের দিন থেকে আবারো কাজে যাওয়া শুরু করলাম। তবে রাতে গাছ কাটার কাজটা আপাতত কিছু দিনের জন্য বন্ধ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরের দিন ভালোই ছিলাম কিন্তু বিপত্তি ঘটল সন্ধ্যে বেলা। বাড়ি ফেরার পর থেকেই আবারো শুরু হলো অস্বস্তি। সেই সাথে পেল পানি পিপাসা। ঘরের এক কোনে মাটির কলসিতে পানি রাখা ছিল। আমি গ্লাসে ঢেলে পানি মুখে দিলাম, কিন্তু গিলতে পারলাম না। কেমন যেন পানসে লাগল। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে এসে মুখে রাখা পানি ফেলে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। তৃষ্ণায় তখন আমার বুক , গলা শুকিয়ে আছে। মনে হচ্ছিল এখন এই তৃষ্ণা নিবারণ না করলে নির্ঘাত মারা পড়বো। আমাদের বাড়ির দু বাড়ির পরেই টুকুদের বাড়ি। সেদিন ওদের বাড়িতে বন থেকে ধরে আনা হয়েছিল বন মোরগের বাচ্চা। আমাকে বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে দেখে টুকু আমাকে ওদের বাড়ির দাওয়ায় নিয়ে গেল। তারপর আমার হাতে মুরগি ধরিয়ে নিজে জবাই করল সেটি । মুরগির গলা চিড়ে বেরিয়ে আসা রক্ত দেখে তৃষ্ণা বহুগুণ বেড়ে গেল আমার। না চাইতেও অদৃশ্য এক টানে আমার মুখ আপনা-আপনিই চলে যাচ্ছিলো টুপটাপ করে ঝরে
পড়তে থাকা রক্তের দিকে। টুকু মুরগি আমার হাতে রেখেই রান্না ঘরে গেলো বঁটি রাখতে । আমি যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম। টুকু চলে যেতেই জবাই করা মুরগির গলায় মুখ লাগিয়ে দিলাম আমি। মুখে রক্তের স্বাদ লাগতেই ধক করে জ্বলে উঠলো আমরা চোখ দুটো। অতঃপর এক নিঃশ্বাসে শুষে নিলাম মুরগিটির দেহের সবটুকু রক্ত । তারপর মাটিতে মুরগিটি রেখেই বেরিয়ে এলাম টুকুদের বাড়ি থেকে। তখনো আমার মুখে লেগে আছে লাল রক্তের ছোপ। সেদিন সন্ধ্যা থেকে আবারো পড়ে রইলাম গতদিনের সেই বড় গাছ তলায়। সেদিন কিন্তু আর কোন জন্তু আসে নি আমার কাছে। তারপর থেকে আস্তে আস্তে খুব কিছু সহনীয় হয়ে গেল আমার। দিনে রাতে যখনি আমার তৃষ্ণা যাগতো তখনি বুনো জানোয়ারের রক্তে তৃষ্ণা নিবারণ করতাম‌ । এইভাবেই গড়িয়ে গেল প্রায় বেশ কিছু মাস। একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমার রক্তের নেশা কিন্তু শুধু পূর্ণিমার রাতেই জাগতো। এছাড়া বাকি দিনগুলো আমি স্বাভাবিকই থাকতাম। তবে এ সুখ আমার কপালে বেশি দিন টিকে নি। একদিন এক গ্রামবাসী আমাকে এক বুনো হাঁসের রক্ত খেতে দেখে। ব্যাস পুরো গ্রামবাসী সেদিনকেই আমাকে আর আমার পরিবারকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। আমার মা ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে নি তাই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় হার্ট অ্যাটাক করে পাড়ি জমায় আমার বাবা আর ভাইয়ের কাছে। আমার স্ত্রী ও আমাকে দেখে সেদিনের পর থেকে বেশ ভয় পেতো কিন্তু স্বামী ব্রতা হওয়ায় আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে নি ও। আর যাবেই বা কোথায়। বাবা-মা তো সেই কবেই গত হয়েছে ওর যা একটা ভাই আছে সেও ওর ভাবীর কথায় ওঠে আর বসে। আর নন্দিনীর ভাবী নন্দিনীকে খুব একটা দেখতে পারতো না। তাই অভাগিনী নিজের নিয়তিকে মেনে নিয়ে আমার সাথে সংসার করছিল। কিন্তু এক চাঁদনী রাতে আমার ভেতরকার সেই পশুটা বেরিয়ে এসে তছনছ করে দেয় আমার সংসার । আমার নিজের হাতেই শেষ করে আমার স্ত্রী আর আমার ফুটফুটে মেয়ে দুটোকে। যখন আমার স্বম্ভিত ফিরে তখন সব শেষ হয়ে গেছে। ঘরের মেঝেতে তখন ঠাঁই পেয়েছে তিন তিনটে রক্তশূন্য লাশ। সেই থেকে মানুষের উষ্ণ রক্ত হয়ে ওঠে আমার প্রিয় খাবার। পূর্ণিমা রাতের চাঁদের আলোয় আমি হানা দিতে থাকি বড়কল গ্রামে, যাদের জন্য আমি আমার স্ত্রী,কন্যা সন্তানকে হারিয়েছি। সর্বশান্ত হয়েছি, হারিয়েছি আমার সোনার সংসার। একে একে শেষ করতে থাকি তাদের।”

এতটুকু বলে থামলো ভদ্রলোকটি । ডাঃ আয়মান পুরো গল্প শুনে মনে করল লোকটি হয়তো সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। কেননা এ ধরনের রুগীরা তাদের কল্পনায় একটা রাজ্য করে তোলে। খুব দ্রুত চিকিৎসা না করলে এসব রুগী মারাত্মক হিংস্র হয়ে ওঠে। এবার লোকটির দিকে তাকিয়ে ডাঃআয়মান ঠান্ডা গলায় বললেন,

–” দেখুন আমি আপনাকে একজন সাইকিয়াটিস্ট্রের নাম লিখে দিচ্ছি। আপনি যত দ্রুত সম্ভব ওনার সাথে দেখা করবেন। বুঝতেই পারছেন আমি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, আপনার রোগের চিকিৎসা এখানে হবে না। আমার বন্ধুটি অনেক ভালো। আপনি ওর কাছে গেলে খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে আমি মনে করি।”

ডঃ আয়মানের কথায় লোকটার চোখটা আবারো যেন থক করে জ্বলে উঠলো। মুহূর্তের মাঝেই লোকটি চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

–” আমাকে আপনার পাগল মনে হচ্ছে। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না তো। তাহলে নিজের চোখেই দেখে নিন সত্যিটা কিন্তু আফসোস আজকের পর সত্যি কথাটা জানাবার জন্য আপনি আর থাকবেন না।”

কথাটা বলার পর সুশান্ত নামের লোকটির দেহ আস্তে আস্তে বড় লোমের ঠেকে যেতে লাগলো। ধীরে ধীরে লোকটি পরিণত হলো লোমশ নেকড়েতে। তারপর গগনবিদারী হুংকার ছাড়ল আকাশের দিকে তাকিয়ে। ইটের ভাটার মতো জ্বলতে থাকা লাল টকটকে চোখদুটো ঘুরে তাকালো ডঃ আয়মান এর দিকে। সেকেন্ডের মাঝেই ঝাঁপিয়ে পড়ল টেবিলের ওপর প্রান্তে। তারপর শোনা গেল ধস্তাধস্তির আওয়াজ । অতঃপর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বিকট এক শব্দ শোনা গেল পুরো এলাকা জুড়ে। বুকসেলফটার পায়ের কাছে পড়ে রইল বিভৎস জন্তুটি। জন্তুটির বুক চিরে বেরিয়ে গেছে একটা বুলেট। ডঃআয়মান বিশ্চিত দৃষ্টিতে এগিয়ে গেলো সেদিকে। হঠাৎ ডঃআয়মানকে এগিয়ে আসতে দেখে মৃদু নড়েচড়ে ওঠল জন্তুটি তারপর ডঃ আয়মানকে ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙে বেরিয়ে গেল সে । ডাঃ আয়মানের অবস্থা তখন বিধ্বস্থ। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনের রিসিভারটি কানে লাগিয়ে কল দিল রাঙামাটি জেলার লোকাল ধানায়।

রাত্রির সাড়ে বারোটা। চারিদিক নিস্তব্ধ। টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। রিমিঝিমি আওয়াজ আসছে বৃষ্টির বর্ষণ হতে। সারাদিন বৃষ্টি হওয়ার দরুন আজ আর বাড়ি যায় নি নিলয়। থানাতেই রয়ে গেছে । থানায় নিলয়ের সাথে রহমত আলী সহ আরো তিন চারজন আজ ডিউটিরত আছে। তারা সকলেই যে যার কাজে ব্যস্ত। কেউবা দাড়িয়ে আছে পেলের সামনে কেউবা ডেস্কে বসে ঝিমুচ্ছে। ভারী বর্ষণে সবাই অলস সময় কাটাচ্ছে। হঠাৎ শুনশান নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে ক্রিং ক্রিং করে ভেজে ওঠল টেলিফোন। নিলয় টেলিফোনের রিসিভার তুলে কানে ধরে চুপচাপ রইল মিনিট দুয়েকের মতো। তারপর রিসিভার নামিয়ে রমজান মিয়াসহ আরো দুজনকে নিয়ে কালো রঙের জিপে করে বেরিয়ে গেলেন থানা থেকে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here