নীড়হারা_পাখি,পর্ব : ৩ (last part)
Susmita_Jana
তাই আজও খাবারে লবণের পরিমাণ বেশি হয়ে যাওয়ায় কাব্য অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলো আমি তখনও চুপ করে মাথা নীচু করে রেখে ছিলাম। থাপ্পড়, লাথি মারলেও যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলেও মুখে কোনরকম আওয়াজ করলাম না। নিঃশব্দ চোখের পানি ঝরাচ্ছি।
মাঝরাতে ছাদে উঠে আসি। এই ছাদটাই যেনো আমার কাছে শান্তির পরিবেশ মুক্তির পরিবেশ। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে এই ছাদেই নিজেকে মুক্ত করে দিই। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি মহান আল্লাহতালা হয়তো আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন। আমিও দেখতে চাই এই জীবনের পরিসমাপ্তি কোথায়!!
সকালে আমি দরজা খুলে অবাক হয়ে যাই। কারণ আমার সামনে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা আমাকে দেখে হাসছেন। যতোই হোক আমার জন্মদাত্রী বাবা তো আমি কি রাগ করে থাকতে পারলাম। ছলছল চোখে বাবা বলে ডাকলাম,,
” আমার জামাই বাবা কোথায়? ”
বাবার মুখে এমন কথা শুনে আমি আরও বেশী অবাক হলাম। আমি অনেক আশা করেছিলাম বাবা বলবে কেমন আছিস মা?
আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই কাব্য চলে আসে। বাবা কাব্যর সাথে ভিতরে চলে যায়। আমি দরজা খুলে এখনো দাঁড়িয়ে আছি। ভাবছি এই বুঝি বাবা বলবেন,, কেমন আছিস মা?
কিন্তু বাবা যে এতোক্ষণে তার জামাইকে নিয়ে ভিতরে চলে গেছেন তা বুঝতেই পারি নি। শাশুড়ি মা এর ডাকে নাস্তা তৈরি করলাম। আমার বাবা আর স্বামীর কাছে নিয়ে আসলাম।উনাদের কথোপকথন শুনেই বুঝলাম বাবা তো নিজের স্বার্থ ছাড়া এক পা এগোয় না। নিজের প্রয়োজনেই এসেছেন। বুকের মধ্যে একরাশ কষ্ট নিয়ে সারাদিন পার করলাম।
সন্ধের দিকে সারা শরীরে কাঁপুনি দেয়। পচা গরমে যখন সবাই ঠান্ডা বাতাস খাচ্ছে আমি তখন লেপের তলায় নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করছি। ইচ্ছে করছে আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দিতে।
আমার স্বামী আসতেই শাশুড়ি মা আমার নামে অভিযোগ করলেন। উনি কথাগুলো এতো জোরেই বলছিলেন যা আমার কানের ভিতরে ঢুকে মাথায় আঘাত করছিলো।
“রাজরানী বিয়ে করেছিস তো। সারাদিন শুয়ে বসে কাটায়। আর আমি বৃদ্ধ বয়সে এখনো কামলা খাঁটুনি খাটি। আর চারপাশে দেখ ছেলের বিয়ে দিবে সব আয়েশ করছে আমার পোড়া কপাল। ”
শুধুমাত্র রাতের রান্নাটা উনাকে করতে হয়েছিলো বলেই উনি এতো কথা শোনালেন। আর এদিকে সারা সকাল থেকে বাসার ধূলো ময়লা পরিষ্কার করা, মোছা শুধু তাই নয় হাজার খানেক জামাকাপড় পরিস্কার করেছি। এগুলো আমার রোজকার কাজ। একটা কাপড় তিন চার বার করে ধুতে হয় আমার শাশুড়ি মার পছন্দ না হলে।
আমি জ্বরে গুটিগুটি মেরে শুয়ে কাঁপছি। কাব্য বেশ রাগ নিয়েই রুমে ঢুকে। তবে আমাকে লেপ কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখে কিছুটা নরম হল। আমার কাছে এসে আমার কপালে হাত ছোঁয়ালো। তারপর একটা জ্বরের ঔষধ দিয়ে চলে গেল।
এইভাবেই আমার এক বছর পূরণ হল। মা এর কথা শুনে মারধর করতো। আবার ছোট ছোট কোন বিষয় নিয়েও কথা শোনাতো। এভাবেই কাটছিলো আমার জীবন।
কিন্তু সেদিন এর পর আমার সবকিছু হারিয়ে গেলো। আমার স্বামী নেশা করতো। প্রায় কোন কোন রাতে মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরতো। একদিন সারা রাতটা আমি জেগে কাটালাম। উনি বাসায় আসেননি সকালে কল এলো। জানতে পারলাম উনি গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। শোনা মাত্রই ছুটে চলে গেলাম।
ডক্টর বললো”আঘাতটা মাথায় বেশি হয়েছে। অনেক রক্তপাত হয়েছে। মাথার শিরা কেটে গেছে। দুঃখিত আপনার স্বামীকে বাঁচানো গেলো না। ”
এটা শোনার সাথে সাথে আমার পুরো পৃথিবীটা থমকে গেলো। আমার চারদিকে শুধুই অন্ধকার। যতোই হোক স্বামীতো, উনার প্রতি সম্মান ভালোবাসা আছে কষ্ট তো হবেই।
কাব্য মারা গেছে এক মাস হতে চললো। এই এক মাসে আমাকে আর মার খেতে হয়নি। কোন অপমান শুনতে হয়নি। স্বামী মারা যাওয়ার কষ্ট হলেও দিনশেষে আমি ভালো ছিলাম।দুই মাসের মাথায় আমার শাশুড়ি আমাকে তাড়িয়ে দিলেন। তার কারণ,, সেদিন সকালে আমি আমার শাশুড়ি মাএর ঔষুধ কিনতে দোকানে গিয়েছিলাম। ঔষধ কিনে এনে যখন বাসার দিকে পা চালাচ্ছিলাম তখন খুব চেনা একটা কন্ঠ স্বরে থমকে দাঁড়ালাম। পিছনে ফিরে দেখি যেই মানুষটার হাত ছেড়ে দিয়েছিলাম পরিবার এর কথা ভেবে, আজ থেকে এক বছর আগে। সেই মানুষটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে।
“কেমন আছো তৃষা? ”
প্রিয় মানুষটার প্রশ্নে বুকে তোলপাড় করা এক ঝড়ের সৃষ্টি হল। তবু নিজেকে দমিয়ে রাখলাম।
“এই তো বেশ আছি। ”
মুখে হাসি টেনে কথাটা বললাম। কিন্তু আমার মনে হল প্রিয় মানুষটা আমার উত্তর শুনে খুশি হলো না।
“আমি সব কিছু জানি তৃষা। তোমার স্বামী মারা গেছেন এক মাস হল। ”
আমি মুখটা নিচু করে নিলাম। চোখে পানি এসে গেছে। প্রিয় মানুষটি আমার হাতটা ধরলো।
” জানো তৃষা আমি এখন চাকরি করি। আমার এখন গাড়ি বাড়ি সব আছে। কোন অভাব নেই। আমার। আগে তোমাকে দশ টাকার ফুচকা খাওয়াতাম মাসে একবার। কারণ সপ্তাহে খাওয়াবার মতো আর্থিক ক্ষমতা আমার ছিলো না। কিন্তু এখন আমি তোমাকে পাঁচ তারা হোটেলে খাওয়াবার ক্ষমতা রাখি। “আমি জানি না কথাগুলো কেনো বলছে! তাহালে কি আমাকে অপমান করছে!
আমি আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হাসি মুখে বলি,,
“ও ভালো থাকবে। ”
“হুম আমি ভালো থাকবো যদি তুমি আমার সাথে থাকো।”
“কি বলছো তুমি এসব? ”
“আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমি বেকার ছিলাম বলে তোমার বাবা আমার সাথে বিয়ে দেননি। কিন্তু এখন আমি চাকরি করি আমার টাকা পয়সা আছে। তোমার বাবা মেনে নিবে। চলো আমরা আবার এক হই।”
“না তুমি ভুল করছো। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী মারা গেছে বলে আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। তুমি আমার থেকেও ভালো মেয়ে পাবে। বিয়ে করে নাও সুখি হও। ভালো থেকো। ”
হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে আসলাম। হাজার ডাকেও পিছন ফিরে আর তাকালাম না। মানুষটার মায়ায় যদি পড়ে যাই আবার। আর তাছাড়া সমাজ কি বলবে! যেই ছেলেটাকে আমি বেকার বলে ছেড়ে দিয়েছিলাম এখন সে রোজগার করে বলে তার কাছে ফিরে যাবো! লোকে তো নিন্দা করবেই।
পাড়ার লোক এসে শাশুড়ি মা কে আমার নামে নালিশ করলেন কারণ রাস্তায় আমি পরপুরুষ এর হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জায়গা পেলাম না স্বামীর বাসায়। আমার চরিত্রের দোষ আছে বলেই না কি আমি উনার ছেলেকে খেয়ে ফেলেছি। তাড়িয়ে দিলেন বাবার বাসাতেও জায়গা পেলাম না।
ঘেন্না লাগছিলো পৃথিবীটাকে এই মানুষগুলোকে। রাস্তায় নেমে পড়লাম, পুরো একটা দিন রাস্তায় বসে কাটালাম।
তারপর দিন সকালে বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চে বসে আছি। হঠাৎ আমার সামনে একজন বয়স্ক মহিলা এসে দাঁড়ালেন। প্রথমে আমি জিনতে না পারলেও তার মুখে আমার নাম শুনে কন্ঠস্বরটা খুব চেনা লাগলো।
ভালো করে তাকিয়ে দেখি আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। এখন হয়তো অবসর প্রাপ্ত হয়ে গেছেন।আমাকে উনার বাসায় নিয়ে গেলেন। আমার সব কথা শুনে আমাকে আশ্রয় দিলেন। উনার ছেলে আর ছেলের বউ উনার দায়িত্ব নেয়নি তারা বিদেশে চলে গেছে। আমাকে পেয়ে তিনি জড়িয়ে ধরে সব কথা বললেন। উনার কষ্ট গুলো আর আমার কষ্ট গুলো যেনো এক হয়ে গেলো। উনিই আমাকে পেয়ে খুশি হলেন কারণ এই বয়সে উনাকে কেউ দেখবেন। আর আমিও বাঁচলাম। আশ্রয় পেলাম।
উনার সাহায্যে আমি এখন স্কুলের টিচার হয়েছি। ভালোই কাটছে। যা আয় করছি তাতে বেশ ভালো মতোই চলে যাচ্ছে। হুম আমার কষ্টের অবসান ঘটেছে।
……. সমাপ্ত……..
গল্পটা সত্যঘটনা অবলম্বনে লেখা। আমার কল্পনায় না। এক আন্টির জীবনের গল্প লিখলাম। নাম গুলো কাল্পনিক। জানি না নীড়হারা_পাখি নামটা দেওয়া ঠিক হয়েছে কি না। তবে আন্টির কথা শুনে আমার এই নামটাই মনে হয়েছে।