নীলাম্বরীর_প্রেমে,পর্ব -৬
Tuhina pakira
আয়ু নিজের বাড়ির সদর দরজায় এসে দাঁড়ালো। স্পর্শদের বাড়ির সদর দরজা টা খোলা। বসার ঘরে স্পর্শের বাবা কিছু একটা করছে। আয়ু আর স্পর্শের বাড়ির মাঝে রয়েছে একটা রাস্তা। রাস্তা পেরোতে আয়ুকে কষ্ট করে তিন পা ফেলতে হবে। আয়ু একবার রাস্তার এইদিক ওইদিক দেখে নিল।
কারণ ওদের বাড়ির পাশের মোড় দিয়ে যেকোনো সময় কোনো সাইকেল বা গাড়ি এসে যেতে পারে। চারিদিক ফাঁকা দেখে আয়ু ভো দৌড়ে স্পর্শ দের বাড়িতে ঢুকে গেলো।
শিশির চৌধুরী তখন হলরুমে বসে পেপার পড়ছিলেন। কলেজের প্রোফেসর হওয়ার পাশাপাশি তিনি একটা এনজিওর সাথে জড়িত। যার দরুন সে প্রায়ই খুব ব্যস্ত। তা বলে এমন ব্যস্ত না যে সকালে পেপার পড়ার সময় পায় না। আসলে বহু বছর আগে থেকেই তিনি এই অভ্যেস আয়ত্ত করেছেন। সেই থেকে এই ভাবেই চলছে।
আয়ু গিয়ে স্পর্শের বাবার সামনের সোফায় বসে বললো ,
-” কী করছো পাপা? ”
শিশির চৌধুরীর খুব ইচ্ছে ছিল একটা মেয়ের। কিন্তু তার ইচ্ছে পূরণ হয়নি। স্পর্শই তার এক সন্তান। অপরদিকে কয়েকবছরের ব্যবধানে বন্ধু জয়ের ঘর আলো করে আসে ফুটফুটে এক মেয়ে। ছোটো বেলা থেকেই আয়ুকে তিনি ‘পাপা’ বলানো শিখিয়েছে। আয়ুও সেই থেকে স্পর্শের বাবাকে ‘ পাপা’ বলেই ডাকে।
চোখের চশমাটা নাকের কাছে নিয়ে এসে বললেন ,
-” এইতো আমার মা টা। তা সারাদিন কোথায় ছিলিস? একবারও যে তোর দেখা পেলাম না। ”
– ” ছিলাম তো একজায়গায়। কিন্তু তোমাকে বলা যাবে না। ”
– ” কেনো বলা বারণ নাকি? ”
-” তা বলতে পারো। আচ্ছা মিমি আর মা কোথায়? ”
স্পর্শের মা টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে বললো ,
-” এইতো আমি এখানে। আর তোর মা জননী আসছে। রান্নাঘরে আছে। ”
-” ওইতো তোর মিমি এসে গেছে। বলছি নীলা আমাকে এক কাপ চা করে দাও তো। ”
-” না এখন আর চা হবে না। এক্ষুনি খাবার দেবো একেবারে খেয়ে নেবে। অলরেডি রাত ৯:৩০ টা বাজতে গেলো।
চৌধুরী বাবু জানেন এই কথা বললে তাকে প্রথমেই শুনতে হবে ‘না’ । কিন্তু তিনি তাও বললেন। আসলে সারাদিনে নিজের স্ত্রীর শাসন বারণ না শুনলে তার যেনো দিন যায় না। পিছন ফিরে নিজের স্ত্রী কে একবার দেখে নিলেন তিনি। সারাদিনের খাটা খাটনির মাঝেও তার মধ্যে কোনো যেনো কষ্ট চোখে পড়ে না। সারাদিন কিছু না কিছু করেই চলেছে। কিন্তু তার মধ্যে নেই কোনো অভিযোগ । ওই মানুষটার সঙ্গে দেখতে দেখতে ২৩ বছর কী করে যে চলে গেলো তার হিসেবই ঠিকঠাক রাখা হয়নি।আসলে মানুষের জীবনের ভালো সময় গুলো যেনো খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়। এখনও মনে হয় এইতো সেইদিন বিয়ের পর যখন এই বাড়িতে তার পা পড়েছিল। মা বলেছিল , ” বাড়িতে লক্ষ্মী এসেছে। ” সত্যিই তার স্ত্রী লক্ষ্মীই বটে।
খবরের কাগজে আবারও চোখ রেখে চৌধুরী বাবু বললো,
– ” আয়ু মা দেখ টেবিলে জল আছে।”
আয়ু উঠে জল আনতে যেতেই স্পর্শের মা ওকে জলটা হাতে দিল। আয়ু হেসে জলটা স্পর্শের বাবাকে দিতে যেতেই তিনি বললেন ,
– ” জলটা তোর মিমিকে খেতে বল। এই গরমে তার ক্লান্তি কাটবে। আর তুই গিয়ে স্পর্শ আর দিহানকে ডেকে আন। ”
আয়ু হেসে ওর মিমিকে জলের গ্লাসটা দিয়েই উপরে ছুটলো।
স্পর্শের মা তার স্বামীর দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে জলটুকু খেয়ে আবারও রান্নাঘরে ছুটলো। তার স্বামীর ছোটছোট কেয়ার গুলো তার খুব ভালো লাগে। এতগুলো বছরে তা এখনও বদলায়নি ।
চৌধুরী বাবু তার সহধর্মিণীর চলে যাবার আভাস পেতেই হাসতে হাসতে পেপারটা উল্টে আবারও খবর পড়তে মন দিল।
♣
-” স্পর্শ দা , ও স্পর্শ দা ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? ”
অপর দিক থেকে কোনো উত্তর ই আয়ু পেলো না। উপরে এসে থেকে আয়ু ওকে ডাকছে কিন্তু ওর কোনো সাড়া নেই। ঘরের দরজা বন্ধ করে কী করছে কে জানে।
-” আমাকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে তুমি কিনা ঘুমোচ্ছো এটা হবে না। তাড়াতাড়ি দরজা খোলো। ”
অপরদিকে স্পর্শ ঘরের ভিতরে একবার আলমারি থেকে কিছু বের করে ব্যাগে রেখে ব্যাগটা সাইডে রেখে কিছু জরুরি ডকুমেন্টস চেক করতে করতে বলল,
-” তুই যা পাঁচ মিনিটে আমি আসছি। ”
-” তুমি না এলে আমি যাবো না বলে দিলাম। তাড়াতাড়ি এসো তো।”
-” বেশি না বকে তুই যা। নাহলে এক চড় মারবো।”
– ” ধুর , ভালো লাগে না। পচা ছেলে , খচ্চর কোথাকার। ”
– ” আমি জানি আমি পচা ছেলে তোকে বলতে হবে না। আর আমাকে তুই কোন সাহসে খচ্চর বলিস ? আমার জানা মতে তোর বাপ চাষবাস করে না যে আমি গিয়ে তোদের খড় চুরি করে আনবো। যা ভাগ এখন। দেরি হলে কিন্তু আজ আর নীচেই নামবো না।”
আয়ু অবশেষে হার মেনে গজগজ করতে করতে নীচের দিকে পা বাড়ালো।
♣
সদর দরজা দিয়ে আয়ুর বাবা আর দ্রুতি কে ঢুকতে দেখে স্পর্শের বাবা খবরের কাগজটা রেখে দিয়ে বললো ,
– ” এই তোর আসার সময় হলো জয়। কতক্ষণ অপেক্ষা করছি জানিস?”
-” বাবাহ , চৌধুরী বাবু দেখি আমার অপেক্ষা করছে। শুনেও শান্তি। তবে মাঝে মাঝে অপেক্ষা ভালো। সম্পর্কে হৃদয়ের টানটা সচল থাকে। ”
-” আয় বস। এই যে দ্রুতি মা দাঁড়িয়ে না থেকে বসো।”
-” না না কাকু ঠিক আছে। বলছি আয়ু দি কোথায়?”
-” তোমার আয়ু দি তো উপরে। যাও তুমিও যাও। সকলকে একে বারে ডেকে আনো।”
-” আচ্ছা।”
দ্রুতি চলে যেতেই দুই বন্ধু খোশ গল্পে মাতলেন ।
♣
সিঁড়ির কাছে আসতেই আয়ু দ্রুতিকে দেখে বললো ,
-” ভালো বোন আমার যা তো দিহানকে ডেকে আন।”
কথাটা বলেই আয়ু নেমে গেলো। দ্রুতি বিরক্ত হয়ে বলল,
-” উহু , আমি যাবো না। গেলেই ও আমার নামের ঘোল বানাবে।”
-” ঘোল না ফ্রুটি।”
দ্রুতি দিহানকে সামনে দেখে বললো ,
– ” তুই আবার আমার নাম কে নিয়ে মজা করছিস।”
দিহান হেসে আয়ুর ভাই আয়ানের হাত ধরে ওর দিকে তাকিয়ে বললো ,
– আরে না রে আসলে আমি আয়ানকে জিজ্ঞেস করছিলাম বাড়িতে ফ্রুটি আছে কিনা। তাই নারে?
আয়ান দ্রুতির দিকে তাকিয়ে হেসে বললো ,
– ” হ্যাঁ দ্রুতি দি। দিহান দা তো তাই বলছিল।”
দ্রুতি ভ্রু কুঁচকে বললো,
-” তা শুনে তুই কী বললি? ”
-” কী আবার বলবো , বললাম যে আমি কী জানি দ্রুতি দি কে জিজ্ঞেস করে দেখো। ”
দ্রুতি রেগে আয়ানকে মারতে যেতেই ও নীচের দিকে ছুটলো ।
দ্রুতি হাত গুলোকে শক্ত করে মুড়ে বললো,
-” ধুর ভালো লাগে না।”
দ্রুতি রেগে নীচের দিকে পা বাড়ালো। দিহান ও ওর পিছু পিছু আসতে আসতে বললো ,
-” ধুর , খুব ভালো লাগে।”
♣
দ্রুতি এসে দেখলো আয়ু , আয়ান , ওর মেসো , স্পর্শের বাবা চেয়ারে বসে আছে। স্পর্শের মা আর আয়ুর মা খেতে দিচ্ছে। দ্রুতি আয়ুর পাশের চেয়ার টায় বসতে যেতেই কেউ এসে বসে পড়লো। দিহানকে দেখে দ্রুতি ভ্রু কুঁচকে আয়ুর সামনের চেয়ারটায় বসে পড়লো।
-” বাহ্ আয়ু দেখি আমার পাশে। ”
আয়ু হেসে বলল ,
-” এটা কিন্তু ঠিক না। আমার বোন না এখানে বসবে বলে এলো।’
-” তোর বোন যদি বসতে না পারে আমি কি করবো। আর তাছাড়া প্রতিদিনই তো ও তোর পাশে বসে আজ না হয় আমি বসলাম। ”
আয়ু ওর মিমির দিকে তাকিয়ে বললো ,
-” আচ্ছা মিমি আজ হঠাৎ কিসের জন্যে পিকনিক। কই আমাকে আগে বলোনি তো। ”
-” আরে এমনি ভাবলাম সবাই একটু একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করি আর কিছু না। এই নে খেয়ে দেখ তোর মায়ের মতো বানাতে পেরেছি কিনা? ”
আয়ু কে বিরিয়ানি দিতে দিতে মিমি কথাটা বলে অন্যদিকে গেলো। আয়ু আর কিছু বললো না।
সেইসময় নীচে এলো স্পর্শ। স্পর্শকে দেখে দিহান উঠে গিয়ে স্পর্শের কাঁধে হাত রেখে বলল,
-” আজকের বিরিয়ানি ট্রিট দিয়েছে আমাদের স্পর্শ দা। আয় চল চল তুই আজ স্পেশাল গেস্ট। আমাদের বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছিস বলে কথা। ”
স্পর্শকে ওর জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে দিহান গিয়ে দ্রুতির পাশের চেয়ারে বসে পড়লো।
-” স্পর্শ দা কেনো স্পেশাল গেস্ট হবে ও কী রান্না করেছে না টাকা দিয়েছে। স্পর্শ দা কী চাকরি করে যে আমাদের বিরিয়ানি খাওয়াবে।”
স্পর্শ সামান্য হেসে আয়ু কে বললো ,
-” আয়ু শোন? ”
আয়ু স্পর্শের দিকে তাকাতেই ও আয়ুর মুখে এক চামচ বিরিয়ানি খাইয়ে বললো ,
-” এই যে তোকে আমি বিরিয়ানি খাইয়ে দিলাম। আর কিছু বলবি?”
আয়ু কিছু না বলে চুপচাপ মুখ নাড়তে লাগলো ।
আয়ুর খাবার মাঝে গালের টোল পড়া জায়গাটা স্পর্শের বেশ লাগে। কী সুন্দর ভাজ পড়ে। স্পর্শ নিজেকে যেনো সামলাতেই পারলো না। দুহাতে আয়ুর গাল দুটো টেনে মিষ্টি করে বললো ,
– ” সো কিউট আয়ু বুড়ি।”
আয়ুর গাল টানায় আয়ু ঠোঁট ফুলিয়ে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে রইল। ওদের কাণ্ডে সকলে হি হি করে হেসে উঠলো।
(চলবে )