নীলাম্বরীর_প্রেমে,পর্ব :১৩,১৪

নীলাম্বরীর_প্রেমে,পর্ব :১৩,১৪
Tuhina pakira
পর্ব :১৩

-” মামী মনি তাড়াতাড়ি এসো , স্পর্শ দা এসে গেছে।”

দিহানের গলায় ‘স্পর্শ এসে গেছে’ কথাটা শ্রবণ গোচর হতেই স্পর্শের মা হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। কিন্তু বেশি দূর যেতে হলো না। তার আগেই কেউ তাকে জড়িয়ে ধরলো। এতদিন পর ছেলেকে কাছে পেতে তার চোখ ছলছল করে উঠলো। স্নেহ মিশ্রিত মমতাময় হাত ছেলের মাথায় রাখলেন। ভিডিও কলে কী ঠিক মতো ছেলেকে দেখা যায়।

-” কেমন আছিস?”

-” আমি ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো?”

-” এই যে তোকে কাছে পেয়ে আরও ভালো হয়ে গেছি।

স্পর্শ তারপরে আয়ুর মায়ের কাছে গেলো। আয়ুর মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-” কতো বড়ো হয়ে গেছিস। ”

– ” আমি তো বড়ো হয়ে গেছি তবে আমার দুই মা কিন্তু এখনও ইয়ং আছে। ”

-” স্পর্শ দা তুমি একদম ঠিক বলেছো। এই দুই মা জননীর মাথায় এখনও একটাও পাকা চুল দেখতে পেলাম না।”

সোফায় বসে ছিল আয়ু আর স্পর্শের বাবা। দিহানের কথায় দুইজনেই হেসে উঠলো।

-” জয় ওনারা নাকি এখনও ইয়ং। শুনেই হাসি পাচ্ছে।”

-” আরে শিশির বাচ্চারা ভুলে গেছে মার্কেটে চুল কালো করার কতো রকম ব্র্যান্ড রয়েছে।”

দুই বন্ধুর কথায় আয়ু এবং স্পর্শের মা গায়ে মাখলো না। উল্টে দুই জনে তাল মিলিয়ে বললো,

-” যারা ওই সব ব্যবহার করে তারাই ভালো জানে। আমাদের ওই সব কিছু ব্যবহার করতে হয় না। ”

হঠাৎই কোথা থেকে আয়ান ছুটে এসে স্পর্শকে জড়িয়ে ধরলো।
-” কেমন আছিস ছোটু?”

-” আমি খুব ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

-” বিন্দাস।”

– ” আজ স্কুলে যাসনি? ”

-” না। তুমি আসবে আর আমি স্কুলে চলে যাবো তা হতেই পারে না।”

দিহান আর দ্রুতি কে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে দেখে স্পর্শ ওদের দিকে এগিয়ে গেলো।

-” কী রে দুজনের কী খবর? কেমন চলছে নিউ কলেজ লাইফ।”

কথাটা বলতে দেরি , দিহান যেনো লাফিয়ে উঠলো।

-” বিন্দাস লাইফ দা। শুধু প্রবলেম একটাই।”

স্পর্শ ভ্রু কুঁচকে বললো, – “কী?”

দিহান বলার আগেই দ্রুতি হরবর করে বললো,

-” ওই যে গর্দভ টা এখানেও আমার পিছু ছাড়লো না।”

দিহান দ্রুতির মাথায় চাটি মেরে বললো,

-” ওই আমি তোর পিছু কী ছাড়বো উল্টে তুই আমার পিছু ছাড়িসনি। চল হাট।”

দ্রুতি দিহানের পা মাড়িয়ে ধরলো।

-” তুই হাট। হাটে গিয়ে জিলিপি , বাদাম বিক্রি কর।”

দিহান নিজের পায়ে হাত দিয়ে বললো,
-” বাপরে মরে গেলাম। ওই আমার বুঝি লাগে না।”

-” লাগার জন্যেই মারা বাবু।”

-” শয়তান মাইয়া।”

-” তুই শয়তান ছোকরা।”

-” ওই তোকে বলেছি না , আমকে ছোকরা বলবি না। ”

-” বেশ করবো বলবো। তুই কি করবি?”

-” কী করবো দেখবি?”

দ্রুতি কিছু বলতে গেলেই স্পর্শ ওকে থামিয়ে দিল।
স্পর্শ এতটা পথ এসে সত্যিই খুব ক্লান্ত। তাই ওদের ধমক দিয়ে বলল,

-” তোরা এবার চুপ কর। যেখানে একসঙ্গেই আছিস, সবসময় একসঙ্গেই থাক তোরা। কিন্তু আমার মাথা খাস না। মা আমি ঘরে যাচ্ছি। ”

-” হ্যাঁ যা। আমি তোর খাবার আনছি। খেয়ে রেস্ট করবি।

স্পর্শ নিজের ঘরে চলে গেলো। অপরদিকে দ্রুতি আর দিহান নিজেদের মধ্যে খুনশুটি করতে করতে বাইরের দিকে চলে গেলো। ওদের পিছনে গেলো আয়ান। ওকেই এদের সামলাতে হবে। যখন ছোটো ছিল তখন আয়ু আর স্পর্শ এর ঝগড়া সামলানোর চেষ্টা করতো না। বরং স্পর্শকে হেল্প করতো। ওর দিদিকে যখন স্পর্শ দা রাগায় কেনো যেনো ওর খুব ভালো লাগতো। ওদের ঝগড়াটা আয়ানের কাছে খুব কিউট লাগে । কিন্তু দ্রুতি আর দিহানের ঝগড়া অন্যরকমের, একপ্রকার হাতাহাতি। একে অপরকে পারলে মেরে হসপিটালে ফেলে দিয়ে আসে। খুব ডেঞ্জারাস ঝগড়া।

এতো গুলো দিন পর নিজের ঘরে এসে স্পর্শের যেনো নিজেকে প্রফুল্ল লাগছে। নিজের ঘরের মধ্যে কিছু একটা ব্যাপার তো আছে। নাহলে আকাশের পাখিরা সারাদিনের ক্লান্তির পড়ে নিজের ঘরে ফিরে যেতো না। স্পর্শ ঝট করে ওয়াশ রুমে চলে গেল। গা হাত খুব কিরকির করছে। তার উপর গা ম্যাজম্যাজ তো আছেই। এখন শাওয়ার নিলেই নিজেকে চাঙ্গা ফিল হবে। স্নানের এক আলাদা উপকারিতা আছে। যা মানুষকে বলতে গেলে এক প্রকার আরোগ্য দেয়। ওর মা আগে থেকেই ওর জামাকাপড় গুছিয়ে রেখেছে।

কিছুক্ষণ পর স্পর্শ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। ঝিমিয়ে পড়া শরীরটা একেবারে চনমনে হয়ে গেছে। গলায় টাওয়াল ফেলে মাথা মুছতে মুছতে আগের অভ্যেস মতো বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। যদিও সেই মহাশয়া এখন ওপারের বারান্দায় নেই। তিনি কলেজ গেছেন। বারান্দায় যাবার আগেই স্পর্শের মোবাইল টা বেজে উঠলো।

-” কাল সন্ধ্যাবেলা সামনের চায়ের দোকানে চলে আসবি। আড্ডা হবে।”

-” আরে স্পর্শ আড্ডা তো হবেই। তবে তুই যে এলি একবারও বললি নাতো।”

-” আমি যদি বলতাম আপনারা আজ অফিস না গিয়ে এখানে বসে থাকতেন।”

-” সে তো থাকতামই। তুই আসছিস বলে কথা।”

-” ওই জন্যেই বলিনি। এই সবে নতুই চাকরি পেয়েছিস। এর মধ্যে ছুটি করে লাভ নেই। কাল শনিবার তাই সন্ধ্যা বেলা চলে আসবি। ”

-” সে তোকে বলতে হবে না। আমি আর অরূপ ঠিক সময়ে পৌছে যাবো।”

-” আচ্ছা রাখ। কাল দেখা হবে। ”

স্পর্শ ফোনটা রাখলো। হঠাৎই কিছু মিষ্টি সুরেলা শব্দ স্পর্শের কানে এসে বারি খেলো। স্পর্শ আস্তে আস্তে সেই দিকে এগিয়ে গেলো। শব্দ টা বারান্দা থেকে আসছে। সেখানে লাগানো রয়েছে উইন্ড চিমস। ওটা হাওয়ার তালে দুলছে। তা থেকে সুরেলা শব্দ গুলো ভেসে আসছে।

স্পর্শের যতদূর মনে পড়ে, ওর বারান্দায় কোনো উইন্ড চিমস ছিল না। তাহলে এটা এখানে কে লাগাবে, ওর মা? তবে যাই হোক জিনিসটা ওর খুব ভালো লেগেছে। উইন্ড চিমসে পাঁচটা লম্বা গোল মেটেল দিয়ে ঘেরা। সব থেকে মাঝের টা ঠিক কতকটা একটা পাতার মতো লাগানো। ওর মধ্যে কিছু লেখাও রয়েছে। খুব ছোটো অক্ষরে লেখাটা সহজে চোখে পড়বে না। তাতে খুব সুন্দর করে লেখা,

” শুভ জন্মদিন।”

স্পর্শ কী মনে করে মেটেলেটা উল্টো করে ধরতেই চোখে পড়লো, “স্পর্শায়ু।”

স্পর্শ আয়ুর ঘরের দিকে তাকালো। ওকে কাউকে জিজ্ঞেস করতেই হবে না এটা কে দিয়েছে? এতক্ষণে ও বুঝেগেছে খুব কাছের কারোর কান্ড এটা। মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল স্পর্শের। কেনো যেনো আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে।

-” এইটা আয়ু দিয়েছে।”

স্পর্শ চমকে তাকিয়ে দেখলো ওর মা। মাকে দেখে হালকা হেসে ও ঘরে চলে গেল। ওর মা ওর পিছু যেতে যেতে বলল,

-” তোর যাবার কয়েকদিন পর দিয়েছিল। তোর জন্মদিনের গিফট। আমিই ওখানে লাগিয়ে রেখেছি। মেয়েটার চয়েস আছে বলতে হবে।”

স্পর্শ ওর মায়ের হাত ধরে বিছানায় বসালো। ও মেঝেতে হাঁটু ভাঁজ করে বসে মায়ের কোলে মাথা রাখলো।

-” ওর পছন্দের সব কিছুই মায়াময়,ভালোবাসাময়। তাই না মা?”

-” আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে না। তোর মনকে জিজ্ঞেস কর।”

-” আমার মন তো এক জায়গাতেই স্থায়ী। ওই যে ,#নীলাম্বরী_প্রেমে। বুঝলে মা জননী?”

– ” আপনিই বুঝুন আমার সুপুত্তুর।”

(চলবে )

#নীলাম্বরীর_প্রেমে
#Tuhina pakira
পর্ব : ১৪

দুপুরের বেশ কড়া রোদ আজ। কপালের পাশ দিয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে, তা বারবার মুছে চলেছে আয়ু। আয়ু রাস্তা দিয়ে একাই হেঁটে আসছে। আর মাত্র বড়ো জোর ১৮ পা ফেললেই ওর বাড়ি। দুপুর হওয়ায় রাস্তায় কেউই নেই। আয়ুর মনে কেবল একটাই ভয়, ভুলেও যেনো মন্টু কাকুদের পোষা কুকুর টা না বেরিয়ে আসে। ও কুকুর খুব ভয় পায়। তার উপর পাড়ার মন্টু কাকুদের কুকুর মানেই সে আয়ুকে তাড়া করবেই করবে। কে জানে ওই কুকুরটার সঙ্গে আয়ুর কোন জন্মের ঝগড়া? হাতে থাকা ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো আয়ু। এখন দুপুর পৌনে 2টা। সূর্যের তীর্যক রশ্মি আয়ুর চোখে এসে পড়ছে। সূর্যের দিকে হাত দিয়ে আলো আসা আটকাবার চেষ্টা করে আয়ু আকাশের দিকে তাকালো। নীল আকাশের মাঝে সাদা অপরূপ মেঘমালা। কিছুটা দূরে বাঁশ বাগানের বাঁশ ঝারের মাথার দিকে ছোটো ছোটো বাঁশ পাতা হয়েছে। এই ছোটো ছোটো পাতা গুলো বেশ দেখতে লাগে। তার ফাঁকে খোলা নীল আকাশের সাদা মেঘমালা। সেখান দিয়ে ছোটো ছোটো পাখি গুলো একবার এই ডাল তো ওই ডাল করছে। জমিতে চাষ করা ক্লান্ত চাষিরা ঘুমিয়ে পড়েছে সামনের খামারের ওই যে বড়ো অশ্বত্থ গাছের তলায়। প্রকৃতি যেনো
থেমে গেছে কয়েক মুহূর্তের জন্য। প্রকৃতি তার লুকানো মায়াময় সিঁন্দুকের কৌটোয় আরেকটা অলস দুপুর লিখে রাখতে ব্যস্ত। দুপুরের শোভা প্রকৃতির এক নিবিড় ভালোবাসার বন্ধন। প্রকৃতি যেনো দুহাত ভরে এই বন্ধন অনুভব করছে। এই মোহনীয়তার মাঝে আয়ু থাকতে পেরে ওর মনের মাঝে প্রফুল্লের বিরাজ হচ্ছে। আয়ু নিজের মনেই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার কটা লাইন আউরে নিলো,

-” ওই যে অশ্বত্থ গাছটি, ও তো
পথিক জনের ছাতা,
তলায় ঘাসের গোলচেখানি
আদর করে পাতা।
চড়ছে দূরে গরু বাছুর,
গাছের তলায় শুয়ে,
দেখছে রাখল মেঘগুলো যায়
আকাশ টাকে ছুঁয়ে।”


বাড়িতে ঢোকার মুহূর্তে কারও কথায় আয়ু থেমে গেলো।

-” তোর আজ কলেজ যাবার কী ছিল? আমি বারণ করেছিলাম না।”

আয়ু জিভ কেটে পিছন ফিরে বললো,

-” সরি মিমি আসলে?”

-” আমি আসলে নকলে চিনি না তাড়াতাড়ি বাড়ি তে আয়। তোর খিদে পেয়েছে না?”

-” না মিমি আমি বন্ধুদের সাথে খেয়ে এসেছি। এখন কিছু খাবো না। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেবো।”

-” আমি এতো কিছু জানি না। তুই ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি আমাদের বাড়ি আয়। আমি পায়েস বানিয়েছি খাবি আয়। ”

-” মিমি শোনো তো।”

কিন্তু আয়ুর মিমি ওর কোনো কথাই শুনলো না। নিজের বাড়িতে চলে গেলো। নিজের ঘরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। স্পর্শ দুপুরে কিছুই খায়নি।এখনও ঘুমোচ্ছে। এতটা পথ জার্নি করেছে ঘুম তো পাবেই। স্পর্শের বাবা বাড়ি থাকলে এই দুপুরে তিনি নিজের ছোটো লাইব্রেরীর ঘরে থাকেন। দুপুরে তিনি ঘুমে মগ্ন না উপন্যাসে ডুবে থাকাই পছন্দ করে। দিহান আয়ানের কাছে রয়েছে। দুজনে নয় ঘুমোচ্ছে, নয় কোথাও দুষ্টুমি করতে ব্যস্ত।

কিছুক্ষণ পর আয়ু কতকটা লুকিয়ে লুকিয়ে স্পর্শদের বাড়িতে এলো। হলরুম পুরো ফাঁকা। আয়ু ওর মিমির ঘরে চলে গেলো। স্পর্শের মায়ের বসে থেকে তখন কেবল চোখে ঘুম এসেছে। সেই সময় আয়ু গিয়ে ওনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।

-” চল খাবি?”

-” মিমি বিশ্বাস করো আমি কিছু খাবো না। তুমি বরং আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। আমি একটু ঘুমোই।”

-” ঠিক আছে ঘুমো।”

তিনি আর কথা না বাড়িয়ে আয়ুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর আয়ু ঘুমিয়ে পড়লো। স্পর্শের মায়েরও সারাদিনের খাটাখাটনির পর দুচোখে ঘুম হানা দিল।

৩:১২ নাগাদ স্পর্শের ঘুম ভাঙলো। হাই তুলতে তুলতে নীচে নেমে এলো। আগের অভ্যেস মতো মায়ের ঘরে গেলো। স্পর্শ ওর মাকে বসে ঘুমাতে দেখে মায়ের গলা ধরতে গিয়েও ধরলো না। হঠাৎই ওর নজর গেলো ওর মায়ের কোলে। স্পর্শের মুখে অজানা কারণেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। আয়ু ওর মায়ের কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।

-” আহা, আমার মায়ের কোলে শুয়ে ম্যাডাম দেখি ভালই ঘুমোন। আচ্ছা নিশ্চিন্তে ঘুমান। আমি বাপু তোকে ডিস্টার্ব করবো না।”

স্পর্শ নিজের মনে কথা গুলো বিড়বিড় করে নিজের রুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো ওর মোবাইল টা নিয়ে। টুক করে ওদের দুজনের কটা ছবি তুলে নিলো।

-” এদেরই তো মা – মেয়ে লাগছে। তাহলে আমি কি বানের জলে ভেসে ভেসে এলাম নাকি। ”

স্পর্শ নিজের মনে বিড়বিড় করে এগিয়ে গেলো ওর বাবার টেবিলের পেন দানির কাছে। সেখান থেকে ব্ল্যাক কালারের পেন টা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলো আয়ুর দিকে।

আয়ুর ঘুম ভাঙলো আরও কিছুক্ষণ পর। ঘুমের মাঝে মনে হলো ওর মুখে কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছে। চোখ খুলতেই চোখে পড়লো এক মায়াবী চোখ। ওর দিকে নীচু হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। আচমকা স্পর্শকে দেখে ও বেশ ঘাবড়ে যায়। তড়াক করে উঠে বসে। ভাগ্যিস স্পর্শ ওর সামনে থেকে সরে গিয়েছিল। নইলে এতক্ষণে দুজনের মাথাই ঠুকে যেতো। আয়ুর নড়াচড়ায় স্পর্শের মায়ের ও ঘুম ভেংগে যায়। তিনি হঠাৎ স্পর্শ কে দেখে ঘাবরে যান। পড়ে মনে পড়ে স্পর্শ আজই বাড়ি ফিরেছে।

-” কী রে উঠলি তবে? তোর খিদে তেষ্টা পায় না নাকি?”

কথা বলার মাঝেই তিনি দেখেন স্পর্শ আয়ুর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে।তাই তিনি আয়ুর দিকে তাকান। তার মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। আয়ু ভ্রু কুঁচকে স্পর্শের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। পড়ে মিমিকে হাসতে দেখে ও মিমির দিকে গোলগোল চোখে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠলো। বিছানার বিপরীতে থাকার ড্রেসিং টেবিলের আয়ানায় নিজেকে দেখে থমকে যায় আয়ু। নাকের দুই পাশ দিয়ে বিড়ালের মত গোঁফ করা, চোখের কোণে আধিবাসী মেয়েদের মতো তিনটে অতএব চিহ্ন আঁকা। আয়ু নিজেকে দেখে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু ওকে এভাবে দেখে স্পর্শ আর ওর মা হুহা করে হেসে উঠলো। কিন্তু স্পর্শের মা যেই আয়নার দিকে তাকালো তিনি যেনো থমকে গেলো। আয়ুর মতো তার মুখের ও একই অবস্থা। দুজনেই মুখ ফুলিয়ে স্পর্শের দিকে তাকালো। স্পর্শ হাতের পেনটা আগের জায়গায় রেখে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো। বলা যায় না গুলাব ঝড় এখানেই না বর্ষিত হয়।

কিন্তু দরজার কাছে যেতেই আয়ু ওর পিছনে তাড়া করলো। স্পর্শও ভো দৌড় দিয়েছে।

-” এটা তুমি কি করেছো স্পর্শ দা?”

-” দারুন না। তোদের কিন্তু হেব্বি লাগছে।”

-” তুমি ছুটছো কেনো? আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলো না , হেব্বি লাগছে।”

-” আমি কি পাগল নাকি। আমি যেই দাঁড়াবো তুই কি আমাকে ছেড়ে দিবি নাকি?”

-” ছেড়ে দেবার তো কথাই নেই। তোমাকেও আমি পুশি ক্যাট সাজাবো। তাড়াতাড়ি দাঁড়াও।”

এতক্ষণ ওরা সারা হল রুম জুড়ে ছুটোছুটি করছিল। হঠাৎ করেই আয়ু থেমে গেলো। পুরোনো কতো দুষ্টু মিষ্টি স্মৃতি ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো। চোখটা ছলছল করে উঠলো আয়ুর। ও একবার স্পর্শকে দেখে নিয়ে মিমির ঘরের ওয়াশরুমে চলে গেল।

স্পর্শের মা একে একে সব খাবার এনে টেবিলে রাখলো। আয়ু কে অনেক বলার পর ও শুধু পায়েস খাবে বলে রাজি হয়েছে। আয়ু কে একটা বাটিতে পায়েস দিয়ে তিনি গ্লাসে জল ঢালছিল তখন স্পর্শ এসে আয়ুর ঠিক সামনের চেয়ারে বসলো। আয়ু একবারও স্পর্শের দিকে তাকালো না। ও নিজের মতো খেয়ে চলেছে।

নিজের ঘরে ফোনের রিংটোন শুনে স্পর্শের মা স্পর্শকে বললো,

-” নে খেতে শুরু কর। সব তোর পছন্দ মতো রান্না, সুক্ত, ইলিশ সব আছে। আমি দেখি কে ফোন করলো।”

স্পর্শ বাচ্চাদের মতো হেসে মাথা দোলালো। ওর মা চলে যেতেই ও খাবারে হাত দিতে গিয়েও থেমে গেলো। সামনে আয়ু নিজের মতো খেয়ে চলেছে। সামনে যে কেউ বসে আছে সেই দিকে ওর কোনো হুশ নেই।

-” কী রে আয়ু, কেমন আছিস?”

আয়ু স্পর্শের দিকে না তাকিয়েই বললো,
-” ভালো।”

ব্যাস আর কিছু বললো না আয়ু। উল্টে বিপরীত মানুষটাকে,” সে ভালো আছে কিনা? ” জিজ্ঞেস করবে, তা ও করলই না। কতকটা ইচ্ছে করেই। আয়ুর মতে সামনের মানুষটা খুব বেশিই ভালো আছে হয়তো। কিন্তু একবারও ভাবলোনা ‘ভালো আছে’ আর ‘হয়তো ভালো আছে’ এর মধ্যে তফাৎ কতটা।

স্পর্শের যেনো সহ্য হলো না আয়ুর ব্যাপার। তাই ও টেবিলের দিকে ঝুঁকে সামনে আয়ুর সামনে থাকা পায়েসের বাটিটা টেনে আনলো। পাশে রাখা একটা চামচ নিয়ে নিজেই আয়ুর বাটির পায়েস খেয়ে নিলো। বেশি না দুই চামচ মতোই ছিল।

সামনে বড়ো একটা জায়গায় পায়েস রাখা সত্বেও, আয়ুর থেকে পায়েসের বাটিটা নিয়ে নেওয়ার আয়ু পায়েসের বড়ো বাটিটা ওর দিকে টেনে নিয়ে খেতে লাগলো। স্পর্শও কী কম যায় নাকি। ও আবারও আয়ুর থেকে পায়েসের বাটিটা টেনে এনে নিজের মতো খেতে লাগলো। মুখের খাবারটা শেষ করে আয়ু স্পর্শের থেকে পায়েসের বাটিটা নিজের কাছে টেনে এনে খেতে লাগলো। এই ভাবেই দুজনে ভাগ বাটোয়ারা করে পুরো পায়েস টা খেতে লাগলো।

স্পর্শের মা নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আয়ু আর স্পর্শের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এক ধ্যানে। হঠাৎই তার কাঁধে কেউ হাত দিয়ে বললো,

-” এখানে দাঁড়িয়ে কি করেছো?”

আয়ুর মা পাশে তাকিয়ে দেখলো ওনার পতি দেব অর্থাৎ স্পর্শের বাবা।

-” কিছু না ওদের দেখছি। কী ভালো লাগছে না ওদের?”

স্পর্শের বাবা আয়ু আর স্পর্শের দিকে তাকিয়ে বললো,

-” ওরা ওই ভাবে বাটি টানাটানি করে খাচ্ছে কেনো? বাড়িতে কী বাটির অভাব পড়েছে?”

স্পর্শের মা বেশ বিরক্ত হয়ে স্বামীর দিকে তাকালো।

-” ওটা যদি তুমি বুঝতে তাহলে তো হয়েই যেতো। পাতি মাষ্টারমশাই। যাও চা দিয়ে যাচ্ছি আমি।”

-” আমি পাতি মাস্টার মশাই হলে তুমি তো আর আমার ছাত্র না। তুমি হলে সহধর্মিণী। বুঝলেন ম্যাডাম।”
-” যাও তো।”

স্পর্শের মা চলে গেলো রান্নাঘরে। এদিকে আয়ু ও স্পর্শ দুজনেই পায়েসের বাটি শেষ করে ফেলেছে।

-” এই আমার পায়েস কয়?”

দিহানের কথায় স্পর্শ আয়ুর দিকে তাকিয়ে বললো,

-” ওই পাশের বাড়ির বুড়ি টা খেয়ে নিয়েছে।”

-” আর এই বাড়ির হুলো বুড়ো বেড়ালটা বেশি খেয়ে নিয়েছে।”

স্পর্শের দিকে ভেংচি কেটে আয়ু নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। স্পর্শ ও শিস দিতে দিতে নিজের ঘরে চলে গেল। শুধু দিহান রয়ে গেলো। পায়েসের বাটিটা তুলে দেখলো বাটির গায়েও কিছু লেগে নেই।

-” আমার পায়েস।”

(চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here