নীলচে_তারার_আলো,পর্ব_১০

নীলচে_তারার_আলো,পর্ব_১০
নবনী_নীলা

মোহনা আরো বললো,” রাগ যদি ওর উপর না থাকে তাহলে ভালোবাসে দেখতেই পারিস। তোর যদি তেমন কোনো ইচ্ছা থাকে তাহলে আমাকে বলতে পারিস। আমি হিয়াকে তোর রুমে শিফট করিয়ে দিবো। আর বলতে লজ্জা লাগলে একটু হাসবি তাহলেই আমি বুঝে যাবো।”

” হয়েছে তোর আর জনসেবা করতে হবে। আমার প্রয়োজন হলে আমি তুলে নিয়ে আসতে পারবো। তোর হেল্প আমার লাগবে না। আর আমার ইচ্ছে ছাড়া তোর এসব ট্রিকসেও কাজ হবে না। দিদি এখন যা এই রুম থেকে। উল্টা পাল্টা কথা বলে মাথাটা ধরিয়ে দিয়েছিস।” থমথমে মুখে বললো শুভ্র।

” আরে বুঝি বুঝি। আমাকে বলতে লজ্জা লাগছে তোর।”, বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো মোহনা।

“এই তোর বর ফিরবে কবে? এইভাবে মুক্ত পাখির মতোন তোকে ছেড়ে দিয়েছে কেনো? বরের শোকে তো পাগল হয়ে যাচ্ছিস। উল্টো পাল্টা বকছিস।”

শুভ্রের কথায় মোহনা মুখ বাকিয়ে বললো,” ফিরেছে জামাই কিন্তু আমি যাবো না। আমাকে এসে নিয়ে যেতে বলেছি, বিকেলে আসবে।”

“এমনিতেই তো কথা বলে কম জ্বালাস না আর কত অত্যাচার করবি।”, কফির মগটা টেবিলের একপাশে রাখতে রাখতে বললো শুভ্র।

” এই আমি তোর বড় হই, সম্মান দিয়ে কথা বল।”, ভ্রূ কুচকে বললো মোহনা।

” ওকে ম্যাডাম আপনি এখন আসুন।”,

” জলদি নীচে আয়।”,বলেই আড় চোখে তাকিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো মোহনা।

আজ শুক্রবার শুভ্রের ভার্সিটি নেই। সারাদিন সে কি করবে সেটাই ভাবছে। বই পড়তে পারে কিন্তু বই আনতে আবার ওই মেয়েটার রূমে যেতে হবে। উফফ আরেক যন্ত্রণা।

🌟 বিকেলে মোহনার বর সত্যি সত্যি এলো মোহনাকে নিয়ে যেতে। ব্যাবসায়ের কাজে তাকে অনেকদিন দেশের বাহিরে থাকতে হয়েছিল।
মোহনার প্রেম করে বিয়ে, সে আরেক ইতিহাস। রবীউল সাহেব এই ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবেন না। আরাব সবে ভার্সিটি থেকে বের হয়েছে বেকার এক ছেলে। এমন ছেলের সাথে কিছুতেই তিনি মেয়ে বিয়ে দিবেন না।মোহনাকে আরাবের সাথে চার বছর কোনো যোগাযোগ রাখতে দেন নি রবীউল সাহেব। মেয়েকে বড়ই ভালোবাসেন, তিনি চান নি মেয়ে সারাজীবন কষ্ট করে কাটায়।

কিন্তু আরাব হাল ছাড়েনি। সে নিজের পায়ে দারিয়েছে। ভালোবাসার মানুষটিকেও পেয়েছে। রবীউল সাহেব আরাবের এমন পরিবর্তন দেখে অবাক হয়েছিলেন ঠিক তবে এটাও বুঝেছেন যে ছেলেটা অসাধারণ। একদিন হটাৎ সপরিবারে নীলকুঞ্জে আরাব উপস্থিত। রবীউল সাহেব রীতিমত অবাক,তিনি না করার কোন উপায় পেলেন না। নিজেকে মোহনার জন্য একদম উপযুক্ত করে তবেই এসেছে রবীউল সাহেবের সামনে। মোহনা তখন তার ফুফুদের বাড়িতে গিয়েছে বেড়াতে। হটাৎ বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনেই মোহনার যে কান্না, তাকে সামলায় কে?

আরাবের অনুরোধে বাড়ির সবাই ছেলের পরিচয় গোপন রাখে। আংটি পরানোর দিন আরাবকে দেখে মোহনা অজ্ঞান হয়ে গেছিলো। তারপর জ্ঞান ফিরতেই কান্না শুরু। সে ঘটনা বলে এখনো আরাব হাসে আর মোহনা তখন গাল ফুলিয়ে থাকে।

আরাব সেই বিকেলে এসে বসে আছে। মোহনা অকারনেই নিজেকে অনেক ব্যাস্ত রাখছে। আসার পর থেকে আরাবকে শান্তিতে একটা কথাও বলার সুযোগটা দেয় নি সে। আরাবকে এইভাবে জ্বালিয়ে সত্যি মজা পায় মোহনা। মোহনা সিড়ি বেয়ে দোতলার বড় করিডোরটার দিকে যাচ্ছে। আরাব তার পিছু পিছু আসবে সে সেটা জানে। তাই মুচকি মুচকি হাসছে।

মোহনা করিডোরে আসতেই আরাব পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে বলল,” এবার পেয়েছি। ম্যাডাম আপনার এতো ব্যাস্ততা কিসের?”

মোহনা হকচকিয়ে আশেপাশে তাকালো। তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যাস্ত হয়ে বললো,” কি করছো! ছাড়ো।”

আরাব কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
” এটা আমাকে ইগনোর করার শাস্তি,ছাড়বো না।” বলেই আলতো করে মোহনার গালে চুমু খেলো। মোহনা লজ্জায় লাল হয়ে চুপ করে রইলো। আরাব এমন কিছু করবে সে ভাবেনি। এতো দিন পর আরাবকে কাছে পেয়ে তার ভাল্লাগছে ।

হিয়া ছাদ থেকে নামছিলো। সিড়িটা করিডোরের সাথেই, নামার সময় মোহনা আর আরাবকে দেখে সে লুকিয়ে পড়লো। এইসময় নিচে নামলে ওরা হয়তো ডিস্টার্ব হবে। হিয়া রেলিংয়ের মাঝখান দিয়ে মাথা বের করে তাকিয়ে রইলো, সুযোগ পেলে নেমে যাবে। এদের দুজনকে একসাথে সত্যি মানায়। কিছু কাপল থাকে না দেখলেই মনে হয় মেড ফর ইচ আদর। এরাও তেমন।
কিন্তু হটাৎ আরাবের এমন কান্ড দেখে হিয়া হকচকিয়ে গেল। আমনা আমনি তার মুখে হাসি চলে এলো। কি কিউট আরাব দুলাভাই, রোমান্টিক ও বটে।

শুভ্র দোতলায় উঠছিলো হিয়াকে এমন মাথা বের করে রাখতে দেখে আস্তে আস্তে উপরে উঠে একদম হিয়ার সামনে এসে দাড়ালো। হিয়া তখন নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসছিলো।

হটাৎ আচমকা শুভ্রকে দেখে আতকে উঠলো সে। শুভ্র একদম হিয়ার মুখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে জোড়ে চিৎকার দিতে যাবে বুঝতে পেরে তখনই শুভ্র হাত দিয়ে হিয়ার মুখ চেপে ধরে চিৎকার থামলো।

তারপর ভ্রূ কুচকে বললো,” বাদর উপাধিকে এতোই সিরিয়াসলি নিয়েছো যে একদম বাদরের সব গুনে নিজেকে গুনন্নিত করে নিচ্ছো।”
হিয়ার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ইচ্ছে তো করছে শুভ্রের হাতে একটা কামড় বসিয়ে দেয়। কামড়টাকি দেওয়া যায়? কি হবে দিলে? জোড়ে একটা কামড় বসিয়ে দৌড় দিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে ফেলা যাবে। হিয়া আড় চোখে নিজের রূমের দরজার দিকে তাকালো বেশি দূরে নাই কাছেই আছে। একটা কামড় তো লোকটাকে দেওয়াই যায়।

বাঁদর দেখেছো বাঁদরের কামড় খাও নি। আজ বুঝবে কতো ধানে কত চাল। যা ভাবা তাই কাজ হিয়া চোখ বন্ধ করে সজোরে শুভ্রের হাতে কামড় বসিয়ে দিলো। শুভ্র চোয়াল শক্ত করে ব্যাথা সহ্য করলো। হিয়া ভেবেছিল চোখ খুলে দেখবে শুভ্র ব্যাথায় কাতরাচ্ছে কিন্তু খুলে তাকিয়ে দেখলো শুভ্র শক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরে এনার কি ব্যাথাও লাগে না? কি মুশকিল! হিয়া ভয়ার্ত দৃষ্টিতে একবার শুভ্রের দিকে তাকালো। বাপরে তাকিয়ে আছে কিভাবে? আজকে শেষ। আজ আর রক্ষে নেই রে হিয়া।

তবুও নিজেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করতে রেলিংয়ের থেকে মাথা বের করে দৌড় দিতে যাবে শুভ্র হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। আচমকা এমন টানে হিয়া ছিটকে এসে শুভ্রের বুকের পড়লো। কিছুক্ষণের জন্যে যেনো নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো হিয়ার। সেকেন্ড কয়েক পরেই হিয়া লাফিয়ে শুভ্রের বুক থেকে মাথা তুললো। হার্ট বিট যেনো লাফাচ্ছে, হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। শুভ্র শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে। সে চাহনিতে হিয়ার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। শুভ্র কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় খেয়াল করলো মোহনা আর আরাব এইদিকেই আসছে। শুভ্র হিয়াকে টানতে টানতে ছাদের সিড়ির দিকে নিয়ে গিয়ে দেওয়ালের সামনে দাড় করালো। হিয়া চুপ করে আছে কারণ কিছুক্ষনের মধ্যে তার ওপর দিয়ে যে ভয়াবয় ঝড় আসতে চলেছে তার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করছে।

হিয়া পিছাতে পিছাতে একদম দেওয়ালের সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো। দেওয়ালটা আরেকটু পিছে থাকতে পারলো না। হিয়া অভিযোগ নিয়ে একবার আড় চোখে তাকালো দেওয়ালের দিকে।

” কি হলো পিচাচ্ছো কেনো? কিছু না করার আগেই এতো ভয়?”, বলতে বলতে শার্টের হাতা ভাজ করছে শুভ্র। শুভ্রের দিকে তাকিয়ে হিয়ার চোখ কপালে উঠে গেলো শার্টের হাতা ভাজ করছে কেনো লোকটা কি তাকে মারবে? যদি ধিশুম করে নাকে একটা ঘুষি মারে। নাকি তুলে আছাড় দিবে? দিতেও পারে। ভয়ে হিয়ার ইচ্ছে করছে দেয়ালটা কেটে দেওয়ালের ভিতরে ঢুকে যায়।

শুভ্র এগিয়ে আসতে আসতে বললো,” খুব সাহস তো তোমার! তা এখন দেখি মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না কেনো? কাম অন, সাহস দেখাও। কথা বলো। স্পিক আপ।” শেষের টা কড়া গলায় বলতেই হিয়া কেপে উঠলো। শুভ্র এগুতে এগুতে একদম কাছে চলে এসেছে। দেয়ালের দুপাশে হাত রেখে ঝুকে আসতেই হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো।

শুভ্র নিজের হাতের দিকে তাকালো একদম দাগ বসিয়ে দিয়েছে,লাল হয়ে আছে সেই অংশ। শুভ্র দাতে দাত চিপে বললো,” একচুয়ালি আমি তোমাকে বাঁদর বলে ভুল করেছি। তোমাকে বিড়াল বলা উচিৎ ছিল, জঙ্গলী বিড়াল।”, শুভ্রের এমন কথায় হিয়া রেগে তাকালো। হিয়া দাতে দাত চিপে বললো,” দেখুন আমাকে আপনি এইসব বলবেন না। আমি মোটেও জঙ্গলী বিড়াল না।”

” বিড়াল তোমাকে বলবো না তো কাকে বলবো? বিড়াল হওয়ার সব কোয়ালিটি তো তোমার মধ্যে আছে। খালি গালের দুপাশে দুটো দাড়ি নেই বিড়ালের যেমন থাকে।”, শুভ্রের এই কথায় হিয়া চটে গেলো। রেগে গিয়ে বললো,” দেখুন একদম উল্টা পাল্টা কথা বলবেন না। আমি বিড়াল হলে আপনি কি? হনুমান কোথাগার।”, শেষের কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে আসলো হিয়ার।বলেই সঙ্গে সঙ্গে মুখ চেপে ধরলো সে। আজ আর রক্ষে নেই এই লোকটা তোকে তুলে ছাদ থেকে নিয়ে ফেলে দিবে। একেই বলে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা। আজ তুই শেষ।

শুভ্রের রাগ যেনো আকাশ ছুঁয়েছে। শুভ্র ধমকের সুরে বললো,” কি বললে তুমি?” সে ধমকে হিয়ে ভয়ে চুপসে গেছে। সেই মুহুর্তে রহিমা খালা পনির জগ হাতে শুভ্রের রূমে যাচ্ছিল। শুভ্র এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের রাগ কমাচ্ছিল। রহিমা খালাকে দেখে ওনার হাত থেকে পানির জগটা নিয়ে এসে সবটা পানি হিয়ার মাথায় ঢেলে দিতেই হিয়া ভিজে একাকার হয়ে গেলো। রহিমা খালা হটাৎ এমন কিছু দেখে হকচকিয়ে উঠলেন। শুভ্র জগটা খালাকে এগিয়ে দিয়ে বললো,” তুমি এখন যাও।” রহিমা খালা হতবাক হয়ে নিচে নামলেন।

হিয়া ভেজা অবস্থায় নিজের দু বাহু ধরে প্রচন্ড রাগ নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্র হিয়ার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো,” এইবার একদম পারফেক্ট বিড়াল লাগছে, যাকে বলে ভিজে বিড়াল।” বলেই হিয়ার দিকে তাকালো।

রাগে হিয়ার গা জ্বলে যাচ্ছে। দাতে দাঁত চিপে সে রাগ সহ্য করছে। শুভ্র হিয়ার দুপাশ থেকে হাত সরিয়ে দাড়ালো তারপর বললো,” আমাকে রাগিয়ে দিলে তার ফল তোমার জন্যই খারাপ হবে। বেটার আমার থেকে দূরে থাকো।” বলেই শুভ্র চলে গেলো। হিয়া রাগী চোখে শুভ্রের চলে যাওয়া দেখলো। তারপর মনে মনে বললো,”এই হনুমানটাকে যদি আমি পানিতে ফেলে নাকানি চুবানি না খাইয়েছি আমার নাম হিয়া না। আমিও কম যাই না।”

[চলবে ]

4 COMMENTS

Leave a Reply to Idrisha Cancel reply

Please enter your comment!
Please enter your name here