নীলকণ্ঠ অন্তিম_পর্ব

নীলকণ্ঠ
অন্তিম_পর্ব
নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা
________
অফিসে পৌঁছে কণ্ঠ দেখতে পেল এমডি বা নীল কেউই এসে পৌঁছায়নি। সে অপেক্ষা করতে থাকল। পাঁচ মিনিটের মাথায় মি. শোভন তথা অফিসের এমডি এসে পৌঁছলো। একবার সে কণ্ঠের দিকে দৃষ্টিক্ষেপণ করল অতঃপর নিজের কেবিনে চলে গেল। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শোভন চিৎকার করে তার পিএ জিহানকে ডাকে। জিহান ছুটতে ছুটতে শোভনের কেবিনে উপস্থিত হলে শোভন চিৎকার করে নীলের কথা জানতে চায়। জিহান নতমস্তকে জানায় নীল এখনো অফিসে পৌঁছেনি। এসব কিছুর নিরব দর্শক ছিল কণ্ঠ। চুপচাপ সে দেখতে লাগল স্বার্থের জন্য শোভন ঠিক কতটা নিচে নামতে পারে। বেশ খানিকটা সময় শোভন তার চেচামেচি চালিয়ে গেল। অথচ অফিস টাইম শুরু হতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি। এসব চিন্তায় মগ্ন ছিল কণ্ঠ ঠিক তখনই আগমন ঘটে নীলের। নীল আসার খবরটা জিহান তৎক্ষণাৎ মি. শোভনকে জানান। মি. শোভন কেবিন থেকে বেরিয়ে নীলের পথ রোধ করে দাঁড়ান। অতঃপর নীলের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু বাক্য ছুড়ে দেন।
‘ কী ব্যাপার মিস্টার সৈকত ইভান নীল? চাকরি করার ইচ্ছে আছে? কোনো কাজই তো ঠিক মতো করেন না। ‘ তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবেই কথাগুলো বলল শোভন।
‘ অবশ্যই চাকরি করার ইচ্ছে আছে স্যার কিন্তু আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। ‘ অবাক হয়ে বলল নীল।
‘ না বোঝার মতো কোনো কথা তো বলিনি আমি। স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বলেছি। একটু পরে আমার কেবিনে আসবেন। ‘ রাগান্বিত হয়ে বলল শোভন।
‘ ওকে স্যার। ‘ প্রবল হতাশায় জর্জরিত কণ্ঠে বলল নীল।
এদিকে কণ্ঠ বসে বসে পুরোটা কথোপকথন শুনল। রাগ তার শিরা উপশিরা জুড়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শুধুমাত্র তাকে কেন্দ্র করে শোভন, নীলের সাথে এহেন আচরণ করছে। এ যেন কণ্ঠ মেনে নিতে পারছে না। তবুও চুপচাপ সবটাই সে প্রত্যক্ষ করে চলেছে। আজ যদি কোনো বিরাট ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি কণ্ঠ হতো! তবে নীলকে এতটা কষ্ট পেতে দেখা লাগত না। এসব নানান আজগুবি চিন্তায় চিন্তিত হয়ে রয়েছে কণ্ঠ। এমতাবস্থায় নীলকে ডেকে পাঠালেন শোভন। নীল কেবিনে যাওয়ার পূর্বে কণ্ঠের চিন্তিত মুখাবয়বের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। চোখের ইশারায় কণ্ঠকে শান্ত হতে বলল এবং আশ্বস্ত করে কেবিনে পা বাড়ালো। কণ্ঠের বুকের ভেতরে ধক করে উঠল। আবার যে কত অপমান সইতে হবে সেই দুশ্চিন্তায়।
________
নীল আর শোভনের কথা শোনার প্রবল আগ্রহকে দমিয়ে রাখতে না পেরে অভদ্র একটা আচরণ করে বসল কণ্ঠ। সে নক না করেই কেবিনে ঢুকে পড়ল। তৎক্ষণাৎ শোভন বলে উঠল,
‘ তোমাকে আমি ডেকেছি? ‘
‘ আসলে স্যার আমার রেজিগ্নেশন লেটারটা….. ‘ কণ্ঠ কথা সম্পন্ন করার পূর্বেই তাকে থামিয়ে শোভন বলল,
‘ বাইরে গিয়ে বস। আমি তোমার সাথে এ নিয়ে পরে কথা বলব। ‘
‘ স্যার আসলে আপনার সাথে কথা বলাটা জরুরি। ‘
কথোপকথন চলছিল। হঠাৎ এক পর্যায়ে ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। পুরো কেবিন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। কেবিনের বাইরে প্রচুর কোলাহল, মানুষের চিৎকার। মুহূর্তেই পরিস্থিতি পাল্টে গেল। শোভনের মনে জমে থাকা ক্রোধ ভয়ে রূপান্তরিত হলো। কণ্ঠের দৃষ্টিপটে সেই ধোঁয়াটে স্বপ্ন ভেসে উঠল। আর নীলের চোখে তার মায়ের মায়াময় মুখাবয়ব আর নীলার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ভেসে উঠল। কণ্ঠ এগিয়ে গিয়ে কেবিনের দরজা সামান্য একটু খুলতেই পুরো কেবিন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। নীল বলল,
‘ কণ্ঠ দরজা চাপিয়ে দাও। আগুন লেগেছে বোধহয়। পুরো ফ্লোর ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে পরেছে। ‘
‘ আমাদের বের হতে হবে তো। ‘
‘ ইলেকট্রিসিটি নেই লিফট বন্ধ হয়ে আছে। পুরো ফ্লোর অন্ধকার। এখান থেকে আমরা কীভাবে বের হবো। আচ্ছা আমি ফায়ার সার্ভিসকে কল করছি। ‘
অতঃপর যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে ধোঁয়ার পরিধি বেড়েছে আর আগুনের তীব্রতাও। অষ্টম তলার কেউ বের হতে পারেনি। আগুনের সূত্রপাত ষষ্ঠ তলায়। তাই সিড়ি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে রয়েছে। অষ্টম তলায় প্রায় আটাশ জন আটকা পড়েছে। খবরের শিরোনামে বড় বড় অক্ষরে লাল কালিতে ব্রেকিং নিউজ আকারে প্রচারিত হচ্ছে ” স্বপ্নীল ম্যানশনের ষষ্ঠ তলায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। সপ্তম ও অষ্টম তলায় আটকা পড়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক। ”
মুহূর্তের মাঝে কী থেকে কী ঘটে গেল! নীলা খবরের চ্যানেল পাল্টাতে গিয়ে এহেন একটা সংবাদ দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তাহলে তার ভাইয়া এখন কী অবস্থায় আছে? এসব ভেবেই শরীর হিমশীতল হয়ে আসে নীলার। দ্রুত সে নীলকে কল করে। একবার, দুবার, তিনবার এভাবে বহুবার কল দিতে থাকে সে কিন্তু রিসিভ হয় না।
__________
অপরদিকে,
ঘটনাস্থলে এখনো ফায়ার ব্রিগেড পৌঁছতে পারেনি। অষ্টম তলায় আটকে পড়া ২৮ জনের মাঝে নীল, কণ্ঠ ও শোভন রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছে। কেউ স্বাভাবিক নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের কার্যক্রম চালাতে পারছে না। বিষাক্ত ধোঁয়ার প্রকপে সকলের অবস্থা আশঙ্কাজনক। নীলের ফোন দীর্ঘসময় যাবৎ ভাইব্রেট করছে। সে কলটা রিসিভের চেষ্টা করছে কিন্তু কোনোমতেই পারছে না। অনেকটা সময় চেষ্টার পর কম্পনরত হাতের দ্বারা পকেট হতে ফোন বের করল নীল। ২৩টা মিসড কল উঠে রয়েছে তাতে। প্রতিটি কল এসেছে নীলার নাম্বার থেকে। নীল অনেক কষ্ট করে নীলার নাম্বারে ডায়াল করল। রিং হতে না হতেই কল রিসিভ হলো,
‘ ভাইয়া তোর অফিসে আগুন লেগেছে না? ‘ এতটুকু বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে নীলা।
‘ ধুর পাগলি কাঁদছিস কেন? সামান্য আগুন লেগেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই উদ্ধার কাজ শুরু হবে। আমার কিচ্ছু হবে না দেখিস। ‘ নিজের ভেতরকার আবেগগুলোকে চেপে অনেক কষ্টে কথাগুলো বলল নীল। কণ্ঠ নীলের পাশেই বসে আছে এবং নীলের হাত শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে।
‘ ভাইয়া আমার খুব ভয় করছে। ‘ কান্নারত কণ্ঠে বলল নীলা।
‘ তুই মাকে কিছুই বলিস না। আম্মু টেনশন করবে। আর কান্না করিস না। চোখের পানি মোছ। আমি কয়েকটা কথা বলব মনোযোগ দিয়ে শুনবি। ‘ আদেশসূচক কণ্ঠে নীল বলল।
‘ বল ভাইয়া। ‘ নাক টেনে বলল নীলা। কিন্তু চোখের পানি কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না তার।
‘ আমার আলমারিতে কিছু ফিক্সড ডিপোজিড এর কাগজপত্র আছে। মোট ৩টা ব্যাংকে ৫ টা অ্যাকাউন্ট করা আছে। সব মিলিয়ে ছাড়ে ছ’লাখ টাকা আছে। আমার সারাজীবনের সঞ্চয়। তোর বিয়ে আর মায়ের চিকিৎসার জন্য জমিয়ে ছিলাম। জানি খুবই সামান্য তবে কিছুদিন কষ্ট করতে হবে না। আর গুরুত্বপূর্ণ কথা শোন আমার টেবিলের ড্রয়ারে একটা ডায়েরি আছে ওখানে সবগুলো অ্যাকাউন্টের পিন নাম্বারসহ যাবতীয় তথ্য লেখা আছে। কী হলো শুনছিস তো নাকি কেঁদেই যাচ্ছিস? ‘
‘ আমি শুনেছি ভাইয়া। ভাইয়া তোর খুব কষ্ট হচ্ছে নারে? ‘ বলেই ডুকরে কেঁদে উঠে নীলা।
‘ তা তো একটু হচ্ছেই। কাজের কথা শোন। তুই আলমারি খুলে কাগজপত্রগুলো খুঁজে দেখ আমি লাইনে আছি। আর ডায়েরিটাও খোঁজ। না পেলে বল। আমার জমানো কিছু টাকা আলমারির নিচের তাকে কাপড়ের ভাজে আছে। সব খুঁজে দেখ জলদি। ‘ আবারো নীলের আদেশ।
‘ ভাইয়া আমি পারব না। ‘
‘ কথা কম বল আর চোখ মোছ। যা বলেছি তা শোন। ‘ নীলের শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কলটা নীল কেটে দিল।
_________
নীলের মা হাঁক দেন নীলার উদ্দেশ্যে,
‘ নীলা রে আমার মনটা যেন কেমন করছে নীল আসবে কখন? ‘
‘ এসে পড়বে হয়ত কাজে আটকে গেছে। ‘ গলা স্বাভাবিক করে মায়ের ঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বলল নীলা। চোখ থেকে তার অঝোরে জল নির্গত হচ্ছে।
‘ ওহ্ আমি নামাজ পড়ে রেডি হই। নীল নিয়ে যাবে তো। ‘
নীলা কোনো উত্তর দেয় না।
___________
কণ্ঠ অনেক চেষ্টা করে কথা বলার। কিন্তু তীব্র গলার জ্বালায় তা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠে। তবুও সে নীলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ নীল আপনাকে একটা মিথ্যে কথা বলেছি গতকাল রাতে। আমি না আপনাকে খুব ভালোবাসি। আপনার সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু নিয়তি আমাদের সহায় ছিল না। নীল আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি। ‘
জবাবে নীল শুধু বলে, ‘ আমিও ‘ আর কিছুই সে বলতে পারে না। কাঁদতে থাকে। হঠাৎ নীল ও কণ্ঠ শোভনের দিকে দৃষ্টিপাত করে শোভন অঝোরে চোখের পানি ফেলছে। তাদের চোখাচোখি হতেই ইশারায় হাতজোর করে ক্ষমা চায়। নীল ও কণ্ঠ সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। কণ্ঠ বারবার পানি খেয়ে শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে। আর নীল হাত দিয়ে ধোঁয়া সরাবার অনর্থক চেষ্টা চালাচ্ছে।
________
স্বপ্নীল ম্যানশনের বাইরে উৎসুক জনতার তীব্র জটলা পেকেছে। অনেকেই স্বেচ্ছাসেবক তবে দেখতে আসা লোকের সংখ্যাই বেশি। ইতোমধ্যে আটকে পড়াদের স্বজনদের আহাজারিতে এলাকার আকাশ, বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। মি. শোভনের স্ত্রী ও সন্তানেরা বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। তিনি মি. শোভনকে কল করলেন। সাথে সাথেই রিসিভ হলো,
‘ আমাকে মাফ করে দিও। সারাজীবন তোমাকে ঠকিয়েছি। আল্লাহ হয়তো তার শাস্তি আমায় দিচ্ছেন। ছেলে মেয়েদের দেখে রেখো। ওদের মানুষের মত মানুষ কর। আমার মত মুখোশধারী হতে দিও না। ‘ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন শোভন।
‘ তোমার কিছু হবে না। আমি সব জানতাম, তুমি কখনোই আমায় ঠকাওনি। আমি জেনে, বুঝে সবটা মেনে নিয়ে ছিলাম শোভন। ‘ মিসেস. শোভনের গলা কাঁপছে।
‘ তুমি মহান। আমার মত নিকৃষ্ট কীটের মুখে তোমার নাম উচ্চারণ করে তোমাকে কলঙ্কিনী করতে চাই না। ভালো থেকো, মাফ করে দিও। ‘ কলটা কেটে দিলেন শোভন।
গগনবিদারী চিৎকারে ভেঙে পড়েন মিস. শোভন। মাকে কাঁদতে দেখে সন্তানেরাও কান্নায় ভেঙে পড়ে। চারিদিকে হৃদয় বিদারক দৃশ্য। অনেকেই বিল্ডিং থেকে লাফিয়েছেন বাঁচার আশায় কিন্তু অতটা উঁচু থেকে পড়ে কেউই বাঁচতে পারেনি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতেই পারছে না ফায়ার সার্ভিস। কী এক বিভীষীকাময় অবস্থা!
আগুন জ্বলছে প্রায় আট ঘণ্টা যাবৎ। এখন পড়ন্ত বিকেল। থেমে থেমেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে। অষ্টম তলার কেউ বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। সকলেই তীব্র ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ইহলোক ত্যাগ করেছে। অনেকগুলো লাশের সাথে উদ্ধার হয় একজোড়া লাশ যারা একে অপরের হাত শক্ত করে আকড়ে ধরে রয়েছে। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। ঠিক ধরেছেন #নীল_কণ্ঠ একত্রে হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে সঙ্গে নিয়ে গেছে তাদের অপূর্ণ ভালোবাসা। সব পরিণতি পূর্ণতা পায় না, অপূর্ণ থেকেই হারিয়ে যায়। ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল নীল ও কণ্ঠের সাথে। ৪৩ টা লাশের মাঝে তারাও ছিল। বাঁচার ইচ্ছে থাকলেও নিয়তির দোষে তা হয়ে উঠেনি।
________
সমাপ্তি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here