নিষ্কলুষচিত্ত তুমি-১২ শেষ
লেখা : মান্নাত মিম
হিম করা শীতল বাতাসে শিরশির করে কাঁটা দিয়ে ওঠে গা। কিন্তু সেটা গা সওয়া হয়ে গেছে পলকের। বেশ পছন্দের এই জায়গাটা পলকের কাছে। কারণ প্রায়ই নন্দিতা ছাদে বসে একাকী সময় কাটাত। নন্দিতার পছন্দের বিষয়টা এখন পলকের পছন্দনীয় হয়ে ওঠেছে।
“সে যদি আসে সন্ধ্যায়,
দু’হাতে ভরা জ্যোৎস্নায়,
অপলক তাকিয়ে আমি,
চুপিসারে বলে যাবে কি—
ভালোবাসাে আমায় তুমি?”
গুনগুনিয়ে বলা কবিতাবৃত্তি করল। যা কি না আকাশ স্বাক্ষী হিসেবে আর বাতাস মৃদুমন্দ দুলে দুলে ভালোবাসার অপেক্ষার স্বীকারোক্তি হিসেবে জানান দিলো। পলকের এই অপেক্ষা নামক বস্তুর আদৌও কি অবসান ঘটবে জানে না সে। আর না জানে এই ছাদের দরজা দিয়ে সেই ভালোবাসার নারীটির প্রবেশ ঘটবে। একা নারী পৃথিবীতে টিকে থাকাটা বেশ দায়। নন্দিতা এখন কোথায় আছে কীভাবে আছে, সেই চিন্তাটা আরো বেশি দগ্ধ করছে পলকের হৃদয়কে; খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অন্তঃকরণের ভেতর রক্ত প্রবাহের সৃষ্টি করছে। সে যে জীবনে কাউকে আর ভালোবাসতে পারবে না। আসলে এটা সত্যি না ভালোবাসা হতেও পারে কিন্তু পরিণত বয়সের প্রথম ভালোবাসাটা কখনো ভুলে থাকা যায় না। গভীর রাতে ঘুম ভাঙলে একাকীত্বে ভুগলে, সেই প্রথম ভালোবাসার স্মৃতি জাগ্রত হয়। মা’য়ের কথায় হয়তো বিয়েটা করতে হবে, নিজের তো আর একা জীবন না সেখানে মা নামক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কথার বরখেলাপ তো আর হওয়া যাবে না। সেই হিসেবে হয়তো আরেকবার বসন্তের আগমন ঘটবে জীবনে স্ত্রী নামক সত্তার সাথে। তবে ধুলোমলিন হয়ে ডায়েরির বাজে শুকনো গোলাপটা পড়ে থাকবে মনের কোণে। এতকিছু ভাবনার মাঝে হঠাৎই পলকের খেয়াল হলো, যেদিন নন্দিতা চলে গিয়েছিল, সেদিন সে-ই সর্বপ্রথম জানতে পারে চলে যাওয়ার কথাটা। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর এক কাপ চায়ের তাগিদে রান্নাঘরে যায় সে। গতকাল লায়লা বেগমের প্রেশার বেড়ে যাওয়ার কারণে ওষুধ খেয়ে ঘুম দিয়েছেন বিধায় সকাল সকাল ওঠার তাঁর তোড়জোড় নেই, উপরন্তু দিনটি শুক্রবার। ছেলের-ও অফিসের তাড়া নেই। তাই নির্দ্বিধায় একটা ভালো ঘুম হবে, ভেবে আরামের ঘুম দিয়েছেন। এদিকে পলক ফুরফুরে মেজাজে চা বানিয়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে ওপরে যাবে, ভাবল একবার নন্দিতার ঘরের সামনে দিয়েই যাচ্ছে সে জাগ্রত নাকি দেখাই যায় একবার। সজূগ থাকলে তাকেও ছাদে নিয়ে যাবে গল্প বলার সঙ্গী হিসেবে। আহা! আজকের দিনটা এত সুন্দর কেন? ভাবতেই মন-মেজাজের খুব উৎফুল্লতা টের পেল পলক। সেই আবেগাপ্লুত ভাবনা যে তার বাকি জীবনে অন্ধকারাবৃত হয়ে একাকীত্বের অনুশোচনার দহনে পুড়াবে সেই ক্ষণটিকে তার তেমন উপলব্ধি হলোই না। আনন্দ মাটি হওয়ার চিন্তা এলোই না। আসবে কী করে, মানুষ কি জানে নাকি তার সম্মুখের ভবিষ্যৎ কী? যদি জানতো তাহলে প্রত্যেক’কেই নিজেরর নিজের জীবনে বাদশাহ থাকত। এগিয়ে গিয়ে দরজা টোকা কী দিবে হাট করা খোলা দরজা পলকের সামনে উন্মোচন জয়ে থাকতে দেখে ভেতরে এগিয়ে গেল ভীরু পায়ে। কেন জানি মন তার হু হু করছে, অজানা আশংকায়। খানিকের আনন্দে ভাটা পড়ে গিয়ে ভয়েরা ঘিরে ধরেছে চারিদিক থেকে। শূন্যতা বিরাজমান রুমটা দেখে মাথা পুরো আউলে গেল পলকের। ভেতরে ভাবনা এলো হয়তো ছাদে গিয়েছে নন্দিতা। দ্রুততম পায়ে ছাদে পৌঁছালে ওপরে ওঠতেই চায়ের কাপের গরম চা ছলাৎ করে ছলকে পলকের হাতে পড়ল কিছুটা আর কিছুটা নিচের জমিনে। ঝেরে ফেলে দিলো চায়ের কাপসহ। কাপটা পড়া মাত্রই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল কয়েক খণ্ডে। ঠিক তার হৃদয়ের টুকরোর মতো। কারণ হৃদয়ের টান অনুভব করছে যাকে হৃদয় দিয়েছে, সে চলে গেছে। শূন্য ছাদ দেখে হৃদয়টা সেটা আগেই উপলব্ধি করতে পারছে। কিছুই ভালো লাগছে না। তবুও ফিরে আবার গেল এ আশায় হয়তো দেখার ভুল রয়েছে। ওহ্হ, সম্ভবত ওয়াশরুমে মেয়েটা। ইস! আগে কেন ভাবনাটা এলো না তার? এখন গিয়ে দেখলে অবশ্যই রুমে শায়িত অবস্থায় দেখতে পাবে সে নন্দিতাকে। ভাবনাটা মাথায় আসা মাত্র দ্রুত নেমে এলো নন্দিতার রুমের সামনে। সেই উন্মুক্ত দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। এবার ভালোভাবে খেয়াল হলো তার। বিছানার পাশের থাকা টেবিলে একটা গোলাপ দেখা যাচ্ছে। শুকিয়ে আছে বেশকিছুটা আর কিছুটা হালকা কাঁচা লাল। এগিয়ে গিয়ে দেখল, একটা কাগজ ভাঁজ করে তারউপর গোলাপটা রাখা। গোলাপটা ছুঁয়ে দেখল সরিয়ে রেখে কাগজটা হাতে তুলে নিলো। খোলা মাত্রই সুন্দর, পরিষ্কার, ঝরঝরে লেখা সম্মুখে উন্মোচিত হলো।
“কী সম্বোধন করব বা করা উচিত বুঝতে পারছি না? আপনি না আমার ভাই আর না বন্ধু। প্রিয়-ও বলা চলে না। প্রিয় তো তাঁরা যাদের মাঝে একটা সম্পর্ক থাকে, কিছু একটার সম্পর্ক। আমাদের সেটা হওয়ার সম্ভাবনা একদমই নেই, আর না সেটার একটা সুষ্ঠু ভবিষ্যৎ আছে। তাহলে সেই সম্পর্ক গড়ে তোলার এত বৃথা চেষ্টা কেন? হয়তো ভালোবাসি নিরবধি পুরোটা কিন্তু বললাম না। ওই তো হয়তো’র মাঝে বাঁধার দ্বিধাটা রেখে দিলাম। আমার চলে যাওয়াটাকে মেনে নিয়ে আন্টির ঠিক করে রাখা ফারজানা আপুকে বিয়ে করে নেবেন৷ ভালো, খারাপ মিলিয়েই মানুষ তাই বলে সে জীবনসঙ্গী হিসেবে খারাপ হবে এমনটা নয়। ক’জন পারে ভালোবাসার মানুষটাকে জয় করার জন্য সবকিছু করতে? কিছু ভালোবাসা হয় অসহায় তো কিছু ভয়ংকর। দোয়া করি, আপনার জীবনে সুখ বয়ে আসুক আমার ভাগেরটাও। আমি একা মানুষ এত সুখ দিয়ে কী করব বলুন তো? হা হা। আমার খোঁজ নিয়েন না, অযথাই কষ্ট করবেন, আমি বাড়িতেও ফিরে যাব না। ভাগ্য কোথায় নিয়ে যায় নিজেও ঠিক জানি না। একটা কথা বলি, আমাকে কি মনে রাখবেন কখনো? মনে রেখেন না কিন্তু।
“সব চাওয়ারই কি পাওয়া মেলে?
কিছু কিছু প্রাপ্তির খাতায়ও শূন্যতা মেলে।
মনে করেন, আমার ভাগ্য সেই খাতা মেলে বসেছে।”
ইতিতে কিছুই লেখা না। লেখা থাকবে কী করে, তাদের তো আর সেই ইতি-প্রিয় ভালোবাসা বা অভিমানের সম্পর্ক নয়। যার ভিত্তিতে গড়ে ওঠবে ইতি-প্রিয় সম্মোধন শব্দ। স্রেফ চলে যাওয়া বার্তা আর নতুন জীবনের শুভকামনা জ্ঞাপন করার মাধ্যম, ব্যস এতটুকুই। সম্পূর্ণ চিঠিটা দু’বার, তিনবার পড়ল। অল্প কথায় লেখা চিঠিটা নিদারুণ আগুন বিহীন জ্বলাচ্ছে পলক’কে ভেতরই ভেতরে। হাঁসফাঁস লাগছে, মনে হয় গলায় বড়সড় কাঁটা আঁটকে আছে। অদৃশ্য সেই কাঁটা। মৃত্যু হলেও বুঝি এত কষ্টের হতো না। নন্দিতা তাকে খোঁজার জন্য কোনো পথ খোলা রাখেনি। না তার পরিবারের বিষয়ে কখনো বলেছে যে, সেই সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে খোঁজে বের করবে আর না ফোন নিয়ে গেছে। খবরটা শুনে ফারজানা চলে আসে। লায়লা বেগমের মুখে শুনে সত্যতা যাচাই করে। ঘটনা সত্যি মনে হলে ভাবে, বেশ চলে গিয়ে পথ ফাঁকা করে দিলো। এবার শান্তি মিললো। কতদিন ধরে পেরেশানিতে সে ভুগেছে এই নন্দিতার জন্য কত রাত নির্ঘুম হয়ে দুশ্চিন্তায় মরে যেতে হয়েছিল। সেই ঝামেলা নেই ভাবতেই মন’ই মনে নেচে উঠল। সেই হাসিখুশি ভাবটা সম্মুখে প্রদর্শন করল না সবাইকে। কিন্তু হায়! পলক’কে বিয়ের কথা বলতেই, এবার সরাসরি নাকচ করে বেঁকে বসে। অপেক্ষা নামক শব্দের সাথে মিত্রতা করে নেয়।
______
অমোঘ সত্যকেও বিশ্বাসে নারাজ পলক। এই যে, নিজ ইচ্ছেতে চলে যাওয়া নন্দিতা আর ফিরবে না। সেদিনের সেই উষ্মা স্পর্শ প্রখরভাবে অনুভব করার জন্য আর ফিরে পাবে। এখন সেই ওষ্ঠে কেবল জলন্ত আগ্নেয় লাভার অংশ ছুঁয়ে যায়, না সেই কোমল স্পর্শ। বাড়ির থেকে বেশ কিছু দূরে অবস্থান করা দোকানে আবারও আগমন পলকের সেই প্রথম দিনের মতো। জলন্ত সিগারেটের কুন্ডলী অন্ধকারে অন্যরকম তারতম্য সৃষ্টি করছে। যেখানে দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তার অপরপাশের ঝোপে নন্দিতাকে পেয়েছিল, সেই বরাবর বালু ফালানোর ডেজারের মোটা পাইপে বসে বসে সিগারেট টানতে থাকল। আর অপলক তাকিয়ে দেখতে লাগল অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানটা। সে চাইলে পারত নন্দিতার ধর্ষক’দের কাছ থেকে নন্দিতার ঠিকানা জানতে। তবে কেন জানি মন তার সায় দিলো না। নন্দিতার চলে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে সম্মান দিলো। তার ধর্ষণকারী’দের কাছে গিয়ে সাহায্যের প্রার্থনা করতে গিয়ে পশুগুলোর মুখ দর্শনের ইচ্ছাটা নিতান্তই ঘৃণ্য মনে হলো। মন খারাপের সময়টাতে একটু সুখানুভূতি অনুভব করার ইচ্ছায় পকেট হাতড়ে সেই চিঠিটা বের করল পলক। কত সহস্রবার যে চিঠিটা সে পড়েছে বলার বাইরে। আবারো পড়ল, আরেকবার। আওড়াল সেই শূন্য খাতার বাক্যটা। নন্দিতার ভাগ্যে শূন্য খাতা মেললেও পলক তার পাশটা নন্দিতার জন্য শূন্য করে রেখেছে। কিন্তু সেটা কতদিন ঠিক নেই। কারণ পৃথিবী বিচিত্র তারচেয়েও বিচিত্র সেখানে বসবাসকৃত মানুষজন। আর সাতরঙের চেয়েও অধিকতর রঙিন মানুষের মন ও জীবন। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায় সেখানে।
সমাপ্ত।
কাহিনিটা বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া। গল্পের মতো সবসময় মিল থাকে জীবন নামক উপন্যাসে।
Allah rohomote polok jeno tar nondita k fire pai