#নিশুতি_তিথি,পর্ব ৮,৯
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ৮
১৬.
আঞ্জুমানকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে পরেরদিন দুপুর নাগাদ। রাতে শুধু একবার আলীর জোড়াজুড়িতে ওটি রুমে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তারপর গিয়ে একেবারে সুদর্শনীর দেখা দুপুর গড়িয়ে বিকেলে পায়। শরীরের ক্ষত আস্তে আস্তে সেরে যাবে, যা ক্ষত হয়েছিল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলে মুখ ক্ষত-বিক্ষত হতে বেঁচে গেছে। নাহলে যে কী হতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মাঝে আলী তাকে একবার চোখের দেখা দেখে বাড়ি চলে যায়, নার্সদের কড়া দায়িত্ব দিয়ে যায় আঞ্জুমানকে দেখে রাখার। বাড়ি হতে ফ্রেশ হয়ে এসে শুনতে পায় আঞ্জুমানের জ্ঞান ফেরার কথা। মনে মনে বেশ ভালো ছক কষে নিয়ে দেখা করতে যায়। তবে ভেতরে গিয়ে সকল ছক কষার স্থান গুমোট বাঁধে মরার মতো নির্জীব, নিস্তেজ, প্রাণহীন হয়ে কেবিনের ভেতরের সফেদ বেডে শুয়ে থাকা আঞ্জুমানকে দেখে। বদ্ধ আঁখিযুগলে নিচে কালো দাগের স্থান পেয়েছে। মেয়েটা বেশ শুকিয়ে গিয়ে গৌরবর্ণা থেকে রঙ কিছুটা কালচে হয়ে এসেছে একদিনেই। এসব কিছুই আলীকে দেখিয়ে দেখিয়ে ভেতরের পাপবোধকে খুঁচিয়ে দিচ্ছে। ভেতর থেকে আওয়াজ তুলছে কোনো এক অনুভূতি,
‘দেখ, মেয়েটাকে তুমি কোন পর্যায়ে এনে ছেড়েছ।’
তবে ভেতরকার আরেক নির্বোধ সত্তা তা যেন মানতে নারাজ,
‘তাকে পাওয়ার জন্যই তো এতকিছু।’
‘তবে মেয়েটা যে এখন বেঁচেও প্রাণহীন, মৃত। তুমি কি এই জীবন্মৃত আঞ্জুমানকে’ই চেয়েছিলে?’
‘জীবিত বা মৃত সারাজীবন আমার সাথেই থাকতে হবে তাকে।’
‘গেয়ারের মতো কথাবার্তা তোমার। সত্যি আজ বা কাল হোক, প্রকাশ পেলেই এই ফুল তোমার আঙিনায় আর থাকবে না। হয় মূর্ছা যাবে নয় হারিয়ে যাবে।’
আলীর মাথা রাগে দপদপ শুরু করেছে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য বোধ করছে।
‘না, মানি না আমি।’
এবার আলীর মুখ নিসৃত হলো শব্দযোগ বেশ চিৎকারের সুরে। এতে করে আঞ্জুমানের বদ্ধ আঁখি উন্মোচিত হয়ে গেল। সম্মুখে থাকা আলীর চেহারায় গম্ভীরভাবটা স্পষ্টত হতেই ভয় পেয়ে সে-ও চিৎকার করে উঠল। আলীর সম্ভিত ফিরলে আশ্বস্ত ভঙ্গিতে আঞ্জুমানের উদ্দেশ্যে বলল,
‘হুস, হুস! শান্ত হ। আমি, আমি-ই তো। ভয় পাচ্ছিস কেন?’
এরইমধ্যে নার্সের আগমনে আঞ্জুমান নিজের দূর্বল শরীর নিয়ে নার্সের কাছে গুটিয়ে গিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে। যার ফলে নার্স আলীকে বিরক্তি ভঙ্গিতে বলল,
‘আপনি যান। আপনাকে দেখে পেশেন্ট ভয় পাচ্ছে।’
আলীর যারপরনাই রাগ হলো। তবে ভাবল, মেয়েটা তাকে দেখে কেন ভয় পাচ্ছে বোধগম্য হলো না। কিন্তু করার আপাতত কিছু নেই। সুস্থ হলে জানান দিবে তার আসল ভয়ের অস্তিত্বকে। এই অসুস্থতার মাঝে তার অন্য সত্তার প্রকাশ পেলে হিতে বিপরীত ঘটার আশংকা রয়েছে। তাই চুপ থাকাই ভালো। বাইরে বেরিয়ে এসব ভাবার মাঝে ফোন বেজে উঠল। দেখে রিমার কল। মেয়েটার সাথে তার কথা হয়েছে গতকাল রাতে। তারপর আর কথা হয়নি বলতে গেলে সেই সুযোগটাই হয়নি। ব্যস্ততা তাকে ঘিরে রেখেছিল বলে। তাও সেদিন ফোন বন্ধ থাকার কারণ দর্শাতে গিয়ে দম-জান সব বেরিয়ে গিয়েছিল তার। অতিরিক্ত ভালোবাসে কি না মেয়েটা তাকে, তাই যা বুঝ দিয়েছে সে তা-ই মেনে নিয়েছে মেয়েটা। ফোন রিসিভ করে কানে তুললে অপরপাশের মেয়ে কণ্ঠী বলল,
‘কী খবর জনাবের? ফোন-টোন দেওয়ার খবর নেই দেখি এত ব্যস্ততা কীসের?’
‘বিবি সাহেবাকে বিরক্ত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না বলে।’
‘জনাব, এভাবে বলতে পারল? আমি কি তার কথায় বিরক্তবোধ করি না কি? উলটে তার ফোনের অপেক্ষা করি অধির আগ্রহে।’
মুচকি হেসে আলী বলল,
‘সেটা জনাব জানে। তবে জনাব তার বিবিজানের জন্য খুব বড়ো একটা সারপ্রাইজ তৈরি করছে। এটার জন্য বিবির সাথে কথা বলা হয়ে উঠছে না, সেজন্যই জনাবের এত ব্যস্ততা।’
সারপ্রাইজ! তাও আলীর থেকে। তড়িৎ গতিতে বিদ্যুতের মতো শিহরণ বয়ে গেল রিমার সারা গা জুড়ে। কী সারপ্রাইজ হতে পারে আলীর? আলী যদি-ও তাকে ছোটোখাটো, সাধারণ সারপ্রাইজ দিয়ে থাকে। যেমন, বাইরে ঘুরতে যাওয়া, হঠাৎ হঠাৎ ভালোবেসে এটা-সেটা কিনে দেওয়া। সেসব তো রিমার জানা। কিন্তু অজানা বড়ো সারপ্রাইজের কথা শুনে দমবন্ধ, দমবন্ধ অনুভব হচ্ছে তার। জীবনের মোড় ঘুরার মতে। সইতে না পেরে অবুঝের মতো ফট করে জিজ্ঞেস করে ফেলে,
‘কী সারপ্রাইজ বলো না?’
‘এই বোকা মেয়ে, সারপ্রাইজ বলে দিলে সেটা কি আর সারপ্রাইজ থাকে না কি?’
তবুও রিমা গো ধরে উৎসুকতার সহিত বলতে লাগল,
‘এই শোন না, প্লিজ বলো। বলো প্লিজ।’
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আলী বলল,
‘আমি আসছি তোমাদের বাসায় কাল, পরশুর মধ্যে।’
একটা চিৎকার দিয়ে রিমা উত্তেজনার সহিত বলল,
‘সত্যি বলছ, বাসায় আসছ?’
বলে খানিক থেমে উত্তেজিত হওয়া কণ্ঠ ঢিমেতালে নিয়ে এসে বলল,
‘ওয়েট, ওয়েট। বাসায় তো আসো’ই। এটা আবার সারপ্রাইজ হলো কীভাবে? তাও ব-ড়ো সারপ্রাইজ।’
শেষের বড়ো শব্দটাকে টেনে টেনে বলল রিমা। আলী তখন কথা ঘুরানোর জন্য উলটে তাকে প্রশ্ন করল,
‘এটা সারপ্রাইজ মনে হলো না তোমার কাছে? আমি তোমার কাছে সারপ্রাইজ না, তাও সবচেয়ে বড়ো? থাক তাহলে না-ই বা গেলাম তোমাদের বাড়ি।’
শেষের বাক্য মলিনতার রেশ ধরে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল আলী কথাটা। সে জানে, সে কী রিমার কাছে। এত বছর হয়ে এলো সম্পর্ক, তাও রিমার ভালোবাসায় কমতি এলো না। আর আলী! হা হা! তার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞাটা নাহয় অসংজ্ঞায়িত থাক।
‘না, না প্লিজ সোনা এসো তুমি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সারপ্রাইজটা তুমি। প্লিজ রাগ না করে এসে পড়ো। তোমার পছন্দের সব রান্না করব।’
লজ্জিত সজ্জায় সেজে শেষের কথাখানি বলল রিমা।
১৭.
বেশখানিক সময় কথা কাটাকাটি হলো আলীর। তাও আবার ডাক্তারের সাথেই। কারণ, আঞ্জুমানকে বাড়িতে শিফট করতে চায় সে। কিন্তু ডাক্তারের এক কথাই, মেয়েটা অসুস্থ আলীর কি চোখে পড়ে না? অপারেশন হওয়া মেয়েটাকে কীভাবে বাড়িতে নিতে চাইছে! প্রশ্ন করাট চেয়ে বিষয়টা ডাক্তারের কাছে বেশ অবাকান্বিত ঠেকলো। তবে আলী সেসবের ধার দিয়েও গেল না। অর্থেবিত্তের কাজে লাগিয়ে বেশ সাবধানতা অবলম্বনে আঞ্জুমানকে ক্লিনিক থেকে বাড়িতে নিয়ে ফিরে এলো। গেস্টরুমেই স্থান পেল আঞ্জুমান। কেবিন থেকে এম্বুল্যান্সে ওঠানোর সময় শুধু একবার ঘুম পাতলা হয় তার। এরপরে ওষুধের কড়া ডোজে ঘুম ভাঙেনি। ক্লিনিক থেকে দু’জন নার্স-ও হায়ার করা হয়, দায়িত্ব তাঁদের আঞ্জুমানকে দেখভাল করার। বিন্দুমাত্র ভুল তো নার্সদের চাকরির নাম ঘুচিয়ে দিবে। সবকিছুর ঠিকঠাক মতো গুছানো আলী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেখে। অতঃপর আঞ্জুমানের জন্য সকল ব্যবস্থা করে রাখা জিনিসপত্র পারফেক্ট হতে দেখলে চলে আসে নিজ রুমে। নিজে ফ্রেশ হয়ে নেয়। দু’দিনের ক্লান্তি তাকে বেশ নাজেহাল করে দিয়েছে। বিছানায় শরীর লাগানোর মতো সময়ও ছিল না। আজ ক্লান্ত শরীর বিছানা পেয়ে ভার ছেড়ে দিলো। আরামের আবেশে দু’চোখ বোজে এলো। কতক্ষণ সয়ম নিয়ে ঘুমালেো আলী সে খেয়াল হলো না। তবে আরামের ঘুম হারাম হলো করিম মিয়ার ডাকে। তখন বাইরের ঘুটঘুটে আঁধারে বোধগম্য হয় সময়টা রাতের। বেরিয়ে রাতের ডিনারে যাওয়ার সময়কালে একবার আঞ্জুমানকে দেখার তীব্র তৃষ্ণা জাগল মনে। এগিয়ে গেল করিডোর বরাবর শেষ মাথার রুমে থাকা গেস্ট রুমের দিকে। গেস্টরুমের সোফায় একজন নার্স ঘুমন্ত। দু’জন শিফট অনুযায়ী কাজ করবে। একজন দিনে তো একজন রাতে। তবে আজ দিনের জনই সময় দেবে। কাল থেকে পরিবর্তন হয়ে আসবে। তাই বোধহয় মেয়েটার ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছে। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে নজর পরিবর্তন করল। সেই নজর এসে পড়ল আঞ্জুমানের ওপর মেয়েটা এখনো ক্লিনিকের ড্রেস পরিহিত। মাথার বড়ো বড়ো চুলগুলো মোটা মোটা দু’টো বেনিতে আবদ্ধ করা। খানিক হাসল বেনিগুলো দেখে। মেয়েটা বেনিতে বাচ্চা বাচ্চা লাগে। ভেতরের এক সত্তা তখন সুযোগে বলে উঠল,
‘মেয়েটা তোমার অনুযায়ী বাচ্চা’ই।’
কথাটা উপেক্ষা করে বাঁকা হাসি মুখে ঝুলিয়ে এগিয়ে আঞ্জুমানের মুখের ওপর ঝুঁকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল তাকে। মেয়েটাকে না পছন্দ করার কারণ খুঁজতে লাগল। কাজটার জন্য মেয়েটাকে তার নিখুঁত মনে হলো। এরচেয়ে বেটার অপশন হতেই পারে না।
‘আগুন ঝরা স্পর্শ,
তোমাকে করবে ত্রস্ত।’
চলবে…
#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ৯
___________
১৮.
আগুনঝরা দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীরে রিমাদের বাড়ি এসে পৌঁছায় আলী। যদিও-বা এসি গাড়িতেই তার আসা-যাওয়া তা সত্ত্বেও ঢাকা শহরের জ্যামে পড়ে কাহিল অবস্থা। রিমা দ্রুত এসি ছেড়ে দেয় বসার রুমের। বাড়িতে পুরুষ মানুষেরা নেই। এই দুপুরের সময়টা বাড়ির পুরুষরা নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থানরত। তাই আপাততর জন্য আলীর সাথে দেখা করতে আসেন রিমার মা রান্নাঘর থেকে। হাতে করে ট্রে-তে নিয়ে এলেন ফলের জুস ও হরেক পদের টুকরো করে কাটা ফল। এগিয়ে রাখলেন সেগুলো সেন্টার টেবিলে। ইশারায় মেয়েকে বুঝিয়ে দিলেন আলীর হাতে তুলে দিতে সেসব। রিমা-ও অরেঞ্জ ফলের জুস আলীর হাতে তুলে দিলো। অন্য সোফায় রিমার মা বসে বললেন,
‘আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?’
ক্লান্ত মাখা গলায় আলী শোধাল,
‘না, না কোনো সমস্যা হয়নি। উলটো আরো বেশি লজ্জিত। আপনারা কেন গাড়ি পাঠাতে গেলেন?’
এটা নতুন কিছু না। আলীর গ্রাম থেকে শ্বশুর বাড়ি আসার জন্য বাস বা ট্রেন জার্নি করতে হয় না তাকে। বড়োলােক শ্বশুর মশাই নিজের গাড়ি বরাদ্দ রেখেছেন মেয়ের জামাইয়ের জন্য। এমন সুযোগ-সুবিধা ভোগে মনে মনে বেশ চাইত আলী, পেলোও। তবে মুখ নিসৃত লজ্জাটা তাঁদের দেখানোর জন্য বজায় রাখল বেশ সূক্ষ্ম অভিনয়ের মাধ্যমে। অভিনয় জিনিসটা আলীর রক্তে রক্তে বহমান। কিন্তু সে-তো অভিনেতা নয়, তবুও জীবন নামক চরিত্রে তার অভিনয় খুব ভালো চলছে। কারণটা কিছু কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণে উচ্চবিত্ত, সম্পদশালী মানুষের কাঁধটা ভীষণ প্রয়োজন ও গুরুত্বপূর্ণ। সেই কাঁধে ভর দিয়েই তো সামনে এগুনোর সিঁড়ি। যাইহোক সল্প আলাপচারিতা শেষে রিমার রুমে এসেই ওয়াশরুমে চলে যায় লম্বা শাওয়ারের প্রয়োজনে। আর রিমা আলমারিতে আগে থেকে বিদ্যমান আলীর ড্রেস বের করে বিছানায় রেখে বাইরে চলে যায় দুপুরের লাঞ্চে কী তৈরি হচ্ছে দেখার জন্য। একে তো আলী জামাই মানুষ, সাদাসিধে খাবার তো পরিবেশন করা যায় না। সে জামাই যত বছরের পর বছর পুরোনো সম্পর্কের হোক না কেন, শ্বশুরালয়ে সে সবসময় নতুন জামাই হিসেবে গণ্য।
ওয়াশরুম থেকে টাওয়াল পরিধান করে বের হয় আলী। বিছানায় নিজের জন্য আগে থেকে ড্রেস দেখে স্মিথ হাসে। জানে যে, কাজটা কার। বিড়বিড় করে বলে ওঠে তখন,
‘ভাগ্যের পরিহাস—
যে মত্ত আমাতে,
সে আমি মত্ত অনুপমাতে।’
এদিকে রান্নাঘর থেকে তদারকি সেড়ে নিজ রুমের দিকে আসছিলো রিমা। অতঃপর রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশে দেখতে পায়, আলীর হাতে তার রেখে যাওয়া টি-শার্ট। সেটা হাতে নিয়ে মুচকি হাসিতো ব্যস্ত সে।
‘কী ব্যাপার জনাব, মুখে এ কীসের হাসি?’
মিটিমিটি লজ্জিত হাস্যমুখে রিমার প্রশ্ন। তবে আলী বিচক্ষণতার সহিত ধরতে পারল রিমার লজ্জিত হওয়ার কারণটা। তাই সে উলটে প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষে রিমার দিকে এগিয়ে গেল তাকে আরো কুণ্ঠিত, সংকোচগ্রস্ত করতে।
‘এত লজ্জা কীসের, হুম? আমাকে কি এই অবস্থায় প্রথম দেখছ না কি জনাবা?’
অতি নিকটে নিজ একান্ত প্রেমিক পুরুষের মোহনীয় কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলা কথায় শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে কম্পমান হচ্ছে। চক্ষুদ্বয় মুদে আসছে আমুদে। একসময় নিজ মুখমণ্ডল আলীর উষ্ণত্ব অনুধাবনে আহ্লাদিত হয়ে বোজে আসে আঁখিযুগল। খানিক পরেই পায় মুখশ্রীতে পানির ঝাপটা। হকচকিয়ে চক্ষুদ্বয় উন্মুক্ত করলে হো হো করে আলীর হাসি দেখে হতভম্ব হয়ে থমকে তাকায়। আলীর হাসিমাখা মুখ সবচেয়ে বেশি নজর কাড়া। ভাললাগার এটাই প্রথম দিক, তারপরে আসে হৃষ্টপুষ্ট দেহ যেটাকে বলা হয় সিক্সপ্যাক বডি। আলী গ্রামের ছেলে যার দরুন সে শহুরে ছেলেদের মতো জীম করে না। তবুও তার স্বীয় শরীরের প্রতি সে খুবই যত্নবান। এতই যত্নবান পুরুষ যে, খুব ঘনিষ্ঠ মূহুর্তে গায়ে রিমাকে ভালোবাসার চিহ্ন দেওয়া থেকে পর্যন্ত মানা করে দেয়। রিমার একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা দেখে তার সম্যক মুগ্ধকরণ কাটাতে আলী তুড়ি বাজাল। থতমত খেয়ে রাগান্বিত হওয়ার ভানে মুখ ভেংচি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল রিমা। তা সত্ত্বেও রুমের দরজা পর্যন্ত থমকে দাঁড়িয়ে পিছু মুখী হয়ে বলল,
‘খেতে আসুন।’
বলেই একছুট লাগাল।
১৯.
লিপি নিজ রুমে আবদ্ধ হয়ে বিছানায় হাঁটুমুড়ে বসে। কয়েকদিন যাবৎ মনের মধ্যে থাকা অনুশোচনা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এই অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে সে নিজেকে ঘরবন্দি করে শাস্তি দিচ্ছে। তা সত্ত্বেও কৃতকর্মের পাপবোধ তাকে বন্দিদশাতেও শাস্তি নামক শান্তি দিচ্ছে না। এরমধ্যে লিমার মা বেশ দুশ্চিন্তায় জড়িয়ে আছেন, মেয়ের এহেন কর্মকাণ্ডে। ক’দিন যাবৎ মেয়ে তাঁর সাথে কারো বাড়িতেই কাজে যাচ্ছে না। এভাবে ঘরে পড়ে পড়ে থাকলে তো আর অন্ন মুখে জুটবে না আর। আজ এর হেনেস্তা করেই ছাড়বেন ভেবে মেয়ের কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে নিলেন, তন্মধ্যে করিম মিয়া এসে উঠানে নিজের উপস্থিত জানান দেওয়ার জন্য হাঁক ছাড়ল,
‘লিমার মা! ও লিমার মা বাড়িত আছনি?’
গ্রামের লোকজনের সাথে গ্রাম্য ভাষায় তার যত কথা। সেই হিসেব কষেই আঞ্চলিক ভাষাতে বাক্যের বেশ পালটে ফেলল করিম মিয়া। তার ডাক শুনে লিমার মা আর মেয়ের কক্ষের দিকে পা আগালেন না। ফিরে এলেন করিম মিয়ার ডাকে উঠানের মাঝে।
‘কী হইছে ডাকো যে?’
‘ছোটো সাহেব কইলেন তোমার মাইয়াডারে বাড়িত নিয়া যাইতে।’
‘ছোটো সাহেবের বাইত?’
‘হ।’
চোখ-মুখ অস্বাভাবিকভাবে কুঁচকে এলো লিমার মায়ের। ছোটো সাহেব অর্থাৎ আলী আকবর কেন তার রাজপ্রাসাদের মতো বড়ো বাড়িতে লিমাকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব রাখছে? সেখানে মানুষ থাকে না কি? যাও থাকে তো ক’জন হাতেগোনা। এরমাঝে তাঁর মেয়ে গিয়ে করবে’টা কি? আদ্যোপান্তে ভেবে কোনো কুল-কিনারা না পেয়ে করিম মিয়াকেই প্রশ্ন করে বসলেন লিমার মা,
‘আমার মাইয়ারে দিয়া তাঁর কী কাম?’
প্রশ্নের জবাব আগে থেকেই তৈরি করিম মিয়ার, তাই সাথে সাথে উত্তর এলো,
‘খবর শোনো নাই, সাহেব যে বিয়া করছে? তাঁর বউয়ের দেখভালের জন্য লিমারে কামে নিছে সাহেব। চিন্তা কইর না মোটা অংকের বেতন পাবা।’
অর্থকড়ির লোভ কার না থাকে। সেখানে যদি এমন দিন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা লিমাদের পরিবারের হয়, তাহলে তো এসব কাজকর্মকে তারা খোদার দেওয়া আশীর্বাদ মনে করে। তাই কাজটা হাতছাড়া করতে নারাজ লিমার মা। দ্রুত শব্দযোগে তিনি বললেন,
‘আইচ্ছা, আইচ্ছা বুঝছি। এহন কও কহন তে কহন পর্যন্ত কাম করব মাইয়ায়?’
মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানিয়ে আলীর হুকুম করা কথার অনুযায়ী বলল,
‘উহুম, সাহেব বলছেন সেখানে থাইকা কাজ করন লাগব।’
লিমার মা’র এবার অক্ষিপট কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম।
‘জোয়ান মাইয়া আমার। মাথা ঠিক আছেনি?’
‘তোমার মাথা ঠিক আছেনি? জোয়ান মাইয়া দেইখা কী হইছে? তারে কী কেউ খায়া ফেলবনি? সহিসালামত থাকব, সবাই আছি না।’
‘আঞ্জুর কথা আমরা জানি কিন্তু।’
‘তাে কী হইছে তাতে? তোমার মাইয়ার দিকে সাহেব ফিরাও চাইব না। উনি তো বেশিরভাগ সময় ঢাকা থাকেন। মাঝেমধ্যেই শুধু গ্রামে থাকবেন। যখন না থাকবেন তখনকার সময়ে তোমার মাইয়ায় ছোটো বেগমের মন ভুলায় রাখব, যেন ছোটো বেগম একলা একলা মন খারাপ না করে থাকেন।’
বিভিন্ন কথার বাকবিতন্ডায় শেষমেশ লিমার মা রাজি হলেন মেয়ে লিমাকে আলীর বড়ো বাড়ি পাঠানোর উদ্দেশ্যে। ঘরের ভেতরে সকল কথাবার্তাই লিমার কর্ণগোচর হলো। সে তো জানে, বড়ো বাড়িতে তাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? আসল উদ্দেশ্যটা কী? মাঝেমধ্যে মন চায়, ঝুলন্ত ফ্যানের সাথে নিজেকে ফাঁস লাগাতে। না সে সেদিন বড়ো বাড়িতে আঞ্জুমানকে নিয়ে যেত, আর না আলী আকবরের চোখে পড়ত মেয়েটা। আর না তাকেই জড়াতে হতো এসব ষড়যন্ত্রের গহীনে। এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস নামক আফসোস বেড়িয়ে আসে মুখ নিসৃত হয়ে।
চলবে…