#নিশুতি_তিথি,পর্ব ২,৩
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ২
____________
৩.
টিনের দোচালা ঘর। ঘরে আছে ছোট ছোট দু’টো রুম জরাজীর্ণ পরিবেশ। ঘরের সামনের খোলা বারান্দা দিয়েই ঘরে প্রবেশ করার পথ। রুম দু’টোতে বেশি কিছু নেই বলা চলে। একটাতে শুধু চৌকি, আর মাটিতে বিছানো মাদুর। থাকে শুধু তিনটি মানুষ তাই এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যেটা প্রয়োজন সেটাই নেই। একজন পিতা, যেটা মাথার উপর বট গাছের মতো ছায়া দিবে। ভরণপোষণের দায়িত্ব নিবে। লিপি, তার মা ও ছোট্ট ভাই লিমনকে নিয়ে তাদের পরিবার। লিপি ও লিমন লেখাপড়া করে না। তাদের পান্তা আনতে দিন ফুরায় আবার নাকি লেখাপড়া। বেশ হাস্যকর! লিপির মা মানুষের বাড়ি কাজ করে যা পারে তা দিয়ে খাবার জোগাড় করেন। লিপি-ও তার মায়ের সাথে মাঝে মাঝে অন্যের বাসায় কাজ করে। কিছু বাড়তি আয়ের আশায়। তবুও গরিবের কপাল ফুটোই থাকে। এক পয়সা জাদুবলে আর পাঁচ পয়সা হয় না।
লিপিদের বাসায় আঞ্জুমান বসে বসে কাঁচা আমের ভর্তা খাচ্ছে। আর তার দিকে তাকিয়ে তার খাওয়া দেখছে লিপি। এমন তাকিয়ে থাকা দেখে আঞ্জুমান কপট রাগ নিয়ে লিপিকে বলল,
‘তুই এমন কইরা আমার দিকে তাকাবি না।খাইলে খা, না খাইলে না খা। এমনে তাকায় থাকলে আমার পেট ব্যথা করব পরে।’
‘আইচ্ছা আঞ্জুমান আলী ভাইয়ে তোরে, আমারে তখন ছাইড়া দিলো কেন? আবার সাথে আমগুলা-ও আনতে দিলো।’
ভাবুক নয়নে ভাবনার প্রকাশ করে লিপি আঞ্জুমানের কাছে, অথচ আঞ্জুমান নিজের বেখেয়ালি চিন্তাভাবনা করেই শেষ করতে পারে না আবার লিপির করা মারপেঁচ প্রশ্নের উত্তর দিবে, যেখানে অন্যের মনে কী আছে তা নিয়ে।
‘এই এক পেঁচাল তুই কখন থেকে জিগাইতাছোস, হ্যাঁ? আমি কেমনে কমু কেন আমাদের ছাইড়া দিলো? সাথে আবার আম-ও দিয়া দিলো। আমি কি তার মনের ভিত্তে গিয়া দেখছি?’
আসলেই তো আঞ্জুমানের করা প্রশ্নগুলো একদমই ঠিক। সে তো জানে না অন্যের মনে কী চলে তাই সেগুলোর উত্তরই বা তার কাছে কীভাবে আশা করা যায়?
তখন আলীর করা রাগ আঞ্জুমানের দিকে তাকিয়েই প্রশমিত হয়ে গিয়েছিল। লিপি আর আঞ্জুমান খুবই ভয় পেয়েছিল। মনে হচ্ছিল এই না জানি আম চুরি করার কারণে তাদের নিয়ে বিচার বসায়। তখন তো আবার দু’জনের পরিবারের সবাই তাদের’কে উত্তম-মধ্যম দিবে। কিন্তু তার চিন্তা ভাবনার উর্ধ্বে গিয়ে আলী তাদের’কে বলে আমগুলো নিয়ে যেতে। তখন তারা হতবাক হয়ে একে-অপরের মুখে চাওয়াচাওয়ি করল আলীর কথা শুনে। তবুও বেশিক্ষণ সেটা টিকল না। তাড়াতাড়ি কেটে পড়ার চিন্তায় আমগুলো নিয়ে বিদায় হলো। তাও আবার মেইন গেইট দিয়ে, তখন আবার দারোয়ান আরেক কাহিনি ঘটাল। দারোয়ান তাদের’কে দেখে ভড়কে গেল। আর তাদের গেটের বাইরে যেতে দিতে চাইল না। বারবার আঞ্জুমানের হাত ধরতে চাইছিল। কিছুতেই তাদের’কে আম নিয়ে যেতে দিবে না। তাও আবার চুরি করা, তারই নাকের নিচ দিয়ে। যা দারোয়ানের গায়ে লাগল। কিন্তু শেষে দেখে বাড়ির কর্তাই তাদের’কে ছেড়ে দিতে বলছে। তাই সে-ও মুখটা কাচুমাচু করে আঞ্জুমান এবং লিপিকে ছেড়ে দিলো। কেন দিলো তাদেরকে ছেড়ে?
কিন্তু আঞ্জুমানের যে বোকা মগজ, বেশি কিছু আর সে চিন্তা করতে পারল না। সামনে থাকা কাঁচা আমের ভর্তায় মশগুল হয়ে পড়ল। লিপি যাও কিছুটা চিন্তিত ছিল, তবে ওই যে কথায় আছে না— ‘সবই এক গোয়ালের গরু’ কথাটি একদমই তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সে-ও খালি মস্তিষ্কের ব্যক্তি ঠিক আঞ্জুমানের মতো। তাই সে-ও আর বেশি চিন্তা ভাবনা করল না। ভর্তা খাওয়ায় ধ্যান দিলো আনন্দের সহিত। ভর্তা খাওয়া শেষ হলে দু’জন মিলে বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে, নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল হয়ে পড়ল। কিন্তু আসন্ন বিপদের আভাস আর টের পেল না । যদি টের পেত তাহলে এতো চিন্তা শূন্য থাকত না। এখন শুধু আসন্ন বিপদের অপেক্ষা। না জানি সেই বিপদ তাদের কতো দূরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়?
৪.
রাতে আলী আকবর শুয়ে আছে, আর তার চোখে ভাসছে সকালের দৃশ্যগুলো। ভুলানো যাচ্ছে না মেয়েটির চেহারা, মনের ভেতর বোধহয় গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছে। মনে হচ্ছে, ডাগর ডাগর চোখ দু’টো যেন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এখনো চেয়ে আছে তার দিকে। লম্বা উন্মুক্ত চুল তার মনকে উন্মাদ করে তুলছে ক্ষণে ক্ষণে। কী করবে সে এখন? কীভাবেই বা সামাল দিবে এই উত্তাল হওয়া বেসামাল মনটা’কে? তার যে ওই ডাগর আঁখির মেয়েটিকে চাই। হঠাৎ করে নিচের তলা থেকে বাড়ির কাজের লোক করিম মিয়ার ডাকে ভাবনা জগৎ থেকে ফিরে আসে আলী। বাবা-মা নামক ছায়া ব্যতিত সে বাড়িতে একাই থাকে। সে যখন বাইশ বছর বয়স তখন ঢাকা যাওয়ার পথে বাবা-মা দুজনেই এক্সিডেন্টে মারা যায়। সে আবার তার বাবা-মা’য়ের একমাত্র সন্তান। আবার তার বাবা ছিল তার দাদার একমাত্র সন্তান। যেন সেই যোগসূত্র ধরেই সে বাবা-মায়ের একমাত্র হওয়া সন্তান। কাজের লোক করিম মিয়া বেশির ভাগ সময় বাড়িটা দেখাশোনা করে। আলী নিচে গেল করিম মিয়ার ডাকে, গিয়ে দেখা গেল তার স্ত্রী রিমা এসেছে। সে বেশির ভাগ সময় নিজের বাবার বাসায় থাকে ঢাকাতে, মফস্বল এলাকা আবার তার বেশি একটা পছন্দ না। স্বাভাবিকই মেয়েটার জন্ম, বেড়ে ওঠার স্থান এত সহজে ভুলে গ্রামীণ এলাকায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না। বাবা-মা, তিন ভাই ও ভাবিদের নিয়ে তাদের পরিবার। রিমা সেখানে অতি আদরের একমাত্র মেয়ে। যাকে কি না তাঁরা সবাই চোখের মনি করে রাখে। তার সব স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ করে। সেজন্যই তো আলীর মতো গ্রামের ছেলেকে মেয়ে দিতে বেশি ঝামেলা করল না। কারণ তাদের ভালোবাসার বিয়ে। ভালোবাসাটা আসলে রিমার দিক থেকেই। আলী তো কেবল তাদের টাকা’কে ভালোবেসেছে। সাথে যদি ফ্রি মেয়ে শরীর পায় তাতে মন্দ কীসের? আর আলী-ও থাকে সেখানে, যেটাকে একপ্রকার ঘরজামাই বলে। গ্রামে আসা মাঝেমধ্যে তাও চেয়ারম্যান পদটার কারণে। রিমির আচমকা আগমনে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ল আলী। সে ভ্রু কুঁচকে রিমাকে দেখে বলল,
‘কী ব্যাপার হঠাৎ এখানে এলে যে? ফোন-ও তো দিলে না। একা কীভাবে আসলে?’
‘কেন আসতে পারি না, নাকি? তোমাকে সারপ্রাইজ দিব বলে গ্রামে আসা। গাড়ি দিয়ে ড্রাইভার সাথে পাঠিয়েছে বাবা। তাছাড়া কতোদিন হয়ে এলো তোমাকে কাছেও তো পাই না একটু।’
শেষের কথাটা আলীর গলা জড়িয়ে ধরে বলল রিমা। বস্তুতই বাড়িতে কেউ একটা থাকে না। খাবার রান্না, ঘর গুছানো সকালে একবার কাজের মহিলা এসে করে যায়। আর করিম মিয়া নিচের তলার কোণার রুমে থাকে, যেখান থেকে সহজে বাহিরটা দেখা যায় না। গলা জড়িয়ে থাকা অবস্থায় রিমাকে কোলে তুলে নিলো আলী। রিমা-ও বেশ আবেশে আলীর গলা জড়িয়ে ধরে তার বুকে নাক ঘষতে লাগল। দু’জনই দু’জনকে কাছে পাওয়ার আশায় এগিয়ে যেতে লাগল নিজেদের শয়নকক্ষে। হায়! কোথায় গেল কিছুক্ষণ আগের নিষ্পাপ মেয়েকে চাওয়া? এক দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল সেটা।
নিশাচর মধ্য রাত হবে হয় তো! বাগানের দিকের বারান্দাটা আলীর’ই পছন্দ করা তৈরি, যেটা রুমের সাথে অ্যাডজাস্ট করা। উন্মুক্ত বক্ষ নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে একমনে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াচ্ছে আলী। চারিদিকে কেমন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে! কিন্তু তার মনে কেবল প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের বাতাস বইছে।এতেই বুঝা যাচ্ছে কেউ একজন এই ঝড়ের কবলে পড়ে নিঃস্ব হবে। সে কেউ-টা কে? আলীর ধ্যানমন সেই কেউ-টা বলতে সকালের সেই মেয়েটিকে বুঝাচ্ছে। হৃদয়টা যে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছে আলী। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়ায় সম্বিত ফিরে পেল। পিছনে তাকিয়ে দেখে তার স্ত্রী রিমা। শ্যামলা বর্ণের মেয়েটিকে দেখতে অতটাও খারাপ লাগে না। কিন্তু তাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য তো শুধু তার বাবার সম্পত্তি পাওয়া। রিমা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে? ঘুমাচ্ছ না যে?’
‘ঘুম আসছে না।’
‘ঘুম আসছে না কেন? জানতে পারি।’
পেছন থেকে রিমাকে সামনে নিয়ে এসে ঘুরিয়ে তার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
‘মনটা সারাক্ষণই তোমায় কাছে পেতে চায় তাই।’
বলেই রিমার কাঁধে কামড় বসিয়ে দিলো আলী। ব্যথায় মুখ কুঁচকে রিমা জবাব কপট রাগের ভান করে বলল,
‘ইস কী ব্যথা পেলাম! আমাকে নাকি সে আবার কাছে পেতে চায়। আর আসবে না আমার সামনে, ব্যথা দিয়েছ। হুহ্!’
মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে নিলো রিমা কিন্তু তার আগেই শক্ত দু’টো বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া পেলো। খেয়াল করে দেখল বলিষ্ঠ হাতের লোকটি তাকে কোলে করে অন্ধকার ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। রিমা ভাবল, এই মানুষটিকে সে অনেক ভালোবাসে। তার জন্য সে অন্ধকার গহ্বরেও তলিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সে কি বুঝতে পারল, তার মানুষটার মনে এখন কী চলছে? আলী কি তাকে কাছে পেতে চাচ্ছে নাকি সে শুধু তার মনের ঝড়ের খোরাক মিটাতে চাচ্ছে। কিন্তু সে চাওয়া-পাওয়ার পার্থক্যটা কেবলই হারিয়ে গেল দুজনের উষ্ণ নিশ্বাসে।
চলবে…
#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ৩
___________
৫.
‘তোর খালি আছে ঢ্যাং ঢ্যাং কইরা ঘুইরা বেড়ান। এছাড়া আর কোনো কাজ আছে তোর। খাওন তো খালি তোর ভাইয়ের ওপর বইয়া বইয়া খাস। চিন্তা করস কইতে আসে সব খরচ?’
নিরবে কথাগুলো শুনল আঞ্জুমান। আর কথাগুলো হাতের ফোনে বলল তারই আপন বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী। গ্রাম-অঞ্চলে কারো হাতে বেশি একটা ফোন দেখা যায় না। শুধু কিছু বিত্তবান ব্যক্তিদের’ই হাতে থাকে। সেই বিত্তবান ব্যক্তিদের মধ্যে আঞ্জুমানের নানার বাড়ির কর্তা বড়ো মামা-ও পড়ে। ধানের গদি থাকার কারণে ভালোই আয় হয়। নানার বাড়িতে আঞ্জুমানকে কেউ খুব একটা পছন্দ করে না। কারণটা হলো তাকে জন্ম দিতে গিয়ে, তাদের একমাত্র আদরের ছোট বোন মারা যায়। এমনিতেই পাঁচ ভাইয়ের এক বোন আঞ্জুমানের মা। এজন্য তার মা’কে সবাই খুব আদর ও স্নেহ করে। আঞ্জুমানকে জন্ম দিতে গিয়ে তাঁর মারা যাওয়াটা কেউ-ই বিশ্বাস করতে চায়নি। তাই সবাই আঞ্জুমানকে দোষারোপ করে। অলক্ষ্মী সম্মোধনটা তার ছোটোবেলা থেকে পাওয়া আর গা সওয়া। অথচ এখানে তার দোষ কোথায়? সে তো আর নিজ হাতে জন্মদাত্রীকে হত্যা করতে যায়নি। কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ এই প্রবাদগুলো এমন হাজারো কলিকে ফুলে রূপান্তরিত হতে দেয় না, যা অকালেই ঝরে পড়ে। না জানি এই আঞ্জুমান নামক কলির অদৃষ্টে কী লেখা আছে? মুঠোফোনের ওপাশ থেকে আরো নানা গাল-মন্দ, অভিসম্পাত করতে থাকে তার বড়ো ভাবি। আঞ্জুমান কিছু না বলে চোখের জল ফেলে, মুঠোফোনটা তার মামার ঘরে দিয়ে আসে।
হাঁটতে হাঁটতে লিপিদের বাড়িতে চলে আসে আঞ্জুমান। ঘরের সামনের বারান্দায় তখন লিপি চাল বাছাই করছে। আঞ্জুমানকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে এগিয়ে এসে উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কিরে মুখের এমন অবস্থা ক্যান? কী হইছে? চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে দেখি।’
‘আচ্ছা লিপি বল তো, আমার কী দোষ? আমি কী করছি? সবাই ক্যান আমাকে অপয়া, অলক্ষ্মী বলে। আমি মইরা যাই না কেন? তাই অভিশাপ দেয়। শুন না, আমার না মাঝে মাঝে মইরা যাইতে মন চায়। মন চায় গলায় দড়ি দিয়া দিতে। তাইলে মানুষগুলো অন্তত কিছুটা শান্তি পাইব।’
কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে দিলো আঞ্জুমান। তার কান্না দেখে লিপি দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ঘরে নিয়ে বসায়। যে রুমে তারা বসেছে সেটাতে তার মা ও লিমন থাকে, পাশেরটাতে লিপি ঘুমায়। লিপির মা কাজে চলে যাওয়ায় তারা এই ঘরে এসে বসে রয়েছে। ঘরে নিয়ে লিপি পানি এনে দিলো আঞ্জুমানকে। পানি পান করে কিছুটা ধাতস্থ হলো সে। এটা দেখে আস্তে ধীরে লিপি তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হইছে? তুই এমন করলি ক্যান? ঝগড়া হইছে বাড়ির কেউর সাথে?’
‘হুম, সকালে বড়ো মামার ফোনে বড়ো ভাবি ফোন দিছে।’
অতঃপর ফোনে হওয়া যাবতীয় কথাবার্তা লিপিকে জানায় সে। লিপি যদিও জানে তার পরিবার তার প্রতি করা আচরণের সম্পর্কে তবুও স্বান্তনার বাণী শোনায়। যাতে করে কিছুটা হলে হালকা অনুভব হয় আঞ্জুমানের। কিছুক্ষণ সুখ-দুঃখের আলাপ করা শেষে লিপি অনুরোধের সুরে বলল,
‘তুই বস, আমি রান্ধনটা শেষ কইরা নেই। তারপর দু’জন পুকুরপাড়ে যামু গোসল করতে।’
আঞ্জুমান তখন সবকিছু ভুলে গিয়ে চোখ মুছে লিপির রান্না-বান্নার কাজে হাত লাগিয়ে দ্রুত কাজকর্ম শেষ করে দিলো। যদি-ও লিপি না করেছিল সাহায্যের জন্য। তখন আঞ্জুমান কপট রাগ নিয়ে বলে,
‘তুই আমার সখি না? আর তাড়াতাড়ি কাজ শেষ কইরা পুকুরপাড়ে যামু এল্লেগাই তো হাত চালাইতাছি তোর লগে।’
৬.
পুকুরপাড়ে সিঁড়ি তৈরি করা ঘাটলায় দু-বান্ধবী বসে আছে। চারিদিকে গাছগাছালির বেড়িবাঁধ দেওয়া। মনোরম পরিবেশে দুপুরের প্রখর রোদে পানি গরম হয়ে আছে। আম পাকার দিন এমনতর ঝাঁঝালো রোদের তেজ ঝড়-বৃষ্টির আসার আশংকা তৈরি করে। লিপি পানিতে নেমে গেল দেখে আঞ্জুমান-ও নামলো। পুরোপুরি ডুবে দেয়নি এখনো দু’জন, কিছুক্ষণ পানিতে তাদের দুষ্টুমি চলল, ছিটেছিটি চলল। কে কতদূর সাঁতরে যেতে পারে সবার আগে সেই প্রতিযোগিতাও চলল। অথচ আনন্দে আত্মহারা দু’জন খেয়াল করল না, পথধারের এই পুকুরের পাশে হেঁটে চলা মানুষজনের নজরে তারা আসতে পারে। যদি-ও ভরদুপুরে কেউ আসবে না এখান দিয়ে, কারণ সময়টা সকলের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকার। কিন্তু আলী তার স্ত্রী রিমার জন্য পছন্দের মাছ আনতে গিয়েছিল হাঁটে, তাই সদর থেকে ফেরার রাস্তাতে পুকুর হয়ে যাওয়ার সময় দুই বান্ধবী’কে পানিতে মেতে থাকতে দেখে চোখ পড়ল। তবে দৃষ্টি সীমানা কেবল আঞ্জুমানের ভিজে জবজবে শরীরের সাথে এঁটে থাকা শাড়ির অভিন্যস্ত ভাঁজে ভাঁজে। এরইমাঝে সাঁতরে সাঁতরে দু-তিন ডুব দিয়ে পানি থেকে ওঠে এলো তারা। ভিজে শাড়ি শরীরের সাথে এঁটে গায়ের প্রতিটি ভাঁজ যেখানে দৃশ্যমান, সেখানে তারা দু’জন শাড়ি চিপে পানি ঝরাতে ব্যস্ত। তখন গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আলী। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের অবস্থানের জানান দিলে, চমকে তাকায় তার দিকে আঞ্জুমান ও লিপি। এদিকে আলীর নিষ্পলক চক্ষুদ্বয় ষোড়শী যৌবনা আঞ্জুমানের সকল সৌন্দর্য শুষে নিতে ব্যস্ত। তা ভীতু আঞ্জুমান টের না পেলেও স্বল্প বুদ্ধিমান লিপির তীক্ষ্ণ নজর ঠিকই খেয়াল করল আলীর লোভাতুর দৃষ্টি। তাই সে এবার চেঁচিয়ে ওঠে বলল,
‘কী হইছে আপনে কী চান এহানে?’
লিপির বজ্রাহত কণ্ঠস্বরে আলীর দৃষ্টিচ্যুত হলে মেজাজ গমগমে হয়ে যায়। আলী তখন তার বাজখাঁই গলায় লিপিকে বলল,
‘তোর সাহস তো কম বড়ো না! চেয়ারম্যানের কাছে প্রশ্ন করস তাও আবার জোর গলায়!’
গ্রামের সকলেই আলীর শিক্ষিত মূর্খ, নারী লোভী, বদ আচরণের বিষয়ে অবগত। তবে এও জানে সে বেশ ক্ষমতাধর তা কেবল বড়োলোকি শ্বশুর বাড়ির কারণে। তাই ওমন ক্ষমাধরের মুখের ওপর আর কিছু বলার সাজে না দেখে লিপির মুখ ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। আলীর উচ্চস্বরে লিপিকে দেওয়া ধমকে বলা কথায় আঞ্জুমানের মন ভারাক্রান্ত হয়। মনে মনে চেয়ারম্যান আলীকে বেশকিছু গাল-মন্দ করে। তবে মুখে বলার সাহস হয় না আলীর বলিষ্ঠ, উচ্চ দেহ দেখে। ভাবে, তার মতো কাঁধের নিচে পড়া মেয়েকে যদি ধরে তুলে এক আছাড় দেয় তাহলে তাকে আর খোঁজে পাওয়া যাবে না। তাই এখান থেকে সটকে পড়ার জন্য বারবার লিপিকে খুঁচাতে থাকে। লিপি-ও তার অভিব্যক্তি ধরতে পেরে আঞ্জুমানের হাত ধরে যেই না সামনে পা বাড়াবে তখনই আবারও আলীর বাজখাঁই গলার কাছে থমকাতে হলো,
‘এত বড়ো সাহস আমাকে অপমান করার?’
অবুঝের মতো আঞ্জুমান ও লিপি নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করে। অতঃপর লিপি সহাস্যে গলায় শোধায়,
‘কী কন চেয়ারম্যান কাকা, আমাদের সাহস আছেনি এত যে আপনেরে অপমান করমু?’
চূড়ান্ত অবাকের চূড়ায় পৌঁছে ধমকানো গলায় আলী বলল,
‘এই বদ মাইয়া তোর কোন জন্মের কাকা লাগি আমি। ভাই বলবি।’
কথাটা বলল আঞ্জুমানের দিকে তাকিয়ে। অস্বস্তিতে গাঁট হওয়া অবস্থা এবার আঞ্জুমানের। সে এবার সাহস করে আলীকে বলল,
‘যাই লাগেন না, আমরা এখন যাই। ভিজা কাপড়ে কতক্ষণ ধইরা দাঁড়ায় আছি।’
আঞ্জুমানের মুখশ্রীতে লালিমা জড়ানো চিকন কণ্ঠে মাতাল প্রায় অবস্থা আলীর। স্নিগ্ধতা জড়ানো চেহারা এখন চোখের সামনে থেকে চলে যাবে ভাবতেই একদলা কষ্টরা গলায় পাক খাচ্ছে। লোভাতুর দৃষ্টি যে এবার ক্রমেই নিজের আকাঙ্খা পূরণ করতে চাইছে। এদিকে আলীর কাছ থেকে কোনো সদুত্তর না পাওয়ায় আঞ্জুমান লিপির হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু করে। মেয়েটার সাহস দেখে যারপরনাই অবাক হলো আলী। অথচ কিছুক্ষণ আগেও আঞ্জুমানকে ভীত ও আতংকগ্রস্থ মুখ নিয়ে লিপির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সেই কি না গটগট করে হেঁটে চলে গেল আলীকে মুখের ওপর প্রশ্ন ছুঁড়ে পাত্তা না দিয়ে। তবে এমন ঝাঁঝ মরিচের স্বাদই তো চাইছিল আলী। ঘরে বেশি মিষ্টি খেতে খেতে এবার স্বাদের পরিবর্তনটা বেশ জমবে। তবে কথা হলো স্বাদটা নিবে কীভাবে আর মিষ্টির একটা ব্যবস্থা করবেও কীভাবে? ঝাল-মিষ্টি একসাথে থাকলে আবার বিদঘুটে স্বাদে আলীর অবস্থা হবে খারাপ।
চলবে…