#নিশুতি_তিথি,পর্ব ১০,১১
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ১০
২০.
তুমি যাকে ভালোবাসো,
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো,
তার জীবনে ঝর,
তোমার কথার শব্দ দূষণ,
তোমার গলার স্বর,
আমার দরজায় খিল দিয়েছে,
আমার দারুণ জ্বর,
তুমি অন্যকারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর।
শ্যামাঙ্গী মেয়েটার গুণের অভাব নেই, সাথে নেই অফুরন্ত সম্পদেরও।
‘সুখ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে রোজ,
তবুও কেন যেন নেই সেই সুখের খোঁজ।’
মন খারাপের আবেশে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা রিমার মুখের ওপর বৃষ্টির ছিটেফোঁটা উপচে পড়ছে। পেছন থেকে পুরুষালী হাতের আদুরে স্পর্শেও মন খারাপের রেশ সরছে না তার মুখ থেকে।
‘গানটা কেবল তোমার গলায়ই ভালো শোনায়।’
জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুঁতনি রেখে আলীর প্রশংসাও রিমার মুখে হাসির কারণ হতে পারল না। তখন তাকে ছেড়ে দিলো আলী। মনে ক্লেশের ভার সইতে না পেরে এবার ডুকরে কেঁদে উঠল রিমা। আলী তখন তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে, দু’হাতের আঁজলায় তার মুখ তুলে দৃষ্টি সমান করে দু’জনার। সেই অশ্রুভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আলী বলল,
‘মন খারাপ করে কান্না করছ কেন? এখানে তো আমাদের হাত নেই। সৃষ্টিকর্তা চাইলে আমাদের ইচ্ছা পূরণ করবে। বাই হুক অর বাই কুক।’
আলীর শেষোক্তিটি ছিল অস্পষ্ট, তবে নিজের জন্য। অবশ্য সেদিকে রিমা খেয়াল করল না। সে নিজের কান্নার মগ্নতায় আলীর পুরুষ্টু বুকে মুখ গুঁজে রোদনের ঝংকার তুলল। আলী শ্বশুর বাড়িতে দুপুরের লাঞ্চ সেরে ড্রয়িংরুমে বসেছিল। বাড়িতে বড়ো ভাবির অনুপস্থিতি বেশ ভালো করে লক্ষ করেছিল আলীর ধুরন্ধর, অগ্রণী নজর। সেই বিষয়ে রিমাকে জিজ্ঞেস করাতে, রিমা মুখে কুলুপ এঁটে ছিল। অতঃপর ছোটো ভাবির সাথে আবার ভাব-ভঙ্গি বেশ ভালো আলীর। সেক্ষেত্রে তাঁর কাছেই সুযোগে জেনে নিলো বড়ো ভাবির অনুপস্থিতির কথা। জানতে পারল কিছুদিনের জন্য বড়ো ভাবি নিজের বাবার বাড়িতে গিয়েছেন, তবে তাঁকে একেবারের জন্য বের করে দেওয়া হয়নি। বাড়ির পরিস্থিতি ঠান্ডার সাপেক্ষে এই পদক্ষেপ নেওয়া। এখন আলী সাময়িক সময়ের জন্য নিজের ভাবনাগুলোর আজ ছুটি দিয়ে আগলে নিলো রিমাকে নিজের বাহুডোরে।
২১.
আঞ্জুমানের অবস্থা দেখে লিমার বুকটা হু হু করে উঠল। বাপ-মা মরা মেয়েটার কী অবস্থা করেছে জালিমের বাচ্চাটায়! মনেই মনে আলীকে গালাগালির দিলেও মুখে টু শব্দটুকু করার সাহস নাই লিমার। অবশ্য তাদের মতো গরিব আর চালচুলোহীন উপরন্তু মেয়ে মানুষের জীবনে সুখ-ফড়িঙের আশা করা সমীচীন নয়। তারা সবসময়ই পুরুষ জাতির পদতলে পিষ্ট হওয়ার জন্যই বোধহয় সৃষ্ট। তা নাহলে কেন তাদের নরকের জীবনে এক ধুলো পরিমাণ সমীরণ বহে না?
‘এই মেয়ে তোমার নামটা জানি কী?’
‘ল…লিমা।’
আচমকাই নার্সের হাতের ধাক্কা ও প্রশ্নে থতমত খেয়ে তোতলে যায় শব্দসন্ধি লিমার ঠোঁটে।
‘আচ্ছা, যাও তো আমার জন্য একটু স্যুপ করে নিয়ে আসো।’
‘আমি তো সস..প বানাতে পারি না।’
লিমার গলারস্বরে ভীতিগ্রস্ত হওয়ার ইঙ্গিত সাথে শব্দ উচ্চারণে লেখাপড়া না জানার আভাস। তবে নার্সের হাসির ফোয়ারায় অবাকান্বিত হওয়ার যোগ লিমার। কারণ কী এভাবে হাসার? পরক্ষণেই উত্তর মিলল তার।
‘কী কী বললে? স্যুপের নামের নতুন প্রবর্তন দেখছি।’
ফের হাসির ফোয়ারা। আঞ্জুমানের রুমে দু’জনেরই অবস্থান তাদের। নার্সের উচ্চস্বরে হাসির তরঙ্গে আঞ্জুমানের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। ফলাফল চোখ মেলে তাকায় আঞ্জুমান। ব্যথা শরীরে জোঁকের মতো। তবে মনে হয় সেটা রক্ত নয়, চামড়ার মধ্যবর্তী কোমল ও নরম অর্থাৎ মাংশে কামড়ে কামড়ে ধরছে। শব্দ হলো অস্পষ্ট, ব্যথাহত। সেই শব্দে থেমে গেল হাসির ঝংকারা। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো নার্স ও লিমা।
‘ম্যাম, ম্যাম কী হয়েছে?’
দন্ত দ্বারা ঠোঁটের কোণ কামড়ে ব্যথা সংবরণের আঞ্জুমানের দৃঢ় চেষ্টা লিমার অবাকান্বিত যেন আরো বাড়িয়ে দিলো৷ যে মেয়ে অল্প কষ্টে কেঁদে কেঁদে তাকে এসে জানাতো, সে মেয়ে এখন শরীরে কষ্টের হাজারো বর্শা নিয়ে তড়পালেও সহ্য করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে নার্স বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘অসহ্য! এত তাড়াতাড়ি ওঠে গেল। ডোজে কি কাজ হচ্ছে না?’
পরক্ষণেই মনে পড়ল হাসির শব্দে হয়তো জেগে গেছে। নার্সের মন-মেজাজের অবস্থা হলো বিক্ষিপ্ত, ক্রোধিত। তৎক্ষনাৎ লিমাকে বলল,
‘তোমার জন্য এই অবস্থা হলো ম্যামের।’
‘আমি! আমি কীয়ারলাম আবার?’
মূক হওয়া প্রশ্ন লিমার। তবুও ওপাশ থেকে কোনো সদুত্তর এলো না, এলো তো শুধু বিরক্তি হওয়া তীক্ষ্ণ ফলার দৃষ্টি। চাপা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে নার্সের সম্মুখ থেকে সরে দাঁড়ালো লিমা। রাতের শিফটের নার্সটা আসার পর থেকেই লিমার ওপর কেন যেন ক্রুদ্ধ। সেটা অবশ্য লিমার বুঝে আসে না। দিনের বেলার নার্সের সাথে তার দেখা হয়নি। এখন সে ভাবছে অন্য নার্সটা না জানি আবার কেমন হয়! আর আলী যে কবে আসবে? তার যে অনেক কথা আছে আলীর সাথে। একপলক দেখল আঞ্জুমানকে, নার্সটা ইনজেকশন দেওয়ার কারণে আঞ্জুমান ঘুমে তলিয়ে গেল।
২২.
‘ওখানের কী খবর?’
‘ভালো।’
‘সুস্থতা কতটুকু?’
‘ব্যথা সেরেছে, বাকি আছে অল্পকিছুটা।’
‘হাঁটা-চলা?’
‘করতে পারে, তবে বেশি দূর হাঁটতে গেলে আবার ধরে নিয়ে যাওয়া লাগে।’
উপুড় হয়ে আবরণশূন্য গায়ে শুয়ে থাকা আলীর পিঠে আচমকা এসে আক্রমণ করে বসে রিমা। যার ফলে কান থেকে ফসকে পড়ে যায় ফোন। খিলখিল শব্দযোগে ভারি হয়ে ওঠে রুমের চার দেয়াল। সেই শব্দ পর্যন্ত ফোনের অপরপাশে থাকা ব্যক্তি করিম মিয়ার কানে পৌঁছায়। দ্রুত হাতে ফোন তুলে কল কেটে দেয় আলী। ওপাশের দীর্ঘশ্বাস অবশ্য আলীর কর্ণগোচর হয় না। পিঠে ক্ষণ, ক্ষণ সময় নিয়ে দন্তের সুচালো খোঁচা অনুভূত হচ্ছে আলীর। ঘুরে গিয়ে কায়দা করে দু’হাতে রিমাকে নিজের নিচে ফালায়। রিমার হাসি থমকে যায়, নিজের ওপরে আলীর শরীরের ভারে। বেশ সময় নিয়ে দু’জন একদৃষ্টে দু’জনকে দেখে। মুখ নিচু করে রিমার কানের কাছে পৌঁছায় আলী। অঙ্গে জানাশোনা শিহরণ বয়ে যায়। কারণ আলী কাছে এলেই রিমার অনুভূতিরা এলোমেলো হয়ে রক্তকণিকায় দ্রুত বেগে ছুটতে থাকে।
‘কী ব্যাপার? মহারানীর এত হাসির কারণ কি জানতে পারি?’
পরক্ষণেই দমিয়ে রাখা হাসি বিচরণ করল রিমার মুখ জুরে। হাসির দমকে কথা গুছিয়ে বলতেই পারল না সে। ভ্রু কুঁচকে তখন আলী বলল,
‘হাসির সমাপ্তি হলে বলেন তখন। আপনার এই দাস অপেক্ষায় থাকবে।’
বহু কষ্টে হাসি চাপালো রিমা। অন্যদিক মুখ করে রাখা আলীর চিবুক ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
‘ছোটো ভাবি আমাকে লজ্জা দিয়েছে।’
মৃদুমন্দ চেয়ে বলল রিমা। বোঝাই যাচ্ছে কোনো বিষয়ে সে লজ্জায় মরমে মরে যাচ্ছে। এজন্যই চোখের দৃষ্টি পূর্ণ নয়।
‘তাই বুঝি? তা আমার ভালোবাসার রানির মুখশ্রীতে কীসের এত লাজ?’
এবার দু’হাতের পাতায় মুখ ঢেকে ফেলল রিমা। তার বাবা যে তাদের জন্য হানিমুন সুইটস বুক করেছে সুইজারল্যান্ডে, সেটা বলতেই তার এত লাজ-শরমের অবস্থা। মুখ ঢাকা অবস্থায় কেবল তার হালকা গোলাপিবর্ণের অধর উন্মুক্ত। সেই সুযোগে আলী নিজের অধর দিয়ে চাপ প্রয়োগ করল রিমার অধরে। কিয়ৎক্ষণ গড়াতেই ওষ্ঠের পৃথক হতেই রিমা বলল,
‘বাবা আমাদের জন্য হানিমুন সুইটস বুক করেছে সুইজারল্যান্ড।’
এখনো ঢেকে রাখা রিমার চক্ষুদ্বয়। তবে আলীর চোখের অবস্থা সাংঘাতিক। যেন সেই চোখে কোনো বিস্ফোরণ ঘটল মাত্রই। মাথায় তখন শুধু একটা নাম শব্দযোগে ঘুরছে।
‘আঞ্জুমান!’
চলবে…
#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ১১
___________
২৩.
‘আমার চোখের ঘুম নষ্ট করে আছ কি তুমি ঘুমিয়ে?
একবার দেখ জল ভরা নদীতে তাকিয়ে,
আজ ভালোবাসার এক সমুদ্দুর নিয়ে আছি আমি অদূরে দাঁড়িয়ে।’
রিমার সাথে থাকতে থাকতে টুকটাক ছন্দ গঠনের প্রক্রিয়া কাজ করে আলীর মনে। তবে সেটা ভীষণ একান্তে, প্রিয়জনের ক্ষেত্রে। আজ-ও ব্যতিক্রম ঘটল না সেটার। সুইজারল্যান্ডে এসেও মনটা পড়ে রয়েছে সেই ছোট্ট গ্রামের ছোট্ট কিশোরী বধূয়ার পানে। সুইজারল্যান্ডের ঠান্ডা আবহাওয়ায়ও তার শান্ত মন আঞ্জুমানের কথা ভেবে অশান্ত, বেসামাল, তাপীয় হয়ে আছে। মেয়েটাকে দেশে ফেলে এসে মনের মধ্যে শান্তির ছিটেফোঁটাও পাচ্ছে না আলী। যদিও ভেবেছিল, দূরত্ব বাড়লে ভালোবাসার গুরুত্ব কমবে। তা আর হলো কই? গুরুত্বের পারদ ডিঙিয়ে সুউচ্চে অবস্থান করে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে ভালোবাসা নামক অপদার্থ পদার্থটা তাকে। যদিওবা আগে ভালোবাসাটা সদ্য কলি থেকে পরিস্ফুটিত হতে নিয়েছিল, কিন্তু তার আগে ভালোবাসার প্রকাশের ভয়ে ভীত হয়ে দাবিয়ে রাখার চেষ্টায় দূরত্ব বাড়ানোর ফন্দিতে সুইজারল্যান্ডে আসাটা কাজে লাগাল আলী। তা সত্ত্বেও পরিবর্তনের নাম নিশানাও দেখছে না। সারাক্ষণ ভেতরটা উশখুশ করে আঞ্জুমান নামক বন্দি পাখির জন্য। আঞ্জুমানকে ভালোবাসা শিখার নামে নিজের দাবিয়ে রাখা ভালোবাসা কাল হয়ে, বারবার তার মনের মধ্যে ঝড় তুলে আঞ্জুমানকে কাছে পাবার। লিমাকে যদিও আঞ্জুমানের কাছে রেখে এসেছে, তবুও সত্য সম্মুখে আসাও তাকে ক্ষণে ক্ষণে ভীত করে তুলছে। অবশ্য ভয় পাওয়ার মতো মানুষ আলী নয়, শুধু চিন্তা বলা চলে। মনে হয় না তার কথা ডিঙিয়ে লিমার মুখ খুলবে। আবার অতিক্রম করতেও পারে, আঞ্জুমানের প্রিয় সখি বলে কথা৷ যাকে হাত করে আঞ্জুমানকে পেতে চাওয়া। যদিও পরিকল্পিত পরিকল্পনা অর্ধেক সম্পন্ন হয়েছিল। পরে সুযোগ করে দিয়েছিল, নিজে আঞ্জুমান’ই। মন খারাপ করে আত্মহত্যা করতে গিয়ে। পরের চালগুলো আলী দিয়েছিল শুধু। বাড়িটাকে খালি করে করিম মিয়াকে দিয়ে গ্রামের গণ্যমান্য, সম্মাননীয় ব্যক্তিবর্গদের জড়ো করে। সেখানে অবশ্য নিজের লোকও ছিল কিছু। অতঃপর যা হওয়ার তাই হলো। একটু কষ্ট যদিও লেগেছিল আঞ্জুমানের সম্মানহানি হওয়ায়। তবুও করার কিছু ছিল না। কথায় আছে না, ‘কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়’ সেটা বিবেচনা করে নিজেকে দমিয়ে রেখেছিল। মনের ভীতের অংশ তখন প্রশ্ন করে,
‘এসব জানার পরে থাকবে তো তোমার আঞ্জু?’
আলী সশব্দে বলল,
‘থাকবে। তাকে থাকতে হবে। আমার ভালোবাসা থাকতে বাধ্য করবে।’
ভেতরকার সত্তা কিছুই বলল উলটে হেসে উঠল আত্মাভিমানে, অহংবোধে। যা জানান দেয়, কাজটা আলীর ঘৃণিত ছিল। চঞ্চলার ছটফটে, ব্যাকুলা হয়ে চলনশীল স্থগিত করে কেমন চুপচাপ, শান্ত, নিথরে বানিয়ে দিয়ে আলীর আশানুরূপ সাফল্য অর্জনে হার নিশ্চিত করে; যদি ঘটনা আঞ্জুমানের কর্ণগত হয়।
‘কী হলো তোমার? একা একা কী থাকতে বাধ্য করবে বলছিলে?’
‘তুমি ঘুমাওনি?’
আলীর সম্পূর্ণ কথা রিমা শুনেনি বিধায় কথা ঢাকতে অন্য প্রসঙ্গে ঢুকে যায় আলী।
‘কেন? শরীর খারাপ করছে?’
এতক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা, ছাদযুক্ত বারান্দার হিমশীতল বাতাস থেকে সরে এলো, বারান্দা কাচের দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ঘুমঘুম চোখের রিমার কাছে। ঠান্ডা হাত দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিলো। আলীর অতিশয় শীতল হাতের স্পর্শে রিমা খানিক কেঁপে উঠল। দুপুরের লাঞ্চের পরের ঘুমে শরীর তার ম্যাজম্যাজ করছে। আবারও বিছানায় যাওয়ার ইচ্ছে জাগছে। দু-হাত দিয়ে আলীর গলা জড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘নাহ, শরীর ঠিক আছে। শুধু একটু ম্যাজম্যাজ করছে।’
রিমার কোমর ধরে কাছে টেনে নিয়ে আলী বলল,
‘তাই না কি? তাহলে বিবি সাহেবার ম্যাজম্যাজ ভাব কমিয়ে দেই।’
আলীর মুখে দুষ্টুমির বাঁকা হাসিে দেখে বুঝতে পারল লোকটার মনের অভিব্যক্তি। তাই কিছু না বলে লজ্জাময় হাসি দিয়ে মুখ লুকালো আলীর বুকে।
২৪.
রাতের শিফটের নার্সের সাথে সর্বক্ষণ লেগে থাকে লিমা। রাতের শিফটে কর্মরত নার্সের কর্মকাণ্ড দেখার পর থেকেই লিমার রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ফোঁসফোঁস শুরু। দিনের বেলার নার্সটা কাজ-কর্ম ঠিকঠাক করে। আঞ্জুমান তো বেশিরভাগ সময়টা ঘুমিয়ে কাটায়। একটু ধরে খাওয়ানো, যেটা কেবল লিমা’ই করে। ওয়াশরুমে নেওয়া-আনা, গোসল করানোর এসব কাজ কেবল নার্সরা করে; কারণ গায়ের ক্ষতের জন্য। আবার ড্রেসিং করা তো রয়েছেই। কিন্তু রাত্রি প্রহরের নিয়োজিত নার্সটা রাতে পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে কাটায়। যেটা হাতেনাতে ধরেছে লিমা। রাতে হঠাৎ আঞ্জুমান জেগে যায় ওয়াশরুম যাওয়ার তাগিয়ে। অথচ নার্সটা দিব্যি আরামসে ঘুমাচ্ছে। ওয়াশরুমের চাপের তাগিদে সর্বশেষে ডাক দিয়েও যখন নার্সের ঘুম ভাঙাতে অক্ষম হলো আঞ্জুমান, তখন নিজ উদ্যোগে কাঁপন ধরা শরীর নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার উদ্যত হলো ওয়াশরুমের দিকে। কিন্তু নাহ, বাঁধাপ্রাপ্ত হলো শরীর তার সাথে সায় দিলো না। কাঁপাতে কাঁপতে দু-কদম এগিয়েই ধরাস করে পড়ে গেল। ব্যথার ওপর ব্যথায় সম্ভবত গলায় শক্তির জোগান দেয়, তাই সে চিৎকার দিয়ে উঠল। সেই শব্দে নিচ তলায় অবস্থানরত কাজের লোকদের কোয়ার্টারে আলাদা আলাদা রুমে থাকা লিমা ও করিম মিয়ার কানে পর্যন্ত পৌঁছে গেল। দ্রুত কদম বাড়ালো ওপরের তলায় গেস্ট রুমের দিকে। এদিকে চিৎকারে নার্স ঘুম চোখে ওঠে হতভম্ব হয়ে বসে রইল। খানিকক্ষণ বোঝার চেষ্টায় সে হলোটা কী? নিচে পড়ে থাকা আঞ্জুমানের গোঙানি তার ধ্যানচ্যুত করে। এগিয়ে হড়বড়িয়ে আঞ্জুমানকে তুলে ধরার আগেই লিমা এসে তাকে উঠিয়ে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলো। আঞ্জুমানের দরজা সবসময় খোলা রাখা হয়, আলীর আদেশ। অতঃপর সকালে গরম গরম হয়ে খবরটা পৌঁছে যায় আলীর কাছে। রাগান্বিত আলী নার্সকে সামনে পায়নি ভাগ্য ভালো বলে। শুধু চাকরিচ্যুত হয়েছে, সাথে হাসপাতালের চাকরি থেকেও। সেই থেকেই আঞ্জুমানের খেয়াল লিমা রাখে। আর দিনের বেলার নার্সকে কড়া নজরে রাখে। এই তো আঞ্জুমান সুস্থতা হলেই ছুটি সকলের। কিন্তু লিমার? সত্যিই কি ছুটি হবে?
‘কীরে সই কী ভাবছ এত?’
ধ্যানচ্যুত লিমার ভাবনাগুলো আপাতত ছুটি নিলো।
‘কী কইলি?’
‘কিছুই শুনোস নাই?’
মাথূ নেড়ে না বুঝালে আঞ্জুমান মন খারাপের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লিমাকে বলল,
‘তুই আর আগের মতোন নাই রে লিমা। আগের মতো ছোটাছুটি, দুষ্টামিও নাই।’
‘তুই-ই বা কি আছোস আগের লাহান?’
আচমকাই কথাখান বলে লিমা হতবুদ্ধি হয়ে গেল। প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি পরে বুঝল। তার করা প্রশ্নে আঞ্জুমানের মুখে নেমে এলো মেদুর ছায়া। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসা মুখ ডানপাশের জানালা গলিয়ে তাকিয়ে দেখল বাগানের গাছে বসা পাখিদের ভালোবাসা। নাম না জানা এক পাখি আরেক পাখির মাথায় ঠুকরে দিচ্ছে, তবুও সেই ঠুকর খাওয়া পাখি আরো ঘেঁষে রয়েছে অত্যাচার করা পাখির সাথে।
‘ পরিস্থিতি আমারে বদলায় দিছে।’
অবাক হয়ে চেয়ে রইল লিমা তার দিকে। কঠিন শব্দে তৈরি বাক্য আঞ্জুমানের মুখে গম্ভীরতা এনে দিলো। সাথে বুঝিয়ে দিলো ভেতরে থাকা কষ্টের পাহাড় খুবই বিশাল। তার দিকে তাকিয়ে লিমার খুবই খারাপ লাগা সাথে অপরাধবোধ হচ্ছে। সে তো জানে সবকিছুই। এক মন চূয় বলতে তো আরেক মন বলে, আঞ্জুমান তোকে ভুল বুঝব। তার চোখে হারাইবি আগের সই’য়ের ভালোবাসা।
চলবে…