#নিশুতি_তিথি,পর্ব ১
লেখা : মান্নাত মিম
১.
‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই,
সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি……..’
মনের সুখে সুর তুলে দিব্যি গান গেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে আঞ্জুমান আর সাথে তার প্রাণপ্রিয় সখি লিপি। লম্বা চুল যা কোমড় ছাড়িয়ে হাঁটু পর্যন্ত এসেছে, গায়ে আটপৌড়ে করে শাড়ি জড়ানো। আঞ্জুমানের লাফানের কারণে তার হাঁটু সমান চুলও বারবার নেচে উঠছে। তার সাথে তার সখি-ও শাড়ি পরা কিন্তু মোহনীয় লাগার মতো রূপ খেলে উঠেছে একমাত্র আঞ্জুমানেরই। লাগবেই বা না কেন, এতো সুন্দর গায়ের গড়ন সাথে দুধে আলতা রং বুঝি সৃষ্টিকর্তা এমনি এমনি দিয়েছে নাকি। তবে বুদ্ধিসুদ্ধি-টা কেবল সেই হিসেবে কমিয়ে দিয়েছেন।
তাদের দু’জনের যাত্রার উদ্দেশ্য হলো বড় বাড়ির বাগানে যাওয়া। বাড়ির নাম এমন হওয়ার কারণ বাড়িটা বেশ বড়সড়। আর একপাশে থাকা বাগান। ফল-ফলান্তি দিয়ে ভরা বাগানটা। ভাবতে অবাক লাগে মাঝে মাঝে আঞ্জুমানের যে এতো বড় বাগান। অথচ একটাও ফুল গাছ নেই। যাইহোক ফল গাছ তো তাদের জন্যই আছে। তাই ফুলের চিন্তা বাদ। মনে মনে পৈশাচিক হাসি দিয়ে তার সখির দিকে তাকাল। তার সখি লিপি তার তাকানো দেখেই বুঝতে পারল, এখন তার কী করতে হবে। লিপি সামনে থাকা বাউন্ডারির দিকে তাকালো, আবার কিছুদূরে থাকা গেটের দারোয়ান’কে দেখে নিলো। ব্যাটা দারোয়ান আপাতত বাইরে নেই, সুযোগ আছে তারমানে। যাক তাদের জন্য ভালো লক্ষণ ফল চুরি করার। বাড়ির চারপাশে যে প্রাচীর দেওয়া সেটা অবশ্য অতোটা উঁচু নয়। বড়ো মানুষ-রা তা টপকিয়ে যেতে পারবে অনায়াসে। আঞ্জুমান মনে মনে ভাবল,
‘এ্যাহ যেই না নাম বড়ো বাড়ি, তা গো বলে আবার আত্মা বড়ো! হুদাই নামে বড়ো, মনটা ছোট্টই। নাইলে কী অমন ভাবে বাগানের জন্য চারিপাশে দেয়াল টানায়!’
লিপির ধাক্কায় ভাবনা জগতের থেকে বেরিয়ে আসে আঞ্জুমান। সে আঞ্জুমানকে দেয়াল টপকানোর জন্য তাগাদা দিচ্ছে। আর আঞ্জুমান-ও এদিক-সেদিক তাকিয়ে আঁচল কোমড়ে ভালোভাবে পেঁচিয়ে, চুলগুলো খোঁপা করে দেয়াল টপকাল। তার সাথে সাথে লিপি-ও চলে গেল দেয়ালের ওপারে যেখানে বিদ্যমান বিশাল ফলের বাগান।
লিপি এখানে অনেকবার আসলেও আঞ্জুমানের এখানে আসা পড়েনি কখনো। কারণ আঞ্জুমান এখানে বেড়াতে এসেছে কয়েকদিনের জন্য, তাও আবার মাঝেসাঝে। সে অন্য এলাকার মেয়ে। মাত্র ষোড়শী কিশোরী যে কি না অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। তারপর কোনো এক অভিতব্য কারণবসত লেখাপড়াটা তার আর হয়ে ওঠেনি। মা হারা কন্যা হলে যা হয় আরকি, তার ক্ষেত্রেও তেমন। সে দেখতে যতটা মিষ্টি, ততটাই বাউণ্ডুলে, উড়নচণ্ডী ও চঞ্চল। তাই তো তার কাজ সারাক্ষণ ভবঘুরে বেড়ানো। বিক্রমপুরে এসেছে তার নানা বাড়িতে, এখানে প্রায়ই আসা হয় কিন্তু তা সল্প সময়ের জন্য। তাই এলাকাটা অতোটা ঘুরে ফিরে চেনা হয়নি তার। মা মারা যাওয়ার পর ছোট্ট তাকে নেওয়া হয় দাদা বাড়িতে। নানা বাড়ি কেবল নামেই মাত্র, ঘুরাফেরাও হয় না এখানে আসার পর। এখানে আসার সবচেয়ে বড়ো উদ্দেশ্য হলো তার প্রাণপ্রিয় সখি লিপিকে পাওয়া। নানা বাড়ির অনেকে আছে তার সমবয়সী মামাতো বোনরা। কিন্তু তাদের সাথে তার আবার সখ্যতা হয়ে ওঠেনি। তাই অপরিচিত লিপির সাথেই তার এতো মেলামেশা হঠাৎ সাক্ষাৎকারে। দু’টো বড় ভাই আছে তাও তার দিকে তাকানোর সময় নেই। আর ভাবিদের কাছে সে তো চোখের বালি। এমনিতে তার এমন বাচ্চাসুলভ আচরণ ও মায়া মাখা মুখ সবারই মন কেড়ে নিতে বাধ্য।
এখন সে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আম গাছের নিচে। মাঝারি গড়নের কাঁচা আমগুলো দেখে তো তার জিভে জল এসে পড়েছে। তাই সে লিপিকে বলল,
‘শোন লিপি, তুই আশেপাশে চাইয়া দেখ কেউ আসে নাকি। আমি ততক্ষণে গাছে উইঠা আমগুলো আঁচলে ভরতে থাকি।’
লিপি-ও তার কথায় সায় দিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে লাগল। আর এদিকে আঞ্জুমান তরতরিয়ে গাছে ওঠে পড়ল। কয়েকটা আম নিতে গিয়ে খোঁপা করা চুলের সাথে গাছের ডালগুলো আটকা পড়ে যায়। কোনোরকম ছাড়িয়ে নিয়ে আরামসে আমগুলো পেরে নেয়। অনেক গুলো পেরে নেওয়া হয়ে গেলে, সে নিচে নামার চেষ্টা করে। কিন্তু এতগুলো আম নিয়ে এতো উঁচু থেকে নামা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাই আস্তে করে লিপিকে ডাক দেয়। লিপিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘এ্যাই লিপি শোন, আমি এতোগুলো আম নিয়ে নামতে পারতাছি না। তুই এককাজ কর, তোর আঁচলটা মেইলা ধর আমি কিছু আম ফালাই। তখন আম কিছুটা কমলে বাকিগুলো নিয়া আমি নামতে পারমু।’
আঞ্জুমানের কথা শুনে লিপি-ও তার শাড়ির আঁচল মেলে ধরল। আঞ্জুমান-ও পরপর কিছু আম ফেলে নিজের আঁচলটা হালকা করলো। তারপর নিচে নামল।
২.
বাড়িটা সাদা রঙের। গ্রামীণ পরিবেশে ডুপ্লেক্স বাড়ির ওপরে ছাদ দেওয়ার বদলে সেখানে নকশী করে কাঁটা টিনশেড ব্যবহার করে চাল দেওয়া। কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর লাগে বাড়িটার পাশে যে বাগানটা আছে সেদিকের বারান্দা। বারান্দা থেকে দেখা যায় বিশাল ফল গাছের বাগান। সেখানে আছে নানা রকমের ফল গাছ। কোন ফল গাছ নেই, তা বলা বেশ মুশকিল। আসলে এই ফল গাছ লাগিয়ে ছিলেন আলী আকবরের দাদা। তার দাদার ফল অনেক প্রিয় তাই তিনি ফল গাছের বাগান গড়ে তুলেছেন। সে আবার তার দাদাকে অনেক ভালোবাসে। আলী আকবর বাড়ির কর্তা। বিক্রমপুর এলাকার সে চেয়ারম্যান, সবাই তাকে আলী ভাই বলে। কিন্তু তার প্রভাব খুব বেশি একটা নেই বললেই চলে। কেননা তার ন্যায়-অন্যায়ের বিচার ধারা ভালো না। তাই গ্রামের মানুষজন খুব একটা পছন্দ করে না তাকে। এমনিতেও সে এখানে বেশিদিন থাকে না, আর এই চেয়ারম্যান পদটা-ও ছেড়ে দিবে কিছুদিন পরে। তার কারণ আছে অবশ্য। সেখানে নিজের নয়, শ্বশুরের ইচ্ছেই প্রাধান্য।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আলী আকবর।বয়স গিয়ে ঠেকছে ছত্রিশের কাঠগড়ায়। কিন্তু দেখতে লাগে মাত্র সাতাইশ-আটাশ বছরের যুবকের মতো। সে বারান্দায় প্রতিদিন নিয়ম করে একবার আসে, কিন্তু তা বাঁধা ধরা সময় করে নয়। আজ সকাল দিকে সে বারান্দায় এসে বাগানের দিকটায় বাগান দেখছে। কি নির্মল বাতাস! সুন্দর প্রকৃতি, ছায়া ছায়া পরিবেশ। বেশ ভালোই লাগছে তার। কিন্তু সে ভালো লাগাটা স্হায়ী হলো কই? সামনের বিশাল আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের দেখে। মেয়ে দু’টোর আঁচলে পুরে কাঁচা আম নিচ্ছে তা স্পষ্টতেই বুঝা যাচ্ছে। তাই সে তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে নেমে দৌড় লাগাল তাদেরকে ধরতে।নইলে মেয়ে চোর দু’টো চলে গেলে ধরতে পারবে না। গিয়ে সে দেখল মেয়ে দু’টো প্রাচীর তোলা দেয়াল টপকাতে চাইছে।একজন দেয়ালে একহাত ভর দিয়েছে, মানে দেয়ালের ওপারে যাওয়ার জন্য লাফ দিবে।আর একজন নিচে থেকে সে মেয়েটার কোমড়ে হাত রেখে দেয়ালে ওঠাতে সাহায্য করছে। তা দেখে রাগে মুখ লাল হওয়া আলী তাড়াতাড়ি করে গিয়ে পিছনের মেয়েটির হাত ধরে তার দিকে ঘুরাল। সাথে সাথে আঞ্জুমান ছিটকে আলীর বুকের উপর এসে পড়ল, আর তার বাঁধা হাত খোঁপাটা খুলে গেল। এদিকে বেচারি লিপি ধরাম করে নিচে পড়ল, সাথে কোমড়ে বেশ ব্যথাও পেল।এদিকে আলী তার ওপরে ঝুঁকে থাকা মেয়েটার দিকে একদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কিছু চুল মুখের ওপর পরে মেয়েটার মুখ ঢেকে রয়েছে, যার কারণে মেয়েটার মুখের একাংশই শুধু সে দেখতে পাচ্ছে। সে অংশই তাকে মেয়েটার মুখে থাকা চুল সরিয়ে দেওয়ার সাহস দিচ্ছে। কেননা মেয়েটার নাকে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম, পুরো মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছিল। নাকে থাকা নাকফুলটা উজ্জ্বলতাকে যেন আরো বাড়িয়ে দিলো। আলী আস্তে করে আঞ্জুমানের মুখের সামনে থেকে চুলগুলো সরিয়ে কানে গুঁজে দেয়। এতক্ষণ ধরে আঞ্জুমান চোখ বন্ধ করে মুখ কুঁচকে রেখে ছিল। কিন্তু যখন আলী তার চুলগুলো সরিয়ে দেয়, তখন তার হাতের ছোঁয়া পেয়ে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল আঞ্জুমান। তা দেখে আলীর মনে এক শীতল হাওয়া বয়ে গেল। মনে হলো কোনো ঠান্ডা বরফ তার বুকে রেখে দেওয়া হয়েছে। সেটা ধীরে ধীরে তার শিরা-উপশিরায় মিশে যাচ্ছে। সে তাকিয়ে দেখছে তার সামনে থাকা চাঁদমুখকে আর ভাবছে, কতো মায়া খেলা করছে মেয়েটির মুখে! এমন করে তাকিয়ে থাকা দেখে আঞ্জুমান ভয় পেয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল তার থেকে। আর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
‘দেখেন আমায় মারবেন না দয়া কইরা। আমাকে ছাইড়া দেন, আর জীবনেও আম চুরি করমু না। ছাইড়া দেন আমাদের।’
আঞ্জুমানের মুখের কথা শুনে আলীর ধ্যান ভাঙল এতোক্ষণে। সে দেখল আঞ্জুমান তার থেকে কিছু দূরে লিপির পিছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছে। আর আমগুলো তো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এতগুলো কাঁচা আম পেরে ফেলেছে মেয়ে দু’টো, ভাবতেই আলীর মেজাজটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল। তাই ক্রুর দৃষ্টিতে তাকাল তাদের দিকে। কিন্তু তা আর হল কোথায়? সামনে থাকা মায়াবী চাঁদমুখ দেখে রাগগুলো ঠান্ডা তরলে পরিণত হলো। একপশলা বৃষ্টির ছিটেফোঁটা মনে হয় মৃদুমন্দভাবে তার হৃদয়ের অভ্যন্তরীণে ভিজিয়ে দিচ্ছে। কারণ কী এমন হওয়ার? অথচ তা যে হওয়া অনুচিত ছিল।
চলবে….