নিরুদ্দেশ
পর্ব ১৭
হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী সবুজ আর তোতার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। সমস্ত আচার অনুষ্ঠান পালন করেছে তারা। বিয়ের পর স্ত্রীর মুখ একবারও দেখেনি সবুজ। নিয়ম অনুযায়ী কালরাত্রি যাপন করেছে। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব গমগম করছে। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। কিছুটা সময় একা থাকতে চায়। কিন্তু একা হতে পারছে না। বেশি রাত হয়নি। শীতে বাইরে বসে থাকতে ভালো লাগলো না। বাইরে প্রচুর ইয়ার্কি-ফাজলামি চলছে। ক্লান্ত শরীরে আগ্রহ দেখাতে পারলো না। বিয়ে হয়েছে মাত্র তিনটে দিন। এই দিনগুলোতে একটুও ঘুম হয়নি। তার আগের দিনগুলোতেও ঠিকমতো ঘুম হয়নি। ঈশ্বরের কাছে অনেক মানত ছিল। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকে বাড়িতে অনুষ্ঠান হচ্ছে। পূজা অর্চনা হয়েছে। এত কোলাহল কখনই পছন্দ নয় সবুজের। শরীর বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অপেক্ষা না করে নিজের ঘরে চলে এলো। দরজা বন্ধ করলো। হিসেব অনুযায়ী তাদের আজ বৌভাত। ফুল দিয়ে বেশ সাজানো গোছানো ঘর তাকে আকর্ষণ করতে পারল না। ঘরে প্রবেশ করেই পেতলের কলসি থেকে পেতলের ঘটিতে জল গড়িয়ে পান করল। আহ্ শান্তি। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ঘরের মধ্যে যেন প্রাণ ফিরে পেলো। জামা বদলে ঘুমোতে যাচ্ছিল তখনই তোতার কথা মনে পরলো। ঘরে এখন সে আর একা নয়। তার সঙ্গে আরও একজন আছে। কিছুটা হলেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তোতার দিকে ফিরে দেখল সে তার দিকে উদাসীন ভাবে তাকিয়ে রয়েছে। পরনে সাদাসিদে আটপৌরে গোলাপি পাড় শাড়ি, ব্লাউজ, ঢিলে খোপা, গলায় সোনার চেন, কি শান্ত, সুন্দর গতিভঙ্গী, সোনার জগদ্ধাত্রী প্রতিমা বটে। মহিমময় স্নিগ্ধ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলো সবুজ। পাশে গিয়ে বসল। তাকে না ছুঁয়ে বললো,’আপনি খেয়েছেন?’ তোতা মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।
‘আমি ভীষণ ক্লান্ত। ঘুমোতে চাই। আপনি যদি ঘুমোতে চান তাহলে ঘুমিয়ে পড়ুন না হলে যদি মুভি দেখতে চান মুভি দেখুন। আপনার যা মন চায় তাই করুন।’
‘সেকি! আজ তো আমাদের প্রথম রাত্রি। বসে গল্প করবেন না? আমায় গল্প শোনাবেন না? আমার কথা শুনবেন না?’ একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন শুনে সবুজ মুচকি হাসলো। হেসে বলল,’আমি সবকিছু বুঝতে পারছি। আমার কথা বলা কিংবা কথা শোনার জন্য একটুও ধৈর্য নেই। আমি বড় ক্লান্ত। এক সপ্তাহ ধরে ঠিকমতো ঘুম হয়নি। এখন না ঘুমালে অসুস্থ হয়ে পড়বো।’
‘এক সপ্তাহ ঘুমাননি কেন? কি করছিলেন?’
‘সে অনেক কথা। ছোটবেলায় আমার খুব অসুখ হয়েছিল। ডাক্তার দেখিয়েও কিছু হচ্ছিল না। বাঙালি মায়েদের তো চেনেন। ঈশ্বরের কাছে অনেক মানত রেখেছিলেন। বিয়ের আগে সব শোধ করা হয়েছে।’
‘অহহ, বুঝেছি। ঘুমিয়ে পড়ুন। আমিও ঘুমিয়ে পড়ছি।’ সবুজ হাসিমুখে শুয়ে পড়ল। একটু পর পাশে তোতাও শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতায় কেটে গেল। তোতার চোখে ঘুম এলো না। স্বামীর দিকে তাকিয়ে তার মোবাইল চাইল। সবুজ নিজের মোবাইল তোতার হাতে দিয়ে বলল,’দেখতে চাইছেন আমি কতগুলো মেয়ের সাথে কথা বলি। এমনি জিজ্ঞেস করতেন আমি সত্যিটাই বলতাম।’
‘ও মা, এমন বলছেন কেন? আমি একদমই সন্দেহ করছি না।’
‘তাহলে?’ তোতা জবাব দিল না। তার মুখে লাবণ্য হাসি ফুটে উঠল। সবুজ একটু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, সে তার ফেসবুক আইডি খুলে নিজের আইডি খুঁজছে। তার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। তোতা যে নিজের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্টিভ করবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রইল না। কিন্তু সে তো অনেক আগে এক্টিভ করে নিয়েছে। বিয়ের দিন কোনো কারণবশত তোতাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। তখনই তার প্রোফাইল সার্চ করে। স্বামীর ফ্রেন্ডেলিস্টে নিজেকে দেখে ভিরমি খেয়ে গেল। এটা কি করে সম্ভব? কয়েকটা দিন আগে তো দেখেছিল তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্টিভ করেনি। মুখ ঘুরে বললো,’আপনি কখন এক্টিভ করলেন?’
‘বিয়ের দিন। আপনি দেখেননি?’
‘আমি ভুলবশত ফোনটা বাড়িতে রেখে দিয়ে এসেছি। কিন্তু কেন করলেন?’
‘অযৌক্তিক প্রশ্ন করছেন না! আপনি আমার স্ত্রী মনে আছে না ভুলে গেছেন?’ তোতা খুব হাসলো। ফটাফট আরও কয়েকটা নাম সার্চ করে তাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও এক্টিভ করে নিল। বুঝতে পারল সে তার বান্ধবীদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্টিভ করেছে। বড্ড খামখেয়ালী আর ছেলেমানুষি তো! যদিও সবুজ রাগ করলো না। এমন ব্যবহারে খুশি হলো। আদুরে কন্ঠে বলল,’আপনার বয়স কত বলুন তো?’ চোখ বেঁকিয়ে তার দিকে তাকালো। ভরাট কন্ঠে বলল,’আগে আপনি বলুন আপনার বয়স কত? তারপর আমি বলবো।’
‘আমার বয়স কত আর হবে? সাতাশ-আঠাশের মধ্যে।’
‘তাহলে আমি আপনার থেকে চার বছরের ছোট। আমার বয়স চব্বিশ।’
‘বয়স যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু আচরণ তো একদম বালিকার মতো।’ঠোঁট টিপে হাসলো তোতা। মাথার উপর হাত রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করল সবুজ। কিছুতেই ঘুম এলো না। চাইলেও এই জিনিসটা আসে না। বাইরে যতক্ষণ বসে ছিল ততক্ষণ ঘুমে ঝিমোচ্ছিল। কিন্তু শুয়ে পড়তে ঘুম আসছে না। মাথায় কিছু চরিত্র নাড়া দিয়ে উঠছে। মাথার মধ্যে সেগুলো আনতে চাইল না কিন্তু ঘুরে ফিরে বারবার সেগুলোই এল। এদিকে তোতার এখনও সবকিছু স্বপ্ন লাগছে। স্কুল কলেজ লাইফ শেষ করেছে কিন্তু তার জীবনে কখনও প্রেম আসেনি। কৈশোর বয়সে প্রচুর ছুটে বেড়িয়েছে। এ-দিক ও-দিক ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু প্রেমে পড়েনি। এই বিষয়ে সে বড্ড উদাসীন ছিল। শুধু প্রেমের প্রস্তাব নয় বিয়ের প্রস্তাবও পেয়েছিল, তার কাছে সেগুলো খুব বেশি আহামরি লাগেনি। প্রেম ভালো না খারাপ সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে গুরুত্ব অন্যদিকে দিয়েছিল। ছোট ছোট মুহূর্ত আনন্দ খুশি আর নিজেকে গড়ার মাধ্যমে কিশোরী বয়স কাটিয়েছে। আর যৌবনের শুরুটা হয়েছিল দায়িত্ব নিয়ে। বাবা-মার সঙ্গে মাঠে গেছে। সমানভাবে তাদেরকে কাজে সাহায্য করেছে। সে-ই সময় প্রেমের মতো সূক্ষ্ম অনুভূতিতে পা বাড়ানোর সাহস হয়নি। ভাই আর বাবা ছাড়া তেমন কোনো পুরুষ মানুষের সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। কলেজ লাইফে বেশ কয়েকটা পুরুষ বন্ধু ছিল তবে তাদের সাথে খুব বেশি মেলামেশা করেনি। অথচ আজ সম্পূর্ণ অন্য এক পুরুষের পাশে শুয়ে রয়েছে। কেমন একটা লাগছে তার। গভীর অনুভূতিতে ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। কিছুটা অজানা ভয়ও করছে। আবার দূরে সরেও আসতে পারছে না। একবার মানুষটাকে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করলো। তাকে স্পর্শ করলে কি রেগে যাবে? বকুনি দেবে? এমনটা কেন করবে? সে তো তার স্ত্রী? স্পর্শ করার অধিকার রয়েছে। স্বামীকে ঘুমোতে না দেখে আগ্রহটা আরও জেঁকে বসলো। মিষ্টি কন্ঠে বলল,’এই যে শুনছেন?’ সবুজ সাড়া দিতে তোতা বললো,’আপনাকে একটু স্পর্শ করি?’ তার চোখে-মুখে বসন্তের জ্যোৎস্নার আলো খেলে গেল। শৈল্পিক ঠোঁটের কোণে নবকিশলয় হাসির রেখা প্রস্ফুটিত হলো। সবুজ নারী সম্পর্কে উদাসীন হলেও একটা সময় কাজল আর সাথীর সাথে অনেক সময় কাটিয়েছে। নারীদের অনুভূতিগুলো কাছে থেকে টের করেছে।তাদের চাওয়া-পাওয়া ইচ্ছা গুলো কিছুটা হলেও ধারণা করতে পারে। কিন্তু সব নারী তো আবার সমান নয়। পূর্বের নারী আর তার পাশে থাকা বর্তমানে নারীর মধ্যে পার্থক্য অনেক। পূর্বে নারীরা ছিল পরিচিত আর আপনজন কিন্তু বর্তমানে নারীটি তার অর্ধাঙ্গিনী। অনুভূতি ভীষণ প্রকট। পাশ ঘুরে তোতার দিকে তাকালো। সহাস্যে বলল,’আমি আপনার পাশেই শুয়ে আছি। আপনার পা আমার পায়ে অনেকবার লেগেছে। তখন বুঝি স্পর্শ করেননি?’ তোতা চমকে উঠলো। তার পা কখন স্বামীর পায়ে লেগেছে টের করতে পারেনি। উনি বয়সে বড়। প্রণাম করা উচিত ছিল। সে ধড়মড় করে উঠতে যেতেই সবুজ বাধা দিল। প্রয়োজন নেই। অজান্তেই হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও অনেক বার হবে। তোতার লজ্জা করলো। প্রথম দিনে কি সব করে বেড়াচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে সে যেন সঠিক ভাবে মানুষটাকে সম্মান দিচ্ছে না। শ্রদ্ধা ভক্তিতে খামতি পড়েছে। না, এত খামখেয়ালি হলে চলবে না। একটু বেশি সচেতন হতে হবে। অকারণেই তাকে আর স্পর্শ করতে ইচ্ছে করলো না। নিজেকে একটু সরিয়ে নিয়ে বলল,’আপনার বাড়িতে কি কোনো বোতল কিংবা গ্লাস নেই?’
‘কেন বলুন তো?’
‘আপনাকে কিছুক্ষণ আগে দেখলাম পেতলের ঘটিতে জল গড়িয়ে খেতে। তাছাড়া প্রথম বারের মত দেখলাম কারোর বেড রুমের মধ্যে জলের কলসি রয়েছে। প্রায় সবার বাড়িতে জলের কলসি গুলো বাইরে থাকে। রুমের মধ্যে তো বোতলে কিংবা মগ থাকে।’
‘আমি অনেকটা আলাদা। আমার ঘটিতে জল গড়িয়ে খেতে ভালো লাগে। আমার বাড়িতে বোতল কিংবা মগ খুঁজে পাবেন না। তবে চিন্তা করার দরকার নেই। আপনার জন্য এনে দেব।’
‘কিন্তু আপনি তো আমাদের বাড়িতে গ্লাসে জল খেয়েছিলেন।’
‘আমরা কেবলমাত্র নিজের বাড়িতে নিজের মতো থাকতে পারি। বাইরে কখনও সম্ভব না। বাইরে নিজের ভালোলাগাকে বিসর্জন দিতে হয়। এডজাস্টমেন্ট করতে হয়। বাইরে গিয়ে কি বলবো, আমি গ্লাসে জল পান করি না ঘটিতে জল পান করতে ভালোবাসি। আমাকে ঘটিতে জল এনে দাও। কখনো সম্ভব নয়।’
‘হায় ভগবান! আপনি তো দেখছি আলাদা নয় সম্পূর্ণ আলাদা। বড় অদ্ভুত মানুষ।’ সবুজের মুখের চাপা আনন্দের হাসি। একটু পর তোতা আবার বলল,’এখন আমি আপনার ঘরে এসেছি। সারা জীবন এখানে থাকবো। বলতে গেলে এখন থেকে এই বাড়িটা আমারও। তাই আমিও আমার মতো থাকতে পারি। তাহলে আমার যদি কিছু জিনিস আপনার ভালো না লাগে তাহলে আপনি কি মেনে নেবেন?’
‘অবশ্যই মেনে নেব। মেনে নেব না কেন? এডজাস্টমেন্ট কখনো একতরফা হয় না। একটা সম্পর্ক সম্পূর্ণ নির্ভর করে বোঝাপড়ার উপর। সঠিক বোঝাপড়ার অভাবে সম্পর্ক গুলো নষ্ট হয়। একতরফাভাবে কোনো কিছু সম্ভব নয়।’
তোতার অনেক কিছুই জানতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বেশি প্রশ্ন করলো না। ঘরের মধ্যে সবুজ প্রথমে এসে বলেছিল ঘুমোবে। সে বড়ো ক্লান্ত। তাকে অযথা প্রশ্ন করে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। তোতা আর কিছু বলল না। আলো নিভিয়ে দিতে সবুজ একটা জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো। ঘরের মধ্যে দ্বাদশীর চাঁদের আলো এসে পড়েছে। বাইরে মানুষের গুঞ্জন কানে ভেসে আসছে। এতকিছু উপেক্ষা করেও সবুজ ঘুমিয়ে পড়ল। তোতা এবার স্বামীর অনেকটা কাছে গেল। তার ঘুম কিছুতেই আসছে না। আবছা আলোয় স্বামীর মুখ ভালো করে দেখলো। কি পবিত্র নিষ্পাপ উজ্জ্বল মুখখানা। চোখ দুটো সরাতেই ইচ্ছে করছে না। এত বড় ঘরের ছেলে অথচ তার মধ্যে কোনোরকম অহংকার নেই। গলায় একটা লকেট রয়েছে। তাও আবার সোনার চেন নয় -লাল রশ্মি দিয়ে ঝোলানো। হাতে একটাও আংটি নেই। আশীর্বাদে যে আংটি দিয়েছিল সেটাও খুলে রেখে দিয়েছে। তার নাকি এগুলো পরতে ভালো লাগে না। বড্ড নিখুঁত সাধারণ মানুষ। তোতা এবার নিজের হাতটা সবুজের পেটের ওপর রাখল। উত্তেজনায় শরীর কেমন হলো। চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। চোখের জলের কারণ জানে না সে। তবে খুব ভালো লাগলো। আরাম বোধ করলো। সহজে তার চোখে ঘুম এলো না। বাইরে গুঞ্জন একটু একটু করে কমে এলো। আলো বন্ধ হয়ে গেল। নিস্তব্ধ হয়ে গেল পুরো বাড়ি। তবুও তোতা ঘুমোতে পারল না। নিঃশব্দে স্বামীর বুকের স্পন্দন অনুভব করল। বুকের সুগন্ধি তাকে মুগ্ধ করল।
ভোরে ঘুম থেকে ওঠা সবুজের নিত্য অভ্যাস। খুব তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দেখল অঘোরে ঘুমোচ্ছে তোতা। তাকে নাড়া দিয়ে ডাকলো,
‘এই মেয়ে, ও মেয়ে ওঠ, শিগগির ওঠ।’ তোতা কোনো সাড়াই দিল না। সবুজ আবার নাড়ালো। বলল,’এই যে শুনছেন! উঠে পড়ুন ভোর হয়ে গেছে।’
তোতা এবার চোখ খুললো। মিটিমিটি করে সবুজকে দেখলো। তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। সবকিছু যেন স্বাভাবিক। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল,’এখন তো মাত্র পাঁচটা হয়েছে। শীতকালে পাঁচটা মানে অনেক রাত আছে। একটু ঘুমাতে দাও। আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন।’
‘পাঁচটা মানে তো ভোর শীত হোক বা গ্রীষ্ম।’
‘এত সকালে উঠে আপনি কি করবেন বলুন তো? আপনি কি মেয়ে মানুষ? থালাবাসন মাজবেন? একটু ঘুমাতে দাও না। কাজ না থাকলে আমি বেলা নয়টা উঠি।’
‘আচ্ছা ঘুমান। বেশি করে ঘুমান।’ অচেনা জায়গায় তোতা সারারাত ঘুমোতে পারেনি। ভোররাতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছুতে ঘুম ভাঙ্গতে চাইছে না। অলস ভাবে আবার চোখ বন্ধ করল। সবুজ মৃদু হেসে বাইরে বেরিয়ে আসলো। পৃথিবীর বুক থেকে অন্ধকার পুরোপুরি বিদায় নেয়নি। বাড়িতে মা ছাড়া কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। এমনটা রোজই হয়। খুব ভোরে মা,বৌদিমণি, আর সে উঠে। এখন পার্বতী নেই। মাকে সব দেখাশোনা করতে হচ্ছে। সবুজের মনটা বিষন্নতায় ভরে গেল। বৌদিদিমণির কথা মনে পড়ল। কত দায়িত্ববান নারী। সবসময় খেয়াল রাখতো। চোখের আড়াল হলে খোঁজ নিত। অথচ আজ বউদিমণির অনুপস্থিতিতে বিয়ে করতে বাঁধলো না। একবারও মনে পড়েনি। কত দায়িত্বহীন সে! হৃদয় কিছুটা হলেও নিষ্ঠুর। না হলে এত সুন্দর মুহূর্তে প্রিয় একজনের অনুপস্থিতি ভাবালো না! পার্বতী থাকলে খুব মজা হতো। সে একমাত্র দেবরের বিয়েতে আনন্দ করতে চেয়েছিল। কত আশা ছিল। সবসময় বলতো তার বিয়েতে খুব সাজবে। জমিয়ে খাওয়া দাওয়া করবে। ছোট্ট একটা মেয়ে দেখে বিয়ে দেবে তার। যে তার উদাসীন ভাইটাকে গুছিয়ে নেবে। সবুজ কোনো উত্তর না দিয়ে হাসতো। সেসব কিছুই হলো না। বৌদিমণি নিশ্চয়ই তাকে মনে করছে। হয়তো অভিমানে ঝলসে রয়েছে। প্রথম প্রথম এ বাড়িতে এলে নিশ্চয়ই কথা বলবে না। রাগ দেখাবে। তাকে খুব বুঝতো সে। তার কখন কি দরকার সে ছাড়া ভালো কেউ বোঝে না। অদ্ভুত ভাবে তার মন পড়ে নিতে পারতো। চোখ দুটো জাপসা হয়ে গেল সবুজের। বাইরে বেরিয়ে বাগানের দিকে গেল। এত ঝামেলার মধ্যে গাছগুলোর কাছে আসা হয়নি। গাছের পাতা শিশিরে ভিজে রয়েছে। শিশির আঙুলের ডগায় লাগতে ঠান্ডা অনুভব করল। তবে সরে আসলো না। দাঁড়িয়ে রইল। ঠান্ডাও ভালো লাগছে তার। একটু খেয়াল করে দেখলো গাছগুলোতে জল দিচ্ছে মা। আবাক হয়নি। মা মাঝেমধ্যে গাছগুলোতে জল দেয়। কিন্তু বাড়িতে তো মেশিন রয়েছে। মা মেশিনে জল না দিয়ে বালতিতে করে পুকুর থেকে জল তুলে দিচ্ছে কেন? কৌতুহলী হয়ে মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল। মেশিন খারাপ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে সারানো সম্ভব নয়। তাই বালতিতে করে পুকুর থেকে জল তুলে দিতে হচ্ছে। মাকে আর জল দিতে দিল না। নিজেই কাজটা করল। জল দেওয়ার পর বাড়ির ভেতরে গেল না। সকাল হয়ে গেছে। পাওনাদারদের সাথে কথা বলতে একটু ব্যস্ত হয়ে পরলো। তাদের টাকাও মিটিয়ে দিল। সবদিক সামলে নিজের ঘরে ফিরে এলো। দেখল তোতা রেগে কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটার আবার কি হলো? এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? হেসে বলল,’কি ব্যাপার তোতাপাখি? রেগে আছেন মনে হচ্ছে?’
‘আপনার কি বিবেক বুদ্ধি বলে কিছু নেই?’
‘প্রচুর রয়েছে।’
‘মজা করছি না। আমি আপনার বাড়িতে নতুন না! কোথায় কি আছে জানি না। আপনি তো আমায় একটু সাহায্য করতে পারেন?’
‘খিদে পেয়েছে?’
‘খিদে তো পাবেই। কিন্তু সকালে মানুষ প্রথমে বাথরুমে যায়। আপনি সকালে উঠে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাড়িতে যে একটা মানুষ আছে তা দেখবেন না? আর কেউ এখনও পর্যন্ত আমার সাথে দেখা করতে আসেনি। আমার উপস্থিতি আপনারা অনুধাবন করতে পারছেন না?’ সবুজ হালকা হাসলো। জিভ কামড়ালো। সত্যি সে ভুল করছে। মেয়েটি এ বাড়ির কিছুই জানে না। তাকে সব কিছু জানাতে হবে। এর জন্য একটা নারীর প্রয়োজন। আর এই বাড়িতে নারীর অভাব। মা তো এ বিষয়ে বড় উদাসীন আর খামখেয়ালী। তাছাড়া ছোট ছেলের প্রতি রয়েছে কিছুটা অবজ্ঞা আর বিষন্নতা। ধারে কাছে না আসাটাই স্বাভাবিক। সুতরাং নিজের হাতে নিজের স্ত্রীকে সব কিছু দেখাতে হবে আবার শেখাতেও হবে। শুধু স্বামী নয় শাশুড়ির ভূমিকা পালন করতে হবে।
সারাটা দিন বেশ ঝামেলার মধ্যে কাটলো। অনেকদিন ধরে আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে রয়েছে। তারা কেউ-ই আর থাকতে চাইল না। বিকেলের মধ্যে দুটো বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল। বাবাও কাজের জন্য শহরে চলে গেলেন। বাড়িতে রইল মা,দুই ভাই,আর তোতা। পুরো বাড়ি ফাঁকা। মানুষের অনুপস্থিতি বেশ নাড়া দিল। কয়েকদিন ধরে সারা বাড়ি গমগম করছিল। বাচ্চারা এ-দিক ও-দিক ছুটে বেড়িয়েছে। সারা বাড়ি জুড়ে উৎসবের মেজাজ ছিল। বাইরে প্যান্ডেল ছিল। সেগুলো খোলা হয়ে গেছে। এই হাহাকার মনের গভীরে দাগ কাটলো। সবুজের অস্বস্তি যেন আরও বেড়ে গেল। পূর্বের অস্বস্তি বরং অনেক ভালো ছিল। সে বরাবর নিস্তব্ধতা পছন্দ করে তবে কিছু হইহুল্লোড় মনে দাগ কেটে দিয়ে যায়। হঠাৎ করে নির্জনতা মানতে পারল না। চোখে এখনো ঘুম যায়নি। ক্লান্ত আছে। তাছাড়া ব্যক্তিগত হাজারও কাজ পড়ে রয়েছে। ওসব কাজে এখন মন দিতে চায় না। অবসর সময় কাটাতে চায়। বইয়ের পাতায় শুধু অবসরের প্রয়োজনীয়তা লিখে লাভ নেই। নিজেকেও অবসর সময় বের করে অবসর সময় কাটাতে হবে। শুধু ব্যস্ত ভাবে জীবন কাটালে চলবে না। জীবনটাকে উপভোগ করতে হবে ভালোবেসে। এ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন সে।
রোজ সন্ধ্যার সময় সবুজ লক্ষ করে এসেছে নতুন বাড়িতে সন্ধ্যা দেওয়ার সময় বৌদিমণি পুরনো বাড়িতে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। ধূপ-ধুনো ঘুরিয়ে নিয়ে যায়। বৌদিমণি বাড়িতে না থাকলে এই কাজটা মা করেন। আজ মা একই কাজ করলেন কিন্তু পুরনো বাড়িতে প্রদীপ জ্বালালেন না। বাড়িতে একবারও এলেন না। একটু অবাক হল সবুজ। তবে কিছু বলল না। নিজের ঘরেও প্রদীপ রয়েছে। জ্বালিয়ে ফেলল। ঘরের মধ্যে এসে দেখল তোতা চুপটি করে বসে রয়েছে। একাকীত্বে ভুগছে। তার বাবাও আজ বিকেলে ফিরে গেছে। বড় একা হয়ে পড়েছে। এমনিতে পরিবারের সবাইকে ছেড়ে এসেছে তারপর এই বাড়িতে ভালো সঙ্গী হিসেবে এখনও পর্যন্ত কাউকে পায়নি। সবুজ নিজে ঠিকমতো সময় দিতে পারছে না। মেয়েটা বড় কষ্ট পাচ্ছে। তার সঙ্গে একটু গল্প করলে হয়। কিন্তু শরীরটা মানছে না। শরীর যে বড় ক্লান্ত। একটু ঘুমালেই শান্তি। সবুজ ধীর পায়ে এগিয়ে তোতার পাশে বসলো। তোতা চোখের জল মুছে ফেলল। এতক্ষণ সে যে কাঁদছিল নিজেও টের করতে পারেনি। তাকে কাঁদতে দেখে কষ্ট পেল সবুজ। সে কি কোনো ভুল করছে? একটা মেয়ের চোখের জলের কারণ হওয়া ভালো নয়। তার মনের কথা জানতে হবে। ভরসা দিতে হবে। নির্লিপ্তি চোখে তাকিয়ে বলল,’তোতাপাখি! আপনি কাঁদছেন?’
‘আমি তোতাপাখি নই শুধু তোতা।’
‘বলুন না,কাঁদছিলেন? কাঁদছিলেন কেন?’
‘বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। ওদের ছেড়ে কখনো থাকিনি তো।’
‘একটু একটু করে ঠিক হয়ে যাবে। আমি রয়েছি তো। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন ভালো লাগবে।’ তোতা তীব্র চোখে সবুজের দিকে তাকালো। এমন চাহনিতে একটু সংকীর্ণ হয়ে পড়ল সবুজ। বলল,’এমনভাবে তাকাচ্ছেন কেন?’
‘আপনার জীবনে কি ঘুম ছাড়া কিছু নেই? আপনি কি রাজামশাই? আপনি এখন শীতঘুমে যাবেন আর আপনার রাজ্যের মন্ত্রী রাজ্য দেখে নেবেন।’
‘রাজামশাই হতে যাবো কেন? আমি তো সবুজ।’
‘দেখে তো মনে হচ্ছে না আপনি সবুজ। আগেকার দিনে রাজারা যেভাবে খামখেয়ালি ভাবে রাজ্য পরিচালনা করে শুধু ঘুমাতেন। আয়েস করতেন। আপনি তেমনটা করছেন। গতকাল সন্ধ্যা থেকে ঘুমিয়ে গেলেন আজও….।’
‘ঠিক আছে, আপনাকে ঘুমোতে হবে না। আমি ঘুমিয়ে যাচ্ছি। আপনি বসে থাকুন।’ সত্যি সত্যি সে বাচ্চাদের মত হামাগুড়ি দিয়ে পালঙ্কের উপর উঠে এলো। তার ঘুমানোর জায়গায় তোতা বসে ছিল তাই সে তোতার জায়গায় চলে এলো। লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। তোতা অবাক হলো। সত্যি সত্যি শুয়ে পড়ল? হাসি কিছুতেই লুকাতে পারল না। খিলখিল করে হেসে উঠলো। বড় অদ্ভুত মানুষ! কৌতুক করে বলল,’এই যে রাজামশাই, আপনি সত্যি সত্যি শুয়ে পড়লেন?’
‘মানুষের ঘুম পেলে তো ঘুমোতে যায়। আপনি বুঝি না ঘুমিয়ে অন্য কিছু করেন?’
‘তা বলে সন্ধ্যা সাতটার সময়?’ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার বলল,’এখনো সাতটা হয়নি। আর আপনি ঘুমিয়ে যাচ্ছেন। রাতে খাবেন না? এতক্ষণ থেকে ঘুম চলে আসবে?’
‘যদি ঘুম ভাঙ্গে তাহলে খাবো। না হলে থাক। তাছাড়া আমি এমনিতেই রাতে খাবার খাই না। আর বাকি থাকলো ঘুম! আমি অনেক সময় বিকেলে ঘুমিয়ে পরেরদিন সকালে উঠি। ও নিয়ে ভাববেন না।’
‘এবার বুঝেছি আপনি এত মোটা কেন? রাতে না খেয়ে খেয়ে এমন শরীর বানিয়েছেন না? আপনার খাদ্য তালিকাটা একটু বলবেন? আমিও আপনার মতো খাবার খেয়ে আপনার মত শরীর বানাবো।’
‘আমি পাতলা বলে খোঁটা দিচ্ছেন?’
‘বা রে, খোঁটা দেবো কেন? আপনি সত্যি সত্যি মোটা রাজামশাই।’ তোতাকে মজা পেতে দেখে খুশি হলো সবুজ। তার হাসিতে যোগ দিল সে। বেশ অনেক্ষণ হাসাহাসি পর তোতা বললো,’মানছি আপনি দেখতে অনেক সুন্দর। তা বলে নিজের যত্ন নেবেন না? আপনি সত্যি সত্যি অনেক পাতলা। সেদিকে খেয়াল করেছেন? দিনের পর দিন রাতে না খেলে শরীর তো খারাপ করবে। ওই জন্য আপনি অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে পড়ছেন। চোখে ঘুম লেগে থাকে সবসময়। সময় মতো খাবার খান দেখবেন আপনি সহজে ক্লান্ত হবেন না। শক্ত পুরুষ মানুষ হয়ে উঠবেন।’ সবুজ মাথা নাড়ালো।
‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? সঠিক সঠিক বলবেন কিন্তু!’
‘বলুন।’
‘আপনি একা এ বাড়িতে কেন থাকেন? বাবা-মার সঙ্গে থাকেন না?’
‘আমরা পূর্বে সবাই এই বাড়িতে থাকতাম। নতুন বাড়ি হওয়ার পর তাঁরা সেখানে চলে গেছেন। আমার ভালো লাগেনি তাই যাইনি। আমাদের মধ্যে কোনো রকম ঝামেলা নেই।’
‘তা না হয় হল। কিন্তু আপনি আপনার বাবা মার সাথে ঠিকমতো কথা বলছেন না কেন? অজুহাত দেবেন না আমি কিন্তু লক্ষ করেছি। বৌভাতের পর আপনার বাবা-মা বা দাদা কাউকে দেখলাম না এই বাড়িতে আর আসতে।’ সবুজ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,’বৌদিমণি থাকলে নিশ্চয়ই আসতেন।’ তোতা বুঝতে পারল সবুজ কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। জোরজবস্তি করল না। নতুন এসেছে। সবকিছুতে আগ বাড়ানো ঠিক হবে না। ধীরেসুস্থে সবকিছু জানতে হবে। সেও তার প্রসঙ্গতে সঙ্গ দিয়ে বলল,’বৌদিমণি এখন কোথায়?’
‘বৌদিমণির সন্তান হবে। তাই বাপের বাড়ি চলে গেছে।’
‘কি অদ্ভুত পরিবার আপনাদের। জানেন, একজন স্ত্রী তার কষ্টের সময় কাকে সবচেয়ে কাছে চায়?’
‘কাকে?’
‘কাকে আবার? নিজের স্বামীকে চাইবে। যখন একটা মেয়ে গর্ভবতী হয় তখন তার খুব কষ্ট হয়। সে-ই সময় তো সে চাইবে তার স্বামী তার কাছে সব সময় থাকুক। তার হাত শক্ত করে ধরুর। শুধু হাতটা শক্ত করে ধরলে তার অর্ধেক যন্ত্রনা স্লান হয়ে যায়। আর আপনার দাদা বৌদিকে বাপের বাড়িতে দিয়ে এলো। এই সময় তো বৌদির দাদাকে খুব প্রয়োজন। টাকা পয়সা বুঝি সব কিছু?’
‘ওটা ওদের লাইফ স্টাইল। ওরা কি পছন্দ করবে তা তো আমরা বলতে পারি না। তাছাড়া কারোর পছন্দের উপর ছড়ি ঘোরানোর অধিকার আমাদের কারোর নেই।’
‘আমার সন্তান হওয়ার সময় আপনিও বুঝি আমাকে বাপের বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসবেন?’
‘না,না, আপনাকে ছেড়ে আসবো না। আমি আপনার কাছেই থাকবো। আপনার হাত শক্ত করে ধরবো দিলে আপনি তো যন্ত্রণা ভুলে যাবেন।’
‘আপনি সত্যি একটা মানুষ।’ দুজনে হেসে ফেললো। তোতা আর কিছু বলল না। আলো নিভিয়ে দিল। মুঠো মুঠো অন্ধকার নেমে আসলো। অঘোষিত নীরবতা ঘিরে ধরলো। ঘুম ভক্ত স্বামী পেয়েছে। তাই এখন ঘুমোতে হবে। ঘুম না আসলেও বাচ্চা ছেলের মতো শুয়ে থাকতে হবে।
ভোররাতের দিকে ঘুম ভেঙে গেল সবুজের। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল তিনটা বাজে। এতক্ষণ থেকে উঠে কি করবে? তোতাকে ডেকে তুলবে? মন সায় দিলো না। মেয়েটি নিশ্চয়ই রাত করে ঘুমিয়েছে। এখন ডাকা ঠিক হবে না। মনের মধ্যে অনেক ভাবনা এসেছে। কয়েকটি চরিত্র ঘুরপাক খাচ্ছে। সেগুলো লিপিবদ্ধ করতে হবে। না হলে আবার ভুলে যাবে। আলো জ্বালালে চলবে না। অন্ধকারে তো ঘুম ভালো হয়। তোতার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে চাইল না। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বাসিমুখে লিখতে বসলো। গড়গড় করে কলম চলল। কতক্ষণ চললো জানে না। তবে অনেকক্ষণ। হঠাৎ করে কলম থমকে গেল। আর লিখতে পারছে না। হাত ব্যথা নয় মস্তিষ্কে শব্দের অভাব পড়েছে। যে শব্দ গুলো আছে সেগুলো দিয়ে গতানুগতিক লেখা হবে। কিন্তু সবুজ গতানুগতিক লিখতে চায় না। নতুন কিছু সৃষ্টি করতে চায়। দাঁড়িয়ে অস্থির পদচারণ করতে লাগলো। মাথায় নতুন শব্দ এলো না। চেয়ারে গিয়ে বসলো। এদিকে তোতার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। বিছানায় বসে চমকে উঠলো। সবুজের ব্যবহার স্বাভাবিক লাগছে না। আচমকা পরিবর্তন হয়ে গেছে। সে খুব সংবেদনশীল। কারোর উপস্থিতি দ্রুত টের করতে পারে। অথচ তোতার ঘুম ভেঙে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই। সে সাড়া দিয়েছে তবুও তার হুঁশ ফেরাতে পারেনি। এখন অন্য জগতে নিমজ্জিত হয়েছে। লেখকেরা হয়তো এমনই। তারা কোনো কাজে এতটা জড়িয়ে পড়ে যে বাইরে কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারে না। তারা যেমন সংবেদনশীল তেমনই স্থির মস্তিষ্কের অধিকারী। একটা জায়গায় নিজের মস্তিষ্ককে স্থির করে রেখেছে। সহজে সাড়া পাওয়া যাবে না। লেখকেরা সাধারণ মানুষের মতো সাধারণ। কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু একটা তো রয়েছে যার জন্য তারা পৃথিবীটাকে আলাদা রকম দেখতে পায়। সে-ই আলাদাটা হয়তো পাগলামি। মানুষ পাগলামি করেছিল বলে চাঁদে পৌঁছাতে পেরেছিল। মানুষ পাগলামি করেছিল বলে আলো আবিষ্কার করেছিল। এমনি লেখকেরা পাগলামি করে বলে তারা সৃষ্টি করতে পারে। টিমটিমে আলোয় সবুজের মৈনাক মুখমণ্ডল চকচক করে উঠছে। চোখ ফেরাতে পারছে না তোতা। সে বিছানা ছেড়ে সবুজের পাশে চেয়ারটায় বসলো। কালকে দেখেছে ঘরটিতে একটি মাত্র চেয়ার ছিল। আজ সেখানে আরও একটা চেয়ারে এসেছে। তার জন্য যে নিয়ে এসেছে তা আর বলার অপেক্ষায় থাকে না। সবুজকে নাড়িয়ে হাসিমুখে বলল,’এই যে রাজামশাই, আপনার ঘুম কখন ভেঙেছে? ঘুম থেকে উঠে আমায় ডাকলেন না কেন?’ সবুজ ঘুরে তোতাকে দেখল। সচরাচর লেখার সময় তাকে কেউ ডাকলে সে অস্থির হয়ে পড়ে। তার উপর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কিন্তু আজ অদ্ভুত কারণে তার চোখে-মুখে কোনোরকম ক্ষোভের ছাপ দেখা গেল না। ঘুম ঘুম চোখে এলোমেলো অবস্থায় তোতাকে ভারি লাগছে। সবুজকে কিছু বলতে না দেখে তোতা আবার বলল,’আপনি আলো জ্বালাননি কেন? আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে,তাই!’ আলো জ্বালিয়ে দিতেই সবুজ হ্যারিকেনের বাতিটা কমিয়ে দিল। অদ্ভুত রকমের মেয়ে! নিজে প্রশ্ন করছে আবার নিজেই উত্তর দিচ্ছে। অন্যকে বলার সুযোগই দিচ্ছে না। কেউ এত কথা কী করে বলতে পারে? মনে হচ্ছে তারা দশ-বারো বছরের পরিচিত। কে এই ললনা? মেয়েটির প্রতি অনুভূতি এত মধুর কেন? তোতা স্বামীর চোখ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারল না। বাসিমুখে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে। তার ঘাড়টা কত সুন্দর। লাল রশ্মিতে বাঁধা লকেটটি তাকে বারবার আন্দোলিত করছে। কিছুতেই স্থির হতে দিচ্ছে না। থর থর করে কাঁপছে তার ঠোঁট। শরীরের স্পন্দন বড়ো উত্তেজিত। সবুজের জালুস মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনাকে আমি বড় ভালোবেসে ফেলেছি। এই কটা দিনে আপনার ব্যবহার আমাকে বারবার মুগ্ধ করেছে। আপনি মানুষটাই আলাদা। এত সুন্দর কেন আপনি?’ সবুজ উত্তর দিল না। ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসি লেগে আছে।
‘কিছু বলবেন না? আপনি আমায় ভালবাসেন না?’
সবুজ চেয়ার টেনে তোতার অনেকটা কাছে চলে আসলো। ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,’আমরা বারবার বলি ভালোবাসা ভালোবাসা। ভালোবাসার শেষ শব্দটি কি বলুন তো? বাসা,তাই তো? বাসা শব্দের অর্থ হলো ঘর। ঘর কি একদিনে তৈরি হয়ে যায়? হয় না। সময় লাগে। ঘর তৈরির জন্য ইট পাথর বালির প্রয়োজন। ঘর আর ভালোবাসার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ঘরের মতো ভালোবাসারও দুটো দিক রয়েছে। একটা বারান্দা আর একটা খিড়কী। ঘরের বারান্দা বেশ পরিস্কার সামনে অনেক আকর্ষণীয় গাছ রয়েছে সহজে মুগ্ধ হয়ে গেছেন। কিন্তু খিড়কী পাশে অনেক নোংরা আবর্জনা জমা হয়ে থাকে। থুতু ফেলে প্রস্রাব করে। সেগুলোকে যখন পছন্দ করতে পারবেন, সেগুলো পরিষ্কার করতে যখন নাক বাঁকাবেন না তখন সম্পূর্ণভাবে ভালবাসতে পারবেন। ছোট ছোট অনুভূতি আবেগ আবদার দেহের কোনো বিশেষ অংশ সবগুলো দিয়ে ভালবাসা পূর্ণ রূপ ধারণ করে। শুধু ইট দিয়ে যেমন ঘর হয় না তেমনই শুধু রঙ্গিন মুহূর্ত দিয়ে ভালোবাসা হয় না। এখন আপনি ভালোবাসার রঙ্গিন মুহূর্তে আছেন। শুধু সুখ আর সুখ। এটা ভালোবাসার একটি অংশ। ভালোবাসার আর একটা অংশ কষ্ট। প্রচুর কষ্ট পেতে হবে। প্রচুর কষ্ট। এই দুটো যখন সহ্য করতে পারবেন তখনই একটা মানুষকে সম্পূর্ণ ভালবাসতে পারবেন। কয়েকটা দিনে ভালোবাসা হয় না। সময় লাগবে।’
‘ভালোবাসার মানে যদি সত্যিই এমন হয় তাহলে আপনি তো আমায় কোনোদিন ভালবাসবেন না।’
‘কেন?’
‘আপনার তো কোনো কিছুর অভাব নেই। আমি যদি এখনই হারিয়ে যাই তাহলে আপনি আমার মতো অনেককে পেয়ে যাবেন। আপনার কি মানুষের অভাব রয়েছে? আপনি কেন মিছেমিছি আমার জন্য কাঁদতে যাবেন? যখন যা চাইবেন তা পেয়ে যাবেন। আপনি কোনোদিন আমার জন্য কষ্ট পাবেন না।’
‘আপনার কাছে শুধু আপনি রয়েছেন। আর কিছুই নেই। যা রয়েছে তা ক্ষণিকের জন্য। তাই তো কোনো এক রাজ্যের রাজাকে একদিন সূচ পর্যন্ত ধার করতে হয়েছিল। আপনার ভাবনা একদমই সঠিক নয়। এমনটা কখনো ভাববেন না। উল্টোটাও হতে পারে।’
তোতার ঠোঁট জুড়ে হাসি ভেঙে পড়ল। এমন সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। ভোরের আলো তখনও ফোটেনি তাই তোতার হাসি মাখা যৌবন মুখশ্রী দেখা গেল না। ঘন অন্ধকার। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। সবুজ হ্যারিকেনের বাতি বাড়িয়ে দিল। ঘরের মধ্যে হালকা আলো ছড়িয়ে পড়ল। ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে বাসিমুখে গল্প করতে বেশ লাগছে তোতার। ক্লান্তহীন মুখে তোতা বলল,’আমরা না হয় সাধারণ মানুষ। আমাদের বাড়িতে বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থা না থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু আপনাদের বাড়িতেও বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থা নেই!’
‘জীবনে সবকিছুর বিকল্প খুঁজতে নেই, তোতাপাখি। আমি হারিয়ে যাওয়ার পর আপনি যদি আমার বিকল্প খুঁজে নেন তাহলে আমার মূল্য কোনোদিন বুঝবেন না। অন্ধকার আছে বলে আমরা আলোকে ভালোবাসি। আলোর বিকল্প না খুঁজে কিছুক্ষণ অন্ধকারে থাকুন। দেখবেন অন্ধকারও আলোর মতো সুন্দর এবং স্বচ্ছ। অন্ধকারের একটা মৃন্ময়ী রূপ আছে। অন্ধকারকে আমি ভীষণ ভয় পাই। কিন্তু অন্ধকারে মায়ের মৃন্ময়ী রূপ আমাকে সাহস যোগায়। জীবনের সবকিছু বিকল্প খুঁজবেন না। নাহলে জীবনে অনেক কিছু মিস যাবেন।’ তোতা কোনো কথা বলতে পারল না। কেমন ঘোর ঘোর লাগছে। মানুষটার কথা গুলো এত সুন্দর যে ভালো না বেসে পারা যায় না। বারবার প্রেমে পড়তে হবে। এত কথা বলে তবুও কথা বলতে পারছে না। আটকে পড়েছে কারোর মহিমায়। স্বপ্নশীল নবকিশলয় উদ্দাম নদীর চাঞ্চল্য স্থির হয়ে গেছে। শান্ত গতিতে বইছে। সবুজ ফ্যালফ্যাল করে চঞ্চলা নারীর দিকে বেহায়া মতো তাকিয়ে রইল। চোখ কিছুতে ফেরালো না। লজ্জা পেল তোতা। মধুর কন্ঠে বলল,’আমার সুড়সুড়ি লাগছে, রাজামশাই!’
‘কিন্তু আমি তো আপনাকে স্পর্শ করিনি।’
‘এই যে আপনি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। আপনি এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার সুড়সুড়ি লাগে।’
‘বড় অদ্ভুত মেয়ে আপনি!’
পর্ব ১৮ আসছে।।