নিরুদ্দেশ
পর্ব ০৯
দক্ষিণ দিকের জানালার কাছে দাঁড়ালে পুরো শহরটা দেখা যায়। কত ব্যস্ত শহর! শহরের পৃথিবীটা যেন আলাদা। গ্রামের মতো শান্ত স্নিগ্ধ নয়। গ্রামের জন্য মন বারবার ছটফট করে ওঠে। অনেকগুলো দিন হলো প্রাণের সবুজ গ্রামে ফেরা হয়নি। কত আক্ষেপ জুড়ে রয়েছে তার মনের শহরে। পরিবারের আর্থিক অবস্থার একটু উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু মনের আর্থিক অবস্থা দিনের পর দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। মনে একের পর এক দুশ্চিন্তায় বাসা বাঁধছে। স্থির হতে পারছে না। জানালার কাছে প্রশস্ত বুক, নির্মেদ কোমর, দীর্ঘ বাহু, গৌর বর্ণের এক যুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে। যৌবনের শুরুতে শরীরজুড়ে পরিবর্তন এসেছে। মুখে চওড়া হাসি অনুপস্থিত। সন্ধ্যা থেকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শহর দেখছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়েছে। ঠাকুরের কাছে জ্বালানো ধূপের কাঠি ঘরকে সুগন্ধীতে পরিপূর্ণ করে অনেক আগে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। শহরে আসার পর থেকে সংকেত সাধারণত এই সময় বাড়িতে থাকে না। কলেজে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বেরোয়। বাবা কাজ থেকে ফেরার কিছুক্ষণ আগেই ফিরে আসে। আজ আড্ডাতে যায়নি। তার মন ভালো নেই। জমজমাট শহরে অসংখ্য বন্ধু জুটিয়েছে। কিন্তু সবুজ আর সূর্যময়ের মত কেউ গাঢ় দাগ কাটতে পারেনি। স্বাধীন খোলামেলা জীবন পেয়েছে কিন্তু ছোটবেলার মতো বুক ভরে স্বাভাবিক প্রশ্বাস নিতে পারছে না। অকারণে চোখের পাতা দুটো ভিজে গেছে। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। বার দু-একবার বাজার পর হুঁশ ফিরল। বাবা ফিরেছেন। তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দিল। বাবাকে দেখে খারাপ লাগলো। বয়স হয়েছে সামান্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হাঁপিয়ে পড়েছেন। আগে নিজের তলায় থাকতো। নিচের তলায় ঠিকমতো সূর্যালোক না পৌঁছায় স্যাঁতস্যাঁতে ভাব ছিল। খুব অসুবিধা হতো। কিন্তু এখানে এসে একটা সমস্যা গেলেও আবার একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। বাবা রোজ উঠা-নামা করতে পারেন না। বাবার এই ক্লান্ত হিমেল শরীর দেখলে বড্ড মায়া হয় সংকেতের। মনে হয় বাবাকে কোনো কাজ করতে দেবে না। নিজে রোজগার করে খাওয়াবে। কিন্তু হয় না। এখনও কলেজের গণ্ডী পার হয়নি। কে চাকরি দেবে তাকে? কোথায় কাজ পাবে? দিনশেষেও শান্তি পান না তিনি। সন্তান-সন্ততি বাবা-মা বন্ধু-বান্ধবী পরিবার ছাড়াও জীবনে একটা সঙ্গীর প্রয়োজন হয়। তিনি নিজের সঙ্গিনীকে বহু বছর আগে হারিয়েছেন। পার করেছেন অনেকগুলো বছর। কত কথা জমে রয়েছে। নিশ্চয়ই কথা বলতে ইচ্ছে করে। তিনি রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, সবার মতো তাঁরও রাগ অভিমান জন্মায়। সঙ্গিনীর কোলে মাথা রেখে সমস্ত ক্লান্তি উজাড় করতে চান। কল্পনায় কত ইচ্ছে জাগে কিন্তু বাস্তবে ফিরে আসলে সমস্ত ইচ্ছা দুমড়েমুচড়ে শেষ হয়ে যায়।ছোট্ট মনের মধ্যে কত দুঃখ কত আকাঙ্ক্ষা লুকিয়ে রয়েছে তা সংকেতের অভিজ্ঞতার বাইরে। শুধুমাত্র সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ তৈরি করার জন্য নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন। বাবার কথা ভাবতে ভাবতে বড্ড আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। চোখ দুটো পুনরায় ভিজে গেল। কিশোর বয়স পেরিয়ে যৌবনে পৌঁছালেও আজও মনটা বালক কালে সীমাবদ্ধ। সে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। তিনি মোটেও অবাক হলেন না। জানেন, ছেলের ছেলেমানুষি গুলো এখনও পুরোপুরি যায়নি। তিনি ধীরে সুস্থে চেয়ারে বসলেন। পায়ের কাছে বসলো সংকেত। হাসিমুখে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’কি হলো,কাঁদছিস কেন?’
‘তোমার খুব কষ্ট হয় না, বাবা? সারাদিন কত কাজ করতে হয় তোমায়! কি করে এত কাজ করো?’
‘কাজ করলে তো কষ্ট হয় না বরং কাজ না করলে কষ্ট হয়।’
‘বল না বাবা, তোমার খুব একা লাগে না!’
‘একা লাগবে কেন? তুমি তো আছো।’ একটু থেমে আবার বললেন,’তোমার কি হলো বলো তো? এমন করছো কেন? কিছু সমস্যা হয়েছে?’
‘তোমায় দেখলে খুব কষ্ট হয় বাবা। এই শরীরে কত কাজ করো। আর আমি আমার এই দীর্ঘ শরীর নিয়েও কিছু করি না।’
‘কাজ করার একটা সময় থাকে। যখন সময় আসবে তখন করবে। এখন কাজ করার সময় নয়। এখন শুধু পড়াশোনা আর খেলাধুলা আর আড্ডা। এই সময়গুলো কিন্তু আর কখনও ফিরে আসবে না।বুঝলে?’ তিনি থামলেন। সবুজ কোনো কথা বলল না। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ল। একটু পর বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’আচ্ছা বাবা, তুমি আমার কাছ থেকে কি আশা করো?’
‘কিছু না। আমি শুধু চাই তুমি প্রতিষ্ঠিত হও। মানুষ হও।’
‘তুমি তো জানো আজকাল চাকরি কতটা দুর্লভ জিনিস। সহজে অর্জন করা যেমন সহজ নয় তেমনই পরিশ্রম করেও অর্জন করা সম্ভব নয়। স্বার্থসিদ্ধি মানুষের কাছে হেরে যেতে হয়। আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করব তার পরেও যদি হেরে যাই, তখন কি হবে?’
‘বোকা ছেলে! প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানে কি চাকরি পাওয়া? প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানে মানুষ হওয়া। আমি তোমায় মানুষ হতে বলছি।’ সংকেতের মুখে এবার হাসি ফুটল। সন্তানের মুখে হাসি দেখে তিনি বললেন,’এবার খুশি তো?’
‘খুব খুশি।’
‘ঠিক আছে, তুমি বসো আমি গিয়ে রান্না করি।’
‘সে কি! রান্না করবে মানে! খাওয়ার আনোনি!’
‘আজ অনেক খদ্দের হয়েছে। তাই ভাবলাম থাক। বাড়িতে গিয়ে খাবার বানিয়ে নেব।’
‘তা বললে তো হবে না। ওটা তো আমাদের পাওনা। কাকামশাই তো বলেছিলেন রোজ রাতে দুজনের খাবার পাবো। এখন কথা খেলাপ করলে চলবে না। সারাদিন পরিশ্রম করে বাড়িতে ফিরে আবার রান্না করবে! তোমারও তো শরীর রয়েছে। তাকে তো বিশ্রাম দাও।’
‘তোমার কাকামশাইয়ের কোনো দোষ নেই। আমি নিজে থেকে আনিনি। খদ্দের দোকান থেকে ফিরে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। এতে মালিকের অমঙ্গল হয়। তাছাড়া মালিকের দুটো বেশি টাকা রোজগার হবে। একটা তো দিন….। ‘
‘এত ভালো মানুষ হয়ে কি হবে বলতো? যাদের জন্য আজ এত কিছু করছো দেখবে একদিন তারা তোমায় ছুঁড়ে ফেলবে।’
‘এমনটা বলতে নেই বাবু। তাঁরা তো আমাদের সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি। তাহলে কেন খারাপ ভাববো? সবাই সমান হয় না।’ সংকেতের মনটা আবার গলে গেল। বলল,’আমি কেন তোমার মত উদার হতে পারি না? আমি তো তোমার সন্তান। তবুও তোমার গুন আমার মধ্যে নেই। তোমারর মতো সবুজ হয়েছে। ওর ভাবনা গুলো তোমার মত।’ তিনি মৃদু হাসলেন। জবাব দিলেন না। অল্প সময়ের পর বললেন,’সবুজের কোনো খবর পেলি?’ সংকেত মাথা নাড়ালো। তিনি বিড়বিড় করে বললেন,’জানি না কোথায় চলে গেল। একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। কোনো পাত্তা নেই।’ সংকেত বাবার দিকে তাকালো। তিনি হঠাৎ কোনো বিষয় ভেবে কষ্ট পেয়েছেন। সেখানে আর রইলেন না। বিড়বিড় করতে করতে রান্না ঘরে চলে গেলেন। সংকেতও বাবার পেছন পেছন গেল। এর আগে সে অনেকবার রান্না করার চেষ্টা করেছে। প্রতিবারই পুড়িয়ে ফেলেছে। এই কাজটি তার দ্বারা সম্ভব নয়। অযথা সময় আর পয়সা নষ্ট ছাড়া কিছু না। বাবাকে কাজে সাহায্য করল। তিনি ফেরার পথে ডিম এনেছেন। সংকেত ডিমগুলো সেদ্ধ করতে গিয়ে ঠোঙা দেখে চোখ দুটো আটকে গেল। কয়েক সপ্তাহের পুরনো খবরের কাগজ। সেখানে পুরুলিয়া জেলায় লীলা নামে ছয়-সাত বছরের একটা মেয়ের নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি রয়েছে। ঠোঙাটা ধীরে সুস্থে পুরোটা খুলে ফেললো। সম্পূর্ণ পড়ে কিছু আয়ত্ত করতে পারল না। এটুকু বুঝলো মেয়েটি নিজে থেকে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়নি। কেউ তাকে সরিয়েছে। এইটুকু বাচ্চা মেয়ের একা যাওয়ার ক্ষমতা নেই। দেশে এ সব কি হচ্ছে?ছেলেকে হঠাৎ করে খবরের কাগজে মগ্ন হতে দেখে একটু খটকা লাগলো জ্যোতির্ময় বাবুর। তিনি মুখ ঘুরিয়ে জানতে চাইলেন,কি এত দেখছে সে?
‘তেমন কিছু নয়। একটা শিশু সবুজের মতো বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কোনো খোঁজ নেই।’
‘এমন ঘটনা প্রতিদিনই ঘটে। এতে নতুনত্বের কি আছে?’
‘তা তো জানি না। তবে নিউজটা দেখে আমার মাথার মধ্যে শুধু একটা ভাবনা এলো। তুমি তো জানো বাবা, সবুজ কখনও মিথ্যা কথা বলে না। সে যত বিপদের মধ্যেই থাকুক না কেন সত্যি কথা বলার চেষ্টা করে। সত্যটা জানার পর তাকে নিশ্চয়ই কেউ আটকে রাখবে না। বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবে। কিংবা সত্য জানার পর কোথাও ঠাঁই হবে না। পথে পথে ঘুরতে হবে। ও সত্যি নিজে থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছে তো, বাবা! না ওকে কেউ…..।’
সংকেত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। জ্যোতির্ময় বাবু ছেলের বাহু ধরে কাছে টেনে আনলেন।
‘কি হচ্ছে? চোখের জল মোছো। প্রত্যেক কথায় কি তোমার চোখে জল আসে? এত ইমোশনাল হওয়া ভালো নয়। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কবে ঠিক হবে? বলতে বলতে আজ তিনটি বছর হয়ে গেল। ওর কোনো খোঁজ নেই। সব কিছু আমার জন্য হয়েছে। আমি ওর জীবনটা নষ্ট করেছি। ঈশ্বর আমায় কোনোদিন ক্ষমা করবেন না।’ তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কিন্তু কোনো সান্ত্বনা মূলক বাক্য ব্যবহার করতে পারলেন না। কি বলে সান্ত্বনা দেবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তিনিও প্রথম প্রথম ভাবতেন, সবুজ কিছুদিনের জন্য হয়তো নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। তারপর পরিবারের কথা মনে পড়লে ঠিক ফিরে আসবে। কিন্তু সে আসেনি। আসবে বলেও মনে হয় না। ফেরার হলে এতদিনে ফিরে আসতো। সবুজ সবসময় সত্যি কথা বলে। আর যারা সবসময় সত্যি কথা বলে তাদের জীবন অনেক কঠিন হয়। এই কঠিন জীবন কি করে পার করছে? সে ফিরবে না, আর তাকে বাড়িতে ফেরানোর কোনো উদ্যোগ নেই তার বাবা-মার মধ্যে। একটা সন্তান হারিয়েছেন তবুও তাদের পরিবারের মধ্যে খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। সবকিছু স্বাভাবিক সুষ্ঠুভাবে চলছে। যা করার তাঁকেই করতে হবে। তিনিই বা কি করবেন? তিনি তো সাধারন একজন রাধুনী। এ জগৎটা অনেক বড়। কোথায় খুঁজে পাবেন সবুজকে? সে যদি না ফেরে তাহলে তার সন্তানকে সারাজীবন অপরাধবোধ নিয়ে বাঁচতে হবে। এই অপরাধ বোধ তার জীবন থেকে কখনও যাবে না। তাছাড়া তিনিও তো ভালো নেই। সবুজকে তাঁরও প্রয়োজন। তার মুখে কাকামশাই ডাকটা বড্ড মধুর শোনায়। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে সবসময় ছেলের মুখটা ভেসে ওঠে না মাঝেমধ্যে সবুজ আর সূর্যময়ের মুখটাও ভেসে উঠে। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেন তিনি। তাদেরকে কখনও অন্যের সন্তান ভাবেননি।
সবুজ বাবার পাশে বসে বাবার রন্ধন কৌশল দেখছিল। মাঝেমধ্যে চোখ ঘুরিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তিনি তার শুধু বাবা নয় মাও। মায়ের অভাব যে কোনোদিন বুঝতে দেয়নি। তিনি কোনো কিছুতে ব্যর্থ নন। এই ঘামে ভেজা কালো মানুষটা এত মায়াবী কেন? উনাকে দেখলে এত কষ্ট হয় কেন, জানে না সে। তবে বারবার বাবার চোখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে। চোখে উৎসাহিত হওয়ার ইচ্ছা লুকিয়ে রয়েছে। ওই চোখ দুটো লড়াই করতে শেখায়। বাবার চোখের দিকে তাকালে আলাদা একটা উত্তাপ অনুভব করে। পুনরায় কলিং বেল বাজায় সে সেখান থেকে উঠে এলো। বাবা বাড়িতে ফেরার পর সাধারণত আর কলিংবেল বাজে না। আজ আবার কে এলো? বাইরে বেরিয়ে সর্বপ্রথম ঘড়ি দেখল। সাড়ে আটটা বাজে। বেশি রাত হয়নি অন্য কারোর উপস্থিতি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দরজা খুলে অবাক হলো। তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তৃধা।ঋজু শরীর, ঠোঁটের দুই কোণায় সুকুমার ভঙ্গি। শরীরের কুসুমকলি ফুটে উঠেছে। শহরে আসার পর এই প্রথম সাক্ষাৎ হলো। নারীর উপস্থিতিতে উত্তাপ রয়েছে। সে-ই উত্তাপে আমতা আমতা করল সংকেত।বলল,’তুমি! এই সময়ে!’
নিজে থেকে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,’জ্যাঠামশাই তো খাবার আনেননি। তাই মা খাবার পাঠিয়ে দিলেন।’
‘তোমরা এখানে কখন এলে? তোমরা তো এখানে থাকো না।’
‘সকালে এসেছি।’ সংকেত হাসিমুখে তার কাছ থেকে খাবার নিয়ে রান্নার ঘরে চলে এলো। খাওয়ার রেখে বাবার সাথে একটু কথা বলে আবার বাইরে এল। তৃধা যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল ওই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে নিয়ে নিজের ঘর গেল। যদিও নিজের ঘর বলে কিছু নেই। একটামাত্র ঘর রয়েছে সেখানে বাবা ছেলে দুজনেই থাকে। তৃধা সোজা বিছানায় উঠে গিয়ে বসলো। সামনে দাঁড়িয়ে রইল সংকেত। বেশ অগোছালো ঘর। জিনিসপত্র সব কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। গুমোট ভাব সাথে রয়েছে বিচ্ছিরি গন্ধ। অস্বস্তির মধ্যে পড়লো সংকেত। কি করে তৃধাকে খুশি করবে বুঝে উঠতে পারল না। তার নিশ্চয়ই এই ঘরের মধ্যে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে। ঘরে আনাটাই উচিত হয়নি। নিজের বোকামিতে নিজেই লজ্জা বোধ করল। হেসে বলল,’তোমার অস্বস্তি হচ্ছে না!’ তৃধা জবাব দিল না। তার জবাব না পেয়ে আরও বেশি অস্বস্তি বোধ করলো। কি বলবে বুঝতে পারল না। সে আবার আনাড়ির মতো হাসলো। তার পাশে বসার সাহস পাচ্ছে না। আগে ইচ্ছামত তাকে স্পর্শ করতো। পাশে গিয়ে বসতো। চুল টেনে ধরতো। এখন ইচ্ছে করলেও মন সায় দেয় না। এখন সে বড় হয়েছে। তৃধাও বড় হয়েছে। অমন দুষ্টুমি করা উচিত হবে না। পাশে পড়ে থাকা একটা কাঠের চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
‘এখানে বসতে তোমার অসুবিধা হচ্ছে? গরম লাগছে, পাখা চালাবো?’ তথাপি জবাব দিল না সে। তার মুখে যেন কুলুপ আঁটা। সংকেত কোনো কথা ভেবে না পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। এবার মুখ খুলল তৃধা।
‘তুমি তো বড় হয়েছো। ঘর পরিষ্কার করতে পারো না? বাবা এত কাজ করার পর ঘর পরিষ্কার করতে সময় পাবেন? তুমি তো আর ছোট বাচ্চা নও। ঘর থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। বাইরে থেকে কেউ এলে তোমাদের কি ভাববে বলতো? তোমার দিকে কেউ আঙ্গুল তুলবে না আঙ্গুল তোমার বাবার দিকে তুলবে। ভালো লাগবে তোমার? আমার কয়েকটা মিনিটে অস্বস্তি হচ্ছে। কি করে তোমরা দিনের পর দিন কাটাচ্ছো?’
সংকেত দাঁত কেলিয়ে হেসে ফেললো।
‘হাসির কথা বলছি না।’
‘ও কিছু না। পরিষ্কার করে দিলে ঠিক হয়ে যাবে।’
‘পরিষ্কার কখন করবে শুনি? মুখে বললেই তো আর কাজ হবে না।’ বলতে বলতে নিজেই উঠে পড়ে জামা কাপড় ভাঁজ করতে শুরু করলো। সংকেত বেশ স্বস্তি বোধ করলো। এই যে অপরিচিত কেউ তার দায়িত্ব নিচ্ছে, তাদের কথা ভাবছে,তাকে শাসন করছে,সেটা ভেবে তার খুব ভালো লাগছে। অতৃপ্তির মধ্যে কিছুটা তৃপ্তি। অল্প সময়ের মধ্যে যতটুকু সম্ভব ততটুকু গুছিয়ে দিল। তারপর সে কাকামশাই এর সঙ্গে দেখা করে বাইরে বেরিয়ে আসলো। তিনি ছেলেকে বললেন তৃধাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলিতে হাঁটতে রইল। তাদের বাড়ি থেকে হোটেলের দূরত্ব সামান্য। অনেকদিন হলো তারা কোথাও ঘুরতে যায়নি। রবিশংকর বাবুর প্রচুর কাজের চাপ রয়েছে। তাদেরকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার মত সময় নেই। শহরে এত বড় হোটেল থাকলেও ছেলে-মেয়ে কখনও আসেনি। বাবার মস্ত বড় হোটেল দেখার ইচ্ছে ছিল তাদের। তাই তিনি আজ সকালে কাজে আসার সময় স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। জ্যোৎস্না রাত। আকাশের বড় আধখানা চাঁদ উঠেছে। অসংখ্য তারা মিটমিট করছে। শহরের নির্জনতা এখনও নামেনি। গলির মোড়ে হাঁটতে গিয়ে চোখে নতুনত্ব কিছুই পড়লো না। তবে মানুষের সংখ্যা আর কোলাহল দুটোই কমেছে।
‘তৃধা!’
‘হুম।’ সংকেত দ্বিতীয় বার আর কিছু বলল না। ঘাপটি মেরে হাঁটতে রইল। কিছুটা যাওয়ার পর আবার বলল,’এই তৃধা!’
‘বলো, শুনতে পাচ্ছি তো।’
‘তুমি শহরে সকাল থেকে এসেছো, তাই না!’
‘হ্যাঁ, কেন?’
‘না, এমনি।’ সংকেত কিছু একটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু বলতে পারল না। তা অনুমান করতে পারলো তৃধা। প্রচুর চাপা স্বভাবের ছেলে। মুখ থেকে কি করে কথা বের করা যায় তাই ভাবছিলো। এমন সময় সংকেত নিজেই প্রশ্ন করে বসলো। সে তার অনেকটা কাছে চলে এসেছে। যদিও তাতে অস্বস্তি হচ্ছে না বরং ভালো লাগছে। বলল,’আজও কি তন্ময়ের টিউশন ছিল? না মানে তুমি এত রাতে আমাদের বাড়িতে এলে ,তাই!’
‘না, ছিল না। নিজে থেকে এসেছি। শুধু এখন না আমি সকালেও এসেছিলাম কিন্তু তোমায় দেখতে পাইনি।’ সংকেতের বুক মুহুর্তের মধ্যে রঙিন হয়ে উঠল। তৃধা তাকে খোঁজে? তার কথা ভাবে? নিজের মাথায় চাটি মারলো। সকালে যদি বন্ধুদের সঙ্গে না বের হতো তাহলে দেখা হতো। আড্ডা দিতে পারতো।তৃধা নিশ্চয়ই তাকে খুব মিস করে। তাই দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু তৃধার পরবর্তী কথাতে রঙ্গিন হৃদয় মুহূর্তের মধ্যে মলিন হয়ে গেল।
‘তুমি কি মিন করতে চাইছো? মানে দাদা আসতে পারে আমি আসতে পারি না? শুধুমাত্র ছেলেরা রাতে চলাফেরা করতে পারে, মেয়েরা পারে না?’ সংকেত একটু আশ্চর্য হল। তৃধা একটু রাগী স্বভাবের মেয়ে। কারণে অকারণে রেগে যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার রাগটাও দ্বিগুণ হয়েছে। সংকেত শান্ত মাথায় বলল,’আমি এমন ভাবে বলেনি।’
‘তোমার কথা থেকে এটাই পরিষ্কার হয়। অন্তত তোমার কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি।’ রাগ যেন একটু বেশিই দেখাচ্ছে তৃধা। এত রাগ করার কি আছে? এখানে আসা থেকেই রেগে রেগে কথা বলছে।
‘কি হয়েছে তোমার? রেগে যাচ্ছো কেন?’
‘আমি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছি। আর এটাকে যদি তোমার রাগ মনে হয় তাহলে আমার কিছু করার নেই।’ বাড়ির সামনে পৌঁছানোর পর একটু শান্ত হলো। বাড়ির উঠোনে গিয়ে বলল,’সাবধানে বাড়ি যাও। রাস্তায় আবার দাঁড়িয়ে পড়বে না। তোমার জন্য জ্যাঠামশাই অপেক্ষা করে আছেন।’ সংকেত ঘাড় নাড়ালো। তৃধা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করছিল সেই সময় সংকেত তাকে আবার ডাকল। মুখ ফিরে বলল,’কি হলো? ডাকলে কেন?’
‘একটা কথা বলি?’
‘বলো।’
‘তোমরা গ্রামে কবে ফিরবে?’
‘কাল সকালেই।’ সংকেতের হৃদয় আরও চুপসে গেল। মুখ কালো করে ফেলল। তৃধা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,’কেন? তোমার কোনো অসুবিধা আছে?’
‘না,তবে কাল সকালে থেকে গেলে হয় না!’
‘হু হয়,মাকে রাজি করাতে হবে।’
‘তাহলে রাজি করাও।’
‘আচ্ছা।’
সংকেত আবার একবার অবাক হলো তৃধার ব্যবহার দেখে। মুহূর্তের মধ্যেই মাইন্ড চেঞ্জ করে ফেলে। সে হাসিমুখে বলল,’আর কিছু বলবে?’ সংকেত বোকার মত মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলল। তৃধা আর কিছু না বলে ঘরের মধ্যে চলে গেল। বেশ অনেকক্ষণ ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম সংকেত। তৃধা কেমন যেন! কিছুক্ষণ আগে রেগে রেগে কথা বলছিল। আমার এখন হাসি মুখে কথা বলল। তার একটা কথায় থাকতে রাজি হয়ে গেল। অথচ কিছুক্ষণ আগে কত না ঝামেলা করলো। মেয়েদের মন বোঝা কি খুব সহজ? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একা একা হেসে উঠলো।
রোজ সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ে সংকেত। আজ আরও তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল। মেজাজ বেশ ফুরফুরে। বাবা ঘুম থেকে ওঠেননি। আজ নিজে থেকেই বাড়ির কাজ করতে মন হল। এত বড়ো হলেও বাড়িতে তেমন একটা কাজ করে না। বাবা অসুস্থ থাকলে কিংবা খুব ব্যস্ত থাকলে একটু আধটু কাজ করে নয়তো নয়। তাছাড়া জ্যোতির্ময় বাবু ছেলেকে কোনো কাজ করতে দেন না। আজ মনে পুলক জেগেছে। রাতে ঠিকমত ঘুম হয়নি। বাবা ঘুম থেকে ওঠার আগে বাড়ির সমস্ত কাজ সেরে ফেলল। তিনি ঘুম থেকে উঠে একটু অবাক হলেন। তবে কোনো মন্তব্য করলেন না। যথা সময়ে কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে পড়লেন। এই সময় ছেলে একটা অবাক কান্ড করে বসলো। সে বাবাকে সাইকেলে করে ছেড়ে দিয়ে আসতে চাইলো। এক বছরের মতো হলো সংকেত সাইকেল চড়া শিখেছে। গ্রামে থাকাকালীন তিনি অনেক বার চেষ্টা করেছিলেন ছেলেকে সাইকেল চালানো শেখাতে। ভয়ের কারণে সে শিখতে চায়নি। কিন্তু শহরে প্রয়োজন হয়ে পড়ায় শিখে নিয়েছে। তবে কখনও বাবাকে পেছনে বসিয়ে নিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। বাবাও কখনও যেতে চায়নি। ছেলে নিজে থেকে বলায় না বলতে পারলেন না। মনের অন্তরে কোথাও খুশির বায়ু বয়ে গেল। পরম উষ্ণতা অনুভব করল। ছেলে একটু একটু করে বাবার দায়িত্ব নিতে শিখছে, এর চেয়ে ভালো খবর আর কি হতে পারে! সংকেত হোটেল পর্যন্ত বাবাকে পৌঁছে দিল। সাইকেল থেকে নেমেই মুখে সুকুমার ভঙ্গিতে চওড়া হাসি ফুটিয়ে তুললেন। জামার পকেট থেকে দশ টাকার নোট বের করে ছেলের হাতে দিলেন। সংকেত ‘না’ বলল না। তাকে টাকা দেওয়ার সময় সে প্রায় সময় ‘না’ বলে। আজকে ‘না’ বলায় একটু অবাক হলেন জ্যোতির্ময় বাবু। বললেন,’বাবু, কিছু সমস্যা হয়েছে?’
‘না তো।’ আমতা আমতা করে জবাব দিল। তার কথার ধরন দেখে কিছু একটা আন্দাজ করলেন। এবার পকেট থেকে একশো টাকার নোট বের করে ছেলের হাতে দিলেন। এবার সংকেত টাকাটা নিতে চাইল না। তিনি জোর করে দিয়ে গেলেন। সংকেত নির্লিপ্তি দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি কী করে বুঝলেন তার কাছে টাকা নেই? আগে স্কুলে গেলে বাবা কম পারুক বেশি পারুক মোটামুটি টাকা দিতেন। তারপর যখন কলেজে উঠল তখনও টাকা দেওয়া বন্ধ করেনিন।রোজ কাজে যাওয়ার আগে ছেলেকে কিছু টাকা দিয়ে যান। সংকেত এখন কলেজের ছাত্র।বন্ধু-বান্ধবীর সংখ্যা বেড়েছে।নেশা জাতীয় দ্রব্যে হাত দিয়েছে। আগে বাবার দেওয়ার টাকাগুলো জমা হয়ে থাকতো। কিন্তু এখন সব খরচ হয়ে যায়। উপরন্তু বন্ধুদের কাছে ধার করে বসে আছে। তার টাকার খুব দরকার ছিল। বাবা ঠিক বুঝে গেলেন। তবে এখানে তার আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তৃধার সঙ্গে দেখা করা। দেখা হলো না। হোটেলের বাইরে থেকে এ-দিক ও-দিক মুখ ঘুরিয়েও খুঁজে পেল না। সম্ভবত ঘুম থেকে ওঠেনি। সাহস করে ভেতরে যেতে পারল না। প্রায় আধা ঘন্টার মত বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। তেমন কোনো সুবিধা করতে না পারায় ফিরে এলো। সাইকেল একটা জায়গায় রেখে ভবঘুরের মত একা একা শহরে ঘুরতে লাগলো। অনেকক্ষণ ঘোরার পর খিদে পেল। কিছু খেতে হবে। বাড়িতে পান্তা ছাড়া তেমন কিছু নেই। হাতে পয়সা আছে। কিছু খেলে হয়। কিন্তু কি খাবে? শহরের সমস্ত কিছুর দাম চড়া। পাশে চায়ের দোকানে গিয়ে চা আর বিস্কুট নিল। মাত্র দুটো চুমুক দিয়েছে তাতেই বুঝলো চা তেমন একটা সুস্বাদু নয়। বাবার হাতে বানানো চা-ই শ্রেষ্ঠ। পান করতে ইচ্ছে করলো না আবার ফেলতেও পারল না। টাকা দিয়ে কেনা। তবে ক্ষণিকের মধ্যে সূর্যময়কে দেখে চা আর খাওয়া হলো না। টাকা মিটিয়ে বিস্কুট কামড়াতে কামড়াতে তার কাছে ছুটলো। সূর্যময় সংকেতকে লক্ষ্য করেনি। তার কাঁধে হাতের চাপড় পড়তে খুব বিরক্ত বোধ করলো। সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরে কড়া স্বরে জবাব দিতে চাইছিল কিন্তু সংকেতকে দেখে হেসে ফেললো। সংকেতও কৌতুক করতে চাইছিল কিন্তু বন্ধুর রূপ দেখে স্থির হয়ে গেল। কি হয়েছে তার অবস্থা? সেই মেদবহুল মসৃন শরীরটা কোথায় হারিয়ে গেছে। সেও যৌবনে পা দিয়েছে। এই বয়সে তার রুপ যৌবন ফেটে বেরিয়ে আসার কথা। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। দীর্ঘদিন রোদে পুড়ে কাজ করায় তার শরীর ভেঙে গেছে। চোখ দুটো কোটায় ঢুকে গেছে। গৌর বর্ণ শরীর রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। তাদের ছয় মাসের মতো দেখা হয়নি। আর এই কটা মাসে এত পরিবর্তন? কি হয়েছে তার? বড্ড উসখুস করলো। জানতে ইচ্ছা করলো তার কি হয়েছে। করুন কন্ঠে বলল,’তুমি এমন ভাবে শুকিয়ে গেছো কেন? কোনো অসুখ হয়েছে?’ সূর্যময় তার কাঁধের উপর হাত তুলে দিল। সামনের দিকে এগোতে বলল। এগোতে এগোতে একটু হতাশের সঙ্গে বলল,’সে এক লম্বা কাহিনী। কি বলি বলতো, তোমায়?’
‘বলো না কি হয়েছে?’
‘তেমন কিছু নয়। মায়ের টিউমার হয়েছিল। অপারেশনের জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। বাবা টাকা জোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপর বাবা মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে যান। আমি ঘরে একা। আর তখন ধান কাটার সময়। ধান মাঠে পড়ে রয়েছে। সবার বাড়িতে ধান উঠতে রইলো কিন্তু আমার বাড়িতে ধান কাটার মতো কেউ নেই। কি করবো? কোথায় যাবো? একা আর কত করবো? একদিকে মা অন্য দিক ফসল। দুশ্চিন্তায় ঘুম আসতো না। বাবাও আমায় কিছু বলতেন না। কিন্তু মনে মনে পুরো ভেঙে পড়েন। মায়ের অপারেশনের জন্য অনেক টাকা খরচ হয়েছে তার ওপর ধান চলে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। চতুর্দিকে একটা হাহাকার পরিবেশ।’
‘একটু বুদ্ধি খাটালেই তো হতো! দু-একটা মজুরি নিয়ে করে নিলে না কেন?’
‘বাবাও তাই বলেছিলেন। কিন্তু এত মজুরি কে দেব? সব মজুরি দিয়ে ফসল ঘরে তুললে লাভের খাতায় কিছু থাকবে না। তবুও নিয়েছিলাম। আর বাকিটা নিজের প্রচেষ্টায় রাতদিন এক করে মাঠের ফসল ঘরে তুলেছি।’
‘সত্যি।’
সূর্যময় হাসিমুখে বলল,’ভাগ্যিস ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে কাজে যেতাম। কাজ গুলো শিখে নিয়েছিলাম। একটু কষ্ট হয়েছিল কিন্তু পেরেছি। বাবা মা ফিরে এসে অবাক হয়েছিলেন আমার কান্ড দেখে। বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। এই কদিনের পরিশ্রমের শরীরটা ভেঙ্গে যায়। তারপর থেকে কিছু না কিছু না লেগে আছে।’
‘সত্যি গর্বের মতো বিষয়। তোমার পক্ষেই সম্ভব। পরিবারের জন্য কিছু করতে পারলে মনে হয় আমরা বড় হয়ে গেছি, তাই না বন্ধু?’ সূর্যময় জবাব দিল না। আসলে বাজারে কোলাহলের মধ্যে তার কানে কথা গুলো ভেসে আসেনি। এত চেঁচামেচি ভালো লাগছে না সংকেতের। বাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হল কিন্তু সূর্যময় বাধা দিল। সে দরকারের জন্য শহরে এসেছে। কিন্তু কি দরকার তা বললো না। কথা এড়িয়ে গেল। বন্ধুর কাছে কিছু একটা লুকোচ্ছে। বাজারের দক্ষিণ দিকটায় ভিড় খুব কম। সেদিকে অনেক দোকান এখনও খোলেনি। সূর্যময় সেদিকে গেল। কোলাহল কম থাকায় সংকেত প্রশ্ন করে বসলো। এত সকালে শহরে এসেছে কেন? কি এমন জিনিসের প্রয়োজন রয়েছে যে ভোরে উঠে শহরে আসতে হল? তাকে এত উদ্বিগ্ন লাগছে কেন? সূর্যময় চাইছিল না তার দুঃখের কথা কাউকে শোনাতে। বিশেষ করে সংকেতকে। সে কষ্ট পাবে। দুশ্চিন্তা করবে। তবে বন্ধুর বারবার আবদার ফেলতে পারল না। নিজের দুঃখ যন্ত্রণা গুলো কাউকে বললে হালকা হতে পারবে। গড় গড় করে সবকিছু বলে গেল।মায়ের অপারেশনের জন্য বাজারে অনেক ধারদেনা হয়ে যায়। টাকার সুদ ক্রমশ বাড়তে থাকে। ঋণের বোঝা নিতে পারেনি। অতুল বাবু নিজের ট্রলার বিক্রি করে বাজারের সমস্ত ধার দেনা শোধ করেন। তারপর তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। কিছু টাকা বেচে ছিল। তা দিয়ে নিজেদের জন্য নৌকা বানাচ্ছেন। তার উপকরণ কিনতে বাজারে এসেছে। সবকিছু শুনে সংকেতের ভিতর ধুক করে উঠলো। ছোটবেলা থেকে গল্প শুনে আসছে, রাজাকেও নাকি একদিন সূচ ধার করতে হয়। ধনী থেকে গরিব হতে আবার গরিব থেকে ধনী হতে বেশি সময় লাগে না। একটা মুহূর্তে সবকিছু তছনছ হয়ে যেতে পারে। আজ নিজের সামনে উপলব্ধি করতে পারছে। কয়েকটা মাসের আগে যাদেরকে সবচেয়ে সুখী পরিবার মনে করতো তারা আজ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। তারা তো কাউকে ঠকায়নি। অহংকারও ছিল না। তবুও বিধাতার খেলায় মলিন হতে হয়েছে। বিধাতার কাছে সবাই অসহায়। বন্ধুর কষ্টে বড্ড উতলা হয়ে উঠল। একটু ভেবে চিন্তে বলল,’কিন্তু তোমাদের তো নিজস্ব ট্রলার ছিল। অনেক টাকা হওয়ার কথা।’
‘নিজস্ব ঠিক নয়। আরও একজন শেয়ারে ছিলেন। তাছাড়া পুরনো হয়ে গেছে কত আর দাম হবে? আর অসময়ে ন্যায্য দাম না পেলেও বিক্রি করে দিতে হয়। তখন আর ন্যায্য অন্যায্য বলে কিছু থাকে না।’ সূর্যময়ের চোখ জুড়ে বিষণ্নতা বয়ে গেল। সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে সে। সান্ত্বনা ছাড়া তাকে দেওয়ার মতো কিছু নেই সংকেতের কাছে। পিঠে হাত চাপড়ে ভরসা জোগালো। দোকানের কাছে পৌঁছে অতুল বাবুকে দেখে একটু আপ্লুত হয়ে উঠল সংকেত। তিনিও অনেক দিনের পর সংকেতকে দেখে খুশি হলেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গল্প করল। এত বেলা হয়ে যাওয়ার পরও দোকান না খোলায় তিনি একটু বিরক্ত বোধ করছেন। তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সূর্যময়কে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গেল। তাঁকেও বাড়িতে ডাকলো। তিনি রাজি হলেন না। অন্য কোনো দিন যাবেন। বাজার থেকে বেরিয়ে এসে তারা সোজা হাঁটতে শুরু করল। সংকেতের কাছে পয়সার রয়েছে। সূর্যময়ের মুখে কিছুতেই হাসি ফুটছে না।হয়তো, অনেকদিন বাইরের খাবার কিনে খায়নি। বন্ধুকে এই মুহূর্তে কিছু খাওয়াতে পারলে ভালো হয়। যেতে চাইল না তবুও জোর করে তাকে দোকানে নিয়ে গেল। খাবার খাওয়ার পর দুজনে দুটো সিগারেট ধরালো। সিগারেটে টান দিতে দিতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। পথে তৃধার সঙ্গে দেখা হতেই সংকেত তাড়াতাড়ি সিগারেট ফেলে দিল। এ আবার কোথা থেকে এলো? সূর্যময় হাসলো তবে ফেলে দিলো না। যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন ফেলে আর লাভ নেই। সে দেখে ফেলেছে। তৃধা তাদের কাছে পৌঁছে কোনো সম্মানজনক বাক্য না বলে সোজাসুজি গম্ভীর কণ্ঠে বলল,’তোমরা আবার সিগারেট নিয়েছো?’ সংকেত তাড়াতাড়ি বলল,’আমি না। ও একা নিয়েছে। ছোটবেলার অভ্যাস তো তাই…’
‘চুপ! আমি দেখিনি বুঝি!’ এবার সূর্যময় সিগারেট ফেলে বলল,’ছেড়ে দাও না। ও তেমন একটা খায় না। অনেক দিনের পর দেখা হলো তো তাই।’
‘হ্যাঁ ওই আর কি।’ সংকেত আমতা আমতা করে বলল।
‘আমি শুধু ওকে বলছি না তোমাকেও বলছি। এগুলো কি ঠিক করছো তোমরা? তোমায় আমি ঠিক চিনি না। সংকেতের মাধ্যমে তোমার সাথে পরিচয়। বলতো,তোমরা এগুলো কি ঠিক করছো? তোমরা রোজগার করতে পারো? পারো না। বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করছে -ছেলেকে খুশিতে রাখার জন্য কিছু টাকা দিচ্ছে। আর তোমরা কি করছো? সে-ই টাকায় ফুর্তি করছো। নেশা করছো। তোমাদের বাবা যদি কোনোদিন জানতে পারেন তাহলে কি হবে? আমি নিশ্চিত তাঁরা তোমাদের কিছু বলবেন না। কিন্তু মনে মনে ভেবে নেবেন, সন্তানদের মানুষ করতে পারেননি। তখন বাবার দিকে তাকাতে পারবে তো? আমি তোমাদের খেতে বারণ করছি না। তোমরা রোজগার করতে শেখো। তারপর যত ইচ্ছে খাও। বাবার রোজগারের টাকায় কেন এমন করছো? পরিশ্রমের দাম দিতে শেখো। এই তোমাদের বাবার প্রতি শ্রদ্ধা?’ দুজনে মাথা নিচু করে ফেলল। কিছু বলতে পারলো না। তৃধা আবার বলল,’আমি তোমারদের চিয়ে ছোট। এ সব কথা হয়তো আমার মুখে মানায় না। তবে আমি খারাপ কিছু বলছি না। একটু নিজেকে জিজ্ঞাসা করো, তোমরা যা করছো তা সঠিক কি না!’ দুজনের আত্মবোধে লাগলো। মুখ তুললো না। তৃধা তাদেরকে হাঁটার জন্য বলল। কোনো কথা না বলে হাঁটতে শুরু করলো। কিছুটা হাঁটার পর সংকেত দাঁড়িয়ে গেল। তার সাইকেল এখানে রয়েছে। বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর তৃধা বলল,’তুমি আমায় থাকতে বললে আর সকালে নিজেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেল?’ সংকেত কি জবাব দেবে খুঁজে পেল না। কি করে বোঝাবে সে শুধুমাত্র তার সঙ্গে দেখা করার জন্য সকালে বেরিয়ে ছিল। তারপর….।
‘তোমার কোনো কিছুতে ভ্রুক্ষেপ নেই দেখছি। সবকিছুতে আনমনা। আজ কলেজ যাবে না?’
সংকেত মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলল। তৃধা বলল,’তাহলে চলো আজকে আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি।’ পরে সূর্যময়ের দিকে ইঙ্গিত করে আবার বলল,’তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে তো?’
‘বুঝতে পারছি না। বাবাকে জিজ্ঞেস করি তারপর।’
‘কাকামশাইকে বললে ঠিক রাজি হয়ে যাবেন। তুমি সকাল বেলাটা আমাদের বাড়িতে থেকে যাও বিকালে চলে যাবে।’
লীলা নিরুদ্দেশ হবার সাথে সাথে এ বাড়ির সুখও নিয়ে গেছে। সবাই ভেঙে পড়েছেন। কারোর কাজের প্রতি মন নেই। বৌদিমণি উন্মাদ হয়ে রয়েছেন। নিজের মেয়ে ছাড়া কিছু ভাবতে পারছেন না। খাওয়া-দাওয়া নিজের পরিচর্যা ত্যাগ করেছেন। একটা ঘরে সব সময় বন্দী থাকেন। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ে। ছোট মেয়ে সব সময় বাড়ির এ-দিক ও-দিক চলাফেরা করতো। প্রতিদিন সবার কাছে কিছু না কিছু আবদার করে বসতো। আজ কয়েকদিন ধরে তার অনুপস্থিতি ঘরটি হাহাকারে ভরে গেছে। বাজার থেকে এলে মেয়েটি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আর চকোলেট চায় না। বাড়ি থেকে বাচ্চার কান্না আর শোনা যায় না। সবাই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে। সুন্দর লাবণ্য মেয়ের উপর কার নজর পড়লো? পুলিশ কয়েক মাস ধরে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। সুসংবাদ শোনাতে ব্যর্থ হয়েছে। এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে রায়বাবু আরও বেশি ভেঙে পড়েছেন। চলাফেরা একদমই করতে পারেন না। শেষ বয়সে পরিবারের মধ্যে এমন একটা দুর্ঘটনা হতাশ করেছে। বুঝতে পেরেছেন তিনি আর বেশি দিন এই পৃথিবীতে থাকবেন না। শেষবারের মতো সমস্ত সন্তান সন্ততি নাতি-নাতনিদের মুখ দেখে যেতে পারতেন তাহলে শেষ নিঃশ্বাসটি বড্ড সুখকর হতো। সবুজের মন মেজাজ ভালো নেই। একে লীলা গেছে।তার ওপর কয়েক দিন হলো সাথী ভালো মতো কথা বলছে না। প্রথম কয়েক মাস তার সঙ্গে রোজ ফোনে কথা বলতো। সেখানে সে কী কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কী খাচ্ছে, সবকিছুই বলতো। কিন্তু এখন সে কিছু বলে না। বারবার ব্যস্ততার অজুহাতে দেখায়। সামনে নাকি পরীক্ষা! কথা বলতে পারবে না। মাথায় দুশ্চিন্তা নিতে চায় না। অথচ তাকে ফোন করলে প্রায় সময় বিজি থাকে। আজকাল কেমন রেগে রেগে কথা বলে সবুজের সাথে। সবুজের এসব ভালো লাগে না। দুশ্চিন্তা চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে রয়েছে। বাড়িতে ঠিক মত কেউ কাজে মন না দেওয়ায় তার কাজ একটু বেড়ে গেছে। অবসর সময় খুব কম পায়। যেটুকু পায় তাতেও শান্তি নেই। কারণে অকারণে শুধু দুশ্চিন্তা। কয়েকদিন হল ঠিকঠাক লেখাতে মন বসাতে পারছে না। মনোযোগ বারবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
পর্ব ১০ আসছে।।