নিভৃতে_যতনে #Part_19,20

#নিভৃতে_যতনে
#Part_19,20
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
19

আমি ভ্রু দুইটি কুঞ্চিত করে ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে আছি। ওয়াশরুমের দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক করে মাথা বের করে আছে রোয়েন। ইতস্তত গলায় বার বার আমার নাম ধরে ডাকছে। মাথা থেকে মুখ গলা বেয়ে চুয়ে চুয়ে পানি পড়ছে তার। হয়তো শাওয়ার নিয়েছেন। চোখে মুখে আড়ষ্টতা। উনি আরেকবার আমার নাম ধরে ডাকতেই আমি একটু নড়েচড়ে বসে স্থির কন্ঠে উত্তর দিলাম,

— জ্বী বলুন।

উনি ইতস্তত গলায় বলে উঠেন,

— ব্যাগ থেকে আমার টাওয়ালটা একটু দাও।

কথাটা শুনে আমার কি হলো জানি না। হঠাৎ মাথায় দুষ্টুমি চেপে বসলো। মনে হতে থাকলো এইতো সময় সিয়াশা, “এতদিনের টর্চার আর ত্যাড়ামির সকল শোধ তুলে নে তুই। এর চেয়ে পক্ষম সুযোগ আর পাবি না। সুযোগের সৎ ব্যবহার কর।” কথাটা ভেবেই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে পৈচাশিক হাসি। আমি দুষ্টুমি সুরে বলে উঠি,

— যদি না দেই?

সে বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠে,

— মানে?

— মানে যদি আমি টাওয়াল না দেই তাহলে?

উনি গম্ভীর হয়ে বলেন,

— টাওয়াল দাও বলছি।

— দিবো না। নিজে এসে নিয়ে যান।

— বেশি হচ্ছে কিন্তু।

— হুহ! তাতে আমার কি?

সে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,

— কি চাই তোমার?

কথাটা শুনার সাথে সাথে মুখে হাসি ফুটে উঠে আমার। এই তো লাইনে এসেছে। আমি এইবার ভাব নিয়ে বলি,

— বেশি কিছু না। শুধু আমার কাছে সুন্দরভাবে রিকুয়েষ্ট করতে হবে টাওয়ালটা দেওয়ার জন্য।

রোয়েন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— ইন ইউর ড্রিমস।

আমি একটা হামি দিয়ে বলি,

— তাহলে টাওয়ালটাও আমার স্বপ্ন থেকেই নিয়ে যেয়েন। আমি ঘুমালাম।

উনি ফুঁসে উঠে বলে,

— তুমি কিন্তু এখন বারাবাড়ি করছো৷ একবার আমি আসি বাইরে তোমার খবর আছে।

— এত শত কথা না বলে রিকুয়েষ্ট করলেই হয়।

আমার কথা শুনে রোয়েন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,

— থাক লাগবে না৷ আমি এইভাবেই বাহিরে আসছি।

কথাটা শুনার সাথে সাথে আমি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াই। মুখ পাংশুটে হয়ে আসে। আমি চটজলদি বলে উঠি,

— এই না!

সে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলে,

— এই না কি? আসবো আমি?

আমি মুখ ছোট করে বলি,

— দাঁড়ান! দিচ্ছি আমি টাওয়াল।

কথাটা বলে মনে মনে ভাবি,” ব্যাটা যে পরিমানে ঘাড়ত্যাড়া। মচকাবে কিন্তু ভাঙ্গবে না। দেখা গেলো সত্যি বেরিয়ে আসলে? এর কোন ভরসা নেই।” আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে রোয়েনের ট্রাভেলিং ব্যাগটা থেকে তার টাওয়ালটা বের করে ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে এগিয়ে দিলাম৷ সে টাওয়ালটা নিয়ে ধাম করে মুখের উপর দরজাটা লাগিয়ে দিলো। আমি বিরবির করে বলি,

— আগে তো শুধু ত্যাড়া আর খাটাশ ছিল। এখন তো দেখি ব্যাটা নির্লজ্জ ও।

______________________

আকাশের ঘন নীল শীতলতায় যোগ দিয়েছে মেঘালয় মায়া। শুভ্র মেঘে আচ্ছন্ন নীলাভ আকাশ। সূর্যের সোনালি রঙ খেলা করেছে মেঘে মেঘে। দৃষ্টির সীমানা জুড়ে একের পর এক সাজানো পাহাড়ের পরত। সবুজ পাহাড়ে শুভ্র সাদা মেঘের ছায়াদের লুকোচুরি খেলা। এই যেন এক অপার্থিব সৌন্দর্য! এক মুঠো সোনালী রোদ এসে পড়ছে আমার চোখে মুখে। স্নিগ্ধ শীতল বাতাসের দোলে দোল খাচ্ছে আমার হাল্কা ঢেউ খেলানো কেশ। আমি বারান্দার রেলিং এর উপর দুই হাত রেখে উপভোগ করছি প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য। বারান্দার রেলিং কোমড় অব্দি হওয়ায় সবকিছুই একদম খোলামেলা ও প্রাণবন্তর। এইখানে দাঁড়ালে এমন এক অনুভূতি যে হাত বাড়ালেই আকাশ ছোঁয়া যাবে। ভাগ্যিস তখন আর না ঘুমিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। নাহলে প্রকৃতির এই চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যটা মিস করে যেতাম। হঠাৎ নিচের দিকে তাকাতেই ভড়কে যাই আমি। ভূপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার সাত’শ ফিট উপরে বারান্দাটা অবস্থিত হওয়ায় নিচের দিকে তাকালেই দেখা যায় গভীর খাত। হঠাৎ নিচের দিকে চোখ গেলে যে কেউ ভড়কে যাবে। যেমনটা আমি গিয়েছিলাম একটু আগে। আমি লম্বা এক সতেজ ভরা নিঃশ্বাস নিয়ে পিছে ঘুরে সামনে তাকাতেই থমকে যাই। চোখ স্থির হয়ে যায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ প্রায় হয়ে আসে। সামনেই রোয়েন আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকিয়ে আছে।মুখে গম্ভীরতা বিরাজমান। সদ্য গোসল করে আসায় চেহেরায় স্নিগ্ধ এক ভাব ছড়িয়ে আছে। চুলগুলো ভালোভাবে না মুছার কারণে কপালে সাথে লেপ্টে গিয়েছে। চুলগুলো থেকে চুয়ে চুয়ে পড়ছে পানি। রোদের সোনালি আলো তাঁর মুখে পড়তেই কপালে পাশে থাকা পানির কণাগুলো মুক্তার ন্যায় ঝলমল করে উঠছে। যা বরাবর আমার চোখে বিঁধছে। উনি কিছু না বলে আমার দিকে এগিয়ে আসে। তা দেখা মাত্র আমি সাথে সাথে এক কদম পিছিয়ে যাই। কিন্তু পিছনে রেলিং এর সাথে কোমড় ঠেকে যাওয়ায় আর পিছানো সম্ভব হলো না। এইদিকে রোয়েন একদম আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার কোমরের দুইপাশ দিয়ে কাঠের রেলিংয়ের উপর হাত রেখে আবদ্ধ করে ফেলে আমায় তার দুই হাতের মাঝে। তাঁর এই এহেন কাণ্ডে আমি ভড়কে যাই। আমতা আমতা সুরে বলি,

— কি হয়েছে?

উনি আমার মুখের পানে তাকিয়ে ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে বলেন,

— তখন যেন কি বলছিলে?

আমি অস্ফুটস্বরে বলি,

— কখন?

উনি আমার দিকে একটু ঝুঁকে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,

— কেন মনে নাই তোমার কখন?

আমি স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলে উঠি,

— ইয়ে মানে.. আছে। আসলে.. আমি তো শুধু…

উনি আমার দিকে আরেকটু ঝুঁকে আসতেই আমার কথাগুলো গলায় তব্দা মেরে বসে পড়ে। সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলি আমি। মুখ দিয়ে চেয়েও আর একটা শব্দ বের হলো না আমার। তাই চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমায় এইভাবে চুপ থাকতে দেখে তিনি বলেন,

— তুমি তো শুধু কি বলো?

আমি কোন মতে দম ফেলে বলি,

— কিছু না।

কথাটা বলে আমি পিছনের দিকে মাথাটা আরেকটু পিছিয়ে নিতেই আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। পিছনের দিকে ঝুঁকে পড়ার আগেই রোয়েন আমার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেন আর আমার মাথা গিয়ে ঠেকে তা বুকের বা পাশটায়। বেশ কিছুক্ষণ পর কানে প্রতিধ্বনিত হয় রোয়েনের হৃদস্পন্দনের ধুকধুকানি… ধুকধুক.. ধুকধুক। মুহূর্তেই আমার মনের মাঝে বয়ে যায় প্রশান্তির হাওয়া। স্থির হয়ে আসে আমার হৃদস্পন্দন। কোন এক ঘোরে চলে যাই আমি। চুপচাপ তার বুকে মাথা রেখে শুনতে থাকি সেই মধুর ধ্বনি। হঠাৎ তাঁর চুল বেয়ে আমার মুখের উপর এক ফোটা পানি এসে গড়িয়ে পড়তেই আমি নিজের মধ্যে ফিরে আসি। নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে দ্রুত সরে আসি তাঁর থেকে। তা দেখে রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলে,

— তোমাকে বিপদ টানে নাকি তুমি বিপদকে টানো বুঝি না। যখন তখন দেখি খালি বিপদেই পড়তে থাকো।

কথাটা শুনে আমি বিরবির করে বলে উঠি,

— আপনি আমার পাশে থাকলেই বিপদ আমায় ভালোবেসে ফেলে আর কাছে টেনে নেয়। এতে আমার দোষ কোথায়?

কথাটা রোয়েনের কান অব্দি গেলো কি-না বুঝা গেলো না। সে এই বিষয়ে আর কিছু না বলে গম্ভীর গলায় বলে উঠেন,

— যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।

আমি কোনমতে ‘হুম’ বলে দ্রুত পায়ে রুমের ভিতর ঢুকে যাই। এই ব্যাটা বিপদের চারশো বিশ নাম্বার সংকেত। এর থেকে যত দূরে থাকা যায় ততো উত্তম। কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব?

______________________

রাতের সাজেক যেন এক অন্যরকম ভালোলাগা। দিনের উজ্জ্বলতায় চারদিকে নীলাভ আভার ছড়াছড়ি তো রাতের আঁধারে অজস্র তারার হাতছানি। তারাগুলো জ্বলছে পিটপিটিয়ে। তাদেরই অভিভাবক হয়ে আকাশের ঠিক মধ্যভাগে পাহারা দিচ্ছে গোলাকার আকৃতির চাঁদটি। সেই সাথে তাঁর স্নিগ্ধ আলো চারদিকে ছড়িয়ে দিয়ে প্রাণবন্ত করে তুলছে নির্মল প্রকৃতিটিকে। আশপাশ থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার মিষ্টি ডাক। মাঝে মধ্যে কখনো শোনা যায় হুতুম পেঁচার ডাক তো কখনো শেয়ালের হাঁক। মাঝে মধ্যে ভেসে আসছে পাহাড়ের তীব্র আর্তনাদ। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় রাত নয়টা বাজতে না বাজতে মনে হয় যেন গভীর রাত। আদিবাসীরা এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলেও আমরা এখন সজাগ। এর মোক্ষম কারণ শহরের যান্ত্রিক জীবনের সাথে ক্ষাপ মানিয়ে চলার ফলার এই পাহাড়ি এলাকায় এসেও শরীর পড়ে রয়েছে সেই যান্ত্রিক জীবনের মাঝে। যার ফলে এই গভীর রাতের অশরীরী মায়াও আমাদের ঘুমের সাগরে ভাসাতে অক্ষম। সকলেই আমরা রিজোর্টের বাইরের বিস্তৃত সরু রাস্তার উপর হেটে চলেছি। কেউ কেউ টং ঘরে বসে চা খাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে তো কেউ এইখানের ফেমাস আইটেম বেম্বো চিকেন আর বেম্বো বিরিয়ানি নিয়ে মাতামাতি করছে। কেউ বা রাতের খাবার সেরে রুমে গিয়ে বিশ্রাম করার কল্পনা আটছে। আজ আমরা সকলেই ক্লান্ত বলে তেমন কোথাও ঘুরতে যাইনি। শুধু বিকেলের দিকে সকলেই মিলে রুইলুই গ্রামটা একটু ঘুরে এসেছিলাম। এরপর সকলেই মিলে জমিয়েছিল আড্ডার আসর।

আমি আর রোয়েন বসে আছি একটা রেঁস্তোরায়। মূলত বেম্বো চিকেন খাবো বলে। এইখানে বেম্বো চিকেন খেতে হলে ঘন্টা খানিক আগে অর্ডার দিতে হয় নাহলে এইটা খাওয়া ভাগ্যে জুটে না। তাই রোয়েন আগেই অর্ডার দিয়ে গিয়েছিল। তার হাবভাব দেখে যা বুঝলাম সে আগেও এইখানে এসেছে আর তিনি সবকিছুর সাথে অবগত। রেঁস্তোরাটা সুন্দর হওয়ায় আমি চারপাশের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আর রোয়েন ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার মোবাইল নিয়ে।

_________________

রাত প্রায় এগারোটার অধিক বাজে। চারদিকে ঘন অন্ধকার। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। হিম হিম ভাব ছড়িয়ে আছে চারদিকে। মাঝ রাস্তায় হাটছি আমি আর রোয়েন। চারিদিকে একদম পিনপতন নীরবতা। সকলেই এখন রিজোর্টে। হয়তো ইতিমধ্যে অনেকে ঘুমের রাজ্যেও চলে গিয়েছে। আমরাও রিজোর্টে ছিলাম কিন্তু মাঝে রোয়েন একটু বাহিরে এসে হাটাহাটি করবে বলে বেরুতে নিলে আমিও তাঁর পিছুপিছু এসে পড়ি। উপভোগ করতে রাতের এই শীতল পরিবেশটি। রাস্তার একধারে ঝোপঝাড় আর গাছের ঠাসাঠাসি তো আরেকদিকে বিরাট খাত আর বিস্তৃত আকাশ। কি এক মনোরম পরিবেশ। বলতে গেলে মন ভোলানো পরিবেশ। আমি আর রোয়েন পাশাপাশি হাটছি। কোন কথা নেই আমাদের মাঝে। অবশেষে আমি নিরবতা পেরিয়ে বলি,

— আপনি কি সবসময়ই এমন?

কথাটা রোয়েনের কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছাতেই সে থমকে দাঁড়ায় এবং আমার দিকে ভ্রুকুঞ্চন দৃষ্টিতে তাকায়। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

— কেমন?

আমি অকপটে জবাব দেই,

— এমন নির্জীব,ঘাড়ত্যাড়া, রোবট টাইপ? মানে মানুষ তো একটু হাসেও নাকি? সারাদিন এমন গম্ভীর হয়ে থাকে কিভাবে মানুষ?

উনি হিম কন্ঠে জবাব দেন,

— আমি এমনই।

আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— দেখুন ঘুরতে এসেছি আমরা। আপনি ব্যতীত আমি এইখানে কাউকে চিনিও না, জানিও না। সম্পূর্ণ একা আর নতুন আমি এইখানে। এখন আপনিই যদি এইভাবে একঘেয়ে হয়ে থাকেন, কথা না বলেন তাহলে কিভাবে হয়? ঘুরার জন্য হলেও একটা সঙ্গী দরকার হয়। যদি আপনি এমনই থাকেন তাহলে প্লিজ ফেরত চলুন। একা একা আর যাই হোক ঘোরা যায় না।

রোয়েন আমার কথা শুনে কতক্ষণ চুপ থেকে সামনের দিকে মুখ করে বলেন,

— আমি সহজেই যে কারো সাথে মিশতে পারি না। সময় লাগে আমার। সেই সাথে আমি কথা-বার্তা একটু কমই বলি।

আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলি,

— তা তো দেখতেই আছি। তা একটু কি ফ্রি হওয়া যায় না?

উনি এক হাত ট্রাউজারে ঢুকিয়ে অন্য হাত নিজের চুলের মাঝে গলিয়ে দেন। অতঃপর স্বগতোক্তি কন্ঠে বলেন,

— আরেকটু সামনের দিকে যাবে?

তাঁর এমন কথায় আমি ফুঁসে উঠে বলি,

— কথা ঘুরাচ্ছেন আপনি।

সে কিছু না বলে হাটা শুরু করে। আমি তার পিছে যেতে যেতে বলি,

— আপনাকে দেখলে আমার কি মনে হয় যানেন? ছ্যাঁকা খাওয়া বিরহ প্রেমিক। মানে দেবদাসকেও হার মানাবেন আপনি। আচ্ছা আসলেই ছ্যাঁকা ট্যাকা খেয়েছেন নাকি?

শেষের কথাটা কৌতুকের সুরেই বললাম। উনি কথাটা শুনে ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দেন,

— হ্যাঁ খেয়েছি।

#চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_20
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— আপনাকে দেখলে আমার কি মনে হয় যানেন? ছ্যাঁকা খাওয়া বিরহ প্রেমিক। মানে দেবদাসকেও হার মানাবেন আপনি। আচ্ছা আসলেই ছ্যাঁকা ট্যাকা খেয়েছেন নাকি?

শেষের কথাটা কৌতুকের সুরেই বললাম। কথাটা শুনে উনি ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দেন,

— হ্যাঁ খেয়েছি।

তাঁর এই এহেন স্বীকারোক্তি আমার কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছানো মাএ তা বজ্রপাতের ন্যায় প্রতিধ্বনিত হলো। পা যুগল স্থির হয়ে আসলো, চোখে মুখে ফুটে উঠলো অপার বিস্ময়। অধর দুইটির মাঝে সৃষ্টি হলো কিঞ্চিৎ দূরত্ব। বুকের বা পাশটা হুড়হুড় করে মুচড়ে উঠলো। বিষয়টা যে মোটেও আমার বোধগম্য ছিল না তা আমার চেহেরা দেখে সাফ বুঝা যাচ্ছে। আমি কথাটা নিচক ফাজলামো করে বলেছিলাম। এইটা যে বাস্তব হয়ে দাঁড়াবে তা মোটেও আশা করিনি। আমি স্তম্ভিত চাহনিতে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছু দূর যেতেই রোয়েন ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকালো৷ আমাকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো তার। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চার-পাঁচ কদম আমার দিকে এগিয়ে আসলো। শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

— কোন সমস্যা?

আমি কিছু না বলে আড়ষ্ট নয়নে তাঁর পানে তাকিয়ে থাকলাম। জোৎস্নার স্নিগ্ধ আলো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তাঁর উপর। সেই আলোয় তার মুখশ্রীর মুখভঙ্গি আমার নিকট স্পষ্ট। অতি ভাবলেশহীন তাঁর আকার ভঙ্গি। যেন কিছুই হয়নি। অথচ এইদিকে আমার মনের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে ঝড়। আমাকে এইভাবে চুপ থাকতে দেখে রোয়েন আবার বলে উঠলেন,

— কি হলো?

এইবার আমি নিজেকে একটু স্বাভাবিক করলাম। বিষয়টার সত্যতা যাচাই করার জন্য রোয়েনকে জিজ্ঞেস করলাম,

— আসলেই কি তা সত্যি?

আমার প্রশ্ন শোনার পর রোয়েনের ভ্রুকুটি আরও কুঞ্চিত হয়ে আসলো। তাঁর অদ্ভুত দুইটি নয়নে ফুটে উঠলো একটুখানি বিভ্রান্তি। যা আমার নিকট স্পষ্ট। উনি সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

— কোনটা সত্যি?

আমি অতি শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— ছ্যাঁকা খাওয়ার বিষয়টা?

কথাটা শোনার পর তার নয়নে বিদ্যমান বিভ্রান্তি দূর হলো। এক হয়ে আসা ভ্রুকুটি নিজ স্থানে ফিরে এলো৷ উনি শীতল চাহনি আমার উপর নিক্ষেপ করে পুনরায় স্বীকারোক্তি করলেন,

— হ্যাঁ।

তার স্বীকারোক্তিটি যেন আমার মধ্যে বিষন্নতা বয়ে আনে। বুকের কোন এক পাশে তীব্র ব্যথা অনুভব হলো। রোয়েন ছ্যাঁকা খেয়েছে, তাঁর আগে একটা রিলেশন ছিল, উনিও একদা কাউকে ভালোবাসতো কথাগুলো ভাবনার মাঝে আসতেই আমার মন বারংবার বিষিয়ে যাচ্ছে। আমার এমন অনুভূতি হওয়ার কারণ আমি জানি না। না আমি রোয়েনের প্রতি দূর্বল, না আমি তাঁকে ভালোবাসি। তাও আমার এমন অনুভূতি কেন হচ্ছে জানি না। শুধু জানি কোন এক চাপা কষ্ট আমায় তীব্রভাবে ঝাঁকড়ে ধরেছে। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্থির করলাম। নিজেই নিজেকে বুঝ দিতে থাকলাম যে, ” সবারই একটা পার্সোনাল লাইফ আছে, প্রাইভেসি আছে। সেই সাথে একটা অতীতও আছে। অতীতটা হতে পারে তিক্ত অথবা সিক্ত। কিন্তু এর উপরে একটা সত্য হলো সেটা অতীত। যার এখন কোন অস্তিত্ব নেই। যেটা এখন একমাত্র সত্য তা হচ্ছে বর্তমান। আর এইভাবেও এখনকার দিনে রিলেশন করাটা কমন বিষয়। তাই এইটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।”

কথাগুলো আমার মস্তিষ্ক বিচরণ করতেই আমি শান্ত হয়ে যাই। মুখে ঝুলিয়ে নেই সরু হাসির রেখা। হঠাৎ মনের মাঝে একটা প্রশ্ন আসতেই আমি রোয়েনের দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— যদি কিছু না মনে করেন তাহলে একটা প্রশ্ন করতে চাই। চিন্তা নেই আপনার ব্রেকাপের কারণ জিজ্ঞেস করবো না। আমি শুধু জানতে চাই, আপনি কি ব্রেকাপের পরই এমন হয়ে গিয়েছিলেন?

রোয়েন আমার কথা শুনে স্থির চোখে তাকায়। স্বাভাবিক গলায় বলেন,

— আরেহ না! আমি ছোট থেকেই এমন। বলতে পারো ছোট থেকেই ইন্ট্রোভার্ট বা অন্তর্মুখী। আর এর পিছে স্পেসিফিক কোন কারণ নেই৷ আর রইলো আমার ব্রেকাপের কথা। সেটা এমন কোন বিষয় নেই যে প্রশ্ন করা যাবে না বা নিষেধাজ্ঞা আছে।

আমি মিনমিনে গলায় বলি,

— তো বলুন।

রোয়েন দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— ভার্সিটিতে পড়াকালীন বছর খানিক প্রেম ছিল। পরে একটা সময় এসে সে তিক্ত হয়ে উঠে এবং আমাকে জানিয়ে দে সে আর রিলেশন রাখতে চায় না৷

আমি কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— কারণ?

— কারণ এইটাই আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আর আমার বাবা গ্রামের স্কুলের সাধারণ একজন হেডমাস্টার। আমার সাথে তার লাইফ সিকিউর না। এই সম্পর্কের কোন নিশ্চিয়তা নেই। সব শুনে আমিও আর সম্পর্কটা ধরে রাখিনি। ব্যাস! হয়ে গেলো ব্রেকাপ।

— আর খোঁজ করেন নি?

— দরকার বোধ করি নি। কিন্তু পরবর্তীতে এক কমন ফ্রেন্ডের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম যে,তার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে বিয়েও। বর প্রবাসী। অবস্থা ভালো। বিয়ের পর তাকেও বিদেশ নিয়ে যাবে। লাইফ একদম সেট। এইতো!

আমি বেশ কৌতহল নিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— বিয়েটা কি আদৌ হয়েছিল?

উনি ভাবলেশহীন ভাবে বলেন,

— শুনেছিলাম তো হয়েছিল। বাকি আর জানি না।

— অহ আচ্ছা।

এরপর নিরবতা। কথা নেই কারো মুখে। কেটে যায় কিছু প্রহর। জোৎস্নার আলো গলিয়ে পড়তে থাকে ভূপৃষ্ঠের বুকে। স্নিগ্ধ পরশে ভরিয়ে দিতে থাকে আমাদের৷ আমি তাকিয়ে আছি রোয়েনের দিকে আর উনি তাকিয়ে আছে আকাশের পানে। পরিবেশটা যেন স্বাভাবিক হয়েও অস্বাভাবিক। আমার খুব করে ইচ্ছে হলো তাকে জিজ্ঞেস করতে,

— সে কি আপনার আবেগ ছিল নাকি ভালোবাসা?

কিন্তু মনের সংশয় আর আড়ষ্টতার জন্য প্রশ্নটা আর করা হলো না। প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস হয়ে। রাতের অন্ধকার প্রগাঢ় হওয়ার সাথে সাথে হিম বায়ুর আনাগোনা বেড়ে যায়। যা ক্ষণেই গায়ের পশম দাঁড় করিয়ে দেয়। মৃদু কাঁপন ধরে যায় শরীরে। আমি গায়ের ওড়নাটা ভালো ভাবে জড়িয়ে নিয়ে নিজেকে একটু গুটিয়ে নিতেই রোয়েন বলে উঠেন,

— রাত হয়েছে অনেক। এখন ফিরা উচিৎ।

আমিও তার কথায় সাই জানালাম। পাশাপাশি দুইজনই রওনা দিলাম রিজোর্টের উদ্দেশ্যে। আমার শরীরের কাঁপনটা স্পষ্ট হয়ে আসতেই রোয়েন একটা টু শব্দও না করে তার গায়ের জ্যাকেটটা খুলে পিছন থেকে আমার গায়ে জড়িয়ে দেয়। এরপর নির্বোধ ভাবে হাটতে থাকে। ঘটনাক্রমে বুঝে উঠতেই আমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে স্নিগ্ধ হাসি। আমি গায়ে জ্যাকেটটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে আনমনে ভাবি,

— হোক না মানুষটি নিভৃতে গড়া, নির্মল প্রেমিক তো সে আমারই।

_______________________

চারদিকটা এখনো অন্ধকারে আছন্ন। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। হয়তো মিনিট পাঁচেকের মাঝেই রক্তিম এক গোলপিন্ডের দেখা মিলবে। হিম হিম ভাব চারদিকে। গোটা শহর এখনো কুয়াশায় ঘেরা। আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছি। বেশ কিছুক্ষণ পর এক পুরুষালী কন্ঠ এসে বারি খায়। কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। নিজের নাম শ্রবণ হতেই মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠে। সজাগ হই আমি। নিভু নিভু চোখে সামনে তাকাতেই বুঝতে পারি কেউ আমাকে মৃদু পরিমাণে ধাক্কাচ্ছে। সাথে সাথে আমার ঘুম উবে যায়। আমি উঠে বসি। সামনে তাকাতেই দেখি রোয়েন দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে তার গম্ভীরতা। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই তিনি স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠেন,

— তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো। বাইরে যাব আমরা।

আমি একবার কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। বালিশের পাশ থেকে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ঢুলুঢুলু পায়ে এগিয়ে গেলাম ওয়াশরুমের। ফ্রেশ হয়ে আসতে না আসতেই রোয়েন বলে উঠেন,

— গায়ে মোটা কিছু জড়িয়ে নাও। বেশ ঠান্ডা বাইরে।

আমি তার কথা মত গায়ে একটা শাল জড়িয়ে নেই। অতঃপর উনার সামনে আসতেই আমার হাতের কব্জি ধরে বাইরে নিয়ে আসে। বাইরে আসতেই দেখতে পাই চারদিক ঘন কুয়াশায় ঘেরা। কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না। এমনকি রোয়েনের পিছন দিকটাও আমার কাছে আবছা লাগছে। মাত্র আঁধার কাটছে। পুবাকাশে দেখা যাচ্ছে সরু আলোর রেখা। বুঝাই যাচ্ছে সূর্য উঠার সময় হয়ে গিয়েছে। হয়তো কয়েক প্রহর পেরুতেই গোল আকৃতির সূর্যটির দেখা মিলবে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর রোয়েন আমায় নিয়ে এক উঁচু জায়গায় এসে স্থির হয়। আমি তার দিকে কৌতহলী চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— আমরা এইখানে কেন এসেছি?

সে একটু নরম গলায় বলে,

— এখনই দেখতে পাবে। তুমি শুধু চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকো।

আমি তার কথা মত তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে। খানিক বাদেই দেখা গেল, দূর পাহাড়ের ঘেষে বেরিয়ে আসছে সূর্যের রক্তিম লালচে আভা। যা মুহূর্তেই প্রগাঢ় নীল আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে স্নিগ্ধতার ছোঁয়া। পাহাড় আর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য্যিমামা। সবুজের মাঝে লালাভ রক্তিম এক চাহনি। আমি মনোমুগ্ধ হয়ে দৃশ্যটা যখন দেখছি ঠিক তখনই রোয়েন আমার পিছে এসে দাঁড়ান। কিছু বুঝে উঠার আগেই উনি আমার সাথে ঘেষে দাঁড়ান এবং আমার ডান হাতটা চেপে ধরে উর্ধ্বে তা উপরে তুলে ধরেন। ঘটনাক্রমে আমি ভড়কে গেলেও হঠাৎ অনুভব করি শৈত্য কণার মত কিছু একটা আমার হাতের তর্জনী ছুঁয়ে যাচ্ছে। যা মুহূর্তেই গলে গিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমার হাতের তর্জনী আর তালু। সাথে সাথে আমি শিউরি উঠি। হাত সরিয়ে আনতে নিলে রোয়েন আমার কানের সামনে ফিসফিসিয়ে বলে,

— ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এইগুলো মেঘ।

কথাটা কর্ণপাত হতেই আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি শুধু সামনে। মুখের ভাষাই যেন হারিয়ে ফেলেছি। নিজের জ্ঞান শক্তি পর্যন্ত যেন লোপ পেয়ে বসে আছি। ঘোরের মধ্যে চলে যেতে থাকি আমি। মেঘদলের উপরে হাসছে সূর্য। রোদ ঠিকরে পড়ছে মেঘের গায়ে। এ যেন অপরুপ দৃশ্য। দ্বিতীয় বারের মত মেঘ আমার হাতের তর্জনী স্পর্শ করতেই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসি আমি। খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই। একের পর এক মেঘের গায়ে আঁচড় কেটে লিখতে থাকি আমার নাম। মোহনীয় দৃষ্টিতে দেখতে থাকি শুভ্র মেঘে রাঙ্গা পরিবেশ।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here