#নিভৃতে_যতনে
#Part_12,13
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
12
বাসায় এসে আগেই আমি ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ফ্রেশ হয়ে আমি এগিয়ে গেলাম ডাইনিং এর দিকে। পলি আন্টিকে ডেকে বললাম খাবার দিতে। পলি আন্টি এই বাসায় কাজ করে। সকালে আসে আর যায় একদম সন্ধ্যায়। ঘর গুছানো থেকে শুরু করে রান্না-বান্নার সকল কাজ তিনি একাই করে। পলি আন্টি আমায় খাবার দিয়ে যেতেই আমি তাকে জিজ্ঞেস করি,
— তুমি খেয়েছ?
সে পিকে রাঙ্গা লাল ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,
— হো আফা খাইসি।
— আচ্ছা।
কথাটা বলেই আমি খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে আমি রুমে এসে পড়ি। কলেজ ব্যাগটার দিকে নজর যেতেই আমি সেদিকে এগিয়ে যাই। ব্যাগের প্রথম সারির চেইনটা খুলে তার মধ্য থেকে আলতো হাতে একটা বক্স বের করি। বক্সটা হাতে নিয়ে সেটা খুলে দেখতে থাকি। বক্সে ভিতর একটি জেন্টস ওয়াচ। ঘড়িটা ব্ল্যাক চেইনের মধ্যে। ঘড়ির ভিতরে সংখ্যা গুলো কেমন একটু পেঁচানো ধরনের যা দেখতে বেশ আকর্ষণীয়। সেই সাথে এর উপর দিকটা একটু গ্লেজ দেয়। ঘড়িটা সাধারণ হলেও চোখে পড়ার মতন।
আমি ঘড়িটার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি দুপুরের কথা। ক্লাস শেষে সুরাইয়ার সাথে বসুন্ধরা যাই। বসুন্ধরা যেতেই সে ঢুকে পরে ঘড়ির দোকান গুলোর দিকে। আমিও ওর পিছু পিছু যাই। সুরাইয়া নিজের জন্য ঘড়ি দেখতে থাকে আর আমি পাশে দাঁড়িয়েই চারদিকে চোখ বুলাতে থাকি। তখনই এই ঘড়িটা নজর কাড়ে। আমি চটজলদি সেটা বের করে দেখাতে বলি। কি ভেবে জানি না কিন্তু ঘড়িটা আমি কিনে ফেলি। কিনার পর সুরাইয়া জিজ্ঞেস করে উঠে, “ঘড়িটা আমি কিনলাম কার জন্য? তাও আবার ছেলেদের ঘড়ি।” তখন কথাটা শুনে আমিও নিজেও থমথম খেয়ে যাই। নিজেও বুঝতে পারছিলাম না আসলে ঘড়িটা আমি কার জন্য কিনলাম? আমি সুরাইয়াকে কোন উত্তর না দিয়ে অতি সাবধানে কথা কাটিয়ে গেলাম।
কিছুক্ষণ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে নিরবে ঘড়িটা অতি যত্নে কাবার্ডে উঠিয়ে রাখলাম। অতঃপর বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই পারি দিলাম তন্দ্রার রাজ্যে।
_______________________
বিছানায় মুখ ভার করে বসে আছি। সামনেই রোয়েন দাঁড়িয়ে আছে আর আমার দিকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। ডান হাতেই তার আমার ম্যানেজমেন্টের খাতাটি। উনি গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
— ষাটের মধ্যে তোমাকে আমি এভারেজে কত পেতে বলেছিলাম?
আমি থমথম গলায় বলি,
— পঞ্চান্ন!
কথাটা বলে একটু বিরতি নেই। অতঃপর নিজের কন্ঠ একটু শক্ত করে বলি,
— তো কি হয়েছে? ষাটের মধ্যে পঞ্চান্ন না পেলেও তেপান্ন পেয়েছি। হুহ! তেপান্ন পাওয়া কি মুখের কথা নাকি?
সে আরও গম্ভীর হয়ে বললো,
— ষাটে ষাট পেতে তাহলে না মানতাম এইটা পাওয়া মুখের কথা না। কিন্তু পেয়েছ কত? তেপান্ন! ডু ইউ ইভেন নো, এই এক-দুই নাম্বারের জন্য কত পিছিয়ে পড়তে হয়? অনেকের তো সিলেকশনই হয় না। পাবলিক ভার্সিটি কোন হেলায় নেওয়ার জিনিস নয়।
— দোষ কিন্তু আমার না। আমি ভালো মতই পড়ালেখা করেছি। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এখন দুই কম আসলে আমি কি করবো?
— আরও হার্ড ওয়ার্ক করবে। যেখানে দুই ঘন্টা পড়ো সেখানে তিন ঘন্টা পড়বে। নিজের লাইফে ভালো কিছু করতে চাইলে এই কয়েকটা মাস কষ্ট করতেই হবে।
— বলা সহজ করা না।
— করাও সহজ। মনের জোর থাকলেই হয়। তোমার মধ্যে মনের জোর আছে কিন্তু তুমি তা হেলায় নাও। আর এইটার জন্যই তুমি পিছিয়ে যাও। মনে রাখবে, ইম্পসিবল বলে কিছু নেই। তুমি চাইলে সব করতে পারবে আর তুমি না চাইলে কিচ্ছু না। অল ডিপেন্ডস অন ইউ।
আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলি,
— আপনার না মোটিভিশন স্পিকার হওয়ার উচিৎ ছিল। কথায় কথায় খালি জ্ঞান দেন।
রোয়েন এইবার কাঠ কাঠ গলায় বলে,
— তুমি কথায় বুঝার মানুষ না। শাস্তি পেলেই ঠিক হবে। তা তোমার শাস্তি হচ্ছে তুমি এখনই আমাকে ৪টা আর্থিক অবস্থার বিবরনী করে দেখাবে। তাও ১ ঘন্টায়।
আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বলি,
— মাথা গেসে আপনার? ২ টাই একঘন্টায় করা যায় না সেখানে ৪ টা?
রোয়েন আমার কথা শুনে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে ট্রাউজারের পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে বলে,
— ওকে দ্যান! ম্যাথ যেহেতু করবে সেহেতু আরেকটা অপশন দেই। এক ঘন্টা এক পায়ে কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে৷ এখন হয় ম্যাথ করো না-হয় কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকো। নাও দ্যা চয়েস ইজ ইউরস।
আমি গাল ফুলিয়ে বলি,
— কোনটাই করবো না, হুহ!
রোয়েন এইবার ম্যানেজমেন্টের খাতাটা বিছানায় রেখে আমার দিকে ঝুঁকে আসে। এক হাত আমার পাশ দিয়ে রেখে মুখের সামনে চলে আসে। এরপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলেই,
— করতে তোমায় হবেই। বাই হুক ওর বাই কুক।
রোয়েন এত সামনে চলে আসতেই আমি থতমত খেয়ে যাই। নড়তেই যেন ভুলে যাই আমি। শ্বাসরুদ্ধ প্রায় অবস্থা আমার। হুট করেই হৃদয় আমার তার সর্বোচ্চ গতিতে চলাচল শুরু করে দেয়। এত জোরেই চলাচল শুরু করে যে এর প্রতিধ্বনি হয়তো রোয়েন নিজেও শুনতে পাবে৷ বার বার নাকে কেমন এক মিষ্টি সুবাস এসে বারি খাচ্ছে। বুঝতে দেরি নি এইটা রোয়েনের শরীর থেকেই আসছে। মাত্র শাওয়ার নিয়ে এসেছে বিধায় হয়তো সুবাসটা আসছে। সব মিলিয়ে আমার যায় যায় অবস্থা। আমি কোনমতে নিজেকে সামলে একটু পিছে গিয়ে বলি,
— পিঠে যে সমস্যা আছে তার প্রমাণ বার বার দিতে হবে না। সোজা হয়ে দাঁড়ান, করছি আমি ম্যাথ।
সে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে পাশে পড়ে থাকা তার মোবাইলটা উঠিয়ে নেয়। অতঃপর সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
— আমাকে নিয়ে এত না ভেবে পড়ায় মনোযোগ দাও। তোমার কাছে কিন্তু শুধু ১ ঘন্টাই টাইম আছে।
কথাটা বলেই তিনি যেন কাকে ফোন করলেন এরপর কথা বলার জন্য বারান্দায় চলে গেলেন। আমি সেদিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে উঠি,
— আসলেই ব্যাটা আস্ত খাটাশ। জীবনটা আমার ত্যানা ত্যানা করে দিলো।
_____________________
সাপ্তাহিক ছুটির দিন আজ। সকাল প্রায় এগারোটা ছুঁই ছুঁই। আমি এখনো বিছানায় গুটি মেরে শুয়ে আছি। সজাগই আমি কিন্তু তাও পেট জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ঠোঁট চেপে শুয়ে আছি। মেজাজ প্রচন্ড খারাপ। সবকিছুই আজ আমার অসহ্য লাগছে। এমনকি নিজেকেই নিজের অসহ্য লাগছে। মনের মধ্যে জাগছে দুনিয়ার সব আজগুবী বাসনা। ইচ্ছে করছে দুনিয়ায় দারি ধ্বংস করে দিতে৷ এই দুনিয়া ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যেতে। আবার মাঝে মধ্যে প্রচুর কান্না করতে ইচ্ছে করছে। মনে চাচ্ছে কান্না করে দুনিয়া ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু আফসোস কোনটার একটাও আমি করতে পাচ্ছি না। উফফ! অসহ্য।
মিনিট পাঁচেকের মাথায় রোয়েন রুমে আসে৷ আমাকে এইভাবে শুয়ে থাকতে তার ভ্রু যুগল এক হয়ে আসে৷ সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
— নাস্তা করলে না যে?
আমি নিজের চেহেরা বালিশে গুঁজে চাপা স্বরে জবাব দেই,
— ইচ্ছে নেই৷
সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
— তুমি ঠিক আছো?
কথাটা শুনার সাথে সাথে আমার যেন খুব কান্না পেল। আমি নিজেকে কোন মতে সামলে ঠোঁট উল্টিয়ে বলি,
— আছি!
সে দৃঢ় গলায় বলে,
— কোন প্রবলেম হলে বলতে পারো।
আমি নিজের মুখ বালিশে আরও গুঁজে নিয়ে মিনমিনে স্বরে বলি,
— পেট ব্যাথা।
রোয়েন আমার কন্ঠ শুনলো কিনা জানি না। কিন্তু সে চুপ করে রইলো৷ অতঃপর স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,
— আমি বাহিরে যাচ্ছি৷
কথাটা বলে সে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। তার যাওয়ার পর পরই আমার যেন খুব কান্না পেলো। হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করলো। কেন পেল জানি না। ক্ষণেকের মধ্যে আমি আবার রেগে যাই। তখন ইচ্ছে করলো রোয়েন নামক ব্যক্তিকে ধরে বেঁধে প্রচন্ড পিটাতে। কিন্তু কিছু না করতে পেরে বালিশ খামছে ধরলাম। চুপচাপ পড়ে রইলাম বিছানায়।
মিনিট দশকের মাঝে রোয়েন আবার রুমে আসে। তার অস্তিত্ব আমি বুঝতে পেরেও চুপ করে রই। কিছুক্ষণ পর মিষ্টি সুরে একটা ডাক কানে এসে বারি খায়।
— এই তুমি কি ঘুমে?
পরপর দুইবার একই প্রশ্ন প্রতিফলিত হওয়ার পর আমি জবাব দেই,
— উঁহু!
এইবার সে বলে উঠে,
— তাহলে একটু উঠো।
আমি তাও উঠলাম না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। কিন্তু বেশ কয়েকবার ডাক পড়ায় অবশেষে উঠতে হলো আমায়। আমি উঠেই তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠি,
— কি সমস্যা? এতবার ডাকছেন কেন?
সে আমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে একটা পলিথিনের প্যাকেট এগিয়ে দেয়। প্যাকেটটা দেখার সাথে সাথে আমার ভ্রু কুঁচকে আসে। আমি কিছুক্ষণ প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে থেকে রোয়েনের দিকে তাকাই। সে আমার চাহনি দেখে ভাবলেশহীন গলায় বলে,
— নাও।
আমি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুলে দেখি তাতে একটা কাগজে মুড়ানো জিনিস আছে আর কিছু চকলেট ও আইস্ক্রিম। সেই সাথে একটা পিন কিলারও আছে। এইগুলা দেখার সাথে সাথে আমার ভ্রু কুঁচকে আসে। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই পলি আন্টি হটব্যাগ নিয়ে রুমে আসে। অতঃপর রোয়েনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— বাবাজান এই লোন আপনার গরম পানি।
রোয়েন সেটা নিয়ে তাকে চলে যেতে বলে অতঃপর হটব্যাগটা বিছানার এক পাশে রেখে বলে,
— নিজের দরকার নিজের বুঝে নিতে হয়।
কথাটা বলে সে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আর আমি সেইদিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকি। আনমনেই ভেবে উঠি,
মানুষটা এমন অপ্রকাশিত কেন? তার কর্মকাণ্ড, কথাবার্তা সবই অপ্রকাশিত। যেন সে নিভৃতে গড়া। অতি যতনে, অতি নিরবে। যার সন্ধান মিলে শুধু তারই নীড়ে।
আমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে প্যাকেটটার দিকে তাকাই। তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ ঠোঁটের কোনে ফুটে এক চিলতে হাসি।
#চলবে
#নিভৃতে_যতনে
#Part_13
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
আকাশটা আজ ধূসর রাঙা। কালো ও ধূসর মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে উন্মুক্ত আকাশের বুকে। দক্ষিণ দিকে বইছে ঢেউ খেলানো বাতাস। বাতাসের মাঝেই ফুটে উঠেছে ধুলোবালির ঘূর্ণন রেখা। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাখিদের আতঙ্কিত কন্ঠ। সময়টা দুপুর হলেও বাইরে দেখে মনে হচ্ছে যেন গোধূলির লগ্ন ঘনিয়ে এসেছে। আমি দ্রুত বারান্দা থেকে কাপড় নিয়ে আসি অতঃপর বারান্দার থ্যাই গ্লাসটা লাগিয়ে দেই। বিছানা কাপড় রাখতে রাখতে দেখি ইতিমধ্যে হৃদিপু সকল জানালা বন্ধ করে ফেলেছে। আমি কাপড়গুলো বিছানার উপর রাখতে রাখতে হৃদিপুকে জিজ্ঞেস করি,
— পলি আন্টি কি চলে গিয়েছে?
হৃদিপু বিছানায় পা তুলে বসে বলে,
— হ্যাঁ মাত্র গেলো।
— সাথে ছাতা নিয়ে যেতে বলেছিলাম তাকে। নিয়েছিল কি?
— দেখলাম তো নিয়েছে।
আমি এক গাদা কাপড় হৃদিপুর কোলে ছুঁড়ে মেরে বলি,
— বসে আছো কেন? কাজ করো। কাজ ছাড়া কিন্তু এই ঘরে ভাত নাই।
হৃদিপু আমার মুখের উপর একটা জামা গোল করে ছুঁড়ে মেরে তীক্ষ্ণ গলায় বলে,
— ছোট বেলায় তোকে হাতে খায়িয়ে দিয়েছি এইদিন দেখার জন্য? আমার কষ্টের এই প্রতিদান দিলি তুই?
আমি ভ্রু কুঁচকে বলি,
— তো এর চেয়ে বেশি তুমি কি এক্সপেক্ট করো?
হৃদিপু আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উঠে আসে। তা দেখে আমি দ্রুত সরে যাই। হৃদিপু এইবার রুদ্ধ গলায় বলে,
— ইউ বেয়াদব মেয়ে! দাঁড়া বলছি। আজ তোর একদিন কি আমার চল্লিশ দিন৷
কথাটা বলেই হৃদিপু আমার দিকে তেড়ে আসতে নিলে আমি হৃদিপুকে জড়িয়ে ধরে বলি,
— ওলে ওলে আমার বইনাটা। কত রাগ করে।
হৃদিপু ফোঁসফোঁস করতে করতে বলে,
— ছাড় আমায়। ছাড়। হুহ! হুহ!
আমি হেসে বলি,
— ইশশ! ইশশ! কি রাগ। জ্বলে পুড়ে আইস্ক্রিম হয়ে গেলাম।
কথাটা বলেই ফিক করে হেসে দেই। আমার হাসি দেখে হৃদিপুও হেসে দেয়৷ অতঃপর সেও আমায় জড়িয়ে ধরে।
____________________
বাহিরে আজ ঝড় হচ্ছে। আষাঢ় মাসের ঝড়। চাপা এক হুংকার দিয়ে বাতাস বইছে। চারদিকে হিম শীতল এক ভাব। পরিবেশটা শীতল দেখে আমি আর হৃদিপু ঢুকে পড়লাম রান্নাঘরে। মূল উদ্দেশ্য ভুনা খিচুড়ি আর গরু মাংসের রেজালা রান্না করা। বৃষ্টি-বাদলের দিন আর বাঙ্গালীরা খিচুড়ি খাবে না?তা কি হয়! দুইজনে মিলে রান্না শেষ করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। রাতের খাবার খেতে এখনো দেরি তাই আমি মোবাইল নিয়ে খাটে বসলাম। এফবিতে লগইন করে নিউজফিড স্ক্রোল করতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর হৃদিপু আমার পাশে এসে জিজ্ঞেস করে,
— ভাইয়া কবে আসবে রে?
আমি মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলি,
— পরশু আসবে মনে হয়৷ কেন?
— না এইভাবেই।
আমি আর কিছু না বলে চুপ করে রই। আজ দুইদিন হতে চললো রোয়েন বাসায় নেই৷ অফিসিয়াল কিছু কাজ পড়ায় তাকে ঢাকার বাহিরে যেতে হয়েছে। আমার যেহেতু এক্সাম সেহেতু আমাকে নেওয়া সম্ভব ছিল না। আবার আমাকে একবারে একা রেখেও সে যেতে পারছিল না। তাই তিনি সব দিক বিবেচনা করে হৃদিপুকে এইখানে থাকার জন্য বলেন। হৃদিপুও আমার সাথে থাকতে আপত্তি করে নি।
হঠাৎ হৃদিপু বলে উঠে,
— সিয়া তুই কিন্তু ঠিক মত পড়ছিস না। এডমিশন টেস্টের জন্য কিন্তু হাতে বেশি টাইম নেই। পরের সপ্তাহেই হয়তো ডেট পড়বে। এখন সিরিয়াস না হলে কিন্তু ঢাবিতে চান্স পাবি না।
আমি ভাবলেশহীন গলায় বলি,
— নাই বা পেলাম। সমস্যা কি?,
হৃদিপু বিষ্ময়কর ভরা কন্ঠে বলে উঠে,
— লাইক সিরিয়াসলি? তুই বলছিস এই কথা? তোর না স্বপ্ন ছিল ঢাবিতে পড়ার? ইচ্ছে না ছিল আমার ক্যাম্পাসকে নিজের বলার? আমার সাথে ঢাবির প্রাঙ্গনে উন্মুক্ত পাখির মত ঘুরে বেড়ানোর?
আমি হৃদিপুর দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলি,
— সেসব ইচ্ছে যে অনেক আগেই মৃত ঘষিত হয়েছে। আর মৃত জিনিস কখনো জীবন্ত হয় না। হোক সেটা মানুষ বা ইচ্ছে। ভুলে গেছি আমি আমার সকল ইচ্ছে। এখন আর কোন ইচ্ছে কাজ করে না আমার ভিতর। পড়ালেখাও এখন বিরক্ত লাগে৷
হৃদিপু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
— যা তো একটা কলম আর সাদা কাগজ নিয়ে আয়।
আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি,
— কেন?
হৃদিপু একটু কঠোর সুরেই বলে,
— আনতে বলেছি আন। বেশি কথা কেন বলিস?
আমি আর কিছু না বলে মুখ ফুলিয়ে স্টাডি টেবিলের উপর থেকে একটা কলম আর কাগজ নিয়ে আসি। দুইটা তার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলি,
— নাও।
হৃদিপু আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
— তোর কাছে রাখ আর আমার সামনে বোস।
আমি হৃদিপুর কথা মতই তার সামনে বসি। হৃদিপু আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
— এইবার এই সাদা কাগজে একটা সোজা একটা দাগ টানতো।
কথাটা শুনার সাথে সাথে আমার ভ্রু যুগল একত্রিত হয়ে আসে। আমি কৌতূহলপূর্ণ চোখে তার দিকে তাকাই। হৃদিপু আমার দৃষ্টির মর্ম বুঝতে পেরে বলে,
— আহা কর না।
আমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে কাগজের মাঝে একটা দাগ টানি। এরপর হৃদিপুর দিকে তাকাতেই হৃদিপু আমায় বলে,
— এইবার এইটা মুছে ফেল।
কথাটা শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। বিষ্ময়কর চোখে তাকিয়ে রইলাম হৃদিপুর দিকে। অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,
— পাগল হয়েছ? কলমের কালি আবার মুছে কিভাবে?
হৃদিপু ভাবলেশহীন গলায় বলে,
— তাহলে বলছিস এই দাগটা মুছা যাবে না?
আমি অকপটে স্বীকার করি,
— না! এইটা ইম্পসিবল।
হৃদিপু আমার কথা শুনে মুচকি হেসে বলে,
— আমাদের ইচ্ছেগুলো ঠিক এই কলমের কালির মতই হয়। কালো,ঘন ও গভীর এক টান। যা একবার মনের ক্যানভাসে আঁচড়ে পড়লে মুছা বড় দায়। তুই যতই চেষ্টা কর সেই দাগটাকে তুলতে কিন্তু তুই পারবি না৷ সর্বদা এর ছাপ রয়েই যাবে। এর অস্তিত্বও রয়েই যাবে। ঠিক যেমন তুই এই কাগজের পাতা থেকে কলমের দাগ মুছতে পারবি না তেমনই নিজের ইচ্ছেগুলো ভুলতে পারবি না। সেগুলো সর্বদা তোর মনের মাঝেই থাকবে। হোক জীবন্ত অথবা মৃত। অস্তিত্ব কিন্তু রয়েই যাবে আর সেটা তুইও পদে পদে অনুভব করতে পারবি৷
আমি চাপা কন্ঠে বলি,
— কি বুঝাতে চাইছো?
— এইটা যে ইচ্ছাগুলো কখনো ভুলা যায় না। সেগুলো সর্বদাই আমার মনের মাঝে থাকে। শুধু একটা সুযোগ খুঁজে বেরিয়ে আসার। নিজেকে তুলে ধরার। আর তুই এখন সে সুযোগটা পাচ্ছিস। কিন্তু তা কাজে লাগাচ্ছিস না। লাইফ তোকে একটা সুযোগ দিচ্ছে ঘুরে দাঁড়ানোর। সুযোগটা কাজে লাগা। নিজেই একবার ভাব, আমাদের দেশে কতজন নারী পারে বিয়ের পর নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে? কয়টা শ্বশুরবাড়ি বা জামাই হয় এমন যারা কিনা তাদের বউদের পড়ালেখা করায়? ভাব!
আমি কিছু না বলে চুপ করে রই। মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করতে থাকে হৃদিপুর কথাগুলো। কথাগুলো বার বার আমাকে নতুন এক ভাবনা ভাবতে বাধ্য করছে। এইদিকে আমায় চুপ থাকতে দেখে হৃদিপু আবার বলে,
— ভাইয়া তোকে নিজ থেকে পড়াচ্ছে, তোকে সাপোর্ট করছে, তোকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে কিন্তু তাও তুই সেটা হেলায় নিচ্ছিস? নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস কর। যেমন আগে করতি। নতুন দমে, নতুন রুপে, নতুন উদ্যোগে নিজের ইচ্ছাগুলো জীবিত কর। তোর মনোবল কিন্তু অনেক স্ট্রোং। সেটা আপাতত এখন ঢাবির দিকে স্থির কর। আই নো ইউ ক্যান ডু ইট। গিভ এ চান্স টু ইউর সেল্ফ৷ প্লিজ! ভুলে যাস না তোকে নিজেকে প্রুভ করতে হবে আর এর শুরু কিন্তু এখন থেকেই।
হৃদিপুর কথাগুলো শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। নির্মল চোখে তাকিয়ে রই হৃদিপুর দিকে। মস্তিষ্কে চলতে থাকে হাজারো ভাবনা, হাজারো চিন্তা। মনে পড়ে অতীতগুলো। সেই ইচ্ছে, সেই মনোভাব গুলো। সকলের ব্যবহার গুলো। হঠাৎই আমার বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস। আমি কিছু না বলে শুধু আপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। ঠিক তখনই তপ্ত এক নোনাজলের ফোটা গড়িয়ে পড়ে চোখের কার্নিশ বেয়ে।
#চলবে