নিভৃতে_যতনে #Part_10,11

#নিভৃতে_যতনে
#Part_10,11
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
10

রাত প্রায় নয়টা ছুঁই ছুঁই৷ আমি বিছানায় গালে এক হাত দিয়ে বসে আছি৷ সামনে বই আর কতগুলো শিটের ছড়াছড়ি। এদের মাঝেই কলম, পেন্সিল ও রাবারের লুকোচুরি খেলা। পাশেই রোয়েন ল্যাপটপে কি যেন করছে। আমি একবার আড়চোখে রোয়েনকে দেখছি আরেকবার বইখাতা গুলোর দিকে। মাঝে মধ্যে দুই একটা বই নেড়ে চেড়ে দেখছি। কিন্তু বুঝতেই পারছি না পড়াটা শুরু করবো আসলে কোথা থেকে? যাই দেখছি সব নতুন লাগছে। এমনকি ডেবিট ক্রেডিটের বিষয়টাও নতুন লাগছে। ফিন্যান্সের সাধারণ সুদ আসলের সূত্র ও যেন এখন জাগাখিচুড়ি লাগছে। মনে হচ্ছে যেন এইগুলো আমি জীবনে চোখেই দেখিনি। করা তো দূরের কথা। এইগুলো এখন কিভাবে কভার আপ করবো? হাও?
মাঝে মাত্র ১ মাস গ্যাপ গিয়েছে আর এতেই আমার অবস্থা যাচ্ছে তা। অবশ্য এই এক মাসে আমার উপর দিয়ে কম ধকল যায়নি৷ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক চাপে ছিলাম, ডিপ্রেসড ছিলাম। তার উপর এই বিয়ে৷ এক কথায় এইসবের মাঝে পড়ালেখা আমার পিছনের জানালা দিয়ে পালিয়ে চান্দের দেশে চলে গিয়েছে কিন্তু এখন আমার কি হবে? এত মোটামোটা বই, শিট আমি আড়াই মাসের মধ্যে কিভাবে শেষ করবো? হাওওওও? হৃদিপুকে এখন উল্টিয়ে পিটাতে ইচ্ছে করছে। কে বলেছিল আমার এক কথাই বিকেলের দিকেই বইগুলো পাঠিয়ে দেওয়ার? বই যদি আজ না পাঠাতো তাহলে এটলিস্ট আজ এই খাটাশ ব্যাটা জোর করে আমায় পড়াতে বসাতে পারতো না৷ হুহ!

কথাগুলো ভেবেই আমার ভিতরের সকল দুঃখ উপচে পড়ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি ঠুস করে চোখ চিরে দুঃখ বেরুবো আর ঠাস করে গালে ছাপ বসাবে। কিন্তু এই প্রসেস চালু করার আগেই রোয়েন ফুল স্টোপ লাগিয়ে দিয়ে বলে,

— বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে বুঝি পড়া হয়ে যায়?

কথাটা শুনে আমি রোয়েনের দিকে তাকাই। দাঁতে দাঁত চেপে বলি,

— আমি বলেছি পড়া হয়ে যায়?

রোয়েন আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— তাহলে এইভাবে উল্লুকের মত বইগুলোর দিকে তাকিয়ে আছো কেন? পড়া শুরু করো।

শেষের কথাটা তিনি আদেশের সুরেই বললেন। আমি রোয়েনের কথা শুনে ব্যঙ্গ করে বলি,

— পড়া শুরু করো! বললেই হয় নাকি? আরেহ ভাই আমার আগে তো বুঝতে হবে কোথা থেকে শুরু করবো।

উনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

— আমি তোমার ভাই লাগি?

আমি একটু ভেবে বলি,

— হ্যাঁ লাগেন এই তো। জামাই ভাই!

কথাটা শুনে রোয়েনের ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে আসে৷ সে একটু গম্ভীর গলায় বলে,

— হোয়াট রাবিশ! জামাই ভাই কি আবার?

আমি আমতা আমতা করে বলি,

— সংজ্ঞা আপাতত জানি না। জেনে বলবো নে।

রোয়েন এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,

— জেনে আমাকে উদ্ধার করিও৷ এখন পড়া শুরু করো।

আমি মুখ ফুলিয়ে আগে ফিন্যান্স বইটা হাতে নিলাম। তা দেখে রোয়েন বলে,

— আগে সহজ কোন সাবজেক্ট থেকে পড়া শুরু করো। লাইক বাংলা, ইংরেজি ওর ম্যানেজমেন্ট।

আমি উনার দিকে সুরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— কোন খুশিতে?

উনি নিজের ল্যাপটপে দিকে মনোযোগ দিয়ে বলেন,

— প্রথমেই সহজ কোন সাবজেক্ট দিয়ে পড়া শুরু করতে হয়। এতে ব্রেনে চাপ কম সৃষ্টি হয় আর সহজেই পড়া মনে রাখতে পারে। সেই সাথে মনোযোগ ও সৃষ্টি হয়৷ যার ফলে পরবর্তীতে হার্ড সাবজেক্টগুলো বুঝতে বেগ পেতে হয় না। ডাফার! না সরি তুমি তো আবার বুঁচি।

আমি নাক ফুলিয়ে হুট করে উনার নাক টেনে ধরে বলি,

— আরেকবার যদি বুঁচি বলেছেন না আপনার নাক আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। আমি মোটেও বুঁচি না। হুহ!

আমার এই এহেন কান্ডে রোয়েন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। উনি আমার দিকে গোলগোল চোখে তাকায়। অতঃপর এক ঝাটকায় আমার হাত সরিয়ে টান দিয়ে আমায় একদম তার কাছে নিয়ে যান। অতঃপর শীতল কন্ঠে বলেন,

— তোমার সাহস কিভাবে হয় আমার নাক ধরার? আর বুঁচিকে বুঁচি বলবো না তো কি বলবো ডাইনি?

প্রথমে তার এত কাছে চলে আসায় আমি ভড়কে যাই। তার থেকে সরে আসার চেষ্টা করি কিন্তু পরক্ষণেই তার কথা শুনে আমি কটমট চোখে তাকাই। কাঠ কাঠ গলায় বলি,

— আমার নাক বুঁচা না বুঝলেন। একদম কিউট একটা নাক আমার। একে অপমান করার কোন অধিকার নাই আপনার।

আমার কথা শুনে রোনের ঠোঁটের এক কোনে সুরু এক হাসির রেখা ফুটে উঠে৷ উনি আমার মুখের দিকে একটু ঝুঁকে বলে,

— তাই নাকি?

উনি আমার এত কাছে চলে আসায় আমি ভড়কে যাই। সেই সাথে মুহূর্তেই আমার বুক কিঞ্চিৎ ধক করে উঠে। প্রায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা আমার। নয়ন দুইটি চঞ্চল হয়ে আসে আর ঠোঁট ও গলা শুকিয়ে আসে। আমি কোন মতে জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট যুগল ভিজিয়ে নিয়ে আমতা আমতা করে বলি,

— হু..ম! এ..খন স..ড়ু…ন প্লি..জ!

কথাটা বলেই আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। চোখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম তার নয়ন দু’টি মাধুর্য বেশ গভীর। কিছু তো একটা আছে এই নয়ন যুগলের মাঝে। যা আমাকে গভীর ভাবে এক ঘোরের মাঝে ফেলে দিচ্ছে। আগে জানতাম মেয়েদের চোখ নাকি সর্বনাশী চোখ হয়৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ছেলেদের চোখও সর্বনাশী হয়। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের লিখা গানের দুটো’ লাইন মস্তিষ্কে টনক নেড়ে উঠে,

” প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস—
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”

আমার তার প্রতি এমন চাহনি দেখে উনার ভ্রু কুটি কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে আসে। উনি আমার নাক টেনে দিতেই আমি ঘোর থেকে বেরিয়ে আসি আর আমি তার থেকে ছিটকে দূরে এসে পড়ি। রোয়েন নিজের কাজের দিকে মন দিয়ে বলে,

— পড়া শুরু করো মিস বুঁচি।

কথাটা শুনে রাগ হলেও আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ ম্যানেজমেন্ট বইটা নিয়ে জোড়ে জোড়ে পড়া শুরু করলাম। মূল উদ্দেশ্য রোয়েনকে জ্বালানো। মায়ের কাছে শুনিছি তিনি নাকি কাজের সময় শব্দ পছন্দ করেন না। তো আমি সেই সুযোগের সৎ ব্যবহার করছি। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অতিক্রম হওয়ার পরও যখন রোয়েনের কোন প্রতিক্রিয়া পেলাম না তখন পাশে ঘুরে দেখি খাটাশ মহাশয় কানে হেডফোন লাগিয়ে কাজ করছে। সেটা দেখার সাথে সাথে আমি নিজের কপালে চাপড় মেরে বিরবির করে বলি,

— ভুলে যাস কেন এই ব্যাটা একটা আস্ত খাটাশ। একে সায়েস্তা করা এত সোজা না।

কথাটা বলে পাশে তাকিয়ে দেখি রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখ ‘প’ টাইপ উচ্চারণ করতেই নিবে তার আগেই আমি বলি,

— উফফ! পড়ছি তো ভাই। এতবার বলা লাগে?

কথাটা বলে বইয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। এমন একভাব করলাম যে, এখনই আমি টুপ করে বইয়ের ভিতর ঢুকে যাব।

_____________________

সকালে আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছি এমন সময় রোয়েন তাড়া দিয়ে বলে,

— সময় কি তোমার জন্য বসে থাকে?

আমি আয়নার মধ্য দিয়েই রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলি,

— মানে?

— কয়টা বাজে খেয়াল আছে? ১০ টায় ক্লাস তোমার আর এইখানে অলরেডি নয়টা বাজে। রাস্তায় যে কি পরিমাণ জ্যাম থাকে সেইদিকে খেয়াল আছে?

আমি নাক ফুলিয়ে বলি,

— হয়েই গিয়েছে।

কথাটা বলে মিনিট পাঁচেকের মাঝেই ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে একবারে পরিপাটি হয়ে গেলাম। রোয়েন আমার দিকে একবার তাকিয়ে বাইরে বের হয়ে যায়৷ আমিও তার পিছু পিছু বেরিয়ে আসি। বাবা-মাকে বলে রওনা দিয়ে দেই।

পার্কিং এরিয়াতে এসে দাঁড়াতেই দেখি রোয়েন কোথাও যেন চলে যায়। অতঃপর মিনিট দুয়েকের মাঝেই উনি এক বাইক নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়৷ বাইক দেখে আমি তার দিকে বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাই। অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,

— এইটা কোথা থেকে টপকালো?

রোয়েন হাতে থাকা দুইটা হেলমেট খুলতে খুলতে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়৷ শীতল কন্ঠে বলেন,

— মানে?

— বাইকটা কার?

উনি বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলে,

— চালাচ্ছি যেহেতু আমি সেহেতু কার হওয়ার কথা এইটা?

আমি তার উত্তর শুনে থমথম খেয়ে বলি,

— আপনারই। কিন্তু এতদিন দেখলাম না যে?

— সার্ভিসিং এ ছিল।

হঠাৎ মুখ ফোসকে বেরিয়ে আসে,

— কিন্তু আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার মত খাটাশের বাইকও থাকতে পারে।

কথাটা বলেই আমি অস্বস্তিতে পরে যাই। নয়ন দুটি আমার চঞ্চল ভঙ্গিতে এইদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এইদিকে রোয়েনের আমার দিকে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। অতঃপর আমার দিকে একটা হেলমেট এগিয়ে দিয়ে বলে,

— উঠো!

রোয়েনের কথা শুনে আমি আরেক দফা বিপাকে পড়ে যাই। কেন না এর আগে আমি বাইকে উঠি নি। কিভাবে উঠে তাও জানি না। আমি তাকে ইতস্তত সুরে বলি,

— আমি বাইকে উঠতে পারি না।

সে আমার কথা শুনে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণের মত করে উঠে। অতঃপর এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,

— তা পারবে কেন? পারো তো খালি আমার মাথা খেতে। ডিসগাস্টিং!

কথাটা বলেই তিনি আমায় আগে হেলমেট পড়তে বললেন এবং বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে উঠতে হবে৷ আমিও তার কথা মত হেলমেট পড়ে উঠে পড়ি বাইকে। সেই সাথে রোয়েনের কোমড়ের দিকে শার্ট আঁকড়ে ধরি। রোয়েন একবার কিছু বলতে গিয়ে বললো না। চুপচাপ বাইক স্টার্ট দিয়ে দিল।

_________________________

দেখতেই দেখতে চার দিন কেটে যায়। আজ বাবা-মা দেশের বাড়ি চলে গিয়েছেন। বেশ খারাপই লাগছে। কেন না এই কয়েকদিনে তাদের সাথে অনেক ভালো এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার। যে ভালবাসাটা আমি ওই বাসায় পায়নি তা তাদের কাছে পাচ্ছিলাম। বাবার ভালোবাসাটাও আমি পেয়েছে শ্বশুর নামক বাবাটির কাছ থেকে। এক মায়ের ভালোবাসা তো পেয়েছিলামই এইখানে এসে দ্বিতীয় মায়েরও ভালোবাসা পেয়েছিলাম। বলতে গেলে দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম তাদের উপর। এখন তাদের চলে যাওয়ায় বুকের ভিতর চাপা এক কষ্ট অনুভব হচ্ছে। কিন্তু তা মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারছি না।

পড়ন্ত বিকেলের সময়। আকাশ আজ সমুদ্রের নীলের মত স্বচ্ছ। সেই স্বচ্ছ আকাশের বুকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে তুলোর মত পেঁজো পেঁজো মেঘ। রোয়েনদের বাসা রাস্তার ধারে না হওয়ায় পরিবেশটা বেশ নিরব। বারান্দার কার্নিশের উপর বসে এক জোড়া চড়ুই পাখি সুরে তুলতে বিভোর। আমি বারান্দার এক কিনারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি বাইরে। উদ্দেশ্য প্রকৃতির মাঝে থেকে নিজের মনের বিষন্নতা দূর করার। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে একটা ফ্রেশ মুড নিয়ে রুমে চলে আসি। রুমে এসে মোবাইল নিয়ে গেম খেলতে বসে পড়ি। মিনিট দশেক যেতে না যেতেই রোয়েন হাতে একটা কাগজ নিয়ে রুমে ভিতর প্রবেশ করে। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এরপর অতি গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,

— হোয়াট ইজ অল দিস সিয়াশা?

#চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_11
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— হোয়াট ইজ অল দিস সিয়াশা?

কথাটা শুনার সাথে সাথে আমি ভড়কে যাই। অস্ফুট দৃষ্টিতে রোয়েনের দিকে তাকাই। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ দেখে আমি আমতা আমতা সুরে বলি,

— মানে কি?

রোয়েন আমার কোলে একটা কাগজ ছুঁড়ে মেরে বলে,

— এইটা কি?

আমি রোয়েনের দিকে একবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে কাগজটা হাতে নেই। ভাঁজ খুলেই বুঝতে পারি যে এইটা আসলে আমার একাউন্টিং এক্সামের খাতা। খাতার বা দিকটায় মোটা লাল কালি দিয়ে ২০/৬০ লিখাটা যেন জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠেছে। প্রেপারেশন ভালো ছিল না বিধায় এই রেজাল্ট। আমি খাতাটা দেখার পর কিঞ্চিৎ রোয়েনের দিকে তাকাই। ঠোঁটের কোনে সুরু এক হাসির রেখা ফুটানোর বৃথা চেষ্টা করে অস্ফুট স্বরে বলি,

— একাউন্টিং এর খাতা।

রোয়েন এইবার রুদ্ধদ্বার কন্ঠে বলে উঠে,

— কত পেয়েছ একবার দেখেছ? ষাটের মধ্যে মাত্র বিশ। এইটা কোন নাম্বার হলো? এই নাম্বার নিয়ে তুমি পাবলিক ভার্সিটিতে এক্সাম দিবে? লাইক সিরিয়াসলি?

আমি থমথম গলায় বলি,

— ইয়ে মানে..

উনি তার অগ্নি দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে বলেন,

— ডু ইউ ইভেন নো? পাবলিক ভার্সিটির এভারেজ নাম্বারও কত? জাস্ট এক নাম্বারের জন্য মানুষ শত জনের পিছে পড়ে যায়, চান্স পায় না। আর তুমি তো এখনো কোটি মাইল দূরে।

আমি মিনমিনে গলায় বলি,

— তো কি করবো?

আমার এই কথায় যেন রোয়েন আরও রেগে যায়। সে রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠে,

— কি করবে মানে কি? ইউ হ্যাভ টু ওয়ার্ক মোর হার্ড। কোচিং এর সব এক্সামে এভারেজে হলেও ষাটের মধ্যে পঞ্চান্ন উঠাতে হবে।

কথাটা শুনার সাথে সাথে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি গোলগোল চোখে তাকিয়ে রই। এই ব্যাটা কি পাগল? ষাটের মধ্যে পঞ্চান্ন? কেমনে কি ভাই? ওভার ডেট কিছু খেয়ে কথা বলছে নাকি? আমি অস্ফুটে সুরে বলে উঠি,

— ষাটের মধ্যে মানুষ পঞ্চান্ন কিভাবে পায়? হাও? আমি জীবনেও পারবো না।

— তুমি পারবে মানে সাথে তোমার ঘাড়ও পারবে। আর যদি তা না পেরেছ তোমার খাওয়া-দাওয়া সব অফ।

রোয়েনের কথা শুনার সাথে সাথে আমার ঠোঁট যুগলের মাঝে কিঞ্চিৎ দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। আমি অস্ফুটে স্বরে বলে উঠি,

— এইটা তো শিশু নির্যাতন।

কথাটা শুনে রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— এইখানে শিশু কে?

আমি কিঞ্চিৎ বলে উঠি,

— কেন আমি!

কথা বলে আমি নিজেই ব্যাক্কল বনে গেলাম। বোকা চোখে তাকিয়ে রইলাম রোয়েনের দিকে। আমি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে উঠে। এই প্রথম আমি রোয়েনকে হাসতে দেখছি। এর আগে কখনো তাকে হাসতে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না আমার। হাসার ফলে তার দুই ধারে থাকা গেজ দাঁত ফুটে উঠেছে। গেজ দাঁত দুইটি একদম ভ্যাম্পায়ারের দাঁতের মত। উঁচু, ধারালো আর সুক্ষ্ম। হাসিরটার প্রাণ হিসাবে যেন সেই গেজ দাঁত গুলো পালন করছে। কথাটা না বললেই নয়, তাকে হাসলে কিন্তু মারাত্মক লাগে।
আমি স্নিগ্ধ চোখে তার হাসির দিকে তাকিয়ে আছি। সে হেসেই আমাকে বলে,

— তুমি শিশু? লাইক সিরিয়াসলি? তা শিশুদের বুঝি বিয়ে হয়?

উনার কথা শুনে আমি ভড়কে যাই। আমতা আমতা করে বলি,

— ইয়ে মানে.. শিশুর জায়গায় নারী হবে। আর এইভাবেও শিশু হোক আর নারী হোক নির্যাতন তো নির্যাতন এই৷ হুহ!

রোয়েন হালকা হেসে বলে,

— তা নির্যাতনটা তকমাটা যখন লেগেই গিয়েছে তাহলে সেটার সৎ ব্যবহার করা যাক কি বলো?

আমি পুনরায় ভড়কে গিয়ে বলি,

— মানে?

উনি সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পকেটে নিজের দুই হাত গুঁজে বলে,

— এখন থেকে আমি তোমায় পড়াবো প্লাস তুমি পড়া না পারলে শাস্তিও দিব।

কথাটা শুনে আমার ঠোঁট যুগল আপন শক্তিতে নিজের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে নেয়। অস্ফুট স্বরে বলে উঠি,

— অ্যাহ!

রোয়েন কিছু না বলে চুপচাপ নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়। আমি চটজলদি বলে উঠি,

— আপনি না সায়েন্সের স্টুডেন্ট? আমাকে কিভাবে পড়াবেন? আপনি তো কমার্সের পড়া জানেন এই না।

সে ভ্রু কুঁচকে বলে,

— কে বলেছে আমি সায়েন্সের স্টুডেন্ট?

আমি মিনমিনে গলায় বলি,

— তো কমার্স নিয়ে পড়তে বলেছিল কে? সায়েন্স বা আর্টস নিয়ে পড়লে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?

— হ্যাঁ যেত।

আমি তীক্ষ্ণ গলায় বলি,

— আমি পড়বো না আপনার কাছে।

— লেটস সি৷

কথাটা বলেই তিনি রুম থেকে বেরিয়ে যান। আর নিজের কাপালে চাঁপড় মেরে বলি,

— এই ছিল তোর কপালে বুঝলি সিয়াশা। খাটাশ জামাই তো জামাই, এখন খাটাশ টিউটারও সে। হায় কপাল!

____________________________

রাত প্রায় আটটা ছুঁইছুঁই। আমি রুমের মধ্য ভাগে এক পায়ে কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আপ্রাণ চেষ্টা করছি নিজেকে ব্যালেন্স করার। কিন্তু তেমন ব্যালেন্স রাখতে পারছি না। রাখতে পারবো কিভাবে? জীবনে এইভাবে কানে ধরেছি নাকি? আজ জীবনে প্রথম এই খাটাশ ব্যাটাটার জন্য ধরতে হচ্ছে। তাও সাধারণ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি বলে। তাও প্রশ্ন কি ছিল? “স্বতন্ত্র অংশীদারী আইন পাশ হয় কত সালে?” আরেহ ভাই এর থেকে কত ইমপোর্টেন্ট ইমপোর্টেন্ট সাল আছে তাই মনে রাখা যায় না। সেখানে এইটা মনে রাখি কিভাবে? কিন্তু এই খাটাশকে তা কে বুঝায়? আমি রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে আর আমার বইয়ে কি যেন আঁকিবুঁকি করছে। তা দেখে আমি অস্ফুট স্বরে বলে উঠি,

— আর কতক্ষণ? পা ভেঙ্গে যাচ্ছে আমার৷

সে ভাবলেশহীন গলায় বলে উঠে,

— যতক্ষণ না তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ।

আমি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলি,

— জানি না তো। আর তার উপর এইটা এত ইমপোর্টেন্ট ও না যে মনে রাখতেই হবে।

আমার কথা শুনে সে কিঞ্চিৎ আমার দিকে চায়। অতঃপর গম্ভীর গলায় বলে,

— ছোট ছোট ধূলিকণা থেকেই কিন্তু এক স্তুপ সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে টিলা এরপর ধীরে ধীরে পাহাড়। তাই কখনো ছোট খাটো জিনিস কে অবহেলা করতে নেই। তাদের কে কম ইমপোর্টেন্ট বুঝতে নেই। বুঝেছ?

আমি গাল ফুলিয়ে মাথায় দুলাই। কিন্তু মনে মনে ঠিকই তার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলি৷ সে মিনিট দুয়েক পর আমাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বলেন এবং তার হাতের বইটা আমার হাতে দিয়ে বলে,

— নাও এখন এইটা পড়ো আর আমি যে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম সেটার উত্তর ও খুঁজে বের করো। না পারলে এরপরের বার পানিসমেন্ট ডাবল হবে।

আমি কিছু না বলে চুপচাপ বইটা নিয়ে মন দিয়ে পড়া শুরু করে দেই৷ কেন না এতক্ষণে আমি তাকে চিনে গিয়েছি। শাস্তি যেহেতু ডাবল দিবে বলেছে তার মানে দিবেই আর আমাকে নাস্তানাবুদ করেই ছাড়বে। স্বাদে কি খাটাশ বলি? হুহ!

___________________________

দেখতেই দেখতে এক সপ্তাহ চলে গেল। রোয়েনের ছুটিও ফুরিয়ে আসলো। তিন-চারদিন হতে চললো সে পুনরায় অফিসে নিয়োজিত হয়েছে। সকালে আমাকে কোচিং এ নামিয়ে দিয়ে সে অফিসে চলে যায়। বাকি আসার সময় আমায় একাই আসতে হয়। একা আসতে হয় বললে ভুল হবে, আসার সময় আমি এক সঙ্গী পেয়েছি৷ নাম তার সুরাইয়া। আমার সাথেই পড়ে এবং আমাদের এলাকাতেই থাকে। আমি থাকি ধানমন্ডি ‘নাইন এ’ নাম্বার রোডে আর ও থাকে পনেরো নাম্বার রোডে। তাই যাতায়াতে তেমন আর সমস্যা হয় না।
প্রথম দিকে ভেবেছিলাম খাটাশটা অফিসে গেলে হয়তো বা আমাকে আর পড়াতে পারবে না। তার হাত থেকে নিস্তার পাবো। কিন্তু সে যে গুড়ের বালি। তার অফিস টাইম শেষ হয় ছয়টা। সাতটা কি সাড়ে সাতটায় সে বাসায় এসে হাজির। এরপর ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে রাত নয়টা শুরু হয় আমার ক্লাস। যা চলে রাত এগারোটা অব্দি। এরপর পরেরদিনের জন্য এক গাদা পড়া ঝুলিয়ে দেয় গলায়৷ সেই সাথে পড়া না পড়লে শাস্তি তো আছেই। মানে সে না থাকলে আমায় পড়তেই হয়। পড়া থেকে আর নিস্তার নেই আমার।

কিছু দিন আগেই ম্যানেজমেন্টের উপর ষাট মার্কের পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তারই রেজাল্ট দিয়েছে আজ। ষাটের মধ্যে তিপ্পান্ন পেয়েছি। সেই সাথে এই পরীক্ষায় হায়েস্ট নাম্বারও আমি এনেছি। ভাবা যায়? সবই হচ্ছে মিস্টার খাটাশ ব্যাটার কামাল। যে হাড় খাটুনি আমাকে দিয়ে করাচ্ছে এমন নাম্বার পাবো না তো কি পাবো? ইতিমধ্যে ক্লাসে বেশির ভাগ সকলেই আমাকে নিয়ে টুকিটাকি কথা বলতে ব্যস্ত। বিষয়টা বেশ ভালোই লাগছিল। টপার টপার ফিলিং আসছিল৷ হিহিহি!
ক্লাস শেষে আমি নিজের ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে আসতে নেই তখন সুরাইয়া এসে বলে,

— ট্রিট দে।

আমি ভ্রু কুঁচকে বলি,।

— কোন খুশিতে?

সুরাইয়া দাঁত কেলিয়ে বলে,

— বাহ রে! এত ভালো রেজাল্ট করেছিস ট্রিট দিবি না? ট্রিট না দেওয়া পর্যন্ত আজ তোকে ছাড়ছি না। হুহ!

আমি এক গাল হেসে বলি,

— আচ্ছা যা এক প্লেট ফুচকা খাওয়াবো নে।

সুরাইয়া হালকা হেসে বলে,

— ওকে ডান! বাট আগে বসুন্ধরা যাব একটু। আমার কিছু কিনার আছে।

— আচ্ছা। চল এইবার।

কথা শেষ হতেই দুইজনে বেরিয়ে পড়লাম বসুন্ধরার উদ্দেশ্যে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here