নিভৃতে_যতনে #Part_08,09

#নিভৃতে_যতনে
#Part_08,09
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
08

গোধূলির লগ্ন। পশ্চিম আকাশের বুকে হেলে পড়েছে সূয্যিমামা। আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে রক্ত জবার রক্তিম আভা। কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘের মাঝে কোথাও নীল, কোথাও বা হলুদ রঙের লুকোচুরি খেলা। ঝিরিঝিরি বাতাসে জানালার পর্দাগুলো দুলছেন। বিছানার পাশে জানালাটা হওয়া সুবাদে বাতাসের স্নিগ্ধ পরশ ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ জুড়ে। আমি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছি আর লবণ মরিচ দিয়ে মাখা কাঁচা আম চিবুচ্ছি। মাঝে মধ্যে আড়চোখে বারান্দার দিকে তাকাচ্ছি আর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় গুনছি। পাক্কা এক ঘন্টা দুই মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড পর হৃদিপু নিজের ফোনালাপ থুরি প্রেমালাপ শেষ করে রুমের ভিতরে আসে। হৃদিপুকে রুমে আসতে দেখে আমি ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে সুর টেনে বলি,

— অহহহ হোওওওওও!!

আমি এমন শব্দ করতেই হৃদিপু আমার দিকে সুরু দৃষ্টিতে তাকায়। অতঃপর বলে,

— কি?

আমি কাঁচা আম চিবুতে চিবুতে বলি,

— আহা এত প্রেম! আগে জানতাম না তো। আচ্ছা, বাসার সবাই কি জানে তাদের অতি ভদ্র মেয়ে তলে তলে টেম্পো চালাচ্ছে?

হৃদিপু সাথে সাথে বলে উঠে,

— আস্তাগফিরুল্লাহ! আমাকে জুতা,ঝাড়ু নিয়া দৌড়ানি মারবে।

আমি নিজের মধ্যে দুঃখী দুঃখী ভাব এনে বলি,

— আজ তোমায় দেখে মনে হচ্ছে জীবনে করলামটা কি? আসলেই আমি আজ প্রমাণ পেলাম, কচ্ছপের দৌড় বহুত দূর।

হৃদিপু আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

— মানে?

আমি সোজা হয়ে বসে বলি,

— মানে হচ্ছে ছোট থেকেই আমি চঞ্চল আর তুমি শান্ত। একদম খরগোশ আর কচ্ছপের ঝুটি আমাদের। তো সেই হিসাবে প্রেম করার কথা আমার আর বিয়ে বসার কথা তোমার। কিন্তু লাস্টে দেখা গেল এর উল্টোই হয়ে গেল। প্রেম করলা তুমি, বিয়ে করলাম আমি। ইশশ! ফিলিং বহুত দুঃখ।

হৃদিপু আমার কথা শুনে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলে,

— ইউ খবিশ! আমাকে তুই খোটা দিচ্ছিস? লজ্জা করে না বড় বোনকে এইসব বলতে?

বলে আমার কাছে এসে পিঠের উপর ধপ করে কিল বসিয়ে দিল। আমি ব্যথায় উঁহু উঁহু করে বলি,

— ইউ বেয়াদব মহিলা! মুখে কথা বলা যায় না, হাত পা চলে কেন এত?

হৃদিপু মুখ ভেঙচি কেটে বলে,

— আর তোর মুখ এত কেন চলে?

— তাতে তোমার এত কেন জ্বলে?

হৃদিপু আমার দিকে তীক্ষ্ণ দিকে তাকিয়ে থেকে ছুঁ মেরে কাঁচা আমের বাটি নিয়ে আম খাওয়া শুরু করলো। আমি সেদিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলি,

— আমি রাগ করেছি।

হৃদিপু আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— আম নিয়ে নেওয়ার জন্য?

আমার মাথা না সূচক দুলিয়ে বলি,

— উঁহু! তুমি আমার দুলাভাইয়ের ব্যপারে এখনো বিস্তারিত কিছু বলো নি বলে তাই। কবে থেকে ঘুরিয়েই যাচ্ছ। বেয়াদব মহিলা একটা। আজ না বললে তোমার ব্রেকাপ নিশ্চিত। হুহ!

হৃদিপু হু হু করে হেসে উঠে বলে,

— কি জানতে চাস বল।

— সব!

— সময় হোক জানতে পারবি। আপাতত এতটুকু জেনে রাখ উনি প্রবাসী। টোকিওতে আছে বর্তমানে।

— বাবা গো! তোমার দৌড় দেখি আসলেই বহুত দূর। ব্যাপার-স্যাপার দেখি সাংঘাতিক।

হৃদিপু এখন গম্ভীর গলায় বলে,

— থামবি তুই এইবার?

আমি মুখ ভেঙচি কেটে বলি,

— হুহ! ভালা মানুষের দাম নাই।

কথাটা বলেই আমি রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। মায়ের রুমের সামনে দিয়ে যেতেই ওসমান সাহেব আমাকে গম্ভীর কন্ঠে ডেকে উঠলেন।

— সিয়াশা!

ওসমান সাহেবের কন্ঠ শুনেই আমি থমকে গেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে রুমের দিকে উঁকি দিলাম। দেখলাম সে খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আমি ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকাতেই সে পুনরায় আমার নাম ধরে ডেকে উঠে,

— সিয়াশা! এইদিকে এসো।

আমি ভ্রু কুটি কুঞ্চিত রেখেই তার রুমে প্রবেশ করি৷ তাচ্ছিল্যের সুরে বলি,

— আজ সূর্য কোন দিক দিয়ে উঠেছে যে আপনি স্বয়ং নিজ থেকে আমায় ডাকছেন?

সে গম্ভীর গলায় বলে উঠে,

— অকারণে ডাকি নি তোমায়। এই প্যাকেট গুলো দেওয়ার জন্য তোমায় ডেকেছি।

— প্যাকেটে কি?

— তোমার আর জামাই এর জন্য কিছু জামা কাপড় আছে এতে আর এই খামে কিছু টাকা আছে। জামাই বাজারের জন্য।

আমি শক্ত করে বলি,

— আর আপনি এইগুলো দিচ্ছেন কোন হিসাবে?

সে বিষ্ময়কর কন্ঠে বলে উঠে,

— মানে?

আমি ভাবলেশহীনভাবে বলে উঠি,

— আমার জানা মতে এইসব নিয়ম-রীতি কনের বাবা করে। কিন্তু আপনি তো আমার বাবা নন। আমি কি বলেছিলাম ভুলে গিয়েছেন? কবুল বলার সাথে সাথেই আপনার সাথে আমার সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। সো এইসব নিয়ম-রীতি আর আপনাকে মানতে হবে না।

— সেটা তোমার হিসাব! আমি শুধু আমার দায়িত্ব পূরণ করছি৷

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলি,

— জীবনে আমার প্রতি কোন দায়িত্বটা পালন করেছেন যে এখন দায়িত্ব গিরি দেখাতে এসেছেন? এসব আপনার প্রাণ প্রিয় মেয়েটাকে গিয়ে দেখান আমাকে না। সেই সাথে আমার কুনজর থেকে বাঁচিয়ে রাখুন। যেভাবে এতটা বছর বাঁচিয়ে এসেছেন।

হঠাৎ ওসমান সাহেব হালকা চেঁচিয়ে উঠেন,

— সিয়াশা!

— চিল্লাবেন না। বাধ্য হয়ে এসেছি এই বাসায়। অন্যথায় এই বাসায় পা রাখারও বিন্দু মাত্র ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু নিশ্চিন্তে থাকুন, এই শেষ আসছি এই বাসায়। আর আসবো না।

পিছন থেকে তখন নাসরিন বেগম বলে উঠে,

— তোর মত মাইয়ারে বুঝি আমরা ঘরে আনবার ও চাই?

আমি পিছনে ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলি,

— আসতে কে চায়?

নাসরিন বেগম তেতে উঠে বলে,

— আবার মুখে মুখে কথা কস। অপয়া জানি কোনহানকার।

— নতুন কিছু বলুন। একই কথা শুনতে শুনতে কানটা খুলে পড়ে গেল।

— দেখছোস ওসমান! মাইয়ার সাহচ দেখছোস নি?

আমি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলি,

— তামাশা করার জন্য ডেকেছেন আমায়?

ওসমান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,

— তামাশা তুমি করছো আমরা না।

আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বলি,

— অহ সরি! ভুলে গিয়েছিলাম তামাশা তো শুধু আমি এই করি। মানুষের জীবন ধ্বংস ও আমি এই করি। অন্ধকার নিয়ে আসি সবার জীবনে। ঘোর অন্ধকার! যেমন আপনার মেয়ের জীবনে নিয়ে এসেছি। আপনার পরিবারের উপর নিয়ে এসেছি।

বলে হু হু করে হেসে উঠি। নাসরিন বেগম তেতে উঠে বলে,

— তুই বার বার কথার মাঝে আমার নাতিনটারে টাইন্না আনোছ কেল্লা? আমার নাতিনটার সুখ তোর বুঝি সজ্জ্য হয় না? এহন তো নিজের বদনজর থেইক্কা রেহাই দে ওরে। শান্তিতে থাকবার দে।

আমি নাসরিন বেগমের দিকে তাকিয়ে বলি,

— আমি তো সুখেই আছি তাহলে অন্যের সুখ দেখে আমি জ্বলবো কেন? বরং আমার মনে হয় আমার সুখ দেখে আপনার জ্বলে।

নাসরিন বেগম কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওসমান সাহেব বলেন,

— থামো তো মা। আর সিয়াশা তুমি কি চাও এখন তা বলো।

আমি নির্মল চোখে তাকিয়ে বলি,

— আমি কি চাইবো?

— এইগুলো তুমি নিবে কি না?

— প্রশ্নই আসে না।

— ঠিক আছে। তুমি এখন আসতে পারো।

আমি আর কিছু না বলে সোজা রুমে চলে আসি৷ রুমে এসে চুপচাপ দরজা লাগিয়ে বসে রই। মাথাটা ব্যথা করছে। ঠোঁট দুইটি শুকিয়ে এসেছে। গলা বার বার ধরে আসছে। মনে হচ্ছে যেন গলার মাঝে কোন কাঁটা বিঁধে আছে যা ক্ষণে ক্ষণে আমায় পিড়া দিচ্ছে। গাল নাক গরম হয়ে এসেছে। হয়তো লালও হয়ে এসেছে। নয়ন জোড়া যেন আজ অবাধ্য হয়ে উঠেছে। কিছুতেই কথা শুনছে না। আমি দ্রুত ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে থাকলাম। কল ছেড়ে মাথায় পানি দিয়ে নিলাম। বেশকিছুক্ষণ মাথায় পানি দেওয়ার পর বেরিয়ে আসলাম। ইতি মধ্যে সারা গা পানিতে ভিজে একাকার। আমি কোন মতে চেঞ্জ করে মাথা মুছতে মুছতে বারান্দায় চলে গেলাম। চারদিকে গুমোট অন্ধকার। আকাশের বুকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শুভ্র আলোর ছড়াছড়ি। কোথাও হয়তো হাসনাহেনা ফুলটি ফুটেছে। তারই তীব্র ঘ্রাণ বাতাসে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি আকাশের পানে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ পর বারান্দায় রাখা বেতের মোড়াতে বসে পড়ি। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করেনি। ভালো লাগছে এখন।

____________________

ঘন্টা খানিক যেতেই দরজায় করাঘাত পড়ে। দুই একবার দরজায় করাঘাত পড়তেই আমার মস্তিষ্ক সচল হয়ে যায়। আমি চোখ খুলে উঠে দাঁড়াই। অগ্রসর হই রুমের দিকে। দরজার খুলতেই দেখতে পাই রোয়েনের ক্লান্ত মুখখানি। কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘান। সারা গা ঘামে ভেজা। আমি দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়াতেই সে দ্রুত রুমে ঢুকে পড়ে। নিজের ব্যাগ থেকে একসেট জামা আর টাওয়াল নিয়ে ঢুকে পড়ে ওয়াশরুমে। আর আমি বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসে পড়ি। মিনিট দশকের মধ্যেই তিনি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে। আমি তার দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— কোথায় ছিলেন?

সে আমার দিকে বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে বলে,

— তোমার কাজিনরা আমায় কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের প্রাপ্য ট্রিট আদায় করার জন্য। ডিসগাস্টিং!

আমি শান্ত কন্ঠে বলি,

— এতক্ষণ তাহলে আপনি বাসায় ছিলেন না?

সে বিরক্তিকর কন্ঠে বলে,

— থাকলে তো হতোই কাজ।

আমি আর কিছু না বলে চুপ করে থাকি। সে নিজের মুখ হাত মুছতে মুছতে চলে যায় বারান্দার দিকে।

_____________________

সকালে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছি। মা আলতোভাবে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মনের মাঝে কেমন এক শান্তি কাজ করছে। আসলেই মা মানে শান্তির ঠিকানা। তার নীড়েই সকল সমস্যার সমাধান। সকল ক্লান্তির অবসান। মা আমায় এইটা সেটা নিয়ে জিজ্ঞেস করছে। আমিও ভালো মত তার সকল প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। একসময় মা কাজ আছে বলে উঠে চলে যায় আর আমি চুপচাপ সোফায় বসে মোবাইলে গেম খেলতে থাকি। বাসায় এখনো তেমন কেউ উঠে নি। তাই মোটামুটি নীরব পরিবেশ। হয়তো আর একটু পর সোরগোল লেগে যাবে। আমি গেম খেলছি এর মধ্যেই হৃদিপু আমার পাশে এসে বসে। গম্ভীর মুখ নিয়ে বলে,

— সিয়া শুন! তোর সাথে কিছু কথা আছে। কথাটা বলবো বলবো বলেও ভুলে গিয়েছিলাম কাল।

আমি গেম খেলতে খেলতে বলি,

— এখন বলে ফেলো৷

— এডমিশন টেস্ট নিয়ে কিছু ভেবেছিস? এখন যদি কোন কোচিং এ ভর্তি না হোস তাহলে পিছিয়ে পড়বি তো।

আমি গেমের দিকেই মনোযোগ দিয়ে বলি,
— আমি এডমিশন টেস্ট দিচ্ছি না। আমার আর লেখাপড়া করার প্রতি ইন্টারেস্ট নেই।

হৃদিপুর বিষ্ময়ে চোখ বড় হয়ে আসে। সে অবিশ্বাস্য সুরে বলে,

— পাগল হয়েছিস? পড়ালেখার প্রতি ইন্টারেস্ট নেই মানে কি?

আমি গেম শেষ করে মোবাইল অফ করতে করতে বলি,

— নেই মানে নেই।

— তোর না হাইয়ার স্টাডিস নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল? নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রবল ইচ্ছা ছিল? সেগুলো গেল কোথায়?

আমি নির্মল চোখে তাকিয়ে বলি,

— স্বপ্ন সৃষ্টিই হয় ভাঙ্গার জন্য। আমারটাও ভেঙ্গে গেছে। আর তার উপর আমি যদি পড়তে চাইও তাহলে আমাকে পড়াবে কে শুনি? খরচ দিবে কে আমার? তোমার চাচা?

— কেন ভাইয়া পড়াবে। তুমি বলবি তুই আরও পড়তে চাস।

— ইচ্ছা থাকলে না হয় বলবো। ইচ্ছাটাই তো নেই আর। তোমার চাচা যে সকল স্বপ্ন, ইচ্ছেকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে।

— কিন্তু….

আমি হৃদিপুকে বলতে না দিয়ে বলি,

— আমাকে নিয়ে এত টেনশন করো না তো। মানিয়ে নিয়েছি আমি সবকিছুর সাথে। সেই সাথে সম্পর্কটাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি। তাই যেভাবে যা চলতে চাচ্ছে চলতে দাও।

কথাটা বলেই আমি হৃদিপুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। মিনমিনিয়ে বললাম,

— মাথায় হাত বুলিয়ে দাও তো।

#চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_09
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

কফি হাতে নিয়ে রোয়েনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ। কিন্তু সে? সে তো এখনো ঘুমে কাঁদা। ঘড়িতে দশটা বেজে সতেরো মিনিট। বাইরে সকলই ইতিমধ্যে উঠে রোয়েনের খোঁজ নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। তাও খোঁজ নিচ্ছে কার কাছে? আমার কাছে। তাদের ভাব এমন যেন আমি তাকে সাথে নিয়ে নিয়ে ঘুরছি। আমাকে তার কথা জিজ্ঞেস করার সাথে সাথে ঠাস করে উত্তর দিয়ে দিব। যতসব!
অতঃপর মা আমায় ডেকে রোয়েনের জন্য কফি ধরিয়ে দেয় আর বলে রোয়েনকে দিয়ে আসতে। আমি আর কিছু না বলে মুখ ফুলিয়ে চলে আসি রুমে। এসে দেখি মাননীয় আমার বর মহাশয় এখনো ঘুম থেকেই উঠেনি। আমি এক রাশ বিরক্তি নিয়ে রোয়েনকে ডাকতে থাকতাম। কিন্তু না তার কোন সাড়া নেই। আবার ডাকতে গেলেই রোয়েন খ্যাঁক করে ধমকে উঠে অতঃপর আমার গভীর ঘুমিয়ে তলিয়ে যায়৷
মেজাজ আমার আপাতত ফোরটি নাইন হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে এই গরম কফির মধ্যে একে ডুবিয়ে ভূত বানিয়ে ফেলি৷ কিন্তু সব ইচ্ছে কি আর পূরণ হয়? আমি দাঁতে দাঁত চেপে রোয়েনকে ডাকতে থাকি।

— এই যে মিস্টার খাটাশ শুনছেন? উঠবেন নাকি বিছানায় লেপ্টে থেকে শহীদ হওয়ার ইচ্ছে আছে?

কিন্তু নো রেসপন্স। এই ব্যাটার ঘুম দেখি কাঁঠালের আঠার মত। একবার লাগলে উঠতেই চায় না। আমি এইবার একটু উঁচু স্বরেই ডাকতে থাকি। একসময় রোয়েনের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে আর সে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে তাকায়। তা দেখে আমার স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই। রোয়েন উঠে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে বলে,

— হোয়াট?

আমি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলি,

— হোয়াট-ফোয়াট ছাড়েন আর উঠেন। কয়টা বাজে সেই খবর আছে? আপনাকে উঠাতে গিয়ে আমি শহীদ হয়ে গিয়েছি। মানুষ এত ঘুমে বিভোর কিভাবে হয়? হাও?

সে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,

— আমার ও জানা ছিল না মানুষ ভাঙ্গা রেডিও এর মত বাজতে পারে। হেডেক ম্যান!

বলেই সে বিছানা ছেড়ে উঠে পরে আর ফ্রেশ হতে চলে যায়। আমি সেইদিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে থাকি। বিরবির করে বলি,

— এই ব্যাটা আস্ত এক ঘাড়ত্যাড়া৷

_____________________

খাবার টেবিলে সবাই বসে আছি। সকলেই যে যার মত খাচ্ছে। আমিও এক সাইডে চুপচাপ বসে খাচ্ছি। এমন সময় ওসমান সাহেব বলে উঠে,

— রোয়েন বাবা শুনো!

রোয়েনও চুপচাপ খাচ্ছিল। ওসমান সাহেবের কন্ঠ শুনে সে মাথা তুলে তাকায়। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

— জ্বী বলুন।

— রীতি অনুযায়ী আজ তোমায় বাজার করতে হবে। তা তুমি বাজার করতে পারবে তো।

রোয়েন আবার খাবারের দিকে মনোযোগ দিয়ে বলে,

— জ্বী পারবো।

কথাটা শুনে ওসমান সাহেব কিছু টাকা এগিয়ে দিয়ে বলেন,

— তা এই টাকা গুলো নাও আর একটু ভাইজানের সাথে বের হয়ে যেও।

কথাটা শুনে আমি চকিতে তাকাই। রোয়েনও মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অতঃপর বলে,

— টাকা কিসের জন্য?

কথাটা শুনে ওসমান সাহেব থমথমে খেয়ে বললেন,

— বাজারের জন্য।

রোয়েব একটু গম্ভীর গলায় বলে উঠে,

— বাজারটা যেহেতু আমায় করতে হবে তাই আমি চাই পুরো খরচটা একাই বহন করতে।

— কিন্তু বাবা..

ওসমান সাহেবকে কিছু বলতে না দিয়ে রোয়েন বলে উঠে,

— আমি নিজ থেকে বাজারটা করতে চাচ্ছি। আর কিছুই না। আশা করি এতে কারো কোন ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা না।

কথাটা বলেই রোয়েন আবার খাবারের দিকে মনোযোগ দেয়। কথাটা শুনে ওসমান সাহেব একটু অপমানিতবোধ করেন কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বললেন না। চুপচাপ নিজের হাত গুটিয়ে নিলেন। সকলে কিছুক্ষণ রোয়েনের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে ফেলে। আর এইদিকে ওসমান সাহেবের চেহেরা দেখে আমার মনে প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো সুরু হাসি। ভিতরে ভিতরে কি যে খুশি লাগছে আমার আজ। মন চাচ্ছে বাচ্চাদের মত উড়াধুরা লুঙ্গি ডান্স দেই৷ কথা না বললেই নয়, আজ প্রথমবারের মত মানুষটাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে আমার। সে যা করেছে তা যে আমার জন্য মানসিক প্রশান্তি।

_________________

আজ প্রায় দু’দিন হতে চললো সেই বাসা থেকে এসেছি। আসার সময় তেমন কোন ঝামেলা হয় নি। ভালোয় ভালোয় এসে পড়েছি আমরা। এইখানে আসার পর রোয়েনের বাবা-মাকে আপন করে নিতে শুরু করেছি৷ তাদের সাথে মিশতে শুরু করেছি। আর করবোই না কেন? তারা যে আমার অনেক খেয়াল রাখছে। দু’দিনের মধ্যেই মায়ের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে উঠেছে। বাবার সাথেও মোটামুটি। শুধুমাত্র এই খাটাশ ব্যাটার সাথেই আমি সুবিধা কর‍তে পারছি না৷ আর পারবো বা কিভাবে? ঘাড়ত্যাড়া মানুষের সাথে কি সোজা ভাষায় কথা বলা যায়? আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যাকে অসহ্য লাগে তার সাথে ভাব জমায় কিভাবে মানুষ? হাও? আমি তো ভাই পারি না আর পারতে চাইও না। হুহ।

বিকেলে রুমে বসে বসে ফেসবুকিং করছি আর পাশেই রোয়েন বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। কিছুক্ষণ পর রোয়েন ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

— সিয়াশা শুনো!

রোয়েনের ডাক শুনে যেন আমি আকাশ থেকে পড়ি৷ গোলগোল চোখে তার দিকে তাকাই। বুঝার চেষ্টা কথাটা কি তিনি নিজেই বলেছে নাকি কোন ভূত-প্রেত বলেছে। কেন না এই পর্যন্ত যতবার আমাদের কথাবার্তা হয়েছে তা আমি শুরু করেছি আর তিনি আমার কথার পিঠে উত্তর দিয়েছেন। এছাড়া তো বোমা মারলেও উনার মুখ দিয়ে বলি ফুটানো যায় না। আর সে নাকি আজ নিজ থেকে কথা বলছে। আদৌ বিশ্বাস করা যায়? আমি আমতা আমতা করে বলি,

— আমায় কি ডেকেছিলেন?

উনি আমার কথা শুনে মাথা তুলে আমার দিকে তাকায়। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে,

— এইখানে তুমি বাদে দ্বিতীয় সিয়াশা বলে কেউ আছে নাকি?

আমি থমথম গলায় বলি,

— না।

রোয়েন পুনরায় ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে,

— কালকে সকালে রেডি থেক।

— কেন?

— বেরুবো!

আমি ভ্রু কুঞ্চিত করে বলি,

— আপনি বের হলে হবেন,তো আমাকে কেন রেডি হতে হবে?

রোয়েন এক রাশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— তোমাকে নিয়েই বের হবো। ষ্টুপিড!

কথাটা শুনে আমার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে। আমি দৃঢ় গলায় বলি,

— আমাকে নিয়ে? কোথায়?

— কোচিং এ ভর্তি করাতে। সামনে না তোমার এডমিশন টেস্ট?

আমি থমথম গলায় বলি,

— হুম কিন্তু আমি আর পড়তে চাই না। তাই এইসব কোচিং টোচিং এ ভর্তি করানোর কোন প্রয়োজন নেই।

রোয়েন ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টি আরও প্রখর হয়ে আসে। সে গম্ভীর গলায় বলে,

— পড়তে চাও না মানে কি?

আমি স্বাভাবিক কন্ঠে বলি,

— চাই মানে চাই না। আর বিয়ে-শাদির পর আর কিসের পড়ালেখা? এখন তো আমায় সংসার এই সামলাতে হবে। মেইনলি যেটার জন্য আপনি আমায় বিয়ে করেছেন।

রোয়েন এইবার আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগান্বিত কন্ঠে বলে,

— ঠাডিয়ে দিব এক! এক ডিগ্রি বেশি না বুঝলে হয় না? আমি বলেছি সংসার সামলাতে বা বাসার কেউ বলেছে?

আমি থমথম গলায় বলি,

— না কিন্তু….

আমার কথার মাঝেই রোয়েন বলে উঠেন,

— কিন্তু কি? যদি ভেবে থাকো তুমি সারাজীবন আমার টাকায় চলবে তাহলে সে গুড়ের বালি। আমি তোমাকে সারাজীবন ঘরে বসিয়ে খাওয়াবো না। তোমাকে পড়ালেখা করতে হবে এবং নিজে আয় করে খেতে হবে।

আমি কাঠ কাঠ গলায় বলি,

— পারবো না আমি। আপনি আমায় খাওয়ান আর নাই খাওয়ান সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু আমি আর পড়ালেখা করবো না। পড়ালেখা করার ইচ্ছেটাই এখন আর নেই আমার মধ্যে।

— তুমি পড়বে না মানে তোমার ঘাড় ও পড়বে। আমার ওয়াইফ যেহেতু হয়েছ সেহেতু পড়ালেখা তো তোমায় করতেই হবে।

আমি এইবার রেগে গিয়ে বলি,

— কোন জোড়াজুড়ি আছে নাকি?

রোয়েন নিজের কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে আমার এক বাহুতে টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। গম্ভীর গলায় বলে,

— স্বামী যেহেতু আমাকেই মেনেছ সেহেতু তার কথাও তোমার মানতে হবে। এখন সেটা যাই হোক। রাগী না বলে এই না আমি রাগতে জানি না। আমি রাগলে কিন্তু এর পরিনতি খুব খারাপ হবে। তাই বলছি তুমি পড়বে মানে পড়বে। নো মোর আরগিউমেন্টস।

কথাটা বলেই রোয়েন আমায় ছেড়ে দেয় আর রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আমি একবার রোয়েনের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেলি।মস্তিষ্কের মাঝে বিচরণ করতে থাকে একটাই ধ্বনি, “তোমার উপর টাকা খরচ করাই মানে অপচয়। আমি আর এক টাকাও তোমার উপর অপচয় করতে পারবো না।”

উক্তিটি আমার জন্য ওসমান সাহেবের পক্ষ থেকেই ছিল। আর সেই উক্তিটি যেন আমার মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে৷ তাই তো আমি আর চাই না কেউ তার টাকা আর আমার উপর অপচয় করুক। হোক সে আপন অথবা পর।

_____________________

সকালে নাস্তার টেবিলে বসে আছি। সকলে মিলে একসাথে নাস্তা করছি। এমন সময় সালমা বলে উঠেন,

— রোয়েন তোর আর কত ছুটি আছে??

রোয়েন খেতে খেতে বলে,

— আছে পাঁচ-ছয় দিনের মত।

সালমা বেগম তা শুনে বলেন,

— যেহেতু ছুটি হাতে আছে সেহেতু সিয়াশাকে নিয়ে কোথাও থেকে না হয় ঘুরে আয়।

কথাটা শুনার সাথে সাথে আমি বিষম খেয়ে যাই। শ্বাশুড়ি আমার কোন দিকে ইঙ্গিত করেছে তা আমার বুঝতে দেরি নাই। মা তারাতাড়ি উঠে এসে আমায় পানি দেন আর পিঠ বুলিয়ে দেন। একটু পর স্বাভাবিক হতেই রোয়েন বলে উঠে,

— এই বিষয় নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আপাতত সিয়াশার সামনে এডমিশন এক্সাম তাই আজ ওকে কোচিং এ ভর্তি করিয়ে দিতে যাচ্ছি।

সালমা বলে উঠেন,

— এইটার কথা তো মনেই ছিল না আমার। তা আজ ভর্তি করাবি?

রোয়েন ছোট করে “হুম” বলে খেতে থাকে। তৌফিক সাহেব হঠাৎ বলে উঠেন,

— দায়িত্বটা যেহেতু নিয়েছিস ঠিক মত পালন করিস।

কথাটা বলেই তিনি উঠে গেলেন। সালমা বেগম সেদিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ করে বলেন,

— বিকেলে তাহলে বাসায় ফোন করে তোমার বইগুলো দিয়ে যেতে বলো।

আমি কিছু না বলে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাই। খাওয়া-দাওয়া শেষে রোয়েন আমায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ফার্মগেটের উদ্দেশ্যে৷

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here