#ধূসর_শ্রাবণ💚
#লেখিকা:#তানজিল_মীম💚
#পর্ব-১৭
________________
গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে হিয়া চোখ তাঁর নির্মলের মুখের দিকে। একরাশ মুগ্ধতা এসে গ্রাস করেছে তাঁকে। আর নির্মল হাতে স্যাভলন আর তুলো নিয়ে সযত্নে হিয়া ব্যাথা পাওয়া হাতটাকে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। পায়ে আগেই করে দিয়েছে, হিয়ার লাগছে একটু আকটু কিন্তু বর্তমানে সেই ব্যাথাটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাকিয়ে আছে সে নির্মলের চোখের দিকে। নির্মল রেগে আছে, ভয়ংকর ভাবে রেগে আছে যার দরুন হিয়ার দিকে তাকাচ্ছে না সে। আর এই বিষয়টাই বেশ লাগছে হিয়ার। হিয়া যতই মুখে বলুক সে নির্মলকে পছন্দ করে না। কিন্তু ভিতর থেকে অন্যকিছু। নির্মলের ছোট ছোট কেয়ারিং বেশ লাগে হিয়ার কখনো প্রকাশ করা হয় নি কিন্তু লাগে। কিছুক্ষন আগেই নির্মল হিয়াকে কোলে তুলে এনে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। যেহেতু নির্মল ডাক্তার সেই সুবাদে ছোট খাটো ডাক্তারি জিনিসপত্র অলওয়েজ তাঁর গাড়িতেই থাকে। হঠাৎই হিয়ার ভাবনার মাঝে বলে উঠল নির্মল,
‘ আমি ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি এখন ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।’
প্রতি উওরে কিছু বললো না হিয়া নিশ্চুপে তাকিয়ে রইলো সে নির্মলের মুখের দিকে। হিয়াকে চুপ থাকতে দেখে তাকালো নির্মল হিয়ার চোখের দিকে। চোখাচোখি হলো দুজন, কাছাকাছি এলো একটু,হুট করেই নির্মল হিয়ার আর একটু কাছাকাছি এগিয়ে চোখে চোখ রেখে মুচকি হেঁসে বললো,
‘ তুমি যে প্রেমে পড়ে গেছো,তা কি তুমি জানো প্রিয়দর্শনী?’
তক্ষৎনাত চমকে উঠলো হিয়া। আশপাশে তাকালো, ছটফটে মনটা থমকে গেল মুহূর্তেই। বুকের ভিতর দক দক করে উঠলো আনমনে। হিয়ার অস্থিরতা বুঝতে পেরে হাসলো নির্মল চটজলদি হিয়ার কাছ থেকে সরে আসলো সে। গাড়ি স্ট্যার্ট দিল তক্ষৎনাত। আর হিয়া প্রায় নির্বিকার হয়ে বসে রইলো চুপচাপ। লজ্জায় মাটির নিচে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে তার। ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা! আর নির্মল মুচকি হেঁসে গাড়ি নিয়ে ছুট লাগালো দূর সীমানায়।’
_______
পরের দিন।
সন্ধ্যা_৭ঃ০০টা! সেজেগুজে শুভ্রের জন্য অপেক্ষা করছে বর্ষা। মুলত আরোহীর ছেলের জন্মদিনের পার্টিতে যাওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছে সে শুভ্রের জন্য কিন্তু শুভ্রের খবর নেই। শুভ্র সকালেও বলেছিল সে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই চলে আসবে। কিন্তু এখনো আসছে না হয়তো অফিসের কাজে ব্যস্ত এমন চিন্তা ভাবনা নিয়ে বসে রইলো বর্ষা। বর্ষা সেঁজেছিল খুব যদিও লন্ডনে আছে তারপরও একটা সুন্দর জামদানী শাড়ি পড়েছে সে, চুল দিয়েছে খুলে, হাতে বাহারী রঙের কাঁচের চুরি, চোখে কাজল, আইলিনার মাসকারা দিয়ে মন মতো সেজেছিল সে।
‘ কিন্তু শুভ্র কেন এখনো আসছে না’। ঘড়ির দিকে আবারো তাকালো বর্ষা সাড়ে সাতটা বেজে গেছে আর আধঘন্টার মধ্যেই আরোহীর ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। বর্ষা এবার নিরাশ হলো, চুপচাপ বসে রইলো নীরবে। শুভ্র হয়তো আসবে না আর। আর আসলেও তাঁরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবে। ফোনটা বেজে উঠল আবারো আরোহী ফোন করছে বারবার। বর্ষা মোবাইলটা সাইলেন্ট করে চলে যায় বেলকনিতে। আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে হয়তো বৃষ্টি হবে? বর্ষার মনে হুট করেই অভিমানের পাহাড় তৈরি হলো। আনমনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো সে,
‘ আপনি কি আসবেন না শুভ্র?’
এরই মাঝে বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বর্ষার অভিমানী মনটা খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলো নিমিষে। তক্ষৎনাত শাড়ির কুঁচি ধরে দৌড়ে চলে যেতে লাগলো সে নিচে। দরজা খুলতেই মনটা ফ্যাকাসে হলো তার শুভ্র এসেছে ঠিকই কিন্তু পাশে একটা মেয়েকে নিয়ে। শুভ্রের চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ। পায়ে আর হাতে ব্যাথা পেয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছে সে। বর্ষা হতাশ হলো,এগিয়ে গেল শুভ্রের দিকে তারপর বললো,
‘ কি হয়েছে ওনার?’
সাথে সাথে ওপরপাশের মেয়েটি বাংলায় বলে উঠল,
‘ এক্সিডেন্ট! আসলে আমার গাড়ির সাথেই ওনার ধাক্কা লাগে।’
মেয়েটি বাংলা বলছে তাঁর মানে মেয়েটি বাঙালি। বর্ষা গিয়ে ধরলো শুভ্রকে তারপর বললো,
‘ আপনি ঠিক আছেন তো?’
উওরে শুধু মাথা নাড়ায় শুভ্র। বর্ষা মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানায় মেয়েটি মাথা নিচু করে বলে,
‘ ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই আমার জন্যই এমনটা হয়েছে আই এক্সট্রিমলি সরি।’
প্রতি উওরে তেমন কিছু বলে না বর্ষা। শুভ্রকে ধরে আস্তে আস্তে চলে যায় ভিতরে। আর মেয়েটাও বেশি কিছু না ভেবে অগ্রসর হয় নিজের কাজে।’
দরজা আঁটকে সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে শুভ্রকে নিয়ে উপরে উঠছে বর্ষা। বেশ হতাশা ভরা কন্ঠ নিয়ে বললো সে,
‘ আপনি কি হাঁটার সময় ঠিক ভাবে দেখে হাঁটতে পারেন না।’
‘ আমার কোনো দোষ নেই জানো তো। হুট করেই গাড়িটা সামনে চলে আসায় আমি বুঝতে পারি নি।’
‘ আপনি অলওয়েজ এমনই করেন।’
‘ আমি করি নাকি তুমি?’
‘ 😒😒😒
‘ ওভাবে তাকাবে না একদম যা হয়েছে সব তোমার জন্য?’
‘ যা বাবা আমি কি করলাম?’
প্রতি উওরে কিছু বলে না শুভ্র। সত্যি তো ও কি করেছে?’
বর্ষা শুভ্রকে নিয়ে এসে বসিয়ে দেয় খাটে। এরই মাঝে আবারো তাঁর ফোনটা বেজে উঠলো উপরে আরোহীর নাম্বার দেখে কিছুটা নিরাশ হয়ে জোরে নিশ্বাস ফেললো বর্ষা তারপর ফোনটা তুলে বললো,
‘ হ্যালো?’
সাথে সাথে অপরপ্রান্তে হতভম্ব গলায় বললো আরোহী,
‘ কোথায় তুই?’
‘ সরি রে আমি আসতে পারবো না।’
সাথে সাথে নিরাশ হয়ে বললো আরোহী,
‘ কেন?’
উওরে শুভ্রের অবস্থার কথা বললো বর্ষা। বর্ষার কথা শুনে নিরাশ হয়েই বললো আরোহী,
‘ ঠিক আছে কোনো ব্যাপার না ভাইয়া সুস্থ হলে আমার বাড়িতে নিশ্চয়ই আসবি।’
‘ হুম সরি রে?’
‘ ইট’স ওকে।’
এতটুকু বলে ফোন কাটে আরোহী। আর বর্ষাও তেমন কিছু না ভেবে কান থেকে সরায় ফোনটা। হাল্কা খারাপ তাঁরও লাগছে। বর্ষার মনে অবস্থা বুঝতে পেরে শুভ্র নিশ্চুপ কন্ঠে বলে উঠল,
‘ সরি বর্ষা আমার জন্য তুমি যেতে পারলে না।’
উওরে শুঁকনো হেঁসে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো বর্ষা,
‘ কোনো ব্যাপার না। পরেরবার যাবো। আগে আপনাকে সুস্থ হতে হবে তারপর বাকি সব।’
মুগ্ধ হয় শুভ্র বর্ষার কথা শুনে। কিছু বলে না শুধু নির্বাক চোখে তাকিয়ে রয় সে বর্ষার মুখের দিকে। বর্ষা চটজলদি চলে যায় আয়নার কাছে হাতের চুড়িগুলো খুলে ফেলে সে, শাড়িটাও পাল্টাতে হবে তাঁকে। বর্ষার কাজে বেশ খারাপ লাগছে শুভ্রের। মেয়েটা খুব সিরিয়াস ছিল বার্থডে পার্টিতে যাওয়ার জন্য। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো শুভ্র।’
মাঝপথে কেটে যায় ৭ দিন।’
শীতল মিশ্রিত সকাল। ঠান্ডার প্রখর চলছে আজ, আকাশটাও একদম ধবধবে সাদা কালো হয়ে আছে। হয়তো তুষার পাত হবে। গায়ের থেকে মোটা কম্বল সরিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো বর্ষা। পাশেই শুভ্র ঘুমিয়ে আছে। বর্ষা ডাকলো শুভ্রকে বললো,
‘ শুনছেন উঠবেন না অফিস যেতে হবে তো।’
উওরে ঘুম জড়ানো গলায় বললো শুভ্র,
‘ না আজ অফিস ছুটি।’
‘ ওহ, তাহলে ঘুমান।’
এতটুকু বলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো বর্ষা। ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে হবে তাঁকে।’
কিছুক্ষনের মধ্যেই ব্রেকফাস্ট তৈরি করে টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখে বর্ষা। এরই মাঝে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে শুভ্র। শুভ্র নিচে নেমে চেয়ার সরাতে সরাতে বললো,
‘ ব্রেকফাস্ট সেড়ে তৈরি থেকো আমরা বের হবো?’
হুট করে শুভ্রের এমন কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে বললো বর্ষা,
‘ কোথায় যাবো আমরা?’
‘ তা গেলেই দেখতে পাবে আর শোনো মোটা পোশাক পড়বে আজ কিন্তু ঠান্ডা পড়ছে।’
উওরে মাথা নাড়ায় বর্ষা তবে কিছু বলে না।’
অতঃপর ব্রেকফাস্ট সেড়ে শুভ্র বর্ষা দুজনেই শীতকালীন মোটা পোশাক পড়ে তৈরি হয়।’
গাড়িতে বসে আছে শুভ্র। অপেক্ষা করছে সে বর্ষার জন্য কিন্তু মেয়েটার খবর নেই। শুভ্র বোঝে না এত লেট কেন করছে? এমন সময় গায়ে সাদা টিশার্ট তারওপর সাদা রঙের মোটা সুয়েটার হাঁটু পর্যন্ত লং সাথে কালো জিন্স, খোলা চুলে এগিয়ে আসে বর্ষা। বর্ষাকে দেখে নিশ্বাস ছাড়লো শুভ্র অবশেষে আসলো মেয়েটা। বর্ষা দৌড়ে এসে ঢুকে পড়লো গাড়িতে তারপর সিটব্লেট লাগাতে লাগাতে বললো,
‘ চলুন?’
‘ এত দেরি করে কেউ?’
শুভ্রের কথা শুনে শুঁকনো হেঁসে বললো বর্ষা,
‘ ওই একটু সাজতে সাজতে দেরি হলো আরকি।’
উওরে কিছু বলে না শুভ্র। ছুট লাগায় দূর সীমানায়। পরিবেশটা খুব ধমকানো। চারপাশে শীত শীত ভাব প্রখর। রোদ্দুরের ছিটেফোঁটা নেই একদমই। লন্ডনে আসার পর আজই প্রথম যেন শীত জিনিসটা অনুভব করছে বর্ষা। আশপাশের গাছপালাগুলোও থমকে গেছে। একটু একটু সাদা রঙের কিছুটা একটা হাল্কাভাবে গ্রাস করছে তাদের। তবে কি তুষার পাত হবে আজ। হলে মন্দ হয় না। কাছ থেকে কখনো বরফ পড়ার দৃশ্য দেখে নি বর্ষা। ওই একটু আকটু টিভিতে দেখেছিল সে।’
লন্ডনের সরু পথ পেরিয়ে এগিয়ে চলছে শুভ্র বর্ষা। মাঝেসাঝে দু’ একটা পাহাড়ও চোখে পড়ছে বর্ষার। বর্ষা জানে না শুভ্র তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু যেখানেই যাক ভালো লাগছে তাঁর। জানালার বাহিরে তাকিয়ে রইলো বর্ষা। হঠাৎই শুভ্র বলে উঠল,
‘ কখনো স্কেটিং করেছো বর্ষা?’
সাথে সাথে চমকে উঠলো বর্ষা। ভ্রু জোড়া খানিকটা কুঁচকালো তাঁর। ভ্রু কুঁচকেই বললো সে,
‘ না কেন বলুন তো?’
‘ করবে?’
‘ আমি পারি না তো?’
‘ শিখিয়ে দিবো।’
সাথে সাথে চোখ বড় বড় করে বললো বর্ষা,
‘ সত্যি।’
উওরে মাথা নাড়িয়ে বলে শুভ্র,
‘ হুম।’
_____
কফি হাউজের একদম লাস্ট বেঞ্চের কর্নার সিটে বসে ছিল হিয়া। ডাইরি লিখছিল সে। হুট করেই লেখা বন্ধ করে কলমটাকে টেবিলের কর্নার রেখে অভিমানী হয়ে ভাড়ি গলায় বললো,
‘ বাংলাদেশে কেন বরফ পড়ে না, পড়া উচিত ছিল তো সবার তো আর কারি কারি টাকা নেই যে সেই টাকা দিয়ে বিদেশ গিয়ে বরফের মজা নিবে।’
হুট করেই হিয়ার থমকানো কথাবার্তা শুনে আশেপাশের লোকজন তাকালো তাঁর দিকে। কিন্তু সেই তাকানোকে টোটালি উপেক্ষা করে একটু কাঁদো কাঁদো গলায় বললো হিয়া,
‘ পড়া উচিত ছিল তো কম হলেও এই হিয়া নামক বরফ প্রেমিক মেয়েটার জন্য পড়া উচিত ছিল।’
বলেই কাঁচের জানালা ভেদ করে আকাশ পানে তাকালো হিয়া। আকাশটা একদম নিরিবিলি আজ। রোদ্দুর নেই, নেই কোনো মেঘ, আর নাহি আছে পাখিদের উড়াউড়ি। যেটা আছে সেটা হলো শুধু সাদার মিশ্রণ। হিয়া নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে রইলো সেই আকাশের পানে। তার হাতের ডান পাশেই টেবিলের উপর কাপ ভর্তি কফি থেকে ধোঁয়া উঠছে এখনও, একচুমুকও দেই নি এখনো হিয়া। আধও দিবে কি না বেশ সন্দেহ আছে তাতে?’ মনটা হুট করেই খুব অভিমানী হয়ে উঠলো তাঁর তবে সেটা মানুষের ওপর নয়, ওই মাথার উপর দূর সীমানায় থাকা আকাশটার ওপর বড্ড অভিমান হলো। কেন তাঁরা বাংলাদেশের বুকে বরফ দেয় না। দেওয়া উচিত ছিল তো?’
#চলবে…..
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। আর গল্প কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে।]
#TanjiL_Mim♥️