ধূসর পাহাড়,পর্ব_১৮

ধূসর পাহাড়,পর্ব_১৮
লেখিকা আমিশা নূর

দুজনে একসাথে হেসে দিলো। চা খেতে খেতে ওরা দুজন ফুটবল খেলা দেখছে।শুধু ওরা চারজন না আরো কয়েকটা ছেলেও খেলছে।অধ্রী-কানন আর অরণ্য-রৌদ্রময় দু”দল।সমুদ্রের পাড়টাকে খেলার মাঠ করেছে।তবে মাঝে মাঝে খুব বড় ঢেউ এসে ওদের ভিজিয়ে দিচ্ছে।তাতে কারো কোনো আপত্তি নেই।মন দিয়ে খেলছে সবাই।হঠাৎ অরণ্য অধ্রীদের গোল দে।যার ফলে অধ্রী মনে মনে জিতার জন্য অন্য একটা প্ল্যান করে।অাবারো অরণ্য গোল দিতে আসলে অধ্রী ফিসফিস করে বলে,

“অরু তুই যদি আরেক বার আমাদের গোল দিতে যাস তাহলে তোর সব কথা কুয়াশা’কে বলে দিবো।”

অধ্রীর কথা শুনে অরণ্যের পা থেমে গেলো।এই ফাঁকে অধ্রী ওর কাছ থেকে বল নিয়ে নিলো।অধ্রী গোল করে দিতেই অরণ্য রাগান্বিত দৃষ্টিতে অধ্রীর দিকে তাকালো।একইভাবে অধ্রী রৌদ্রময়ের কাছে গিয়ে বলে,
“দোস্ত কাল রাত তিন টায় সীয়ামা মে বি তোর বুকে ছিলো।”
অধ্রী কথা শুনে রৌদ্রময় চমকে গেলো।সে ভালোমতোই বুঝেছে অধ্রী কী বুঝাতে চাইছে।চুপচাপ বল অধ্রীকে দিয়ে রৌদ্রময় পাশ কেটে চলে গেলো।অধ্রী অট্টহাসিতে মেতে উঠলো।খেলা শেষে অধ্রীদের দলই জিতলো।কুয়াশা মুগ্ধ হয়ে অধ্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো।এই মেয়ের মধ্যে কোনো কিছুরই কমতি নেই।সব কিছুতেই পারফেক্ট।কিন্তু সমাজে ওর ছেলের মতো চলাচল করা’টা ভালো চোখে দেখে না।হঠাৎ জলের স্পর্শে আসায় কুয়াশার ভাবনায় অবসান ঘঠলো।সামনে তাকিয়ে দেখলো অধ্রী হাতের মুটোই পানি এনে তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।অধ্রী আর সীয়ামা’র জোরাজোরিতে কুয়াশা সমুদ্রে গোসল করতে বাধ্য হলো।সমুদ্রের নোনতা পানিতে কুয়াশা নিজেকে পরিপূর্ণ করে নিলো।এর আগে কোনো দিন পুকুর কিংবা সমুদ্রে গোসল করে নি।তাই হয়তো আজ এতোটা ভালো লাগছে।অরণ্যের চোখ কুয়াশার দিকেই আটকে আছে।দাঁত কেলিয়ে হাসছে কুয়াশা।এভাবে হাসতে কুয়াশাকে আজই প্রথম দেখছে।মেয়েটাকে একটু খুশি দেখলে আজ কাল তারও ভালো লাগে।

২১.
অনেকক্ষণ ধরে দরজায় কেউএকজন টোকা দিয়ে যাচ্ছে।অরণ্য বাথরুম থেকে বেরিয়ে দরজা খুলতে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো।সাদা গাউন,কাঁধের একপাশে সাদা ওড়না ঝুলানো,বড় ইয়ার রিং,ভেজা চুল থেকে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে।কুয়াশাকে এমন পরিধানে দেখে অরণ্যের ঘোর লেগে এলো।কুয়াশার সাড়া পেয়ে অরণ্য দরজা থেকে সরে এলো।কুয়াশা ভিতরে প্রবেশ করে অরণ্যকে প্রশ্ন করলো,

“রৌদ্রময় কোথায় গেলো?”
“আবব,রৌদ্রময় বাইরে গেলো খাবার আনতে গেলো।”
“ওহ।তোমাদের মোবাইল দিতে আসলাম।”
“দাও।”

কুয়াশা মোবাইল ফেরত দিয়ে চলে আসলে ভেজা জায়গায় পিছলা খেয়ে বিছানায় পড়ে গেলো।অরণ্যের সাথে ধাক্কা লেগে সে ও কুয়াশার উপর পড়ে গেলো।অরণ্যের ছোট চুল গুলো কপালে এসে পড়েছে।চেয়েও কুয়াশা অরণ্যের চোখ থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না।আবারো সেই অদৃশ্য শক্তি তাদের দুজনকে এক সুতোই বেধে রেখেছে।অরণ্য ধীরে ধীরে তার নাক কুয়াশার নাকের সাথে লাগালো।আলতো করে কুয়াশার গলায় চুমু দিয়ে বললো,”ভালোবাসি কুয়াশা!”।কুয়াশা শরীরে বিদুৎয়ের গতি কিছু একটা দৌড় দিলো।এর আগে কোনো ছেলে কুয়াশার এতোটা কাছে আসেনি।কিন্তু কুয়াশা চেয়েও যে অরণ্যকে সরাতে পারছে না।বরং কুয়াশার মন চাইছে সময়টা এখানেই থেমে যাক।অরণ্য কুয়াশার ঠোঁট জোড়া নিজের দখলে নিয়ে নিলো।কুয়াশা নিজে অরণ্যকে সরিয়ে দিতে গিয়ে নিজেও তার সাথে তাল মিলালো।একটু পর নিজের মধ্যে হুস এলে কুয়াশা অরণ্যকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে নিজের রুমে চলে এলো।বিছনায় বসে বার বার একটু আগের ঘটনা মনে করতে লাগলো।অরণের ছোয়ে দেওয়া জায়গায় বার বার হাত বুলাচ্ছে।কুয়াশা দৌড়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে আয়নায় নিজেকে খুটিয়ে দেখতে লাগলো।কানে বার বার অরণ্যের বলা “ভালোবাসি কুয়াশা!” বাক্যটায় বাজচ্ছে।কুয়াশা’র কেমন যেনো অন্যরকম অনূভুতি হচ্ছে।চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে,আবার ঠোঁটে এক রকম ভালোলাগা!কিসের অনুভূতি এটি?

অরণ্যের ভীষণ অপরাধবোধ হচ্ছে।সে কোনো দিন ভাবেনি এমন পরিস্থিতির স্বীকার হবে।কুয়াশাকে সে ভালোবাসে ঠিকই কিন্তু ওর আপত্তিতে অরণ্য কিছুই করবে না।আজকের ভূলের জন্য কী হবে?কুয়াশা কী তাকে মেনে নিবে?


“গাইস আমরা ফিরে যাচ্ছি কখন?”
“কাল।”
“নাহ আমরা আজ রাতেই ঢাকা বেক করছি।”
“হুয়াট?”

দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই গ্রাম এলাকার দিকে আসছিলো।ওরা সবাই ঠিক করেছিলো কালকে ঢাকা যাবে।কিন্তু অরণ্যের কথা শুনে সবাই চমকে গেলো।

“ইয়েস।দিদুন বাসায় ফিরে আসছে।”
“কী বলছিস দাদা!আমাকে তো বৌদি কিছু বলে নি।”
“আরে দিদুনকে গ্রাম থেকে আনতে গেছে বাবা।আর তোরা তো জানিস ঘুরাঘুরি দিদুন পছন্দ করে না।এতোদিন পর বাড়িতে এসে আমাদের দেখতে না পেলে বাসায় তুলকালাম কান্ড শুরু করবে।”
“টিকিট কেটে রেখেছিস?”(অধ্রী)
” নাহ রুমে গিয়ে দেখবো।”
“আচ্ছা তাহলে তো আমাদের গোছগাছ করতে হবে।”
“চল।”

এতোক্ষণের কথায় কুয়াশা কিছুই বলে নি।অরণ্যের সাথে বার বার চোখাচোখি হয়েও এড়িয়ে গেছে।সবাই সামনে হাঁটা শুরু করলে সীয়ামাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,

“দিদুন কে?”
“দিদুন হলো বাবা’র মা।অসুস্থ থাকায় গ্রামে গেছিলো কয়েকমাস আগে।এখন ফিরে আসছে।”
“কিন্তু অরণ্য তো বলেছিলো বাসায় শুধু তোমরা থাকো।”
“দিদুন তো তখন ছিলো না তাই।বি কেয়ারফুল।দিদুন অনেক ডেঞ্জারাস!”
“ডেঞ্জারাস কেনো?”
“ডিসিপ্লিন পছন্দ করে দিদুন।আড্ডা, ঘুরাঘুরি একদম পছন্দ করেন না।উনাকে দেখলে ভয়ে আমার হাত-পা কাপে।”
“আই সি!”

দু’দিন পর….

গত দুদিন ধরে কুয়াশা অরণ্যের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করেনি।এমনকি অসুস্থ বলে টিউশনতেও যায় নি।ঘুমাতে গেলেই শুধু ঐ দৃশ্যটাই ভাসে।নিজেকে কেমন যেনো গুটিয়ে নিয়েছে।তবে সারাক্ষণ অরণ্য নামটাই মাথায় ঘুরে।কুয়াশা শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো মোবাইল ভাইব্রেট হচ্ছে।উপরে “অধ্রী” নামটি ভাসছে।মুচকি হেসে কুয়াশা কল রিসিভ করলো,

“হ্যালো!কুয়াশা?”
“হুম।কেমন আছো?”
“কুয়াশা অরণ্য এক্সিডেন্ট করেছে।”
“কীহ?”
“হ্যা।হসপিটাল থেকে মাত্র বাসায় এলো।আমরা সবাই ওর বাড়িতে যাচ্ছি।তুমি আসছো তো?”

কুয়াশা কোনো উত্তর না দিয়ে কল কেটে দিলো।চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে।অরণ্যের এক্সিডেন্ট হয়েছে শুনে তার পৃথিবী থমকে গেছে।কোনো কিছু না ভেবে কুয়াশা চোখের জল মুচে অরণ্যের বাসার উদ্দেশ্য বের হলো।

২২.
অরণ্যের বাসার সামনে এসে কুয়াশা বেল বাজালো।গতদিন গুলোতে প্রতিদিন অরণ্যই দরজা খুলে দিতো।আজও কী অরণ্য খুলে দিবে?তখনি সীয়ামা দরজা খুলে দিলো।

“দি তুমি?”
“হ্যা..ঐ ঐ আয়ন।”
“আয়ন?”
“আসলে ও ও.র সাথে আড্ডা দিতে এলাম।অনেকদিন হলো ওর সাথে কথা হয় না তাই এখন আগে এলাম।”
“সীয়ামা কে এসেছে?”
“বৌদি…দি ভিতরে আসো।”

কুয়াশা ভিতরে ঢুকে চারপাশে তাকালো।অরণ্যকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।তারমানে রুমে আছে হয়তো।

“আরে কুয়াশা তুমি?কেমন আছো?”
“ভালো।তোমরা?”
“আমাদেরও সব ঠিক।কী সীয়ামা এতোক্ষণ তুই বাইরে দাড়িয়ে কথা বলছিলি?”
“হু।বড়দা’র কফি কই?”
“আমি নিয়ে নিচ্ছি তুই অরণ্য আর আয়নের টা নিয়ে যাহ।কুয়াশা কফি নাও।”

কুয়াশা ট্রে থেকে কফি নিলো।তারপর আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো,

“কৃষ্ণা আপু আয়ন কোথায়?”
“অরণ্যের রুমে।আরে তুমি তো জানো না অরণ্যের আজ বাইক এক্সিডেন্ট হচ্ছিলো।ভাগ্যিস বেশি কিছু হয়নি।শুধু হাতে ব্যাথা লেগেছে।”
“ও”

কৃষ্ণার কথা শুনে কুয়াশা অবাক হলো।অধ্রী তো এমনভাবে বলেছিলো যেনো অনেক বড় আঘাত লেগেছে।

“দি চলো দাদা’র রুমে যায়।”
“হ্যা,কুয়াশা সীয়ামার সাথে যাও।”

কুয়াশা সীয়ামা’র সাথে অরণ্যের রুমে গেলো।ভিতরে প্রবেশ না করে কুয়াশা দরজায় হেলান দিলো।অরণ্য আর আয়ন বালিশ নিয়ে টানাটানি করছে।অরণ্যের বা হাতের কুনোই বেন্ডেজ করা।কিন্তু তারপরও একহাতে আয়নের সাথে ঝগড়া করছে।

“দাদা নে তোর কফি।”
“দিদুন কোথায়?”
“বাবা’র সাথে মিটিংয়ে আছে।”
“হাহাহা।তোর বিয়ে নিয়ে?”
“নাহ,তোমার।”
“কীহ?”
“মজা করছি।দরজার দিকে একটু তাকিয়ে দেখো।”

সীয়ামা’র কথা শুনে ওরা দুজন দরজার দিকে তাকালো।কুয়াশা’কে দেখে আয়ন চিৎকার দিলো।

“আআআআ।”
“কী হলো আয়ন?” (কুয়াশা)
“টিইইচার?”

আয়ন এক মূহুর্ত না দাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।সীয়ামা হাসতে হাসতে বিছানায় বসে পড়লো।কুয়াশা অবাক হয়ে রইলো।

“সীয়ামা আয়ন পালালো কেনো?” (কুয়াশা)
“ওর গায়ে হাত কাটা গেঞ্জি আছে তাই লজ্জা পেয়ে পালালো।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here